#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_১০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( প্রাপ্ত বয়স্কদের ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত। কিছু খারাপ শব্দ গল্পের খাতিরে এসেছে। )
সময় চলছে তার আপন গতিতে। কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। এতদিনে বিনা আর সমুদ্রের সম্পর্কে উন্নতি এসেছে। কন্ঠ কান্নাকাটি করে না এখন আর। কিন্তু একেবারে বদলে গেছে। আগের মতো কথা বলে না। শুধু প্রয়োজনীয় কথার উত্তর দেয়। সাজগোছ করেনি সেদিন থেকে। সব লিপস্টিক ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে পরে আছে। লেখাপড়ার দিকে মনোযোগী হয়েছে। সময় সকল আঘাত ঘুচিয়ে দেয়। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন আজীবন থেকে যায়। এই কয়টা মাস যে কন্ঠ কীভাবে কাটিয়েছে সেটা কেবল ওর পরিবারের লোকজন জানে। বিশেষ করে ইফতি! এই মানুষটার প্রতি কন্ঠর হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে এখন শুধু শ্রদ্ধা আসে। মানুষটা নাওয়াখাওয়া ভুলে সেবিকার মতো যত্ন করে গেছে কন্ঠর। প্রহর এরমধ্যে অনেক বার চেষ্টা করেছে কন্ঠর সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু কন্ঠ কোনো প্রকার সুযোগ দেয়নি তাকে। যে একবার ঠকাতে পারে দ্বিতীয় বার তাকে বিশ্বাস করা বোকামি।
শীত শেষে বসন্ত আসার আগ মুহুর্ত। প্রকৃতিতে এখন দক্ষিণা হাওয়ার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। শহরের নিরিবিলি থেকে একটু দূরে একটা রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে প্রহর ও ঐশী। ঐশী অনেকবার চেষ্টা করেছিল কন্ঠর সাথে কথা বলতে। কিন্তু কন্ঠ তার মেসেজের কোনো রিপ্লাই করেনি। আর না তো কল ব্যাক করেছে। তবুও ঐশীর বুঝতে বাকি ছিল না কন্ঠর সাথে প্রহরের কিছু ছিলো কিংবা আছে। তবুও ঐশী প্রহরকে ছাড়বে না। প্রহর এতদিনে হাজার চেষ্টা করেও ঐশীকে নিজের থেকে সরাতে পারেনি। উপরন্তু অনেক হুমকি দিয়েছে ঐশী। কত সুন্দর ছিলো জীবনটা! একটা বছর পেরোলেই তো কন্ঠকে বিয়ে করতো প্রহর। তারপর সুন্দর একটা সংসার হতো দুজনের! সেসব না করে কেনো ঐশীর সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হলো সেই নিয়ে প্রহর সব সময় ভাবতে থাকে। কাজকর্মে মন বসে না তার। অন্যমনস্ক থাকায় ইতিমধ্যে দু’বার এক্সিডেন্ট করতে করতে বেঁচে গেছে।
” বলো এখানে ডেকেছো কেনো?”
নিরস গলায় শুধালো প্রহর। ঐশী ম্লান হাসলো। এরমধ্যে দুই কাপ কফি দিয়ে গেলো ওয়েটার।
” এখন আর আমাকে ভালোলাগে না? কন্ঠ আপুর মতো আমার প্রতিও মোহ উবে গেছে? ”
” কন্ঠ আমার মোহ না। দুই বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের সম্পর্ক।”
” তাহলে স্বীকার করছো?”
কফিতে চুমুক দিয়ে বললো ঐশী। প্রহরও কফি হাতে নিলো।
” হ্যাঁ করছি। তোমার সাথে ভুলবশত সম্পর্কে জড়িয়ে গেছিলাম আমি। আমার মতিভ্রম হয়েছিল। এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ”
” এতটা সময় সম্পর্কে থেকেও মেয়েটাকে কীভাবে ঠকালে? লজ্জা করছে না বুক ফুলিয়ে আবার সেসব বলিতেছ? ”
” তুমি এসব বলার জন্য ডেকেছো?”
” নাহ। আমাদের বিয়ে করে নেওয়াটা জরুরি এখন।”
বিয়ের কথা শুনে প্রহর বিষম খেলো। মিনিট দুয়েক পরে স্বাভাবিক হয়ে চোখ রাঙিয়ে প্রহর বললো,
” তোমাকে কি কখনো বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আমি ঐশী?”
” না তা দাওনি। কিন্তু বাসায় এসে ঠিক রাত কাটিয়ে গেছো। আর সেই রাত কাটানোর ফল হিসেবে এখন আমি তোমার বাচ্চার মা হতে চলেছি।”
” ওয়েট! ওয়েট। তুমি কি হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকার রোল প্লে করছো? তুমি জানতে না সহবাস করলে বাচ্চা কনসিভ করতে পারো? তাহলে পরে পিল খেলে না কেনো? আর আমি তো তোমার সাথে জোরজবরদস্তি করিনি। তুমি নিজের ইচ্ছে আমার সাথে রাত কাটিয়েছো ঐশী।”
ঐশী ক্ষেপে গেলো প্রহরের আচরণে। সত্যি বলতে ঐশী চেয়েছিল প্রথমে প্রহরের সাথে তার বিয়ে হোক। কিন্তু পরবর্তীতে তার চরিত্রের নমুনা দেখে সে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো তার একটা ভুলের মাশুল হিসেবে তার গর্ভে ছোটো একটা প্রাণের সঞ্চার হয়েছে, তখনই সিন্ধান্ত বদলালো। কন্ঠ প্রহরের অতীত হওয়া সত্বেও কেনো জানি কন্ঠর প্রতি মায়া হয় ঐশীর। তাই প্রহরকে বিয়ে করে আজীবন জ্বালা দিবে বলেই ঠিক করলো ঐশী। বিছানায় শুয়ে যেমন সুখ নিতে আপত্তি ছিলো না তেমনই সন্তানের দায়িত্ব নিতেও আপত্তি শুনবে না ঐশী।
” তুমি যেভাবেই আমার সাথে সহবাস করো না কেনো সত্যি হলো এখন আমি গর্ভবতী। সো বিয়ে কবে কীভাবে করবে সেই চিন্তা করো। নইলে জেলের ঘানি টানতে হবে শীঘ্রই। ”
ঐশী আর কোনো বাক্যব্যয় না করে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রহর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। প্রহরের হঠাৎ করেই মনে হলো এই পৃথিবীতে সব মেয়ে কন্ঠ নয়!
সন্ধ্যা নেমেছে। শহরের কর্মজীবী মানুষেরা যার যার আশ্রয়স্থলে ফিরতে ব্যস্ত। মল্লিক বাড়ির বসার ঘরে বসে আছে সমুদ্র, বিনা। সন্ধ্যায় ইফতিরও আসার কথা কন্ঠদের বাসায়। আজকে বৃহস্পতিবার বলেই সবাই একসাথে লুডু খেলবে বলে ঠিক করেছিল সমুদ্র ও বিনা। কন্ঠ সবকিছুতেই সম্মতি দেয় কিন্তু নিশ্চুপ থাকে। টিভিতে খবর দেখছে ওঁরা দু’জন। বাংলা একাডেমি আয়োজিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর বইমেলা প্রাঙ্গন সরাসরি দেখাচ্ছে টিভিতে। বিনা তো এসবকিছুর সাথে নতুন। ঢাকা শহরে যে বই বিক্রির জন্য মেলাও বসে সেকথা আজকে প্রথম শুনলো বিনা। তাই সে বিস্ময় নিয়ে সমুদ্রর দিকে দৃষ্টিপাত করে শুধালো,
” মেলা কি সব সময় চলে?”
” না। মেলা কেবল ফেব্রুয়ারী মাসে থাকে। এই একমাস বইপ্রেমীদের ইদ বুঝলে?”
” বুঝলাম। আপনি বসুন। আমি বরং কন্ঠ আপাকে ডেকে আনার চেষ্টা করি। জানি হয়তো আসবে না!”
বিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে কন্ঠর ঘরের দিকে পা বাড়ালো। সমুদ্ররও মন খারাপ হয়ে গেলো। একটা সময় কন্ঠ কতো মজা করতো ওদের সাথে। সারাক্ষণ হাসি খুশি থাকা মেয়েটা এভাবে চুপ হয়ে গেছে ভাবতেও কষ্ট হয় সমুদ্রর।
” কই তোদের খেলা কখন শুরু হবে? কন্ঠকে ইফতি রাজি করাতে পারবে তো?”
রান্নাঘর থেকে হাতে ট্রেতে করে কিছু পকোড়া আর বেগুনি নিয়ে বসার ঘরে এসেছেন কন্ঠর মা। সবাই একসাথে বসে খেতে খেতে গল্প করবে বলে এতটুকু নাস্তার আয়োজন।
” আশা করি ভাইয়ার কথা কন্ঠ ফেলতে পারবে না। বিনা গেলো কন্ঠকে ডাকতে। যদিও জানি বিনা পারবে না তবুও! ”
মেয়ের কথা ভেবে বক্ষপিঞ্জর খালি করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শারমিন সুলতানার। এরমধ্যেই কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে উঠলেন দুজনেই।
” মনে হয় ইফতি এসেছে। যাই দরজা খুলে দেই।”
শারমিন গিয়ে দরজা খুলে দেন। ইফতি মুচকি হেসে ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে লোকটাকে। কলেজের শিক্ষকদের একটা মিটিং ছিলো প্রিন্সিপালের নিজস্ব ভবনে। কলেজ রেখে যে কেনো নিজের বাসায় অফিশিয়াল আলোচনা করলেন তিনি সেটা বোধগম্য হয়নি ইফতির। বাসায় না গিয়ে সরাসরি কন্ঠদের বাসায় আসলো সেখান থেকেই। এখনো ফরমাল ড্রেসআপ তার।
” ভাইয়া তুমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর আমরা একসাথে আড্ডা দিবো। বিনা গেলো কন্ঠকে ডাকতে। ”
” তাহলে বরং বাসায় গিয়ে গোসল সেরে আসি। পাঁচ মিনিট লাগবে। বড়ো মা দরজা খোলাই থাক।”
ইফতি দ্রুত বেরিয়ে গেলো। কন্ঠ ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। বিনা ঘরে ঢুকে বসে আছে অনেকক্ষণ। কিন্তু কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। যে কন্ঠ খিলখিলিয়ে হেসে সব সময় কথা বলতো আজ তার চেহারার গাম্ভীর্যের কারণে কথা বলতেও দু’বার ভাবতে হচ্ছে বিনাকে। বিনার নীরবতা দেখে কন্ঠ নিজে থেকেই বললো,
” কিছু বলবে বিনা?”
” কন্ঠ আপা বসার ঘরে চলো। তোমার ভাই আর বড়ো মা-ও আছেন। আর ইফতি ভাইও আসবেন। ”
” আমার কাজ আছে। তুমি যাও।”
সহসাই মন খারাপ হয়ে গেলো বিনার। মুখ মলিন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো বিনা। সমুদ্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বিনা। সমুদ্র বিনার চোখমুখ দেখেই সমুদ্র বুঝতে পেরেছে কন্ঠ “না” বলে দিয়েছে। সমুদ্র আশেপাশে তাকিয়ে একবার দেখে বিনার হাত ধরে কোলে বসালো। কন্ঠর মা নিজের ঘরে গেছেন। বিনার দু-হাত নিজের দুই কাঁধে রাখলো সমুদ্র।
” কী হয়েছে? কন্ঠ আসবে না বলে মন খারাপ হয়েছে? ”
বিনা মাথা নেড়ে “হ্যাঁ ” বললো।
” বোকা মেয়ে! তাতে মন খারাপের কী হয়েছে? আমরা তো জানতামই ও আসবে না এখানে। ওর না আসার কারণও তো তুমি জানো। ভাইয়া আসছে ফ্রেশ হয়ে। তারপর ঠিক কন্ঠ এখানে আসবে। ”
” ঠিক আছে। এখন কোল থেকে নামান। বড়ো মা এসে পড়বে যেকোনো সময়। ”
সমুদ্র মুচকি হেসে বিনার অধর কোণে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো। তারপর বিনা পাশের সোফায় বসে লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো। এরমধ্যে ইফতি চলে এসেছে। সাদা টিশার্টের সাথে লুঙ্গি পরেছে ইফতি। চোখেমুখে এখনও পানিরছিটা। চুলগুলো ভেজা।
” বড়ো মা কোথায় সমুদ্র? ”
” ভেতরে গেলো।”
” বড়ো মা! বড়ো মা!”
ইফতি বারকয়েক ডাকার পরে শারমিন সুলতানা বসার ঘরে এলেন।
” তোর বড়ো আব্বু কল দিয়েছিলেন। কথা বলতে গিয়ে দেরি হলো। তোরা বসে আছিস কেনো? পকোড়া আর বেগুনি তো ঠান্ডা হয়ে গেলো!”
” তোরা খা আমি কন্ঠকে নিয়ে আসছি।”
ইফতি বসার ঘর ত্যাগ করলো। কন্ঠর মা, বিনা ও সমুদ্র অপেক্ষা করতে লাগলো কন্ঠর আসার। শেষ কবে বসার ঘরে এসে বসেছিল কন্ঠ মনে নেই কারো। প্রহরের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার পরে আর সবার সাথে বসে কখনো কথা বলেনি মেয়েটা। সারাদিন পাগলামি করা মেয়েটা চুপ হয়ে গেলে মোটেও কারো ভালো লাগে না।
চলবে,
ইনশাআল্লাহ দুয়েক দিনের মধ্যে আমার দ্বিতীয় বই “নীরবে রাত্রি নামে” বইটি মেলার স্টলে চলে আসবে। বইটি পাওয়া যাবে স্টল নং ২০৭-২০৮ বাংলার প্রকাশনে।
আগের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/100080128645410/posts/390730570274561/
পরের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=391442220203396&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz