#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_২০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
শায়লা কন্ঠর দিকে তাকিয়ে আছে। আসলেই কি বিষয়টা এমন? সমুদ্রর কাছে সে-ও গুরুত্বপূর্ণ আগের মতোই? নাকি কন্ঠ শুধু সান্ত্বনা দিচ্ছে?
” তুই ঠিক বলছিস কন্ঠ? সমুদ্র আমাকেও গুরুত্ব দিবে ভবিষ্যতে? অন্য ছেলেদের মতো বউকে পেয়ে মা’কে ভুলে যাবে না?”
” আচ্ছা মা তুমি যদি ওদেরকে ভালোবাসো তবেই তো ওঁরাও তোমাকে ভালোবাসবে,সম্মান করবে তাই না? এখন যদি তুমি এরকম আচরণ করতে থাকো একটা সময় তো সমুদ্রর তোমার প্রতি খারাপ লাগা চলে আসবে! তুমি যদি আর পাঁচটা সাধারণ শ্বাশুড়ির মতো খারাপ আচরণ করো বিনাও আর পাঁচটা ছেলের বউয়ের মতো তোমাকে খারাপভাবে ট্রিট করবে। ভালোবাসা পেতে গেলে ভালোবাসা দিতে হয় মা। তারচে বড়ো কথা তোমার ছেলেরা সেরকম ছেলে নয় যে বউকে পেয়ে মা’কে ভুলে যাবে। তুমি কেনো অযথা ভয় পেয়ে এরকম বদলে যাচ্ছো? তুমি তো আমার তেমন চাচি ছিলে না! ”
কন্ঠর কথায় বাচ্চাদের মতো করে কান্না শুরু করলেন শায়লা মল্লিক। কন্ঠ দ্রুত শায়লা মল্লিককে জড়িয়ে ধরে। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে তিনি বলেন,
” আমার সত্যি ভয় করছিল কন্ঠ। কিছু দিন আগে এলাকার এক ভাবিকে তার ছেলেরা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসলো। ভাবি কতো করে বললো ছেলে আর ছেলের বউদের, উনি বৃদ্ধাশ্রমে একা থাকতে চাননা। তবুও কেউ তার কথা শুনলো না।”
কথাগুলো শেষ হতেই কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো ইফতির মায়ের। কন্ঠ আলতো করে শ্বাশুড়ির চোখের পানি মুছে দিলো।
” প্লিজ কেঁদো না মা। তুমি কাঁদলে আমার ভালো লাগে? তুমি নিশ্চিত থাকো তোমার জীবনে এমন কিচ্ছু ঘটবে না। তোমার দুই ছেলে আর ছেলের বউরা আজীবন তোমাকে মাথায় করে রাখবে।”
” ভাগ্য করে তোকে ছেলের বউ হিসেবে পেয়েছি রে মা। আর বিনা মেয়েটাও ভীষণ ভালো। আহারে মেয়েটার সাথে ঠিকমতো কথাও বলিনি এতদিন। তবুও সব সময় হাসিমুখে কথা বলেছে আমার সাথে। ডাক্তার কী বলেন কে জানে! চিন্তা হচ্ছে। ”
কন্ঠ বসা থেকে উঠে ডাইনিং রুমে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে শায়লা মল্লিকের হাতে দেয়।
” কিছু হবে না। তুমি পানি খেয়ে নাও। মনে হয় জ্বর-টর অন্য লাইনে চলে গেছে। ঔষধ খেলেই সেড়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ। ”
” তাই যেনো হয়।”
ডাক্তারের সামনের চেয়ারে বসে আছে বিনা ও সমুদ্র। ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট দেখতে ব্যস্ত। সমুদ্র উৎকন্ঠিত হয়ে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের মুখপানে। বিনা ভাবছে কখন বাড়ি ফিরবে। এতগুলো টেস্ট দিয়েছিল। রক্ত দিতে গিয়ে বিনার নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল। নেহাৎ সমুদ্র ভীষণ ভালোবাসে বলেই বকাবকি করেনি বিনাকে। নইলে টেস্ট করার জন্য রক্ত নেওয়ার সময় যেরকম কান্নাকাটি করেছিল বিনা অন্য কেউ হলে এরকম বউকে ধমক দিয়ে স্থান ত্যাগ করতো।
” ভাগ্য ভালো আপনার স্ত্রী’র। ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে তবে ততটা গভীরে যায়নি কেসটা। যেরকম মাথা ব্যথার কথা বলছিলেন ভাবলাম অন্য কিছু কি-না! উনার আসলে মাইগ্রেনের সমস্যাও আছে। এজন্য প্রায় মাথা ব্যথা থাকে। আমি ঔষধ লিখে দিলাম। নিয়মিত ঔষধ খেলে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ ডেঙ্গু জ্বরকে সিরিয়াসলি নিবেন। দিনে কিংবা রাতে যখনই শোবেন মশারী টানানো থাকা চাই মাস্ট। আর পারলে মশা মারার স্প্রে কিংবা কয়েল ব্যবহার করবেন। ”
” ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে তো স্যার? ”
ব্যতিব্যস্ত হয়ে শুধালো সমুদ্র। ডাক্তার সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
” ইয়েস ইয়াং ম্যান। চিন্তা করবেন না। আর এই যে ম্যাডাম, নিজের শরীরের খেয়াল রাখবেন। আপাতত আসুন। ঔষধ শেষ হলে আবারও আসবেন। ”
বিনা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। সমুদ্র উঠে দাঁড়ালো বিনাকে নিয়ে।
” ঠিক আছে স্যার। আসছি।”
ডাক্তারের চেম্বার থেকে দু’জনে বেরিয়ে রিকশায় চড়ে বসলো। বিনার শরীর ক্লান্ত ভীষণ। আরেকটু সামনে থেকে বাসে উঠতে হবে। কিন্তু অতদুর হেঁটে যেতে পারবে না বলেই রিকশায় উঠবার প্রয়োজন পড়লো।
” ডাক্তার কী ভয়াবহ কোনো রোগের নাম বললো সমুদ্র সাহেব? মাগ্রেন নাকি!”
” ওইটা মাইগ্রেন, মাগ্রেন না। আর তেমন ভয়াবহ কোনো রোগ নয়। তবে ঔষধ নিয়মিত খেতে হবে। কিছু খাবা? সকালে তো তেমন কিছু খেলে না।”
” আমি তো খেলাম, আপনিই তো কিচ্ছু খাননি। ”
রিকশা থেমেছে। রিকশা থেকে নেমে সমুদ্র পকেট থেকে বিশ টাকার নোট বের করে রিকশাওয়ালা মামাকে দিলো।
” চলো একসাথে বসে ফুচকা খাই।”
সামনেই রাস্তার পাশে ফুচকার দোকান দেখিয়ে বললো সমুদ্র। বিনা হেসে বললো, “চলুন।”
দুপুরের দিকে বাসায় ফিরেছিল সমুদ্র ও বিনা। তার আগে কন্ঠ ফোন দিয়ে জেনেছিল বিনার রোগের বিষয়। তাই নিশ্চিন্তে ছিল শায়লা ও কন্ঠ। রাত আড়াইটার মধ্যে সেহেরি খেয়ে শুয়েছে বাসার সবাই। শুধু বিনাকেই রোজা রাখতে দেওয়া হবে না। কারণ ঔষধ খেতে হবে নিয়মিত। আগামীকাল পবিত্র শবেবরাত। তাই সবাই রোজা রাখবে মল্লিক বাড়ির। শারমিন সুলতানা এখনো তার ভাইয়ের বাড়ি আছেন।
ভোরের আলো ফুটতেই কুরআন তেলওয়াত করতে বসেছে কন্ঠ। ফজরের নামাজ শেষে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আজকে কোনো রান্নাবান্না নেই বলে সকাল সকাল কুরআন তেলওয়াত করবে বলে ঠিক করেছে কন্ঠ। বিনার জন্য খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। দুপুরে আর রান্না করা হবে না। একেবারে বিকেলে রান্নাবান্না হবে। ইফতি যথাসময়ে কলেজের যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে।
দু’দিন আগে ঐশীর বাচ্চাটা মারা গেছে। বাথরুমে সাবান জলে পা পিছলে পড়েই ঘটেছে এই অঘটন। প্রহর ঐশীকে ভালো না বাসলেও বাচ্চাটা হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু হঠাৎ এরকম অঘটনে প্রহরও কেমন হয়ে গেছে। দু’দিন ধরে চুপচাপ হয়ে গেছে। অফিসেও যায় না। ঐশীর শরীর খারাপ। ঐশীর এক মামাতো বোন এসেছে। ঐশীর সমবয়সী সে-ও, নাম তার সেতু। সেতুই এই দু’দিন বাসার সব কাজকর্ম করছে। ঐশীর শরীরে যতটা না কষ্ট তার তিনগুণ কষ্ট হৃদয়ে। বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে না আনতে পারার কারণে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। আরেকটু সাবধানে কাজকর্ম করলে হয়তো এরকম দূর্ঘটনা ঘটতো না। কিন্তু তকদীরের লেখা কি এড়ানো যায়? সৃষ্টিকর্তা না চাইলে কোনো কিছু সম্ভব না।
মাগরিবের আজান দিচ্ছে। ডাইনিং টেবিলে সবাই বসেছে ইফতার করার জন্য। কন্ঠ সবাইকে খাবার দিয়ে নিজেও বসেছে খেতে। বুকটা কেমন হুহু করে উঠছে মেয়েটার। গত শবেবরাতেও বাবা-মাকে নিয়ে কী সুন্দর সময় কেটেছিল! মানুষটা নেই বলে তাদের সংসার ভেসে গেলো। মা একা একা কান্না করে বলে মামার বাড়ি পাঠালো। এসব ভেবে দু-চোখ ছলছল করছে কন্ঠর।
” কন্ঠ চুপ করে আছিস কেনো? শরবত খেয়েই হবে শুধু? অন্য কিছু খা।”
জাহাঙ্গীর মল্লিক মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন। কন্ঠ ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। সব কথারা কেমন গলার কাছে এসে জড়িয়ে যাচ্ছে। চাচার স্পর্শে যেনো বুকটা আরও কেমন কেমন করে উঠলো। বাবার স্পর্শের মতোই লাগলো। কন্ঠ কিছু না বলে মাথা নাড়লো দু’বার। শায়লা মল্লিক স্বামীকে ইশারায় কিছু যেন বললেন। ইফতির নজরও কন্ঠর দিকে নিবদ্ধ।
” মা মন খারাপ করিস না। আমি তো আছি বল? আমি কি তোর বাবা নই?”
এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না কন্ঠ। জাহাঙ্গীর মল্লিকের হাত ধরে ঠুকরে কেঁদে উঠলো। ইফতির খাবার যেন গলায় আঁটকে গেছে। এই মেয়েটার চোখের পানি কখনো সহ্য করতে পারে না সে। সমুদ্ররও খারাপ লাগছে। জাহাঙ্গীর মল্লিক কন্ঠর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
” এই কন্ঠ কাঁদিস না। এরকম করলে বড়ো আব্বু কষ্ট পান। খেয়ে নে,নামাজ পড়তে হবে তো।”
ইফতির কথায় চোখমুখ ওড়না দিয়ে মুছে নিলো। জাহাঙ্গীর মল্লিক নিজের হাতে একটা পেয়াজু খাইয়ে দিলেন কন্ঠকে।
গোসল সেড়ে নতুন পোশাক পরেছে কন্ঠ। একটু আগে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছে। নামাজ পড়ে তারপর খাওয়াদাওয়া করবে। খেয়েদেয়ে নামাজ পড়তে গেলে কন্ঠর আলসেমি লাগে। শরীর কেমন ভারী অনুভূত হয়। ইফতিও পাঞ্জাবি পরে আতর মেখে রেডি হয়েছে।
” মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বে?”
” হ্যাঁ। তুই নামাজ পড়ে খেয়ে নিস। আমার আসতে দেরি হবে। আর হ্যাঁ বিনার খাওয়ার দিকে খেয়াল করিস একটু।”
পাঞ্জাবির হাতা বোল্ড করতে করতে বললো ইফতি। মসজিদের পানির ট্যাপ থেকে ওজু করবে বলেই হাতা উপরে তুললো। কন্ঠ মুচকি হেসে বললো,
” ঠিক আছে। আমার জন্য আসার সময় বাদাম ভাজা নিয়ে এসো।”
” ঠিক আছে বিবিজান। সাবধানে থাকিস।”
” শোনো।”
” মা’কে বলে যাও।”
” হ্যাঁ তা তো বলবো। দেখি সমুদ্রকে ডেকে ওর হলো কি-না। ”
কন্ঠ মাথা নাড়লো। বাবা আর দুই ছেলে একসাথে মসজিদে শবেবরাতের নামাজ আদায় করতে গেলো। বাসায় রইলো মহিলারা। কন্ঠর মনটা কেমন আকুপাকু করছিল একটু আগে। ইচ্ছে করছিল ইফতিকে বলবে,” বাসা থেকে বের হওয়ার আগে স্ত্রী’কে আলিঙ্গন করে বেরোতে হয়।”
কিন্তু লজ্জা আর অস্বস্তিতে সেটা আর বলতে পারেনি মেয়েটা। সাদা পাঞ্জাবিতে শ্যামবর্ণ পুরুষকে যে কী নিদারুণ লাগছিল সেটা ভাবতেই আনমনে হেসে উঠলো কন্ঠ।
চলবে,
সবাই রেসপন্স করবেন আশা করি। পেইজের রিচ আগের চেয়ে কমে গেছে। 🙂
আগের পর্বের লিংক আগের পর্বের লিংক https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=401923235821961&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz
পরের পর্ব https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=402939809053637&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz