#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪
“বয়স আঠারো হয় নি। এখনই পুরুষ দরকার তোর?”
ঝাঁঝালো বাক্যটা শুনে তোঁষা থমকে যায়। এই কথার ইঙ্গিতটা ঠিক কতটা বাজে তা বুঝতে ওর বেশি মাথা খাটাতে হয় নি। তোঁষা যেন একদম থমকে আছে এহেন বাক্য শুনে। কি বললো এটা মা? তোঁষা’কে চুপ থাকতে দেখে ওর মা এবার ওর বাহু চেপে ধরে বললো,
— কথা বল তোঁষা!
তোঁষা কথা বলবে? কিন্তু কিভাবে? আজ ভাষা গুলো গোছানো যাচ্ছে না কিছুতেই। কোনদিন উচ্চবাক্য ব্যায় করে নি ওর মা। নিজের সতেরো বছরের জীবনে তোঁষা কখনো শুনে নি ওর মায়ের উঁচু গলা। সবসময়ের মিষ্টভাষী ওর মা। ভদ্রমহিলা স্বামী থেকে অনেকটাই ছোট। পার্থক্য না হলেও বছর বিশ তাদের। তুহিন তাকে সবসময় আদরে আদরে রেখেছে। এক মাত্র সন্তান কি না তার প্রিয়তমা নিজের মা-বাবার। হাজার রাগ উঠলেও কোনদিন তুহিন স্ত্রী’র সাথে মন্দ ব্যাবহার করেন নি কিন্তু পরিস্থিতির সাপেক্ষে গতকাল হাত তুলেছিলেন। কতটা অনুতপ্ত সে তা রাতেই টের পেয়েছেন তোঁষা’র মা। তুহিন তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বুকে জড়িয়ে ছিলেন। তার অনেক সখের নারী বলে কথা। তোঁষা’র মা সবটা সময় ধরে ছিলো নির্বাক। তার মুখ থেকে বের হয় নি কোনরূপ বাক্য। তুহিন যেন অস্থির হয়েছিলেন তাতেই।
পনেরো বছরের এক অপরিপক্ক কন্যা এনে দিয়েছেলেন তার মা তাকে। সেই কন্যা থেকে ভালোবেসে, আদর, যত্নে, পেলে পুষে তুহিন ই তো নারী করলো তাকে। কিভাবে যেন একটা ভুলে তুঁষা’র টা এসে পরলো। এতে ক্ষতি বলতে শুধু ছুটে গেল তোঁষা’র মায়ের পড়াশোনা। তুহিন অবশ্য অনেক কষ্টে এইচএসসি টা দেয়ালো বউ দিয়ে। সেই নিয়ে ও তো তার মা কম চিল্লান নি। তুহিন তখন একরোখা জেদ করে তার স্ত্রী’কে পড়াশোনা করিয়েছেন। তুঁষা’র ছিলো প্রচুর চটপটে তাই তো ইচ্ছে থাকলেও আর উপায় হলো না। তারপর? কতগুলো বসন্ত এলো। থাকলো। চলে গেল। যখন পরিপূর্ণ, পরিপক্ক এক রমণী তুহিনের সেই স্ত্রী তখন জন্ম তোঁষা’র। সারাটা বাড়ীতে তখন খুশির ঝলক। এর অবশ্য কারণ ও ছিলো। শেখ বাড়ীতে না হলেও এক যুগের বেশি পর নতুন কেউ আসতে চলেছিলো। তুহিনকে তখন পায় কে? তখনকার ঐ বয়সেই সে যেন পাগল হয়ে যাবে খুশিতে।
যখন খবর পেলো পরী আসবে তখন যেন পাগলামো বাড়লো বহুগুণ। তুঁষা’র তখন যথেষ্ট বুঝদার। ওর মা অবশ্য লজ্জা পাচ্ছিলো। কিন্তু জা, ভাসুর এদের এত এত ভালোবাসা আর তুহিনে’র আদরে সবটা যেন সহজ হয়ে গেলো। শাশুড়ী তখন বেশ বৃদ্ধ। তোঁষা’র জন্মের চারদিন পর ইহকাল ত্যাগ করেন তিনি।
শেখ বাড়ীর সদস্য সংখ্যা তোঁষা’র আগমনে হলো আটজন। তোঁষা’র বড় চাচ্চু তুরাগ শেখ। তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে সন্তান আরহাম এবং আদনান। আর এদিকে তুহিন আর তার স্ত্রী দুই সন্তান। একই ছাদের নীচে তাদের বসবাস। প্রাণোচ্ছল পরিবারটাতে সাজানো এক পুতুল হয়ে এসেছিলো তোঁষা। একমাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন যে থাকত সকলের চোখের পাতায়।
সেই তোঁষা’কে উপরিউক্ত কথাটি তার মা বলেছে। তোঁষা’র বাহু চেপে দ্বিতীয় বার তিনি বলে উঠেন,
— তোর বিয়ে তো আমিই দিবই তোঁষা। তোর যখন এতই পুরুষ প্রয়োজন সেখানে তোকে বিয়ে না দিয়ে আমি কেন পাপিষ্ঠ হব?
— আরহা….
তোঁষা’র চোয়াল চেপে ধরে ওর মা। শক্ত কন্ঠে বলেন,
— একদম চুপ!! কে আরহাম? হ্যাঁ! কে আরহাম? ওর নাম মুখে আনবি না। তোর বাপ তোর খাটিয়া কাঁধে তুলতে রাজি কিন্তু আরহামের সাথে তোর বিয়ে দিতে না।
তোঁষা বড়বড় চোখ দিয়ে ওর মা’কে দেখে নিলো। এতটা হিংস্রতা ওর মায়ের মাঝে কখনো দেখি নি ও। গালে ব্যাথা পেতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু বললো,
— আম্মু.. ব্যাথা পাচ্ছি।
ওর মা ঝট করে ছেড়ে দিলেন। অবিশ্বাস্য চোখে দেখলেন তার পুতুলের গালটা। তার দুই হাতের আঙুলগুলো ডেবে আছে গাল জুড়ে। তখনই আদনান রুমের বাইরে থেকে বলে,
— চাচি?
তোঁষা’র মা যেন চোর ধরা পড়ার ন্যায় পালিয়ে গেলো মেয়ের রুম থেকে। দুই হাতে মুখ চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। গতরাতে স্বামী’র আদর পেয়ে তার সকল অপরাধ ভুলে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন তিনি। তুহিন শেষ আবদার করেছিলো তাকে,
— আমার পুতুলটাকে কিভাবে বাঁচাব প্রাণ? বলো তো?
তোঁষা’র মা শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন স্বামী’কে। আশ্বাস দেন সামলাবেন সবটা। কিন্তু এখন? তার পুতুলের গালে ঐ দাগটা তার হাতের করা। কথাটা ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি পরে তার।
আদনান ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করতেই তোঁষা মুখ তুলে তাকায়। টলমলে চোখে অনুরোধ করে,
— আদনান ভাই, আরহাম ভাই’কে বলুন না আমার কথা।
আদনান মুখ চোখ শক্ত করে তাকায়। তোঁষা উঠে বিছানা ছাড়ে। আদনানের কাছে এসে পুণরায় অনুরোধ করে বলে,
— আপনার ফোনটা একটু দিন না আদনান ভাই। আমি শুধু একবার কথা বলব তার সাথে।
— তোর সাথে কথা আছে তুঁষ।
তোঁষা বিরস মুখে তাকায়। এই “তুঁষ” নামে এই দুই জন ব্যাক্তি ই ডাকে তাকে। নাক টানে তোঁষা। ভেজা গলায় বলে,
— সব কথা শুনব আমি। এই যে ওয়াদা করছি। আগে একবার কথা বলিয়ে দিন না।
আদনান তোঁষা’র মুখপানে তাকায়। ফুলা গাল দুটো লাল হয়ে গিয়েছে। মাত্রই চাচি এ কাজ করেছে তা ওর জানা। আদনান হাত বাড়াতেই তোঁষা দুই পা পিছিয়ে যায়। বাড়ানো হাতটা নিমিষেই গুটায় আদনান। গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বলে,
— সবার কথা মেনে নে তুঁষ। আরহাম কোনদিন তোর হবে না।
তোঁষা যেন মুহূর্তেই রেগে যায়। নাকের ডগা লাল হয়ে আসে। কম্পমান গলায় অগ্নি চক্ষু দিয়ে তাকিয়ে বলে,
— কেন হবে না? একশত বার হবে। হাজার বার হবে। আরহাম ভাই আমার ই হবে। তোমারা সবাই মিথ্যুক। জঘণ্যতম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাকে দূর করেছো।
তোঁষা যেন রাগের মাথায় কাঁপতে থাকে অনবরত। ধৈর্য ধরে আদনান বোঝাতে চেষ্টা করে কিন্তু তোঁষা মানবে না কিছুতেই। অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে হাতের সামনে থাকা পেপার ওয়েটটা আদনানের দিকে ছুঁড়ে মা’রতেই আদনান ওর হাত চেপে ধরে। ধমকে উঠে বলে,
— পাগল হয়েছিস? কি করছিস? খু*ণ করবি আমাকে?
তোঁষা’র মুখ তখন লাল হয়ে আছে। অস্থির হয়ে নিজেকে ছাড়াতে আদনানের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আদনান হাজার চেষ্টা করেও লাভ হয় না। ততক্ষণে তুঁষা’র ও বোনের চেঁচামেচিতে রুমে আসে। তোঁষা’কে ওমন অবস্থায় দেখে দৌড়ে রুমে এসে বুকে জড়িয়ে লাল চোখ দিয়ে আদনান’কে দেখে। তোঁষা রাগে কষ্টে ফুঁপাতে থাকে ভাইয়ের বুকে। তুঁষা’র ওকে ঠান্ডা করতে মাথায় হাত বুলায়। তোঁষা বাবাসম ভাইয়ের বুকের দিকটা খামচে ধরে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,
— তুমি যাবে না ভাই। বলো যাবে না। এরা কেউ ভালো না। কেউ না। আমাকে আরহাম ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও। আমি থাকব না এখানে।
তুঁষা’র বোনকে আগলে রাখে। চোখের ইশারায় আদনান’কে রুম ছাড়তে বলতেই আদনান চলে যায়। তুঁষা’র বোনকে আগলে নিয়ে বিছানায় বসে। চোখ মুছিয়ে দিতেই তোঁষা কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ জানায়,
— আমাকে সবাই মা’রে এখানে ভাইয়া। আমি থাকব না আর। দেখো গালে আম্মু মা’রলো এখন। তোমার সাথে নিয়ে চলো আমাকে।
তুঁষা’র যথেষ্ট সামর্থ্যবান একজন সুপুরুষ। বর্তমানে আর্মিকে আছে ট্রেইনার প্লাস অফিসার হিসেবে। এবার বাসায় আসার কারণটা তার ভিন্ন। তোঁষা’টার জন্যই আসা হলো এবার নাহলে এত তারাতাড়ি ফিরত না ও। বোনের গালে আলতো হাত ছুঁয়ে আদর করে তুঁষা’র। পুরুষনালী ভারী গলাটা বড্ড আদুরে শুনায়,
— বেশি ব্যাথা করছে পুতুল?
.
বড় ভাইয়ের কথা মনে পরতেই তোঁষা’র মনটা খারাপ হয়ে যায়। নজর দেয় ওয়াশরুমের দরজার দিকে। সাওয়ার দিয়ে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। এরমানে আরহাম তখনও গোসল করছে। তোঁষা মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে রাখা। মাত্রই গোসল করেছে ও। ওর নিজের ঠান্ডা লাগছে কি না বুঝা যাচ্ছে না তবে আরহাম ভাই বলেছে,”তুঁষ অনেক ঠান্ডা। তারাতাড়ি আয় এদিকে”।
অতঃপর তোঁষা’কে কম্বলের নিচে ঢুকিয়ে ঢেকে ঢুকে নিজে ওয়াসরুমে গিয়েছে। তোঁষা এক পলক এদিক ওদিক তাকালো। গতরাতে এখানে আসা হলেও এখন পর্যন্ত রুমটাই ভালোভাবে দেখা হয় নি ওর। চোখ গোল গোল ঘুরিয়ে দেখে নিলো তোঁষা। সাদা রঙের দেয়াল কিন্তু বেড সাইডের দিকে আর্টিস্টিক ছোঁয়া। সম্মুখেও সুন্দর করে ডেকোরেট করা দেয়াল। প্রয়োজনীয় কাবার্ড সহ এই কাউচ আর একটা ভ্যানিটি। তোঁষা এখনও জানে না এই ফ্লাট বা রুম আরহামের কি না? তবে রুমের রুচিসম্মত আসবাবপত্র দেখে তোঁষা নিশ্চিত এটা ওর আরহাম ভাই এর ই রুম। বাসায় ও তার রুমটা এমন ঝকঝকা ফকফকা থাকতো। তোঁষা দৌড়ে যেয়ে তার নরম গদিতে ঝাঁপিয়ে পড়তো ছোট থাকতে। সবার জন্য আরহামের রুমে অনুমতি ব্যাতিত প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও তোঁষা’র ক্ষেত্রে ছিলো তা সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম।
কাঁচ দেয়া দেয়ালটার দিকে তাকালো তোঁষা। শীতের দিন বিধায় রোদ উঠেছে দেড়ীতে কিন্তু চলে যাচ্ছে তারাতাড়ি। আরহাম গোসল সেড়ে বের হতেই তোঁষা’র নজরে এলো তার আরহাম ভাই’কে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই রইলো ও। কোন রোকঠোক নেই ওর দৃষ্টিতে। বেহায়া, বেপরোয়া চোখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছে যতটা দেখা যায়।
সাদা টাওয়াল কাঁধে ঝুঁলিয়ে নাভির নিচে টাউজার পড়ে বের হ’য়েছে আরহাম। তোঁষা নির্লজ্জ হয়ে তাকিয়ে রয়। দেখতে থাকে খুঁটিয়ে। লম্বা চওড়া পেটানো শরীরের পুরুষ আরহাম। চওড়া কাঁধ আর সুদর্শন মুখটা তোঁষা’কে যেন খুব করে টানে। বুকে লেপ্টে থাকা কুচকুচে কালো লোম গুচ্ছ ও যেন বাদ গেলো না। তারা ডাকছে তোঁষা’কে। বারবার বলছে, “দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পর এই বুকে তোঁষা। এই বুকটাতে নাক ডুবিয়ে শ্বাস টেনে নে। কম তো কষ্ট করিস নি”।
তোঁষা শুনে মনের কথা শুনলো৷ কেন শুনবে না? এতটা বছর অন্যর কথা শুনে কি লাভ হলো? ধোঁকা ছাড়া কি পেলো তোঁষা? কিছুই না।
আরহাম মাত্রই তাকালো তোঁষা’র দিকে ওমনিই তোঁষা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আরহাম’কে। নাক, মুখ ডুবিয়ে দেয় বুকে। টেনে নেয় শ্বাস বুক ভরে।
আরহাম চোখ বুজে। ওর সার্বাঙ্গ যেন শিউরে উঠে প্রবলভাবে। জড়িয়ে নেয় তোঁষা’কে নিজের সাথে। তোঁষা ও চেষ্টা করে যতটুকু ধরা যায়। আরহামের ঠোঁটে হাসির ঝলক দেখা যায়। ওর চাওয়া গুলো পূরণ হচ্ছে একটু একটু করে। তুঁষ’টা ও তার হচ্ছে একটু একটু করে। আরহাম নিজের বাহু বন্ধনে আটকে থাকা রমণীর মুখটা তুলে। তোঁষা ধীমি স্বরে জানায়,
— আপনার শরীরের ঘ্রাণ এত মাতাল মতাল কেন আরহাম ভাই?
#চলবে…..
[গল্পটা কাল্পনিক তাই বাস্তবতার সাথে মিলালে হতাশ হবেন।]