#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৮
রাত এখন ততটাও গভীর নয় তবে ঘুমন্ত পুরিতে পরিণত হয়েছে রাজশাহী শহর। যেদিকটায় ক্যাম্প সাজানো সেদিকটা’কে শহর বলা চলে না। নিতান্তই বাস্তব এক জঙ্গল এটা। তথ্য একদফা ভাবলো এসব জঙ্গলেই কেন বেশিরভাগ ক্যাম্প গাঁথা হয়?
কি হয় শহরের দিকে থাকতে দিলে? একা মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সামনে পা বাড়ালো তথ্য। নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিতে বললো,
— শহরে কি এত জায়গা আছে যে ট্রেইন করবে এত এত ষাঁড়গুলো’কে?
— ষাঁড়’কে একবার ডেকেই দেখো টুকটুকি তোমার পিছু পিছু জাহান্নামে চলে আসব।
হঠাৎ চিকন গলায় উক্ত বাক্য শুনেই ভ্রু কুঁচকায় তথ্য। পিছনে ঘুরতেই দেখলো চ্যাংড়া দুই চারটা ছেলে দাঁড়িয়ে। এক দেখায় তথ্য চিনে ফেললো এগুলো সব গাঁজাখোড়। চোখের চাহনি আর শরীরে’র ঢুলনি তাই প্রমাণ করছে। যে কিনা দুই ছটাক শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে সে কিনা তথ্য’র মতো মেয়ে’কে তাকে টুকটুকি? আশ্চর্য! ডাকবি শালা ডাক তাই বলে টুকটুকি কেমন শব্দ? কেমন মনে হয় কেউ বুঝি ওকে টিকটিকি ডাকলো। ভাবতেই তথ্য’র গা গিজগিজ করে উঠলো।
নতুন কালে যখন ট্রেনিং এ গেলো তখন সিনিয়র আপা’রা ওকে টিকটিকি’র সাথে বাথরুমে আটকে দিয়েছিলো। সেগুলো কি আদৌ টিকটিকি ছিলো? ইয়া বড় বড় একেকটার সাইজ৷ ওখানকার স্থানীয় লেকগুলো কিছু একটা নামে ডাকতো সেগুলো’কে। তথ্য’র মনে হয়েছিলো সেগুলো ছোট্ট বেলায় দেখা নাভিসাপ। ঐ সাপ দেখলেই সবাই প্যান্ট উপরে টেনে নাভি ঢেকে রাখতো। ধারণা ছিলো ঐ সাপ নাভি দেখলেই নাড়িতে কামড় দিবে।
সেদিন বাথরুমে কি ভয়টাই না পেলো তথ্য। আহা আজও মনে পরলে গা কেঁপে উঠে কেমন। চিৎকার করে ডাকলেও কেউ দরজা খুলে নি।
তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরদিন তথ্য ঐ বড় টিকটিকি হাতে নিয়ে এক সিনিয়র আপা’র গায়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলো। সবাই অবাক হয়েছিলো সেদিন। একরাতে কি না এই মেয়ে’র টিকটিকির ভয় কেটে গেলো? তবে আসল রহস্য আজও কেউ জানে না। সেটা তথ্য’র রহস্য। একান্তই নিজের।
— কি টুকটুকি, কি ভাবো? আমার কাছে আসো। আমার লাল টুকটুকি…..
সজোরে এক থাপ্পড় মার*তেই চ্যাংড়া ছেলেটা ছিটকে পড়লো সাইডে’র ঝোঁপে। তথ্য চোখ রাঙিয়ে ধমকালো,
— আরকবার টিকটিক ডেকে দেখ শালা। তোর চাপার দাঁত খুলে ফেলব আমি।
সেই যে ছেলেটা ঝোঁপে পরলো আর উঠার শক্তি পেলো না। ওখানেই কাত। তথ্য অবাক হলো। এক থাপ্পড়েই এমন। এতো এমন হলো যেখানেই রাত ওখানেই কাত। হাউ রিডিকুলাস।
বাকি তিনটা ছেলে কটমট করে তাকিয়ে বললো,
— তোর তো ত্যাঁজ অনেক ছেমড়ি। তোরে তো আজ….
ব্যাস মাথা গেলো খারাপ হয়ে তথ্য’র। দুই হাত দুই পা এর সঠিক ব্যাবহার করতেই তিনটা ছেলেও নড়বড়ে হয়ে গেল। তথ্য হাত ঝাড়তে ঝাড়তে সামনে পা বাড়ালো। মাত্র ঘটা ঘটনাটায় বিরক্ত হলো বটে। মেয়ে হয়ে শান্তি নেই। এই যে ও আর্মি গার্ল তবুও কি না এই সব এংড়া চ্যাংড়া ওকে টিজ করে। এই ছিলো কপালে? পুড়া কপাল। ঐ এক তুষা’রের প্রেমে পড়ে জীবনটাই ফাঁতা ফাঁতা। ব্যাটা পাত্তা দেয় না।
শুকনো পাতায় পা ফেলার ন্যায় শব্দ কানে বাজতেই তথ্য পিছু ঘুরলো। তুঁষা’র দাঁড়িয়ে হাতে কফির মগ নিয়ে। তথ্য এগিয়ে এলো ওর দিকে। পিছু উঁকি দিয়ে বললো,
— একাই এসেছো?
— হু।
— কফি খাচ্ছো?
তুষা’র কথা না বলে হাতে থাকা খালি মগটা দেখিয়ে বললো,
— শেষ।
তথ্য সামনে যেতে যেতে বলতে লাগলো,
— যাবেন আমার সাথে?
— কোথায়?
— প্রেম নগরীতে।
তুষা’র হেসে ফেললো। বললো,
— তোমার মতো মেয়ের সাথে প্রেম হবে না। মাত্র ই গু*ন্ডামী করলে।
তথ্য চোখ বড় বড় করে তাকালো। আশ্চর্য হওয়া কণ্ঠে বলে উঠলো,
— গু*ন্ডামী?
— মাত্র ই কে মা*রলো ছেলেগুলোকে?
— আমাকে টিকটিকি ডেকেছে।
— টুকটুকি হবে।
— হ্যাঁ হ্যাঁ। বোত সাউন্ডস সেইম।
— এখনও ভয় কাটলো না টিকটিকি’র।
তথ্য চাপা হাসলো। ঐ দিন বড্ড সাহস জুগিয়ে টিকটিকি হাতে তুলেছিলো ও যাতে সিনিয়র আপা’রা আর তাকে ভয় না দেখায়। বুদ্ধিটা যদিও ছিলো তুষা’রের। তথ্য যখন নালিশ জানাতে যায় তখনই তুঁষা’র তাকে এহেন বুদ্ধি দেয়।
হঠাৎ ঝোঁপে’র মাঝে শব্দ হলো। তথ্য তাকাতেই দেখা মিললো সেই সাপে’র। সাথে সাথেই নিজের অজান্তে তথ্য’র হাত চলে গেল পেটে। পরণে থাকা টাউজারটা টেনে তুলতেই হো হো শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ। তুঁষা’র বহু কষ্টে হাসতে হাসতে বললো,
— এখনও তুমি প্যান্ট টানো সাপ দেখলে? নাও প্লিজ ডোন্ট সে নাভিসাপ তোমার নাভি দেখলে কামড়ে দিবে।
লজ্জা পেলো তথ্য। ছোট বেলার এই অভ্যাস’টা ত্যাগ করা যাচ্ছে না। গুইসাপ দেখলেই এমন ভয় লাগে।
______________________
— বই এনে দিবেন আজ।
— দিব।
— দিব মানে? আগেও বলেছেন দিবেন। কোই দিলেন?
বলেই ফুলা গাল দুটো আরেকটু ফুলালো তোঁষা। আরহাম হাতের ব্যাগটা গোছাতো গোছাতে বললো,
— আগে আমাকে পড়ে শেষ কর।
তোঁষা এবার টলমলে চোখে তাকালো। আরহাম তাকাতেই হকচকিয়ে গেল। এই তুঁষ’টাকে বশে আনা বহুত কঠিন কাজ। গভীর তাপস্যা’র বিষয়। এগিয়ে এসে তোঁষা’র গাল ছুঁয়ে দিতেই তোঁষা মাথা নামায়। প্রচুর জেদী এই মেয়েটা চাইলেও রাগ দেখাতে পারে না আরহামে’র কাছে। আরহাম হাত বাড়িয়ে তোঁষা’কে নিজের কাছে টানতে নিলেই তোঁষা উঠে গেলো। আরহামে’র সামনে দিয়ে হেটে রুম থেকে বাইরেও চলে গেলো।
দীর্ঘ দৃষ্টিতে এতটুকুই দেখলো আরহাম। এতক্ষণ দুটো বালিশ এক করে তার উপর উঠে বসে ছিলো তোঁষা। ছোট থেকেই এই বদঅভ্যেস। এতবছর ওকে এভাবে বসতে দেখলেই মা বকতো কিন্তু আরহাম বকে না। উল্টো নিজে বালিশ দিয়ে উঁচু করে দিবে। নিজের তুঁষে’র কোন আবদার বাকি রাখবে না আরহাম। তবে এই পড়াশোনার ব্যাপার’টা ভালো লাগছে ওর কাছে। বিগত কয়েকদিন ধরে তোঁষা বই বই করে পাগল করে দিচ্ছে ওকে। ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো ততক্ষণাৎ।
তোঁষা’র কাছে যেতেই তোঁষা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। হাসলো আরহাম। লম্বা চুলের গোছা ধরতেই তোঁষা ছাড়িয়ে নিলো তা। উঠে যেতে নিলেই এবার আটকালো আরহাম। তোঁষা’কে ধরে রাখে নিজের সাথে। তোঁষা মোচড়ালো। ছাড়াতে চাইলো। লাভ হলো না। আরহাম ওকে কোলে নিয়েই খাটে বসে। তোঁষা’র কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে নরম হয়ে আরহাম বললো,
— আজ এনে দিব সত্যি।
— তিন সত্যি?
— তিন সত্যি।
— যদি না আনো?
— তাহলে সব শাস্তি মেনে নিব।
তোঁষা ঠোঁট উল্টে বললো,
— আমি তো আপনাকে শাস্তি দিতে পারি না।
আরহাম হাসলো শব্দহীন। কন্ঠে তপ্ততা এনে বললো,
— যখন তুই এভাবে রেগে যাস আমার সাথে। কথা বলিস না তখন আমার বুকের ভেতর মনে হয় কেউ পাথর দিয়ে আঘাত করছে। এর থেকে বড় শাস্তি আর কি দিবি?
তোঁষা ঝট করে ঘুরে জড়িয়ে ধরে আরহাম’কে। অপরাধী’র স্বরে বলে,
— আ’ম সরি।
.
আরহাম আজ তার কথা রেখেছে। মোটা মোটা বইগুলো সব টেনে এনে বড্ড ক্লান্ত সে। তোঁষা দৌড়ে আগে ঠান্ডা পানি এনে দিলো ওকে। আরহামে’র ভালো লাগলো তোঁষা’র এতটুকু আদর। আরহাম’কে পানি দিয়েই তোঁষা বইগুলো খুলে বসলো। নতুন কাগজের ঘ্রাণে মনে হলো তোঁষা বুঝি নতুন ইন্টারে ভর্তি হয়েছে অথচ এই বছরই তার পরিক্ষা। তোঁষা বইগুলো হাতাতে হাতাতে বলতে লাগলো,
— আগের বইগুলো দাগানো ছিলো। সমস্যা নেই আমি শেষ করে ফেলব। পরিক্ষা’র পর তো এডমিশন কোচিং এ ভর্তি হতে হবে। তাই না? শুনুন আমি কিন্তু বুয়েট এ পড়ব। আপনার পকেট খালি হয়ে যাবে। তখন কিন্তু কিছু বলতে পারবে না।
আরহাম মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তবে প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। তোঁষা নিজের মতো বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো কিছুক্ষণ। উঠে দাঁড়াতেই আরহাম বললো,
— আমার টাওয়াল দে তো তুঁষ। শাওয়ার নিব।
তোঁষা একপল তাকায় পরপরই আলমারি থেকে টাওয়াল বের করে দেয়। আরহাম কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায়। তোঁষা’র মনে হলো এই প্রথম আরহাম ভাই ওকে এভাবে আদেশ ভাঙ্গিতে কিছু বলেছে। ততটা না ভেবে নিজের বইগুলো রাখার যথাযথ জায়গা খুঁজতে ব্যাস্ত হয় তোঁষা। এদিক ওদিক তাকাতেই যেন হতাশা ভর করে ওর মাঝে। পড়ার টেবিল নেই রুমটাতে। অগত্যা আলমারি খুলে আরহামে’র আর ওর কাপড়ের মাঝে বই গুছিয়ে রাখে ও। বোটানি’টা নিজের কাছেই রাখলো। বায়ো মাথায় থাকে না তোঁষা’র। মুখস্থ বিদ্যা বড়ই খারাপ ওর। একদম যা তা অবস্থা। অন্য ফিজিক্স হোক বা হায়ার ম্যাথ তোঁষা বরাবরই ভালো একজন ছাত্রী।
বইটা নিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসে তোঁষা। প্রথম অধ্যায়টা জটিল মনে হতেই তোঁষা তৃতীয় অধ্যায় খুললো। কোষ বিভাজন কিছুটা সহজ তবে ঝামেলা বাঁধে এগুলোর ধাপগুলো মনে রাখতে। বিরক্ত তোঁষা হার মানে না। বিরবির করে পড়ে যায়।
আজ প্রায় ঘন্টা খানিক লাগিয়ে আরহাম গোসল শেষ করে। টাওয়াল পেঁচিয়ে অর্ধভেজা শরীরে বেরিয়ে এসেই নজরে পরে তোঁষা বিরক্ত মুখখানা। ভ্রু কুঁচকায় আরহাম পরক্ষণেই দেখে তোঁষা’র হাতে বায়োলজি। যার বর ডক্টর সেই বউ কি না বায়ো মনে রাখতে পারে না। আফসোসের বিষয় এটা। আরহাম গলা ঝেড়ে ডাকে,
— তুঁষ?
— উ।
— এদিকে আয়।
তোঁষা একবাক্যে উঠে এলো। আরহাম ওকে টেনে নিলো নিজের কাছে। ওর ভেজা বুকে তোঁষা হাত রেখেই বললো,
— ভেজা কেন আপনি? টাওয়াল কোথায়?
আরহাম ইশারায় দেখালো। তোঁষা লাল হওয়া মুখে বললো,
— ওটা পেঁচানো’র আগেই শরীর মুছা উচিত ছিলো।
— এখন মুছে দে।
— নিজে মুছো।
— বউ আছে না আমার?
— কোথায় তোমার বউ?
তোঁষা’র নাকে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে আরহাম জানালো,
— এই তো।
তোঁষা সরে গিয়ে শুকনো টাওয়াল এনে মুছে দিলো আরহামে’র পেটানো শরীর। সবটা সময় আরহাম দেখলো ওর তুঁষ’কে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই তোঁষা বই হাতে নিলো তখনই ওর কোলে মাথা রাখলো আরহাম। আবদার জানালো,
— টিপে দে।
তোঁষা দম ফেলে হাত রাখলো আরহামে’র চওড়া কপালে। তুলতুলে হাত দিয়ে টিপতে লাগলো কপাল। আরহাম দ্বিতীয় আবদার ছুঁড়লো,
— চুল টেনে দে।
ঘন চুলের ভাজে হাত ডুবালো তোঁষা। টানতে টানতে কখন যে মেয়েটা ঘুমালো টের পেলো না। এদিকে তোঁষা ঘুমাতেই আরহাম ঘড়ি দেখলো। রাত ততটা নয়। দুই ঘন্টা পর তোঁষা’কে ডাকবে খেতে। এরপর আর পড়ার সুযোগ হবে না তোঁষা’র। ভাইব্রেট শব্দ হতে আরহাম বালিশের নীচ থেকে ফোনটা বের করলো। তোঁষা’র আশেপাশে ফোন রাখে না ও।
#চলবে……