প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ১১

0
276

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১১

উদাস মুখে আকাশ পানে তাকিয়ে তোঁষা। আরহাম ভাই তাকে নেয় নি সাথে। তোঁষা জেদ করতেই অসহায় চাহনি দেয় আরহাম। সেই চাহনি উপেক্ষা করে কিছু বলার সাহস আর হলো না তোঁষা’র। খুশি মনে আরহাম’কে বিদায় দিয়েছে। অনেক জেদ করে অনুমতি নিয়েছে বারান্দায় আসার।
আজও আরহাম তাকে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে গেলো। তোঁষা অদূরেই আকাশছোঁয়া পাখিদের দেখা পায়। আরহাম গিয়েছে সেই সকালে। এখন বিকেল। তোঁষা’র তো আজ দুপুরে ও করার মতো কিছু ছিলো না। গোসল তো সকালেই করলো।
যদিও আজ তোঁষা প্লান করেছিলো ঘুমিয়ে দিনটা কাটিয়ে দিবে কিন্তু তাও হলো না। শত চেষ্টা’র পরও তা সম্ভব হয়ে উঠলো না। মানুষ তখনই ঘুমাতে পারবে যখন তার শরীর এবং মস্তিষ্ক ক্লান্ত থাকবে। তোঁষা সাকলেও ভালো ঘুমালো। সারাদিন শুয়ে বসেই কাটালো। ঘুম আসবে টা কোথা থেকে? তোঁষা’র মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে যায়। মনে পরে বাসার কথা। মা-বাবা আর তুষা’রের কথা। তুঁষা’র তাকে অনেক ভালোবাসে। মা ও তাকে ভালোবাসত কিন্তু কেন যে এমনটা করলো তা বুঝে আসে না তোঁষা’র। পিঠে এখন ও ব্যাথা অনুভব হয় তার। ঐ দিনের পিঠে দেয়া আঘাতটা খুব জোরে ছিলো। তোঁষা কখনো ভুলবে না সেটা। শরীরে মা’রের কম আঘাত নেই তার। মা তো তাকে নিজের জান বলে দাবি করতো কিন্তু কেউ কি নিজের জান’কে মা’রে? মা’রে না তো। তাহলে কেন মা মা’রলো তোঁষা’কে? তোঁষা’র ভুলটা কি ছিলো? ভালোবাসা কি ভুল ছিলো? ভুল থাকলে কেন তাকে শুরুতেই থামালো না? যখন তোঁষা সম্পূর্ণ ভাবে ভালোবাসার কাছে আয়ত্তহীন হয়ে পরলো তখনই তারা উঠে পরে লাগলো তোঁষা’কে আরহাম থেকে আলাদা করতে।

কথাগুলো ভাবতেই তোঁষা’র চোখ টলমল করে উঠে। এখন তার কোন চিন্তা নেই। আরহামে’র ঘ্রাণ সারাক্ষণ না পাওয়া গেলেও তোঁষা তার ব্যাবস্থা করে নেয় নিজেই। কখনো আরহামে’র গায়ের শার্ট পরে বা কখনো আরহামের দেয়া পারফিউম সারারুমময় ছড়িয়ে। তবুও কেন জানি দিন শেষে তোঁষা’র মন বিষাদে ভরে যাচ্ছে। বাবার কথা মনে পরছে। বাবা তো তোঁষা’র সাথে ঠিকমতো কথাই বলত না শেষদিকে কিন্তু মাঝেমধ্যে যে রাতে রুমে এসে তোঁষা’র মাথায় হাত বুলাতো তখন তোঁষা সব ভুলে যেতো। মন চাইতো ডুকরে কাঁদতে। কয়েকবার তো বাবা টের ও পেতেন যে তোঁষা জাগ্রত। তখন সন্তপর্ণে তোঁষা’র কপালে চুমু খেয়ে চলে যেতেন তিনি। তোঁষা’র মনে পরছে এখন বাবা’র কথা। কতদিন হলো দেখা হচ্ছে না তাকে। ভাই নিশ্চিত এখনও ক্যাম্পে ফিরে নি। তোঁষা’কে খুঁজে চলছে। কিন্তু তারা পাবে না তোঁষা’কে। কখনোই না। তোঁষা লুকিয়ে থাকবে এখানে। ওর আরহাম ভাই’য়ের কাছে।
.
আজ সন্ধ্যা একটু গড়াতেই আরহাম বাড়ী ফিরলো। তোঁষা তখন টিভি দেখতে দেখতে সোফায় ঢলেছে কিছুটা। আরহাম খুব ধীর শব্দে দরজা লক করে পাছে যদি তুঁষা’টা উঠে যায়? তোঁষা’র কাছে এসে গভীর চোখে দেখলো আরহাম। ঠোঁটে যেন হাসি ঝরা শুরু করে তার এই মায়াবী মুখ দেখলে। তোঁষা’র কপালে পড়ে থাকা কিছু এলোমেলো চুল দেখতেই আরহাম হাতে থাকা ব্যাগটা পাশে রেখে হাঁটু ভেঙে বসে তোঁষা’র বরাবর। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখে তোঁষা’কে। হাত বাড়িয়ে তোঁষা’র মুখে পড়া চুলগুলো সরাতেই তোঁষা চোখ খুললো। আরহাম’কে দেখেই হাসলো অধর এলিয়ে। নিদ্রা মিশ্রিত কন্ঠে ডেকে উঠলো,

— কখন এলেন?

আরহামে’র হৃদপিণ্ডে যেন প্রচুর বেগে জোয়ার বয়ে গেলো। তার তুঁষে’র এই ঘুম জড়ানো কন্ঠ’টা শুনা হয় না আজ অনেকদিন। আরহাম তোঁষা’র চুলগুলো নাড়তে নাড়তে উত্তর করলো,

— মাত্র ই এলাম।

— আমার জন্য কি এনেছেন?

— কি আনব?

দুষ্ট কন্ঠ আরহামে’র। তোঁষা মুখ কুঁচকে উঠতেই আরহাম ওর নাক টেনে বললো,

— বুঁচি একটা, বোঁচা এক নাক নিয়ে সারাক্ষণ মুখ কুঁচকে রাখে।

কথাটা বলেই আরহাম রুমে যায়। তোঁষা অলস ভঙ্গিতে তাকালো পাশের সোফায়। এখন ওর একটুও উঠতে মন চাইছে না। সাপের মতো মোচরাতে মোচরাতে সোফা থেকে নেমে পাশের সোফায় পৌঁছালো। যেই না ব্যাগের চেইন খুলবে ওমনিই আরহামে’র গলা শুনা গেলো,

— তুঁষ! এটা কি ছিলো? এই তুই আজ থেকে এইসব ফালতু কার্টুন দেখবি না। দিন দিন সিনচেন হয়ে যাচ্ছিস।

তোঁষা মুখ ভেঙালো। আরহাম’কে ভেঙিয়ে নকল করে বললো,

— দিন দিন সিনচেন হয়ে যাচ্ছিস।

আরহাম কিছুপল তাকিয়ে রইলো। তোঁষা ব্যাগ হাতড়ে তখন দেখছে ওর জন্য কি কি আছে। কয়েক পদের চকলেট পেতেই তোঁষা মুখে পুরলো আগে টপাটপ। পরে যদি আরহাম ভাই সব খেতে না দেয়?
_____________

— তুঁষ এদিক আয়।

তোঁষা হাতে থাকা গ্লাস রেখে আরহামে’র দিকে যেতেই আরহাম ইনসুলিন পুশ করতে এগিয়ে এলো। তোঁষা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমি নিয়েছি ইনসুলিন।

— কখন?

— যখন আপনি খাবার গরম করছিলেন।

আরহাম ঠোঁট কামড়ে ধরে। কিছু একটা ভেবে তোঁষা’র হাত টেনে নিজের কাছে আনে। তোঁষা মুখ ভর্তি লজ্জা ভাব নিয়ে মাথা নিচু রাখতেই আরহাম ওর মুখ তুলে। চোখে চোখ রেখে বললো,

— এরপর থেকে আমিই পুশ করে দিব। সকালেও আমি রাতেও আমি। মনে থাকবে?

— আমি একাই দিতে পারি।

— উহু। কোন কথা না।

— আচ্ছা আচ্ছা। ছাড়ুন। আমাকে সুচের খোঁচা দিতে মজা লাগে আপনার। বুঝি আমি।

কথাটা বলেই তোঁষা নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আরহাম থেকে। ও এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে। আরহাম আজ তোঁষা’র পছন্দের বিফ করেছে। নাদুস নুদুস তোঁষা’র ভীষণ পছন্দ খাওয়া দাওয়া করা। আজ মনটা ফুড়ফুড়া এত মজার খাবার দেখে। তোঁষা নিজেই দুই প্লেটে খাবার বাড়তে লাগলো অথচ পিছনে রয়ে গেল আরহামে’র রাগান্বিত মুখশ্রী।
তোঁষা’র কথা ওর ভালো লাগে নি। আরহামে’র কি না ভালো লাগে ওর তুঁষ’কে আঘাত করা? আর ইনসুলিন যে আজ একা নিলো এখন আরহাম কি করবে? ভাবতেই আরহামে’র রাগ হলো। দাঁত দিয়ে দাঁত পিষে আরহাম। লাল হওয়া চোখ দিয়ে আশপাশ দেখে হনহনিয়ে কিচেনে চলে যেতেই তোঁষা’র ডাক পরলো,

— আরহাম ভাই, আসুন না তারাতাড়ি। আমার তো লালা পরে গেলো।
________________

রাত্রি’র অন্ধকারে যখন ঢাকা গোটা শহর তখন কফি হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুঁষা’র। জীবন বড্ড অগোছালো হয়ে গেল তার। তোঁষাটা’র কি অবস্থা? পুতুল’টা যে ছটফট করে। আরহাম কি তবে বেঁধে রাখলো ওকে? এক জায়গায় তো পুতুলটা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ওর নাকি দম আটকে আসে। বাসা ছাড়া কোথায় থাকতে পারে না। সেবার যখন এসএসসি’র আগে বার্ষিক পিকনিক এ গেলো তখন রাত এগারোটা’র দিকে কল আসে তুঁষা’রের ফোনে। ওরা এসেছিলো চট্টগ্রাম। এদিকে তুঁষা’রের কোয়াটার তখন। ফোন ধরতেই কানে আসে তোঁষা’র কান্নারত গলা,

— ভাই…. ভাই আমাকে নিয়ে যাও। আমার সাফোকেশন হচ্ছে। ভালো লাগছে না।

তুঁষা’র ব্যাস্ত হয়। আর্মি ম্যান ঝটপট জানায় তার পুতুল’কে,

— পুতুল। ভাই’য়ের জান। ভাই আসছি বাচ্চা। একটু ধৈর্য ধর।

— এখনই আসো ভাই। ভালো লাগছে না।

বলেই ডুকরে উঠে তোঁষা। তুঁষা’র একাই বের হয় আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। তোঁষা’কে নিয়ে আসে নিজের সাথে। সেদিন সারারাত দুই ভাই-বোন চট্টগ্রামের রাস্তা ভ্রমণ করেছিলো। নিকোষ কালো অন্ধকার ভেদ করে হাস্যজ্বল তোঁষা’র মুখটা যেন চিকচিক করছিলো।

পিছনে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই তুঁষা’র বাস্তবে ফিরলো। পাশেই তথ্য দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা তুঁষা’রের জুনিয়র তবে এত বছর ধরে একসাথে থাকতে থাকতে তাদের মাঝে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কিছুটা। তথ্য নিজের কাঁধ সমান চুলগুলোতে দুটো বেণী করাতে একদম বাচ্চা বাচ্চা এক ভাব ফুটে উঠলো তার চেহারায় অথচ নারীটি’র বয়স তুঁষা’র থেকে বছর দশ কি বারো কম হবে। পার্থক্য ততটাও না আবার কম ও না। তথ্য ধীরে জানতে চাইলো,

— কিছু কি হয়েছে?

— না।

— মনে হচ্ছে…

— লিফ তথ্য।

— তুঁষা…

— আ’ম ইউর স্যার। কল মি স্যার ওকেই নট তু্ঁষা’র।

কথাটা বলেই চলে যায় তুঁষা’র। তথ্য’র সাথে অতটাও ভালো সম্পর্ক তার নেই যে পুতুলের ব্যাপারটা শেয়ার করবে। এদিকে তথ্য মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটা তাকে অপমান করে গেলেও কেন জানি ওর খারাপ লাগলো না।
.
তোঁষা ঘুমালো ঘন্টা খানিক আগে। ঘুম কি সে সহজে এলো? আরহাম কত কত কথা বলে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ালো। যখন বুঝলো তোঁষা সম্পূর্ণ ঘুম তখনই আলমারি’র একটা ড্রয়ার খুলে একটা ইনজেকশন রেডি করলো ও। তোঁষা’র কাছে এসে বা হাতটাতে পুশ করতেই তোঁষা “উহ” শব্দ করে। আরহাম তৎক্ষণাত তোঁষা’র পাশে শুতেই তোঁষা ঘুমের মধ্যেই বললো,

— এত উপরে মশা কেন আরহাম ভাই?

আরহাম উত্তর করে না। তোঁষা যখন পুণরায় ঘুমালো তখন আরহাম ওকে বুকে চেপে নিলো। কানে কানে ফিসফিস করে জানালো,

— তোকে আগেই জানিয়ে রাখলাম তুঁষ। পরে বলবি আগে কেন জানাই নি। তুই শুধু আমাকে ভালোবাস। আমাকেই চিন। তোর প্রথম আর শেষ আমিই হই। তোর পাপ আর পূর্ণ্য ও আমিই হই। সব ভুলে যা তুই তুঁষ। শুধু আমার প্রাণ হয়ে থেকে যা।

#চলবে……?
[গল্পটা কাল্পনিক তাই সেভাবেই ভাবুন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here