#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৪
ফরহাদ এক টানা বসে ৩ কাপ চা খেলো। এই অভ্যাস টা অবশ্য আগে ছিল না, কেন জানি নিলুফারের প্রেমে পড়ার পর এটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আর যাই হোক অভ্যাস টা তো খারাপ না। কিন্তু বেশি চা খেলে আবার মুখটা কেমন তেতো তেতো লাগে। তবুও খেতে ভালো লাগে। চায়ের কাপে প্রতিটা চুমুক তাকে নিলুফারের কথা মনে করিয়ে দেয়। কোন অংশে এই অনুভূতি টুকু খারাপ না। তবে শুধু মাত্র এই অনুভূতির জন্য চা খাওয়াটা একদম সহজতর। কোন ধরণের কষ্টের কাজ না এটা। বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফরহাদ। প্রতিটা দিন এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে সে। ক্লান্ত হয় না তবুও। চোখ জোড়া সবর্দা রাখে রাস্তার মোড়ের দিকে। নিলুফার প্রতিদিন এখান দিয়েই যায়। এমনকি তাকে প্রথমবার এই রাস্তা দিয়েই যেতে দেখেছে সে। সেদিনও শাড়ি পড়া দেখেছিল। বসন্তে ছিল তখন। বাসন্তি রঙের একটা সুতি শাড়ি ছিল তার পরণে। মাথায় গোঁজা ছিল এক থোকা কৃষ্ণচূড়া! ফরহাদ নিলুফারের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শুধু। এরপর পর পর ৩ দিন ধরে এসে শুধু অপেক্ষা করে গেছে নিলুফারের জন্য। তবু তার দেখা মিলে নি তার। হঠাৎ করেই যেন উধাও হয়ে গেল নিলুফার! অতঃপর একদিন এসে হাজির হলো নিলুফার! ফরহাদের মনে আছে, একটা ছাপার শাড়ি পড়ে এসেছিল নিলুফার। ফরহাদ সেদিনও শুধু চোখের পাতা ফেলে দেখতে লাগল।
হুট করেই হেসে আকাশের দিকে তাকাল সে। পুরনো কথা মনে করতে খুব ভালো লাগে তার। প্যান্টের প্যাকেটে হাত রাখল সে। তার পরণে নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি। আর প্যান্টের পকেটে একটা চিঠি। প্রেমপত্র বলা যেতে পারে। আজ ৭ দিন হলো এই চিঠি নিয়ে ঘুরছে সে। অনেক ভেবে চিন্তে লেখেছে। হাতের লেখা দরুন সুন্দর তবুও অনেক পৃষ্ঠা নষ্ট করেছে। প্রেমপত্র টা বেশি না এক পৃষ্ঠার লেখা। একটা কাগজের এপিঠ আর ওপিঠ। দুটোনায় ভুগছে এই ভেবে প্রেমপত্র দেবে কি করে। সাহসে কুলাচ্ছে না তার। ফরহাদ নার্ভাস! একটা সিগারেট বের করে ধরাল সে। এতে যদি তার টেনশন কিছুটা কমে। নিলুফার কথার অর্থ হলো পদ্মফুল! হুম পদ্মফুলের মতোই নিলুফার সুন্দর। পানিতে ভেসে থাকা পদ্মভুলের মতো ভাসমান তার চোখ! দূর থেকে দেখল নিলুফার আসছে। ইদানিং প্রায় প্রতিদিনই তাকে শাড়ি পড়তে আসতে দেখা যায়। তবে কি নিলুফার তার মনের কথা পড়ে নিয়েছে, তাকে যে শাড়ি পড়লে অনেক সুন্দর লাগে!
হাতের সিগারেট দ্রুত ফেলে দিলো ফরহাদ! নিলুফার তার কাছেই আসছে হেঁটে। বুক করে শ্বাস নিচ্ছে ফরহাদ। পকেটে হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। তার হৃৎপিণ্ড বোধ হয় এবার বেরিয়ে যাবে। নিলুফার পা ফেলে এগিয়ে আসছে। নিলুফার আজ অন্যমনস্ক! ফরহাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল সে। ফরহাদ তাড়াহুড়ো করে এসে ডাক দিয়ে বসল পেছন থেকে! নিলুফার থমকে দাঁড়িয়ে গেল..
———
আবরার আর ফোন করেনি। একটিবার কি ফোন করা উচিত ছিল না। ওর প্রেমিকা আমি, অভিমান করেছি রাগ করেছি। উচিত নয় কি একবার এসে আমার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করা। এবার প্রথম নয়, বরাবরই এমন। কোন কিছুতে আবরারের কোন উৎসাহ নেই। বরাবরই উদাসীন সে। হুট করেই একদিন এসে হাজির হবে। সেদিন বুধবার ছিল কি না ক্যালেন্ডারে একবার দেখে আসবে না। সেদিন আমায় শাড়ি পড়ে না দেখলে বলবে,
“শাড়ি পড়োনি কেন তুমি, জানতে না আজ আমি আসবো। তবুও শাড়ি পড়লে না। এখনো রাগ কমে নি তোমার। কি গো তুমি!
আমি আহাম্মকের মতো শুধু তাকিয়ে থাকবো। তখন এটা কে বলবে তাকে আজ তো বুধবার নয়। সোমবার! তুমি কেন আজ আসলে। আজ কি শাড়ি পড়ে বসে থাকবার কথা ছিল! তুমি আসলেই একটা পাগল। কথাগুলো শুধু মনে মনেই বলবো। তারপর এক কিঞ্চিত হেসে আবরার হাত খানা জড়িয়ে ধরে বলবো, সরি! ভুলে গেছিলাম চলো এখন একটু হেঁটে আসি। শহিদ মিনারে যাবে কি? অনেকদিন হলো সেখানেই যাই না চলো না যাই!
আবরার হেসে আমার হাত ধরে হেঁটে যাবে। পুরোপুরোই একটা ভাল কল্পনা বলা যেতে পারে কিন্তু এটা বাস্তব। এমন হয়েছে এর আগেও কিন্তু এবার চাইছি না হোক। তাইতো আগে থেকেই শাড়ি পড়ে এসেছি।
হাতের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে হেটে চলে যাচ্ছি হুট করেই পেছন থেকে ডাকল কেউ। শরীর শিউরে উঠলো আমার! একটিবারের জন্য মনে হলো এই তো আবরার। কিন্তু পেছন ফিরতেই বুঝতে পারলাম এটা আরবার না। ফরহাদ! তাকে দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না। এই ছেলেটা এখনো আসে। ফরহাদ আবারো ডাকল,
“নিলুফার!
তার মুখে দ্বিতীয় বারের মতো নিজের নাম শুনে আঁতকে উঠলাম। আমার নাম জানে নাকি সে। নিজেকে স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?
“একটু কথা ছিল তোমার সাথে।
“বলুন!
ফরহাদ সাহস করে পকেট থেকে চিঠিটা বের নিলুফারের দিকে এগিয়ে দিল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি এটা!
“প্রেমপত্র।
নিলুফার হাসল। ফরহাদ মুগ্ধ চোখে সেই হাসি দেখতে ব্যস্ত।
“প্রেমপত্র দিচ্ছেন, অনেক গুছিয়ে লিখেছেন মনে হচ্ছে।
“চেষ্টা করেছি, সম্ভবত পেরেছি।
“আমার নাম জানলেন কি করে?
“খুঁজে বের করেছিলাম।
নিলুফার আবারো হাসল। ফরহাদের ধারণা ছিল নিলুফার হয়তো প্রেমপত্র টা নিবে না নয়তো হাতে নিয়েও ফেলে দেবে। কিন্তু ফরহাদ কে বিস্ময় করে দিয়ে নিলুফার হাত বাড়িয়ে প্রেমপত্র নিলো। এমনকি প্রেমপত্র নিয়ে তার কাঁধের ব্যাগে অবদি রাখল। স্বপ্নের চেয়ে কম কিছু ছিল না তা। ফরহাদকে যেন অস্থির আর অস্বস্তি আঁকড়ে ধরল। সে মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতেই নিলুফার আটকে দিল তাকে। ফরহাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিলুফারের দিকে। নিলুফার হাসছে। খুব কাছ থেকে এই হাসি দেখতে সে। কতোজনের ভাগ্য এমন হয় তার জানা নেই। তবে নিজেকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান বলে মনে হতে লাগল।
“ফরহাদ সাহেব, আপনাকে একটা কথা বলা দরকার। আর তা হচ্ছে আমার এক প্রেমিক আছে বুঝলেন।
ফরহাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নিলুফার হেসে বলল,চমকে গেলেন নাকি। না না চমকানোর কিছু নেই। আমার সেই প্রেমিক আজ ১ মাস হলো উধাও। না কোন টেলিফোন আর না কোন খোঁজ। বুঝতেই পারছেন আমার অবস্থা। সে যাই হোক, আপনার প্রেমপত্র খানা নিয়ে গেলাম। বাসায় গিয়া শান্ত মতো পড়বো। দেখবো আপনার প্রেমে পড়তে পারি কি না। যদি পড়ি তবে তো বেশ ভালো। ভালো থাকবেন!
বলেই পা বাড়ালো নিলুফার। ফরহাদ অবাক চোখে শুধু তাকিয়ে রইল। নিজেকে বাকরুদ্ধ বলে মনে হলো। এতোটা নির্বাক হলো কিভাবে সে! নিলুফারের প্রেমিক আছে সেটা তো সে জানতই না। আর জানল তাও কিভাবে এই নিলুফারের কাছে। নিলুফার কি রসিকতা করল। দেখে তো মনে হচ্ছিল না। তবে কি সত্যি ছিল কথা গুলো…
নিলুফার হেঁটে যাচ্ছে। বেশ মজা লাগছে ফরহাদ কে কথা গুলো বলে। ফরহাদ এখন খুব কষ্ট পাবে এটা ভাবতেই নিজের মনে শান্তি খুঁজে পাচ্ছে। ভালোবাসার আগুনে জ্বলছে সে, কিন্তু একা কেন জ্বলবে। সবাই কে সাথে নিয়েই জ্বলবে। সেটা ফরহাদ হোক কিংবা আবরার। চারপাশে যারা আছে সবাইকে কষ্ট দিবে। নিজে ভালো নেই তাহলে তাদের কিভাবে ভালো থাকতে দেবে সে! নিলুফারের খুব মনে হচ্ছে কাল আর এই ফরহাদ আসবে না, আর এসে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকবে না। আর এসে কখনো তাকে বিরক্ত করবে না। ভালো হবে তখন, খুব ভালো!
——-
রিক্সা থেকে তড়িখড়ি করে নামল ইরা! দূর থেকেই তিতির কে দেখে কয়েকবার ডাক দিল ইরা। তিতির মনে হলো শুনেও তাকায় না। শাড়ির কুচি টা ধরে দৌড়ে এসে হাজির হলো তিতিরের কাছে। তিতির দাঁড়িয়ে আছে শিমুল গাছের নিচে। খুব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ফুলের দিকে। ফুল গুলোকে কয়েকদিন আগেই দেখেছিল কুঁড়ে জন্মেছে আজ একদম ফুটন্ত ফুল লাগছে। পেছন থেকে নিজের নাম শুনে পিছন ফিরল সে। ইরার পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে রৌদ্রের তাপে। মেয়েটা একটু বেশিই সুন্দরী। একদিন নিলুফার তাকে দেখেছিল এরপর থেকেই সাদা চামড়ার মেয়ে বলে ডাকে। আসলেই অনেক সুন্দরী ইরা!
ইরা হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, ব্যাপার কি বলতো? তুই আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন?
“এড়িয়ে গেলাম কখন আবার?
“প্রতিদিন’ই তো এমনটা করিস। সেদিনও এসে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম কতোক্ষণ। কিন্তু তুই এলি না।
“আমার আসবার কথা ছিল?
ইরা চুপ হয়ে গেল। সত্যি কি তিতিরের আসার কথা ছিল। না ছিল না, কিভাবে থাকবে। হঠাৎ ইরার খুব ইচ্ছে করল তিতির কে দেখতে তাই এখানে এসে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু দেখা মিলল না। ইরা তিতিরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত একধরনের লাজুক চাহনি। কথা ঘুরিয়ে ইরা বলল, আসবার কথা নেই মানে! কলেজ আসিস না নাকি!
“হ্যাঁ তা তো আসি তবে মাঝখানে কয়েকদিন আসে নি।
“কেন?
“জ্বর হয়েছিল!
“কি বলিস, দেখি দেখি!
আকস্মিক তিতিরের কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপল ইরা। তিতির খানিকটা অস্বস্তি বোধ করল। ইরা ভ্রু কুঁচকে বলল, না জ্বর তো নেই এখন।
“থাকবে কি করে, জ্বর নেই বলেই তো বাইরে এলাম।
” এসেও এই ঠাডা পরা রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছিস। কেন বুঝি? শরীর যদি আবার খারাপ করে তখন। দাঁড়িয়ে কার অপেক্ষা করছিস শুনি!
“অপেক্ষা তো করছিলাম বটে।
“কার?
“সময়ের!
“রাখ তো তোর পাগল ধরণের কথাবার্তা। এই রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে কারো অপেক্ষা করা লাগবে। চল ওখানে গিয়ে গাছের নিচে বসি। আয় তো!
হাত ধরে টেনে গাছের কাছে নিয়ে গেল ইরা। তিতির তাকিয়ে দেখল রাস্তার কিছু লোক তাদের উপর অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কটুক্তি করছে বোধহয়। তিতিরের খারাপ লাগছে কিন্তু এতে ইরার কি? ইরা এতে মাথা ব্যাথা নেই। কখনো মানুষের কথা গায়ে মাখে নি সে।
ইরার সাথে তিতিরের পরিচয় তার এক বড় ভাইয়ের বোনের বিয়েতে। সেই বোনের বান্ধবী ছিল ইরা। তিতির তাকে দেখে প্রথমে ভেবে ছিল এইই বুঝি বিয়ের কনে। কিন্তু কনে হবার পরও তার এমন ঘোরাফেরা দেখে শুধু বলল, কনে হয়ে এতো ঘোরাফেরা করা ঠিক না।
ইরা মজা করে বলেছিল, কেন ঠিক না শুনি। আমার’ই তো বিয়ে।
“এজন্য ঠিক না, লোকে মন্দ বলবে।
*তাতে আমার কি? এসব আমি গায়ে মাখি নি।
“কিন্তু আজ তো মাখতে হবে, নাহলে আমি ভাইয়া কে বলে দিচ্ছি।
“দোহাই লাগে এমন করবেন না। ভাইয়া জানলে খুব বকবে..
তিতির তখন বাঁকা চোখে তাকাল। ইরা এমন ভাবে তার সাথে কথা বলছিল যেন বিয়েটা বোধহয় আসলেই তার। কিন্তু পরে যখন তিতির সব জানতে পারল অবাকের সীমা রইল না তার। ইরা হেসে হেসে বলল, রাগ করবেন না। একটু মজা নিচ্ছিলাম আর কি!
সেই থেকে তিতির আর ইরার বন্ধুত্ব। যদিও তিতির এই বন্ধুত্ব রাখতে চাইছে না ইদানিং ধরে। ইরার আচরণ মোটেও তার কাছে সুবিধার লাগছে না। ইরার বাবা আবার পুলিশ অফিসার! নিজের অবস্থার কথা ভুলে যায় নি তিতির।
ইরা তিতির কে ঠেলতে ঠেলতে বলল, ক্ষুধা পেয়েছে রে তিতির?
“তো আমি কি করব? বাসা থেকে খেয়ে বের হস নি কেন?
“চুপ করবি, যা বাদাম নিয়ে আয় খাবো।
“বাদাম খেলে পেট ভরবে।
“সময় তো কাটবে। যা না নিয়ে আয়।
ইরা ঠেলেঠুলে আবার উঠাল তিতির কে। তিতির উঠে দাড়াতেই ইরা পেছন থেকে ডেকে বলল, তিতির!
“আবার কি হলো?
“আমায় কেমন লাগছে আজ?
তিতির ভড়কে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ইরার দিকে। রোদের আলো গাছের পাতা ভেদ করে কিছুটা এসে পড়ছে তার মুখের উপর। তবে তা খুব সামান্য!
#চলবে….