#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৪
ইতালিতে এখন প্রায় দুপুর। আজ আগষ্টের ১২ তারিখ। আর্শি ও তার বন্ধুরা ক্যাম্পাসের রাস্তাতে হাঁটছে। এখানের রাস্তাটাও দারুণ সুন্দর। ইউনিভার্সিটির গার্ডেন থেকে চুপিচুপি কয়েকটা ল্যাভেন্ডার ফুল নিয়েছিল। এখন সেগুলোকে কানের কাছে খোলা চুলের সাথে ক্লিপ দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে। আজ তার সাঁজসজ্জাতেও আজ ল্যাভেন্ডারের ছাঁপ। একটা জর্জেটের ঘেরালো ও ফুল স্লিভসের ল্যাভেন্ডার রঙের গাউন ও কেডস। ল্যাভেন্ডার রঙের একটা শিফন ওড়না দুই প্যাঁচ দিয়ে গলায় সামনের দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে। পিটার সামনে গিয়ে বলে,
“আশি, স্মাইল!”
পিটার ফটাফট আর্শির কয়েকটা ছবি তুলে আর্শিকে এনে দেখাচ্ছে। তখনি হুট করে একজন সামনে এসে এক মুঠো অর্কিড দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল আড়াল করে হাঁটু গেড়ে বসেছে আর্শির সামনে। আর্শি সহ ওর বন্ধুরা খানিক চমকে ওঠে। কিন্তু সামনের ব্যাক্তিটি যখন মুখের সামনে থেকে ফুলগুলো নামালো তখন আর্শির মুখাবয়বে অবাক মিশ্রিত হাসি ফুটে ওঠে। আর্শি মুখে হাত দিয়ে বিস্মিত স্বরে বলে,
“শ্রাবণ!’
শ্রাবণ ফুলগুলো নিতে ইশারা করে বলে,
“হ্যাপি বার্থডে, বৃষ্টি।”
আর্শি ফুলগুলো নিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
“থ্যাংকিউ। বাট, তুমি এখানে?”
শ্রাবণ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“সারপ্রাইজ ছিল। তুমি খুশি হওনি?”
“হয়েছি।”
“মনে হচ্ছে না।”
আর্শির হাসি মিলিয়ে যায়। শ্রাবণ কি তবে আবার অভিমান করলো? সে তো সত্যি খুশি হয়েছে। এদিকে শ্রাবণ ভাবছে, ‘ও তো খুশি প্রকাশ করলো না!’ আর্শি শ্রাবণকে অণ্যমনা দেখে হাত ধরে বলল,
“আমি খুব খুশি হয়েছি, শ্রাবণ। তোমার কেন মনে হলো, আমি খুশি হইনি। আমি সত্যি জানিনা।”
শ্রাবণ মুখশ্রীতে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“লেট ইট গো। তোমার ফ্রেন্ডের সাথে ইন্ট্রোডিউস করাবে না?”
“অফকোর্স।”
অতঃপর আর্শি সবার সাথে শ্রাবণের পরিচয় করায়। আর্শি বলে,
“আজকে আর আমি ক্লাস করছি না। সোহা, ক্লাস চুপিচুপি রেকর্ড করে নিস। যদিও লিসা আছে। তাও।”
শ্রাবণ বলে,
“ক্লাস করতে পারো।”
“উম.. না। চলুন তো।”
এই বলে আর্শি শ্রাবণকে নিয়ে কাছেরই একটা রেস্টুরেন্টে গেলো। নিরিবিল দেখে একটা টেবিলেই বসলো। ছিমছাম বেশ সুন্দর। আর্শি খাবার অর্ডার করে শ্রাবণের হাত ধরে শুধায়,
“আপনি আবার মন খারাপ করে আছেন? কিন্তু কেন? তাছাড়া আপনারই বা কেন মনে হল আমি খুশি হইনি?”
শ্রাবণ হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“তুমি এখনও আমাকে ভালোবাসতে পারোনি?”
আর্শি শ্রাবণের হাত ছেড়ে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। শ্রাবণ মনে মনে ছটফট করছে আর্শির বলার। মিনিট দুয়েক পর আর্শি মাথা উঠিয়ে বলে,
“আমি জানিনা, আপনার কাছে ভালোবাসার অর্থ কী? আপনার মনে নিশ্চয়ই এই ভয়টা কাজ করে যে, ও আমার থেকে অনেক দূরে আছে। যদি আমাকে ছেড়ে যায়? তাই না? কিন্তু কেন? আপনি বিয়ের আগে ভাবতেন যদি আমি(আর্শি) অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলি। তাইজন্য আমার পুরো পরিবারকে রাজি করিয়ে আমাকে রাজি করালেন। এখন বিয়ের পর ভাবছেন, যদি আমি ছেড়ে চলে যাই? কেন?”
শ্রাবণ নিজের দিকটা ব্যাখ্যা করতে চাইলো।
“তুমি ভুল ভাবছো। আমি…”
আর্শি বলতে দিলো না। থামিয়ে নিজে বলে,
“আমি সরল সম্পর্ক চাই, শ্রাবণ! আপনিই জটিল করছেন। আমি আপনার মতো অতিরিক্ত ভালোবাসতে না পারলেও ভালো যে বাসি না, এমনও না। ইউ আর মাই হাজবেন্ড। এন্ড আই লাভ ইউ। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না। ভয় যে আমার হয় না, এমনটাও না। আমি ভয়ের জন্য…. থাক বাদ দিন। আমার মনে হয়, আপনি যতো দ্রুত নিজের জবে ঢুকবেন, ততো আপনার মনের জন্য ভালো। আপনি সারাদিন ফ্রি থাকেন বলে আপনার ব্রেণ উলটা-পালটা চিন্তায় মশগুল থাকে।”
শ্রাবণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আই থিংক সো।”
ইতোমধ্যে অর্ডার করা খাবার এসে গেছে। আর্শি নিজের প্লেট থেকে চামচে করে রাইস ও মাশরুমের এক পিস নিয়ে শ্রাবণের মুখের সামনে ধরে। শ্রাবণ নিজের প্লেটের খাবার থেকে মুখে নিচ্ছিলো তখন সামনে আর্শিকে খাবার ধরে থাকতে দেখে মুচকি হেসে খাবারটা নিয়ে নেয়। অতঃপর নিজের হাতের খাবারটা আর্শির দিকে বাড়িয়ে দেয়। আর্শি মুখে নিয়ে নেয়। খেতে খেতে বলে,
“আমরা কি হোটেল বুক করব? নাকি পিটারের বাড়িতে উঠব। যদিও পিটারকে বলিনি।”
শ্রাবণ সাথে সাথে জবাব দেয়,
“হোটেলেই উঠি। কাউকে বোদার করার দরকার নেই।”
“ওকে।”
দুজনেই দুপুরের খাবার শেষে আর্শিদের ফ্লাটের দিকে গেলো। শ্রাবণ বলল,
“তুমি উপরে গিয়ে ব্যাগ প্যাক করে নিয়ে এসো।”
আর্শি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“আপনি যাবেন না?”
“মেয়েদের অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়াটা কেমন দেখায়। তুমি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসো।”
“অ্যাপার্টমেন্টে এখন কেউ নেই। তাই আপনাকে এতো লজ্জা পেতে হবে না। লম্বা জার্নি করে এসেছেন। একটু রেস্ট নিবেন। আমি এর মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে নেব।”
“তুমি যাও। আমি এখানে ঠিক আছি।”
“উঁহু। আমি আপনাকে সাথে করে নিয়েই যাব। আমার ব্যাগ গোছাতে কম করে হলেও আধা ঘন্টা লাগবে। ততক্ষণ আপনি নিচে দাঁড়িয়ে থাকবেন? আশেপাশের লোকজন তখন কিছু ভাববে না? শুধু অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলেই ভাববে? আমি দারোয়ানকে বলে যাবো তো।”
“আচ্ছা চলো!”
শ্রাবণ বাচ্চাদের মতো মুখ করে রাজি হয়। যা দেখে আর্শি হালকা হেসে শ্রাবণের গুছিয়ে রাখা চুলগুলো খানিক এলোমেলো করে দিয়ে দারোয়ানকে বলে উপরে গেলো।
_______
সন্ধ্যায় আরিয়া বিছানায় হেডবোর্ডের সাথে আরাম করে বসে পড়ছিল। আর আশিক নিজের ডেস্কে বসে। তখন দরজায় নক হলে আরিয়া বলল,
“উঠো। দরজা খুলে দেখো।”
আশিক উঠে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলে দেখলো মুশফিকা দাঁড়ানো। হাতে একটা ছোটো ট্রেতে দুই মগ কফি। মুশফিকা হেসে বলল,
“দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”
আশিক হাসার চেষ্টা করে সরে দাঁড়ায়। মুশফিকা রুমে প্রবেশ করে আরিয়ার কাছে বসে। আরিয়াকে এক মগ কফি দিয়ে আরেকটা আশিককে নিতে ইশারা করে। ফের বলে,
“তোমরা পড়ছিলে, তাই ভাবলাম তোমাদের জন্য কফি করে আনি।”
আশিক আরিয়ার দিকে তাকায়, আরিয়া আশিকের দিকে তাকায়। তারপর আরিয়া ওষ্ঠকোণে কৃতিম হাসি টেনে বলে,
“তুমি কেন কষ্ট করতে গেলে, ভাবি। আমাদের দরকার পড়লে আমরা বানিয়ে নিতাম।”
“এটা আবার কষ্ট কী? আমি কি আমার দেবরের মতো ভাই, ও দেবরানীর মত বোনের জন্য এটুকুও করতে পারি না?”
“না পারো। তুমি তো সারাদিন রান্না করেছো। এখন রেস্ট নিবে। তিন-চার দিন যাবত তো তুমিই রান্না করছো। কতো কষ্ট করছো।”
“আরে তেমন কিছু না। চপিং সব তো মেইড করে দেয়। আমি শুধু দুটো আইটেম রান্না করি। ডালটা আবার মা রান্না করেন। ওটা নাকি বাবার খুব পছন্দের।”
“তাও তো করছো। আমি তো শুক্রবার, শনিবার ছাড়া সুযোগই পাই না।”
“তাহলে ওই দুইদিন তুমি রান্না করো। বাকি পাঁচদিন আমি রান্না করলাম। দুই জা তে মিলেমিশে রান্না করলাম।”
মাঝ থেকে আশিক বলে,
“এটা আপনি ঠিক বলেছেন, ভাবি।”
মুশফিকা খানিক মশকরা করে বলল,
“দেখেছ আরিয়া, আশিক চায় তোমার হাতের রান্না খেতে। তাই বলছে।”
আশিক মাথা নুইয়ে লাজুক হেসে ডেস্কের কাছে চলে যায়। আশিককে লজ্জা পেতে দেখে আরিয়াও লজ্জা পায়। মুশফিকা তাড়া দিয়ে বলে,
“আচ্ছা, তাহলে তোমরা পড়ো। আমি যাই এবার। তোমাদের আর ডিস্টার্ব না করি।”
আরিয়া বিপরীতে মুচকি হাসে। মুশফিকাও চলে যায়। আরিয়া দরজা লাগিয়ে এসে আশিকের ডেস্কের কাছে গিয়ে বলে,
“আমার না ভাবির মতিগতি কিছুই বুঝে আসছে না। উনি আমাদের সাথে যেরকম বিহেভ করছে, উনি কি আসলেই তেমনটা? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।”
আশিক অভয় দিয়ে বলে,
“তুমি এত নেগেটিভ ভাবছ কেন? ভাবি আমাদের সবাইকে আপন করে নিতে চাইছে।”
“আরে, মা*থামো*টা!”
আরিয়া কথাটা বলা মাত্রই আশিক সরু দৃষ্টিতে চাইলে আরিয়া এক কানে হাত দিয়ে বলে,
“সরি! তোমার ভাইয়া যে হুট কর বিয়েটা করেছে। নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে। আবার তোমার ভাবি যে এত ভালোমানুষি দেখাচ্ছে এরও কোনো কারণ আছে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ এর পিছনেও কিছুতো আছেই।”
আশিক কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে,
“দয়া করে, তুমি এসব চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে পড়ো। তোমার না পরীক্ষা?”
“পাত্তা দিচ্ছো না-তো?”
“না দিচ্ছি না। যাও পড়তে বসো।”
আরিয়া গাল ফুলিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসে। থেমে থেমে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর চিন্তা করছে।
চলবে ইন শা আল্লাহ,
কালকে দিব বলেছিলাম। আগেরদিন মনে ছিল না যে গতকাল শবে বারআত। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ। রিচেক করা হয়নি।