#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১০
“বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার” অর্থাৎ কোন কিছু বা কাউকে নিয়ে অতিরিক্ত পসেসিভ হওয়া, ইমোশনাল হওয়া, সবসময় তাকে ঘিরে নিজেকে কল্পনা করা। এটা একটা মেন্টাল ডিজঅর্ডার যা বাড়তে থাকলে একসময় মারাত্মক আঁকার ধারণ করে। তখন ঐ নিদিষ্ট জিনিস’টাকে নিজের করে রাখতে সে মরিয়া হয়ে উঠে। হারায় হিতাহিত জ্ঞান। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তার সেই কাঙ্খিত বস্তু চাই ই চাই। তারা ভয় পায় শেয়ার নামক শব্দটা’কে। বিশ্বাস জিনিসটাও কারো’কে করতে পারে না হোক সে যতই আপন। অথচ এরা স্বাভাবিক একজন মানুষের মতোই থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে এরা নিজের কাঙ্খিত বস্তু নিয়ে প্রচন্ড সেসসেটিভ হয়ে থাকে। যার ফলে সম্পর্ক গঠনে হয়ে থাকে এরা সবচেয়ে দূর্বল।
আরহাম আক্রান্ত এই রোগে। বাসায় কেউ ই এটা প্রথমে বুঝতো না। আদনান আর আরহাম জমজ ভাই। আরহাম বড় হওয়ার দরুন সবাই হয়তো আগে ওকে ভালোবাসত। সেইম ওর মায়ের ক্ষেত্রে ও। আরহাম ছোট থেকেই নিজের মা’কে নিয়ে প্রচন্ড সেনসিটিভ। কারো সাথে দিবে না মা’কে। স্কুল থেকে আসলেও তার মা’কে চাই সবার আগে।
সেই বহু বছর আগের এক ঘটনা, একদিন আদনান এসে লুকিয়ে আগে মা’কে জড়িয়ে ধরলো। আরহাম পেছনে থাকায় দেখি নি মা’কে। যেই না দেখলো আদনান আজ আগে মা’কে জড়িয়ে ধরেছে তখনই প্রচুর রেগে গেলো। দৌড়ে এসে আদনান’কে টানতে টানতে বলতে লাগলো,
–আম্মু’কে ছাড়। ছাড়।
আদনান মা’কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে থাকতেই ওর মা আরেকহাতে আরহাম’কে জড়িয়ে ধরতে চায়। আরহাম তখন রাগে মুখ চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। মা’কে তার একা চাই। শেয়ার করে না।
ওর মা সেদিন হয়তো বুঝেন নি ছেলের মন। আরহাম যখন সারাদিন না খেয়ে থাকলো তখন হাজার চেষ্টা করেও তাকে খাওয়ানো গেলো না। অথচ সবাই হাসলো ওর কান্ডে। বলাবলি করলো,”এই মা পাগল ছেলে বউ পেয়ে না বদলালেই হলো”।
আরহাম বদলালো। ভয়ংকর সেই চেঞ্জ। মা তার প্রিয় না এমন না তবে সে মা’কে শেয়ার করেছে। একজনের সাথে খুব করে শেয়ার করেছে। তার মায়ের বুকে ঘুমাতেও দিয়েছে। একসময় মায়ের থেকেও বেশি আঁকড়ে ধরেছে সেই ছোট্ট প্রাণ’কে। তোঁষা’কে। বরফের মতো তুঁষ’টাকে সে স্থান দিয়েছিলো নিজের বুকে। অনুভূতি তখন সে ততটা বুঝে না কিন্তু নামহীনা এক মায়াজালে আটকেছিলো আরহাম সেই ছোট্ট শিশুটার বদনে, মুখের আদলে, গোলাপি রঙা সেই মুখটায়। ছোট্ট ছোট্ট হাত পায়ে। ছোট্ট নরম তুলতুলে তোঁষাটা’কে কোলে তুললেই যেন রাজ্যের প্রশান্তি হানা দিতো তার বুকে। সেটা যেন ছিলো বেনামী এক অনুভুতি। যা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করেছিলো আরহাম’কে। এখনও করছে। আরহামে’র বুকে আজন্ম থেকে যাবে তোঁষা।
__________________
— তুঁষ? উঠবি এখন? নাস্তা রেডি। আমি গোসল করতে যাচ্ছি।
তোঁষা বিড়ালের ন্যায় চোখ বের করে আরহাম’কে দেখলো যে আপাতত আলমারি থেকে কাপড় বের করছে। তখন আর লজ্জায় উঠা হয় নি ওর। এরপর কিভাবে জানি আরেকদফা ঘুমালো। আরহাম পুণরায় ডাকলো না তাকিয়েই,
— প্রাণ উঠবি এখন? আমি কি নাস্তা দিয়ে যাব।
তোঁষা’র কোন উত্তর মিললো না এবারও। আরহাম তপ্ত শ্বাস ফেলে ওয়াসরুমে ঢুকতে নিলেই কোথা থেকে দৌড়ে এসে তোঁষা ঢুকে বললো,
— আগে আমি।
আরহাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললো,
— আগে আমি।
— না না আমি।
— এতক্ষণ যে ডাকলাম?
— কে ঘুমাতে বলেছিলো?
আরহাম দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এই বুঁচি’র সাথে তর্ক করে পারা যায়? তোঁষা’র ব্রাশ এগিয়ে ওর হাতে দিতে দিতে আরহাম বললো,
— নে। আমি তাহলে নাস্তা গুছিয়ে আসি।
আরহাম বের হতে নিলেই তোঁষা ওর হাত টেনে ধরে। আরহাম চোখের ইশারায় কি হয়েছে জানতে চাইলেই তোঁষা দাঁত বের করে হাসলো। আলতো করে টান দিলেও আরহাম এগিয়ে এলো। তোঁষা বা হাতে সাওয়ার অন করতেই ঝরঝর করে পানি পরা শুরু করলো ওদের উপর। মুহূর্তেই ভিজে গেলো দুটি দেহ। আরহাম কিন্তু চাইলেই আটকাতে পারত তোঁষা’কে অথচ আটকালো না। করুক না যা করতে চায়। কত বছরের অপেক্ষা। কোনদিন কি কাছাকাছি আসা হয়েছিলো? একটুও না। হয়নি কোনদিন অনুভূতি ব্যাক্ত করা। আরহাম নিজেই এগিয়ে এসে তোঁষা’র গাল স্পর্শ করলো। তোঁষা লজ্জায় রাঙা মুখটা নামিয়ে রেখেছে। পদক্ষেপ সে নিজেই গ্রহণ করে তখন হুস থাকে না কিন্তু কাজ সারার পরই তার মুখের দিক তাকানো যায় না। সামাল দিতে হয় আরহাম’কে অথচ আরহাম নিজেই বড্ড কষ্টে সব সামলে আছে।
.
তোঁষা নিজের মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে সব নাস্তা টেবিলে রাখলো। তখনই আরহাম কফি হাতে কিচেন থেকে আসে। স্লিভলেস একটা টিশার্ট আপাতত গায়ে। বা হাতের বাহুতে হঠাৎ ই নজর গেলো তোঁষা’র। মুহুর্তেই যেন আঁতকে উঠল ও।
আরহামে’র হাতটা টেনে ধরে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে এখানে? গতরাতে ও না ঠিক ছিলো। বলুন।
আরহাম ঠোঁট কামড়ে ধরে। ওর একটুও মনে ছিলো না তোঁষা দেখে ফেললে কি উত্তর দিবে। কেন যে আজ স্লিভলেস টিশার্ট পরলো? কথাটা ভাবতেই বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হলো ওর। তোঁষা অনবরত প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আরহাম ঝট করে কথা সাজালো,
— তেমন কিছু না তুঁষ। বিষাক্ত কিছু ফুটেছে এদিকে তবে কিছুই হয় নি। হয়তো ইনফেকশন হয়েছে। বিশ্বাস কর এখন ব্যাথা নেই।
আরহাম যাই করুক না কেন তোঁষা’কে মিথ্যা বলে না। অন্তত এই পর্যন্ত মিথ্যার আশ্রয় নেয় নি ও। যেখানে ওর ভালোবাসা সত্য সেখানে মিথ্যা’র কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
তোঁষা’র চিন্তায় বিষন্ন মুখটা তখন ঠিক হয় নি। মুখ কুঁচকে আছে তোঁষা। আরহাম জানে প্রচুর কৌতুহলী মেয়ে তোঁষা। তাই আরহাম খেতে তাড়া দিলো,
— জলদি হা কর তুষ। খেয়ে নে। আজ একটু তারাতাড়ি যাব।
তোঁষা ফট করে উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
— আমিও চলব না আজ?
আরহামে’র মুখটা শুকিয়ে এলেও তা প্রকাশ করে না। তোঁষা’র মুখে খাবার তুলে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলো।
_______________
শেখ বাড়ীর শোক যেন আজ আরো বাড়লো। তুঁষা’র ক্যাম্পে চলে যাচ্ছে। কাঁধে ব্যাগ তুলে বের হতেই ওর মা দৌড়ে এসে ঝাপ্টে ধরে ছেলেকে। হু হু করে কেঁদে উঠেন সশব্দে। তার কান্নার ফলে বেরিয়ে আসেন তুঁষা’রের চাচি, চাচা। ভ্রু কুঁচকে তুরাগ জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাচ্ছো তুঁষা’র?
— ক্যাম্পে।
— না না তুই যাবি না। বাবা আমার যাবি না। মা..মা যেতে দিব না।
— যেতে হবে আম্মু। দেখি ছাড়ো। কেঁদো না।
ওর মা আরো শক্ত করে ধরেন ছেলেকে। ততক্ষণে ধীরে ধীরে তুহিন ও বেরিয়ে এলেন। মন মেজাজ তারও ভালো না। সাথে শরীরটা ও ভালো লাগে না। চিন্তায় চিন্তায় শরীর ভেঙে যাচ্ছে যেন। তবুও দারাজ কন্ঠে বললেন,
— তোমার মা অসুস্থ তুঁষা’র। এখন হুট করে যাওয়ার মানে কি?
তুঁষা’র মা’কে জড়িয়ে ধরে। ঠান্ডা কন্ঠেই উত্তর করে,
— হুট করে? ঐ দিন না জানালাম?
তুরাগ মাঝ দিয়ে বললো,
— আমি তো ভাবলাম ওটা এমনিই বলেছো।
— চাচ্চু এমনিই কিছু আমি বলি না। যদি বছর আগে আমার কথা সবাই শুনতে তাহলে এমন করুন দশায় থাকতে না আজ। অন্তত দুটো নক্ষত্র আজ শেখ বাড়ীতেই থাকতো।
তুরাগ মাথা নাড়ান। কিছু বলেন না। ভুল তাদের দ্বারা হয়েছে। শুধুই কি ভুল? পাপ বলা যায় না এটাকে?
তুঁষা’র মাকে নিয়ে রুমে এসে তার হাত ধরে। মায়ের উত্তপ্ত ললাটে চুমু খেয়ে হাত দুটোতেও চুমু খেয়ে বললো,
— এই হাতে কত আঘাত করছিলে আমার পুতুল’কে আম্মু। মনে পরে?
ফিকড়ে কাঁদে ওর মা। তুঁষা’র মায়ের চোখ মুছে পেছন ফিরে না। বেরিয়ে যায় রুম থেকে। অতঃপর বাসা থেকে। পেছন থেকে চাচি এত ডাকলো কিন্তু দাঁড়ায় না তুঁষা’র। একটা বার পেছন ফিরে না।
তুহিন রুমে ঢুকে তাকায় স্ত্রী’র দিকে। আজও এই নারী’র চোখের পানি দেখতে পারে না সে। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। মাথার এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে আদর করেন। নিজের হাত দুটো স্বামী’র সামনে দেখিয়ে বলেন,
— এই হাত দিয়ে এত মা’রলাম তোঁষাটা’র তবুও মেয়েটা রইলো না।
তুহিন কিছু বললো না। আসলেই তো তখন যদি তুঁষা’রের কথা শুনতো তবে আজ অন্তত মেয়েটা বুকে থাকতো। চোখের সামনে থাকতো।
#চলবে…….
[গল্পটা কাল্পনিক তাই সেভাবেই ভাবুন।]
{অনেকেই বলছেন গল্প এগুচ্ছে না। আপনারাই ভাবুন আগের গল্পের এক পর্বের সমান এখনকার গল্পের পাঁচ পর্ব। ঐ হিসেবে হয়তো দুই পর্ব সমান লিখলাম আজ। তাই রহস্য উন্মোচন হবে অতিশীঘ্রই। অপেক্ষা করুন। ধন্যবাদ।}