একটি_সাঁঝরঙা_গল্প #তানিয়া_মাহি #পর্ব_০৭

0
233

#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_০৭

রাত এগারোটা সাতচল্লিশ। বিছানায় বসে বসে পড়ছিল। পৃথিবীতে অদ্ভুত কিছু মানুষ আছে যাদের বাড়িতে পড়ার জন্য চেয়ার, টেবিল থাকলেও বিছানা আর বালিশ বেছে নিবে ফালাকও তাদের মধ্যে একজন। পড়া শেষ করে বইগুলো গুছিয়ে একপাশে রাখলো। খাটের এক পাশে বড় আয়না। বিছানায় বসলেই নিজেকে দেখা যায়। ফালাক গিয়ে বিছানার এক প্রান্তে বসলো। আয়নায় নিজেকে দেখা যাচ্ছে। আয়নায় নিজেকে দেখে পায়ের দিকে তাকালো সে। পায়ের দিকে তাকাতেই নিশোর কথা মনে পড়লো। কী যত্ন করে ব্যান্ডেজ বাঁধছিল! নিশোর কথা ভাবতেই মুখে হাসি ফুঁটে যায় ওর। এমন হয়তো প্রতিটা মানুষেরই হয় তার প্রিয় মানুষের কথা মনে পড়লে। বেশ কিছুক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখল সে। ঘড়িতে রাত বারোটা জানান দিল। আলো নিভিয়ে দিতে স্যুইচ টিপতেই কানে এলো নিশোর গানের গলা সাথে গিটারের টুংটাং আওয়াজ। ফালাক মৃদু হেসে গান শুনতে শুনতে শুয়ে পড়লো।

আমি বাউন্ডুলে ঘুড়ি
যে আমাকে বাসবে ভালো,
তার আকাশেই উড়ি।

আমি বৃষ্টি ইলশে গুঁড়ি
মাথায় করে রাখলে আমায়,
খেলবো লুকোচুরি,
খেলবো লুকোচুরি।
হুম হুম হুম, হুম হুম হুম..

কত বছর ধরে আমার শূন্যস্থান
দুমড়ে গিয়েও বেঁচে থাকার ভান,
জলের কাছে গিয়েও ফিরে আসি তাই
এই কুয়াশায় খুঁজছে কে আমায়,
এই কুয়াশায় খুঁজছে কে আমায়।

আমি একলা ক্লান্ত ঘুড়ি
যে আমাকে বুঝবে ভালো
তার আকাশেই উড়ি।।

গান শেষ হতেই গিটারের আওয়াজ থেমে গেল। আবির রাতে বাড়ি ফিরে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ করেও কিছুতেই ভালো লাগছিল না। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে এপাশ ওপাশ ফিরছিল শুধু। ঘুম আসছিল না কিছুতেই তাই নিশোকে কল দিয়েছিল। নিশো সাথে সাথেই রিসিভ করতে বুঝলো নিশোও ঘুমায়নি। তাই নিশোকে রুমের বাহিরে আসতে বলে নিজেও গিটারটা নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর তারপরই দুজন গান শুরু করে। গান শেষ হতেই আবির সহাস্য বলে উঠল,

“ভাই, এবার ফ্রেশ লাগছে।”

নিশো গিটারটা বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,“কতদিন এভাবে গান গাই না, ভাই। আগে সবাই একসাথে হয়ে কী সুন্দর আড্ডা দিতাম, গান গাইতাম।”
“সবাই তো এখন যার যার ক্যারিয়ারে ব্যস্ত।”

“শুধু আমি বাদে।” বলে শ্বাস টানলো নিশো।

নিশোর পিঠ চাপড়ে আবির বলে উঠল,“তুই আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে ভালো স্টুডেন্ট ছিলি যদিও আমি পরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গেলাম। তোর রেজাল্টও মাশাআল্লাহ। তুই শুধু শুধু চিন্তা করছিস। এই খারাপ সময় খুব বেশিদিন থাকবে না। ভালো তোর হবেই দেখিস।”
“তোর কী অবস্থা বল?”
“ভাই, আমার বাপ ভালো একটা কাজ করছিল। অনার্স, মাস্টার্স করে আমি কী করতাম? ভালো হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি। দুই, চার, পাঁচ বছরে ভালো একটা পজিশনে যেতে পারব। আমার বাপ কত টাকা ইনকাম করতেছে দেখছিস না? বাপের খালি টাকা আর টাকা। সোজা বাড়ির কাজ পায় এখন! বাড়ির নকশার কাজ বাপ এখন আমাকে দেয়। মাসে কম করে হলেও চার পাঁচটা কাজ করতে পারি৷ এখানে ওখানে যেতে হয়। বাড়ির কাজ দেখতে হয়। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে কাজ বেশি হয়ে গেল। আজ খাওয়ার সময়টাও পাইনি ঠিকমতো।”

“কী যে করলাম আমি! তোর সাথে পড়লে এতদিন ভালো কিছু করতে পারতাম। অন্তত বেকার বলে বাপ বাড়ি থেকে বের করে দিত না। বাড়িতে দাম থাকতো।”

দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল। রাত প্রায় একটার দিকে দুজন দুজনের রুমের দিকে অগ্রসর হলো।
_____

পরদিন বিকেল। বাড়ি থেকে একাই বেরিয়েছে ফালাক৷ বান্ধবী বারিশকে সাথে নিয়ে অর্ডারের কিছু বোরখা কুরিয়ারে পৌঁছে দিতে গিয়েছে। বারিশ ফালাকের ক্লাসেই পড়ে, দুজন বেস্টফ্রেন্ড। দুজনের বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নয়। আজ হঠাৎ বিকেলে ফালাক বারিশকে কল দিয়েছিল৷ বারিশ কল রিসিভ করতেই বলল,

“বারিশ?”
“হ্যাঁ, ফালাক বল। কিছু বলবি?”

ফালাক সংক্ষেপে বলল,“হ্যাঁ বলব বলেই কল দিলাম। ফ্রি আছিস?”
“হ্যাঁ আছি। তুই কোচিংয়ে আসিসনি কেন?”
“আগামী সপ্তাহ থেকে যাব। আমার বাসায় টিউশনি চলছে।”
“কী বলিস! কবে থেকে? আমাকে বলিসনি তো?”
“তুইও তো আমাকে অনেককিছুই বলিস না। কাল সন্ধ্যায় শুধু পড়েছি।”
“স্যার কেমন পড়ায়? কোন স্যারের কাছে পড়ছিস?”
“বলব না। তুইও যদি পড়তে চাস?”
“কেন আমি পড়লে তোর ক্ষ*তি হবে? তুই চাস না আমিও ভালো রেজাল্ট করি?”
“তা চাই। তুই আমার চেয়েও ভালো করলে খুশি হব কিন্তু আমার স্যারের কাছে পড়বি না।”
“কেন বল তো?”
“সেসব অন্য একদিন বলব। চল বের হই।”
“কবে?”
“আজ, এখনই।”
“বের হলে স্যারের কথা বলবি?”
“আচ্ছা বলব।”
“ঠিক আছে।”

এভাবেই দুজনের একসাথে বের হওয়ার কথা হয়েছিল কুরিয়ারে পার্সেল পাঠিয়ে ওখান থেকেই দুজন একটা ক্যাফেতে গেল। কোণার একটা টেবিলে গিয়ে বসলো দুজন। সামনা-সামনি চেয়ারে বসেই বারিশ বলল,

“এবার বল।”

ফালাক ব্যাগ থেকে নিজের ফোনটা বের করে টেবিলের ওপর রেখে বলল,“কী বলব?”
“কার কাছে পড়ছিস?”
“বলতে পারি, একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“উনার কাছে পড়তে চাইবি না।”

মুখ গোমড়া করল বারিশ। মৃদু গলায় বলল,“তাহলে বলতে হবে না।”

ফালাক হাত টান করে বারিশের গাল টেনে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,“চল, আমি তোকে ট্রিট দিব।”
“কীসের ট্রিট?”
“তার কাছাকাছি একধাপ এগুনোর ট্রিট।”
“কার কাছাকাছি? অ্যাই তুই প্রেম করছিস? নট ফেয়ার, ফালাক।”
“প্রেম করছি না। প্রেমের পথে হাঁটছি।”

বারিশ জানে ফালাকের এই বিষয়ে জানানোর হলে নিজেই সাগ্রহে বলতো,“অ্যাই বারিশ জানিস, আমি অমুকের প্রেমে পড়েছি, এটা হয়েছে ওটা হয়েছে ব্লা ব্লা ব্লা।” কিন্তু ফালাক এরকম কখনোই বলেনি কারণ এরকম কিছু ঘটেনি৷ এবার ঘটলেও সেরকম কিছু হয়নি বলেই বলছে না।

সন্ধ্যা নেমেছে। চারপাশ অন্ধকার হতে শুরু করেছে। ফালাক আর বারিশ রাস্তার একপাশ দিয়ে হাটছে। ধুলো এসে ফালাকের কালো রঙের বোরখায় এসে জড়িয়ে যাচ্ছে। বারবার হাত দিয়ে ঝেরে পরিষ্কার করছে আর হাঁটছে। বারিশের বাড়ি পেয়ে গেলে বারিশ ফালাকের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে গেল। একটা রিকশা আসতেই ফালাক সেটায় উঠে বসলো। রিকশা চলতে শুরু করল। ফোনস্ক্রিনে দেখল সময় ছয়টা তেরো।

বাড়ি পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে নিল ফালাক। অনেকক্ষণ হিজাব পরে থাকায় মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছিল। রাবেয়া বেগম মাথায় তেল পানি বসিয়ে দিয়েছিলেন তারপরও মাথায় পানি নিলো সে। এখন একটু ভালো লাগছে। চুল মুছতে মুছতে বাহিরের লাইট অন করতে এসে দেখল নিশো হাতে এক গাদা বই নিয়ে গেইটের ভেতরে প্রবেশ করল৷ ফালাক কিছু একটা ভেবে তোয়ালে কাধের ওপর নিয়েই নিশোর দিকে ছুটলো। সামনে গিয়ে বলল,

“বই কোত্থেকে আনলেন?”

নিশো সরোষ দৃষ্টি ফেলল। বলল,“তোয়া এগুলো পাঠিয়েছে।”
“পড়তে?”
“হ্যাঁ। ”
“আমাকে দিন তো৷ আমি বইগুলো একটু দেখে আপনাকে ফিরিয়ে দিব।”
“বই পড়ার অভ্যাস আছে?”
“অভ্যাস নেই, গড়তে চাইছি। ভালো হবে না? বিয়ের পর বর আর আমি দুজন মিলে বসে বসে বই পড়ব সাথে এক কাপ কফি নিব।”

নিশো ঈষৎ বিষ্ময়ে বলল,“দুজনের এক কাপ?”
“স্যরি এক মগ।”
“একটা কেন?”
“একটায় খেলে ভালোবাসা বাড়বে৷ আপনাকে এসব কেন বলছি! বইগুলো আমার রুমে দিয়ে আসবেন চলুন।”

নিশো আর কথা বাড়াল না তবে মনে মনে খারাপ লাগলো। তার টাকার প্রয়োজন। বইগুলো যদি ফালাক তার কাছে রেখে দেয়? টাকা তো চাইতে পারবে না। কীভাবে প্রয়োজনীয় বই, প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনবে? মুখ মলিন হলো নিশোর।

ফালাক তাড়া দিয়ে বলল,“দাঁড়িয়ে রইলেন যে! চলুন। বই খুব সহজে চাইবেন না কিন্তু। আমি পড়ব তারপর আপনি। দুই একটা আজ নিলে নিবেন তবে বাকিগুলো পরে নিবেন।”

ফালাকের শেষ কথায় গলা শুকিয়ে গেল নিশোর। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। অসহায় দেখালো। নিশোর মুখের অবস্থা দেখে ফালাকের হাসি পাচ্ছে। কী ফ্যাসাদে পড়েছে বেচারা! মুখের ওপর ‘না’ বলতেও পারছে না। নিশোর চোখ লুকিয়ে হেসেই ফেলল ফালাক৷

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here