#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| সপ্তবিংশ পর্ব |
একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়া। খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। মুখটা নিস্তেজ! পাশে কারো উপস্থিতি পেয়ে মুখ ফিরে তাকিয়ে দেখল ফরহাদ দাঁড়ানো। মুহুর্তেই মাথা নামিয়ে ফেলল সে। ফরহাদ কিঞ্চিত হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “মাথা নিচু করার কিছু হয় নি!
“ভাইয়া! আপনিও মনে করেন আমি ভুল করেছি!
ফরহাদ শুকনো ঢোক গিলল। নিলুফারের সেদিনকার বলা কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে! “আমি বিচারক নই শ্রেয়া!
“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন, উনি খু*ন করে নি।
“আমি বিশ্বাস করি তোমায়।
শ্রেয়া শব্দ করে শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে ফেলল। নিলুফার ছাদের দরজার কাছে আসতেই দু’জনকে দেখতে পেল। কেন জানি দু’জনকে একা ছেড়ে দিল সে! আজ ৩ দিন হলো মা’র ঘরের দরজা বন্ধ! বাবা ঘুমাচ্ছে তিতিরের সাথে। শ্রেয়ার মুখ দেখবে না বলে এই কান্ড করেছে তিনি। নিলুফার গতরাত ও শ্রেয়া কে বলতে চেয়েছিলাম, “আয় আমার সাথে ঘুমা! কিন্তু শ্রেয়ার থমকে যাওয়া মুখ দেখে আর বলা হয়ে উঠল না। এখন একা থাকাই ভালো তার জন্য! নিলুফার আবারো সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে তার!
শ্রেয়া কাঁদতে লাগলো হুট করেই। ফরহাদ যেন বিপাকে পড়ে গেল। শ্রেয়া কে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে লাগলো, “কেঁদো না! মামুন নির্দোষ, পুলিশ ঠিক মতো কাজ করছে। দেখলে না সেদিন মোজাম্মেল হোসেন বলে গেল!
“উনি ভালো আছে তো ভাইয়া!
“খুব ভালো আছে।
*আপনি আমাকে একটিবার নিয়ে যাবেন তার কাছে। একবার দেখা করবো তার সাথে!
ফরহাদ বাকরুদ্ধ! শ্রেয়া’র চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। “ভাইয়া আমি কাউকে বলবো না, আসনি শুধু আমাকে একবার উনার কাছে নিয়ে চলুন!
ফরহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল , “আচ্ছা যাবো!
শ্রেয়া দ্রুত চোখের পানি মুছে বলল, “তাহলে চলুন!
“এখনই…
“তিতির ভাইয়া বাসায় নেই, বাবা আসতে দেরি আছে। আমরা এখন গেলে কেউ জানবে না
“তুমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলে না!
শ্রেয়া মাথা নিচু করে ফেলল লজ্জায়। ফরহাদ হেসে বলল, “চলো!
চোখ ভরা অশ্রু নিয়েই ফরহাদের দিকে তাকাল শ্রেয়া!
——
মোজাম্মেল হোসেন কথা রেখেছেন। পুরো দুটি দিন খেতে দেওয়া হয় নি মামুন কে। তৃষ্ণায় তার গলা ফেটে যাচ্ছে। তবুও মনে হচ্ছে সে সুখে আছে। এর কারণ পাশে থাকা লোকটি! গতকাল রাতেও বেধো*রে পুলিশ মে*রেছে তাকে। আ*হত অবস্থায় এখন পড়ে আছে এক কোনে! মার খা*ওয়ার চেয়ে না খেয়ে থাকাই ভালো মনে হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন জানি মনে হলো মা*র খাবার সময় তারও হয়ে গেল। আজ তাকে খাবার দেওয়া হয়েছে। দুদিনের অনাহারে যা পেয়েছে তাই খেয়েছে মামুন! খাবারের স্বাদ টুকু ঠিকমতো নিতে পারে নি। দারোগা বাবু খাবার দেবার পর বলে উঠল, “বলি দেবার আগে পাঠা কে যেমন ভরপেট খাওয়ানো হয় তোকেও তাই করা হচ্ছে!
খাওয়া বন্ধ করে রক্তশূন্য মুখে তাকিয়ে রইল মামুন। খাবার এখন আর গলা দিয়ে নামছে না। তার ক্ষিদে যেন ম*রে গেছে। দারোগা পুরো জেলহাজত কাঁপিয়ে হেসে চলে গেলেন। কোনে পড়ে থাকা লোকটা গোঙানির শব্দ আসতে লাগল। এর মধ্যেই কি যেন বলছে সে! মামুন কান খাড়া করে শুনলো, “পুলিশের মা*র খাওয়ার চেয়ে দোষ কবুল করে নেওয়া ভালো!
মামুন অসহায় দৃষ্টিতে তখন লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে আঁধার নেমে আসছে। কোনমতে পানি খেয়ে শান্ত করল নিজেকে।
মোজাম্মেল হোসেনের সামনে বসে আছে মামুন। আজও তার মুখে সিগারেট। মামুন হাত পা গুটিয়ে নিয়েছে। মোজাম্মেল হোসেন জিজ্ঞেস করল,
“আর কিছু বলবে! কিছু মনে পড়েছে..
“হ্যাঁ!
“কি?
“আমিই খু/ন করেছি , কানা নান্দু কে খু/ন করেছি।
“এই তো সেদিন আমাকে কাজ শিখিয়ে দিচ্ছিলে। আজ দেখছি অন্য সুরে গান গাইছো। দুদিন না খেতে দিয়েই এই হাল।
মামুন শুকনো ঢোক গিলল। তার পুরো শরীর ঘেমে যাচ্ছে। কপাল বেয়ে ঘাম পড়েই যাচ্ছে আর বার বার মুছছে সে। মোজাম্মেল হোসেন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল তার দিকে। অতঃপর দারোগা কে বলে মামুন কে আবারো হাজতে পাঠিয়ে দিল।
মামুন কে হাজতে ঢোকানোর পর পরই আরেকজন দারোগা এসে বলল, “ওর সাথে দুজন দেখা করতে এসেছে।
মামুন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার সামনে দাঁড়ানো শ্রেয়া। এই তিন দিনেই যেন মেয়েটাকে অনেকটা অচেনা লাগছে তার। চোখের নিচে কালচে দাগ, পুরো মুখ শুকিয়ে গেছে। এর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ফরহাদ! তাকে চিনতে কষ্ট হলো না মামুনের।
মামুন হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো?
কেঁদে উঠলো শ্রেয়া। কোন কিছু বলছে না শুধু কেঁদে যাচ্ছে। মামুন আবারো হেসে বলল, “কাঁদছ কেন? আমি ঠিক আছি দেখতে পাচ্ছো না তুমি!
ফরহাদ এসে ধরল শ্রেয়া কে। শ্রেয়া কান্না থামাল বহু কষ্টে। অতঃপর জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন আপনি?
“ভালো আছি! খুব তাড়াতাড়ি ছাড়া পেয়ে যাবো। চিন্তা করো না।
শ্রেয়া মুখ তুলে তাকাল। মামুন ফরহাদ কে উদ্দেশ্য করে বলল, “ভাইয়া আপনি নিয়ে চলে যান ওকে।
শ্রেয়া ইচ্ছে করল আবারো কাঁদতে। কিন্তু সে কাদলো না। মাথা নাড়িয়ে একাই বেরিয়ে আসল সেখান থেকে। মনটা এখন কিছুটা হলেও শান্তি পেয়েছে তার। কিন্তু এই চার দেওয়ালের মাঝে মামুন কে আটকে থাকতে দেখে বহু কষ্ট লাগছে । ফরহাদ এসে তার পাশে দাঁড়াল। বেরিয়ে যেতে নিতেই দারোগা এসে বলল, “বড় স্যার আপনাদের ডাকছে!
——
শ্রেয়া আর ফরহাদ বসে আছে মোজাম্মেল হোসেনের সামনে। শ্রেয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। পিয়ন এসে দুটো চায়ের কাপ আর বিস্কুট রেখে গেল। মোজাম্মেল হোসেন জিজ্ঞেস করল,
“ঠান্ডা কিছু এনে দেবো তোমাদের!
ফরহাদ বলে উঠল,”না! চা’ই ঠিক আছে।
“শ্রেয়া তুমি কিছু বলছো না যে!
“আপনি উনাকে এখনো রেখে দিয়েছেন কেন? ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন?
“আমাদের কাজ তো মামুন শেষ করে দিল।
“মানে ?
“আজই নিজের দোষ স্বীকার করল সে। আমাদের কাজ কমিয়ে দিল।
শ্রেয়া আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মোজাম্মেল হোসেনের দিকে। মোজাম্মেল হোসেন মৃদু হাসল। ফরহাদ বুঝতেই পারছে না এখন কি করবে!
——-
ফরহাদ আর শ্রেয়া সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে এলো। ফরহাদ আতংকে আছে। শ্রেয়ার নিশ্চুপতা আরো ভয় বারিয়ে দিচ্ছে। বাড়িতে ঢোকার পূর্বে শ্রেয়াকে ডাকল ফরহাদ। কিন্তু তার ডাক শুনতে পেলো না শ্রেয়া। আবারো ডাকল ফরহাদ। শ্রেয়া হতচকিয়ে তাকাল। বলে উঠল, “আমি ঠিক আছি ভাইয়া! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য! আপনি এখন ঘরে যান।
বলেই চলে গেল শ্রেয়া। ফরহাদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
রাতে নিলুফারের দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে শ্রেয়া বলল,”আপা আসবো!
“শ্রেয়া! আয়..
“তোমার সাথে আজ ঘুমাবো আপা ।
“হ্যাঁ ঘুমাবি, আয় পাশে বস।
শ্রেয়া এসে নিলুফারের পাশে বসল। নিলুফার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শ্রেয়া নিশ্চুপ। নিলুফার বলে উঠল,
“মন খারাপ তোর!
“না আপা!
“ভাবিস না, মামুন ঠিক আছে। খুব জলদি ছাড়া পেয়ে যাবে।
শ্রেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “উনি আর ছাড়া পাবে না আপা। আচ্ছা আপা খুনের দায়ে কতো বছর জেল খাটতে হয়
“আজেবাজে চিন্তা বাদ দে!
“যত বছর হোক না কেন আমি অপেক্ষা করবো উনার জন্য, তুমি দেখো আপা।
“মামুন খুব জলদি ছাড়া পেয়ে যাবে।
“না আপা পাবে না, তুমি কিছু জানো না কিছু না!
“জানি! ফরহাদ সাহেব বলেছেন আমায়!
হুট করেই কেঁদে উঠলো শ্রেয়া। নিলুফার তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “পাগলি মেয়ে একটা। এতে কাঁদার কি আছে।
“উনি নির্দোষ আপা তাহলে কেন স্বীকার করল? এখন তো পুলিশ’রা আজ তদন্ত করবে না।
“ভয়ে! ভয়ে স্বীকার করেছে!
শ্রেয়া তাকাল নিলুফারের দিকে। নিলুফার হেসে বলল, “মোজাম্মেল হোসেনের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমি ফোন করেছিলাম তাকে।
শ্রেয়া অবাক চোখে তাকাল। নিলুফার শ্রেয়ার কপালে চুমু খেল। অতঃপর বলল, “পুলিশের ভয়ে অনেক নির্দোষ ব্যক্তিও দোষ স্বীকার করে। মোজাম্মেল হোসেন নিজে বলেছেন আমায় মামুন ভয়ে দোষ স্বীকার করেছে। চিন্তা করিস না, মোজাম্মেল হোসেন আসল খুনি*কে
ধরবার জাল বিছিয়েছে। এখন শুধু ফাঁদে পা দেবার অপেক্ষা!
শ্রেয়া বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অতঃপর বলে উঠল, “জানো আপা! আমি সবসময় তোমাকে নিয়ে হিং*সা করতাম! কখনো সহ্য হতো না তোমায়। তুমি এতো সুন্দরী আর আমি… কিন্তু আজ কি মনে হচ্ছে জানো। তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো আপা!
বলেই জড়িয়ে ধরল তাকে। নিলুফার কিঞ্চিত হাসল। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মা নিরবে কাঁদছে। তার মেয়ে আজ বড় কষ্টে আছে!
#চলবে….
[ রি চেক করা হয় নি, ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ রইল ]