#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| ষোড়শ পর্ব |
ফরহাদ রোজ করে দাঁড়িয়ে থাকে সেই রাস্তায়! নিলুফার বের হবার আগে বের হয়ে যায় সে। বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেই রাস্তায়। নিলুফার একটিবার তাকায় তখন এদিক। চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা থাকলে হয়তো নিলুফারের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতে সে! না সেটা তো আর সম্ভব না!
ফরহাদ চা খাওয়ার জন্য বেরিয়েছিল। বাইকের কাছে এসে তাকিয়ে দেখে নিলুফার ওখানে দাঁড়ানো। তাহলে কি নিলুফার তার অপেক্ষা করছিল। ফরহাদ কাছে আগাতেই নিলুফাল হেসে তার দিকে তাকাল। বলে উঠল,
“ফরহাদ সাহেব যে, কোথায় ছিলেন? আপনার অপেক্ষায় করছিলাম!
ফরহাদ খানিকটা অপ্রস্তুত গলায় বলে উঠে,
“কেন?
“বাসায় যাবো বলে, আপনার বাইকে করে নিয়ে যাবেন!
“চলুন!
“আচ্ছা গিয়েছিলেন কোথায়?
“চা খেতে!
“তাহলে দুঃখিত!
“কেন?
“আমার জন্য আপনার আরেকবার চা খেতে হবে, চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে আমার!
“আচ্ছা!
বলেই ফরহাদ বাইকে বসল। তার কথা টুকু সমাপ্ত ছিল না। বলার ইচ্ছে ছিল, তোমার সাথে বসে চা খাবার সাধ আমার অনেক দিনের! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই কথাটার সমাপ্তি করল সে!
চায়ের টং বসে আজ আর চা খাওয়া হলো না। খুব ভিড় জমেছে দোকানের চারদিকে। নিলুফার কে বাইকে বসিয়ে রেখে ফরহাদ চা আনতে গেল। দুই কাপ চা হাতে নিয়ে এলো বাইকের কাছে। নিলুফার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, মেঘ জমেছে! খানিকক্ষণ পর বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টিতে ভিজবেন ফরহাদ সাহেব!
“আপনি ভিজবেন আমি বরং দাঁড়িয়ে থাকবো
নিলুফার হাসল। ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো তখন। বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস এটা। নিলুফার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“আপনি কখনো একজন ভালো প্রেমিক হতে পারবেন না, বুঝলেন তো!
“কেন?
“কারণ আমি বৃষ্টিতে ভিজবো এই কথা বলার পর আপনার বলা উচিত ছিল, না ভিজবেন না আপনার সর্দি লেগে যাবে। তা না বলে কি কথা বললেন আপনি। আপনার পক্ষে কোন মেয়েকে পটানোর কাজ হবে না। ধুর ছাই করে যেকোন মেয়ে তাড়িয়ে দেবে আপনাকে!
ফরহাদ হেসে বলল, এটাতেও কিন্তু একটা মজা আছে।
“এখন প্লিজ বলবেন না একবার না পারিলে দেখ শত বার! বার বার গিয়ে মেয়ে পটাতে যাবেন আপনি!
ফরহাদ হেসে উঠলো। নিলুফার ও হেসে উঠলো তার সাথে। অপলক দৃষ্টিতে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইল ফরহাদ। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা হয়তো পড়ল নিলুফারের গালে। ঝড় ঝড় করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। নিলুফার চোখ বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। বিন্দুমাত্র বিরক্ত লাগছে না তার। ফরহাদের ইচ্ছে করছে এই দৃশ্য ছবি বন্ধ করে রাখতে। কোন মেয়েকে বৃষ্টিতে ভিজলে এতোটা সুন্দর লাগে নিলুফার কে না দেখলে বোধহয় এই কথাটা জানতো না সে।
ফরহাদ বাইক চালাচ্ছে। মাঝে মাঝেই আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখছে নিলুফারকে। মেয়েটা এখনও চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ ফিরে আছে। ফরহাদ বলেছিল নিলুফার কে একাই ভিজতে কিন্তু এখন তারা ভিজছে দুজন একসাথে। নিলুফার এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে ফরহাদের কাঁধ!
——-
এই অসময়ে বৃষ্টি আসবে সেটা জানা ছিল না শ্রেয়ার। কলেজের ভর্তির ব্যাপারে বের হয়েছিল সে। ইর্ডেন কলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছে তার। ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে একটা মুদি দোকানের কাছে। নিজেকে তো বাঁচিয়ে নিচ্ছে ভিজে যাবার হাত থেকে কিন্তু পরণের শাড়িটার নিচের অংশটা বৃষ্টির পানির ছিটায় ভিজে যাচ্ছে। পা দুটোও কাঁদায় মাখামাখি! কেন জানি অসহ্য লাগছে তার। এই বৃষ্টি বোধহয় থামবার নয়! হঠাৎ করেই দৌড়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল মামুন! শ্রেয়া কে লক্ষ্য করেনি সে। বৃষ্টিতে অনেকটাই ভিজে গেছে। কোন মতে গা ঝাড়া দিয়ে একটা সিগারেট কিনল দোকান থেকে। শ্রেয়া অদ্ভুত চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মামুন যেই না সিগারেট ধরাতে যাবে ওমনি তার মনে হলো কেউ তাকিয়ে আছে তার দিকে। শ্রেয়া কে দেখেই থমকে গেল সে। তাকে কোনভাবেই এখানে আশা করে নি সে।
থতমত খেয়ে মুখের সিগারেট টা নামিয়ে রাখল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল সে। শ্রেয়ার দৃষ্টি এখনো তার দিকেই। মামুন আল দাঁড়াল না। এই বৃষ্টির মাঝেই দৌড়ে বের হয়ে গেল সে। শ্রেয়া ভড়কে গেল!
বৃষ্টির গতি বেড়েছে! খানিকক্ষণ পর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এসে হাজির হলো মামুন। দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে সে। শ্রেয়ার দিকে হাতের ছাতা খানা বাড়িয়ে দিল মামুন। শ্রেয়া অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, “এই লোকটা শুধু ভিতু না তার সাথেও বোকা! নাহলে সাথে ছাতা থাকা সত্ত্বেও ভিজে ভিজে আসে কেউ!
হাত বাড়িয়ে ছাতা টা নিল শ্রেয়া। মামুন হাঁটতে হাঁটতে সরে গেল। এক সময় দৌড়ে চলে গেল আবার। তার মুখে যেন হাসির রেখা ছিল। শ্রেয়া এবারো কিছু বলতে পারল না। ছাতাটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। নতুন ছাতা! এখন কি তবে কিনে আনল ছাতা টা!
শ্রেয়া ছাতা মেলে হাঁটতে শুরু করল। এখন আর অসহ্য লাগছে না, মনে হচ্ছে বৃষ্টির চেয়ে মধুর আর কিছু হতে পারে না। মুচকি হেসে ছাতার দিকে তাকাল সে।
মন বলছে পেছন পেছন মামুন আসছে। নিশ্চিত হবার জন্য হঠাৎ করেই পেছন ফিরল সে। মামুন সত্যি ছিল পেছনে। তাকে দেখে ছুটে চলে গেল সে। শব্দ করে হাসল শ্রেয়া। না থাক বেচারা কে আর ভয় দেখাবে না। আসুক পিছনে! এই ভেবেই হাঁটতে লাগল। খানিকক্ষণ পর আবারো মনে হলো মামুন তার পিছনেই আছে। না থাক এবার আর পিছন ফিরবে না। এই মুহুর্তটা ভালো লাগছে তার!
—–
তিতির দাঁড়িয়ে আছে ইরার বড় ভাইয়ের সামনে। তার বড় ভাই পুলিশের আই জি! তাকে দেখে বোঝা দায় বয়স কতো হবে, কারণ তার বয়সের ছাপ মুখে পড়ে নি। নিজেকে সবসময় ফিট রাখে হয়তো। বড় ভাইয়ের নাম মোঃ মোজাম্মেল হোসেন! তার টেবিলের পাশেই ছোট একটা কার্ডে এই নামটা লেখা আছে। তিতির এর মাঝেই সেটা পড়ে ফেলেছে। এছাড়া আরো অনেক কিছুই আছে এই রুমে দেখার মতো। অনেক সম্মাননা আছে! তিতির সেখান থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল। মোজাম্মেল হোসেন এতোক্ষণ পেছন ফিরে ছিল। এখন সামনে ফিরে তিতির কে দেখে বলল,
“তুমি তিতির!
“জ্বি!
“বসো!
বলেই তিনি বসলেন। তিতিরের অনেকটা বিচলিত লাগছে। রুমে এসেই সালাম দিয়েছিল সে। মনে হচ্ছে না তিনি সেটা কানে নিয়েছেন। তিতির তার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। তার মাথা নিচু কিন্তু উপলব্ধি করছে কেউ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। পুলিশের চোখের নিশানা হয় অন্যরকম। এখানে তার দিকে দৃষ্টি তো একটু তীক্ষ্ণ হবেই! মোজাম্মেল হোসেন পিয়ন কে ডেকে বলল চা দেবার কথা। অতঃপর তিতিরের উদ্দেশ্য বলেন,
“তোমার ব্যাপারে ইরা আমাকে সব’ই বলেছে।
তিতির ঢোক গিলে মাথা নাড়ল। মোজাম্মেল হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ইরা আমার একমাত্র বোন। মা বাবা মারা যাবার পর ওর পুরো দায়িত্ব আমার! কখনো কোন কমতি রাখি নি, যা চেয়েছে যখন চেয়েছে তাই দিয়েছি। তুমি জানো ইরার বিয়ে ঠিক হয়েছিল!
“জ্বি!
“ছেলেটা খুব ভালো ছিল, ভদ্র ছিল। পরিবারও ভালো! ভালো একটা চাকরিও করতো, কয়েকদিন পরই চাকরির সুবাদে বাইরেও যেত! ইরা কে তারাও বেশ পছন্দ করেছিল!
তিতির বুক কেঁপে উঠলো। মনে হচ্ছে না জল ঠিক দিকে আগাচ্ছে! তিতির কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। মোজাম্মেল হোসেন টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নাও ঘাম মুছে নাও! নার্ভাস হবার কিছু নেই।
এর মাঝেই চা এসে উপস্থিত হলো! চায়ের সাথে বিস্কিট ও! মোজাম্মেল হোসেন চা এগিয়ে দিয়ে বললেন চা খাও। তিতিরের হাত কাঁপছে। এই কাঁপা হাতেই চায়ের কাপ হাতে নিল। মোজাম্মেল হোসেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোন মতে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে রাখল সে। মোজাম্মেল হোসেন চায়ের কাপের চুমুক দিয়ে বললেন,
“গত পরশু ইরা আমার কাছে এসে তোমার কথা বলল। আজ সেই ছেলেদের আসার কথা ছিল। আমি তাদের বারণ করে দিয়েছি। তা এখন তুমি বলো!
“জ্বি!
“কতোদিন সময় চাও তুমি?
“জ্বি, আমি এখন অনার্স প্রথম বর্ষের পড়ছি!
“পড়ালেখা শেষে চাকরি পাওয়া অবদি!
“আমি চেষ্টা করবো পড়াশোনার পাশাপাশি’ই কিছু একটা করতে! শুধু একটু সময় চাই! ততোদিন ইরাও তার পড়াশোনা শেষ করুক। ওর ইচ্ছে ছিল অর্নাস কমপ্লিট করার!
“হুমম! তা কোন হেল্প চাইছো আমার কাছে।
“না না, শুধু সময়। আমি নিজেই এর মাঝে কিছু একটা করে নেবো।
“তা আর কিছু বলবে।
“জ্বি না।
“কোথায় যাবে এখন?
“টিউশনি আছে, পড়াতে যাবো।
“আচ্ছা যাও তাহলে, আমি ইরার সাথে কথা বলে নেবো।
“আচ্ছা!
বলেই উঠে দাঁড়াল তিতির। আবারো একবার সালাম দিল সে। মোজাম্মেল হোসেন মাথা নাড়ল!
ঘরের আলমারি খুলে কাপড়ের কোনা থেকে বিষে*র কৌটা বের করল ইরা! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কৌটার দিকে। অতঃপর এসে দাঁড়াল বেলকনির দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল সে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে। হাতে মুঠ করে বিষে*র কৌটাটা। তিতিরের সাথে বিয়ে না হলে এটা খাবে বলে এনে রেখেছিল। কিন্তু এখন আর এটার দরকার নেই। ভাইয়া মেনে নিয়েছে। বুক ভরে শ্বাস নিল সে। নিজেকে আজ দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে। এখন আর এটার দরকার নেই। মুচকি হেসে কৌটাটা ফেলে দিল ইরা! আজ সে সুখী, অনেক সুখী!
#চলবে….