#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_০৯
সকাল সকাল ফালাক আর বারিশ নাশতা করতে বসেছে। বারিশ বাড়ি ফিরবে তারপর বাড়ি থেকে অনুষ্ঠান বাড়ি চলে যাবে। ফালাক সকাল সকাল উঠে বান্ধবীর পছন্দের চিকেন নুডলস আর দুইজনের জন্য দুই কাপ গরম গরম দুধচা করেছে। রাবেয়া বেগম জাভেদ সাহেবকে নিয়ে একটু সকালের আবহাওয়া গায়ে লাগাতে হাঁটতে বেরিয়েছেন। মাঝেমাঝেই ভোরবেলা নামাজ পড়ে দুজনের একসাথে বের হওয়া হয়।
বারিশের নাশতা প্রায় শেষের দিকে এমন সময় ফালাকের মনে পড়ল মা-বাবা বের হওয়ার পর যখন বারিশকে সাথে নিয়ে বাড়ির পেছন দিকের বাগানটায় ঢুকেছিল তখন নিশোর রুম থেকে পড়ার আওয়াজ পেয়েছিল। কাল যখন বারিশ বাসায় এলো সাথে সাথে যে বাহিরে চলে গেল তার কিছুক্ষণ পরেই জানালা দিয়ে ফালাক নিশোকে বাসার বাহিরে যেতে দেখেছিল।
ফালাক চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বারিশের দিকে তাকালো। চাপা গলায় বলল,
“তুই নাশতা শেষ করে রুমে গিয়ে বোস। আমি একটু আসছি। ওয়াই-ফাইয়ের পাসওয়ার্ড তো রাতেই নিয়েছিল বোর হবি না। ”
বারিশ খাবার মুখে নিয়েই বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল,“কোথায় যাবি?”
ফালাক বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল,“লোকটা সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ছে। এক কাপ চা অন্তত দিয়ে আসি।”
বারিশ ভ্রু কুঁচকে শুধালো,“লোকটা কে?”
“নিশো ভাইয়া।”
“ভাইয়াও বলিস?”
“বিয়ে করেছি নাকি যে ‘ওগো, কী গো’ বলব? নাকি তুই সামনে আছিস বলে‘তোর দুলাভাই’ বলে সম্বোধন করব?”
“নিশো তো বলতেই পারিস।”
“আমার নিজের ভাইকেও আমি ভাইয়া বলি আর উনাকে নাম ধরে ডাকব? ঘাড়ে একটাই মাথা আমার।”
“উনাকে ভয়ও পাস?”
“পুরুষকে ভয় পাওয়া উচিৎ একটু-আধটু। একেবারেই নির্ভীক হইলে ভবিষ্যতে সংসারে অশান্তি হবে।”
বারিশ খাওয়া বাদ দিয়ে অবাক হয়ে বলল,“ভবিষ্যৎও ভাবা শেষ তোর?”
“অবশ্যই। অতীতেও ভেবেছি, বর্তমানেও ভাবছি আর ভবিষ্যতেও ভাববো। তুই খেয়ে নে, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। রান্নাঘরে যাই।”
বারিশকে নাশতায় ব্যস্ত রেখে ফালাক তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে চলে গেল। চুলায় পাতিলে রাখা গরম চা ছিল আরেকটু গরম করে কাপে ঢেলে নেয়। পাশেই নুডলস নজরে পড়তেই কিছু ভাবলো সে। এখানে যে পরিমাণ নুডলস আছে সেটা নিশোর হবে না ভেবে দৌঁড়ে টেবিল থেকে নিজের প্লেটটা নিয়ে এলো সে। বন্ধুর সাথে নিয়ে বসেছিল শুধু। এক চামচও খাওয়া হয়নি শুধু চা শেষ করেছে সে। প্লেটে বাকি নুডলসটুকুও ঢেলে নিল ফালাক। এবার পারফেক্ট একটা নাশতার ব্যবস্থা করতে পেরেছে ভেবে ফালাকের মুখে হাসি ফুঁটলো।
এক হাতে চায়ের কাপ-পিরিচ এবং অন্য হাতে নুডলস নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই বারিশ বলল,
“প্রেমে পড়ে কি তোর বুদ্ধি লোপ পেল, ফালাক?”
ফালাক ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো,“কেন?”
“ট্রে নিতে পারছিস না? ওভাবে চা পড়ে যাবে তো।”
ফালাক জিহ্বায় কামড় দিয়ে দুই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল।
“ইশ, মাথাতেই আসেনি।”
“যাহ। ট্রে নে।”
ফালাক রান্নাঘরে ফিরে ট্রে নিয়ে নিশোর ঘরের দিকে ছুটলো। নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা নিশোর ঘরের দরজার সামনে উপস্থিত হলো।
হাতের উল্টোপাশে আঙুলের শক্ত অংশ দিয়ে কড়া নাড়তেই পড়ার শব্দ থেমে গেল। উঁচু গলায় জানতে চাইলো,
“কে?”
ফালাক মৃদু গলায় বলল,“আমি, ফালাক। দরজা খুলুন।”
খানিকবাদেই খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো। নাশতার ট্রে হাতে ফালাককে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিশো বেশ অবাক হলো। এ বাড়িতে আসার পর এভাবে শুধু একদিনই খাবার এসেছিল আর আজ এত সকালে নাশতা!
ফালাক নিশোর দিকে তাকিয়ে বলল,“ভেতরে আসতে বলবেন না? বাহিরে এভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন?”
নিশো অপ্রস্তুত স্বরে বলল,“এসো এসো ভেতরে এসো। বাড়ি তো তোমাদেরই, আমি আসতে বলার বা নিষেধ করার কে?”
ফালাক পা বাড়াতেই নিশো একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ফালাক নাশতার ট্রে বিছানার ওপর রেখে নিশোর দিকে ফিরে তাকালো। গম্ভীরমুখে বলল,
“বাড়ি আমাদের ঠিকই কিন্তু এখানে তো আপনি থাকছেন তাই না? আমি অনুমতি না নিয়ে বা আপনি ভেতরে প্রবেশের অনুমতি না দিলে কীভাবে আসব? আমি যদি আপনার বাসায় থাকতাম তাহলে নিজের বাড়ি বলে কি যখন তখন রুমে যেতে পারতেন?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশো। এই মেয়ের সাথে কথায় কেউ পেরে উঠবে না। মুখ ফসকে সত্যি কথা বলে ফেললেও যুক্তিতে হারতে হবে, হারতে হবেই।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিশো বলে উঠল,“সকালে নাশতা বানিয়ে আনতে কে বলেছে? পড়াশোনা নেই? এই বয়সে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে? আপনার বাপকে বলব?”
“আপনার বাপকে বলুন ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আপনার বাপ রাজি হয় কি না দেখুন।”
নিশো তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,“বাপ আমাকেই বাড়িতে রাখতে চায় না আবার আমার বউকে! কোন মেয়ের কপাল পু*ড়াইতে ইচ্ছুক নই।”
ফালাক পরিবেশ হালকা করতে বলল,“টাকা রাতে পেয়ে তখনই বই কিনে এনেছেন! কী ভালো স্টুডেন্ট আপনি!”
“সময় তো বেশি নেই। ভেবেছি যেহেতু এই বিষয়ে সেহেতু পড়তেই হবে। ”
“অনেক সময় আছে তো।”
“দেখতে দেখতে চলে যাবে। সবাই তো কয়েক বছর আগে থেকে প্রিপারেশন নিতে থাকে। আমি কয়েকমাস তো অন্তত ভালোভাবে পড়বই।”
“পড়ুন আর নাশতাটা করে নিন আগে। নাশতা করে নিলে দেখবেন সবকিছু আরও তাড়াতাড়ি পড়া হয়ে যাবে।”
নিশো নাশতার দিকে তাকিয়ে বলল,“চা তো ঠান্ডা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।”
“আমি আর এখন গরম করে এনে দিতে পারব না৷ এখন কষ্ট করে ওটাই খেয়ে নিন। সন্ধ্যায় এক কাপ চা আপনার পাওনা রইল।”
নিশোকে চুপ থাকতে দেখে ফালাক শুধালো,“কী হলো? চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
“ভাবছি।”
“কী?”
“এই যে, আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে কী করতে?”
“চা ঠান্ডা হয়ে গেছে বললে চা নিয়ে চলে যেতাম। আপনি বলে এই কথা বলার পরও চা খেতে দিচ্ছি।”
নিশো কপাল সটান বিস্তৃত করে ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠল, “ভয়ংকর!”
ফালাক আমতা আমতা করে বলল,“আপনি হাতে নিয়ে দেখুন এখনো গরম আছে। আমি আসার আগে বুঝেছিলাম কথা বলতে বলতে চা খেতে দেরি হবে তাই একটু বেশি করেই গরম করেছিলাম তবুও যদি ঠান্ডা হয় তাহলে আমি গরম করে এনে দিচ্ছি।”
নিশো চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে কাপের তলায় হাত দিয়ে বুঝলো খুব একটা ঠান্ডা হয়নি৷ মৃদু হাসলো সে। চায়ে চুমুক দিয়েই পিছনের দরজার দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ডাক দিল,
“রোজমেরিইইইই।”
সাথে সাথে ওপাশ থেকে সাদা রঙের একটা হৃষ্টপুষ্ট, সুন্দর দেখতে বিড়াল দৌঁড়ে এলো। নিশোর পায়ের কাছে এসে আওয়াজ করল,“মিঞ…”
রোজমেরিকে দেখে ফালাকের মুখে হাসি ফুঁটলো। সাথে সাথে নিজেও বসে পড়ল মেঝেতে। আলতো করে বিড়ালটির গায়ে হাত বুলাতেই ফালাকের হাত চেটে দিল সে।
“ওলে আমাল মেলি বাবুতা..” বলেই কোলে তুলে নিল সে। নিশো অবাক হলো। মেরি সবার কাছে যায় না। বাড়িতে নিশোর মতোই তার বাবাকে অপছন্দ করে সে। এই ক’দিন তোয়া রেখেছিল কিন্তু নিশোকে না দেখে খাওয়া দাওয়া ভুলে সবসময় নিশোর রুমে পড়ে থাকতো। তোয়া সন্ধ্যায় মেরির কথা জানাতেই তাকে রাতে নিয়ে এসেছে সে।
নিশো চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বলল,“রোজ তোমাকে চিনলো কবে? ও সবার কাছে যায় না।”
ফালাক রোজমেরির মুখের সাথে গাল ঠেঁকিয়ে আদুরে গলায় বলল,“মেরি বাবু তো আমাকে চিনে তাই না মেরি?”
নিশো চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে বলল,“কীভাবে চিনলো?”
“তোয়া আপু তো মাঝেমাঝেই মেরিকে নিয়ে বের হতো। আমাদের দেখা হলে, এ বাড়িতে আসলে মেরিকে আমিই রাখি।”
“এ বাড়িতেও এসেছে রোজ?”
“হ্যাঁ এসেছে তো। আজ থেকে মেরি আমার কাছে থাকবে।”
নিশো এবার জোরগলায় না বলল। ফালাক রোজমেরির গায় আলতো স্পর্শ করে বলল,“কিন্তু মেরি তো আমার কাছে থাকবে বলছে।”
নিশো চায়ের কাপ বিছানায় রেখে ফালাকের কাছে থেকে রোজমেরিকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়েই বলল,“আমি এখানে আছি বলে রোজ ওই বাড়িতে ভালো ছিল না। খাওয়া দাওয়া করছিল না ঠিকমতো তাই আমার কাছে এনেছি। তোমার কাছে থাকবে না ও। ওর শরীর নষ্ট হবে।”
ফালাক মুচকি হেসে বলল,“ওকে তো আমার কাছেই থাকতে হবে। আপনি তো বাসায় সবসময় থাকেন না।”
নিশো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“আমি যখন বাহিরে যাব তখন তোমার কাছে রেখে যাব, হবে?”
ফালাক মাথা নেড়ে বলল,“ঠিক আছে। এখন আপনি পড়তে বসুন আর মেরিকে আমার কাছে দিন। পড়া শেষ হলে নিয়ে আসবেন।”
নিশো এবার স্ব-ইচ্ছায় রোজমেরিকে ফালাকের কোলে দিয়ে দিল। ফালাক রোজমেরিকে আদর করতে করতে বাহির হবে ঠিক তখনই ফালাক বলে উঠল,
“আমার সবকিছুতেই ভাগ বসাচ্ছো।”
ফালাক পিছনে না ঘুরেই বলল,“একদিন আপনার ওপরও ভাগ বসাবো।”
#চলবে…..