অন্তহীন💜 #পর্ব_৮ #স্নিগ্ধা_আফরিন

0
184

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৮
#স্নিগ্ধা_আফরিন

সূর্য মামা খেপেছে আজ। ভীষণ তার তেজ।
ক্লান্ত বিকেল,আকাশ রক্ত লাল! পরিযায়ী পাখিদের ছড়া ছড়ি আকাশ জুড়ে।সাঝঁবেলা ঘনিয়ে আসছে যে। সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু পরেই ধরিত্রী জুড়ে নিশিথীনির গাঢ় অমা নেমে আসবে।
চৈতিদের বাড়ির ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিচের বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে প্রহন। চৈতি কে হাসতে দেখছে, ছুটাছুটি করতে দেখছে, পেয়ারা গাছের ডালে বসে পেয়ারা খেতে দেখছে। মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। প্রহন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু হিসেব নিকেশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

“এই মেয়ে কে নিয়ে আমি আর পারলাম না। কোথায় জামাইয়ের আশেপাশে থাকবে, কখন কী প্রয়োজন তা দেখবে তা না করে মেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।”
কথা গুলো বলতে বলতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন জুনাইদা। হাতে বরাবরের মতই এক কাপ চা। সরদার সাহেব বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। মেয়ের জামাই আসছে অনেক কেনাকাটা করতে হবে।
জুনাইদা চায়ের কাপ টা সরদার সাহেবের হাতে দিয়ে বললেন,
“চৈতির কান্ড দেখেছেন?”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সরদার সাহেব প্রশ্ন করলেন,
“কী করেছে আমার আম্মা?”

“বাড়িতে আসার পর শাড়ি বদলে সেলোয়ার কামিজ পরে ছুটে বেড়াচ্ছে। এই মেয়ের যে বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সাথে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসছে সেই খেয়াল কী আছে?”

“আহ জুনাইদা। আমার মেয়ের এত সব মাথায় নিয়ে ঘুরার বয়স হয়নি। তুমি একটু নিরিবিলিতে ওরে বুঝাই ও।”
জুনাইদা সরদার সাহেবের দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে গেলেন রান্নাঘরে। রুপা রান্না ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সিফা পেঁয়াজ কুচি করছে। দুই দিন ধরে রুপার শরীর টা ঠিক ভালো যাচ্ছে না। রুপা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুনাইদা চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন,
“বড় বউ, একটু কষ্ট করে মা চৈতি কে ডেকে দাও না।”

“আচ্ছা মা। আমি ডাকছি ওকে।”
রুপা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় প্রহন কে চোখে পড়লো।ছাদ থেকে নামছে। রুপা কে দেখে প্রহন বললো,
“পিচ্চি কে একটু ডেকে দিবেন ভাবি?”

রুপা মুচকি হেসে জবাব দিলো,
“আমার ননদকে ছাড়া বুঝি মন টিকছে না?”

“আসলে তা না। একটু দরকার ছিল তাই আর কি।”

“আমি চৈতি কেই ডাকতে যাচ্ছি।”
রুপা সদর দরজা পেরিয়ে চলে গেল বাগানের দিকে। প্রহন চৈতির রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
_______________________

বাগানে এসে গলা উঁচু করে চৈতির নাম ধরে ডাক দিলো রুপা। কিন্তু চৈতির কোনো সাড়া পেল না। বাগানের ভেতর খুঁজতে লাগলো। কোথাও পেলো না চৈতি কে।
বাগানে চৈতি কে না পেয়ে রুপা ভাবলো ছাদে আছে। পরক্ষনেই মনে হলো,
প্রহন ছাদ থেকেই নেমে এসে চৈতি কে ডেকে দিতে বলেছে।ছাদে থাকলে তো প্রহন ডেকে দিতে বলতো না। “তাহলে মেয়েটা কোথায় গেল? একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”রুপা জলদি করে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। রান্না ঘরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলো,
“চৈতি কী কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না মা।”

রুপার কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেন জুনাইদা। বুকের মাঝে ধক করে উঠলো। হাতের কাজ রেখেই তিনি সরদার সাহেবের রুমে ছুটে গেলেন।
সহধর্মিণী কে এমন ছুটে আসতে দেখে বসা থেকে উঠে সরদার সাহেব জিজ্ঞেস করলে,
“কী হয়েছে?”

“চৈতি কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“কী? বাগানে,ছাদে খুঁজে দেখেছো ভালো করে? গাছের উপর উঠে বসে নেই তো আবার?”

“বড় বউ গিয়েছিল চৈতি কে ডাকতে। কিন্তু ও কোথাও চৈতি কে খুঁজে পায়নি। বাগানে,ছাদে কোথাও নেই।”
চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো সরদার সাহেবের। মাথায় হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লেন।

জুনাইদা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। জুনাইদার পিছনে পিছনে সরদার সাহেব ও গেলেন।
জুনাইদা সবাইকে ডেকে নিয়ে গেলেন চৈতি কে খোঁজার জন্য।”আজ যদি মেয়েটা নিজে থেকে লুকিয়ে থাকে খুঁজে পেলে ঠাঁটিয়ে এক চড় খাবে আমার হাতে।”মনে মনে কথা গুলো বললেন জুনাইদা।

বেশ খানিকক্ষণ খোঁজার পর ও চৈতির দেখা মিললো না।এত সময় পর ও চৈতিকে রুমে আসতে না দেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো প্রহন।বাড়ি ফাঁকা।কেউ নেই।ভ্রু কুঁচকে গেলো প্রহনের।”হঠাৎ করে সবাই গেল কোথায়?”বাইরে থেকে চিল্লাচিল্লির শব্দ পেয়ে সেখানে যায় প্রহন।

“আব্বু আমাকে গাছের উপর থেকে নামাওওও।”

আচমকা চৈতির গলার স্বর শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়। সবাই গাছের উপরে দেখতে থাকে। প্রহনের চোখ পড়ে চৈতি যে গাছে ঝুলিয়ে আছে সেই গাছের মগডালে।
বিচিলিত কন্ঠে প্রহন বলে উঠলো,
“পিচ্চি এত উপরে উঠছো কেন? শক্ত করে গাছের ডাল চেপে ধরো।ভয় পেও না।”

প্রহনের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই চৈতির দিকে তাকালো। সরদার সাহেবের বুকের উপর থেকে যেন ভারি পাথর সরে গেল। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি।

প্রহন নিচে থেকে চৈতিকে গাছ থেকে নামার কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়ার ফলে এই সব ট্রেনিং তার নেওয়া হয়েছে।
প্রহনের কথা মতো চৈতি মগডাল থেকে অনেক টা নিচে নেমে আসে। ভয়ে জান যায় যায় অবস্থা।মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে আর জীবনে ও এত বড় গাছে উঠবে না।
গাছের গোড়ার কাছাকাছি আসতেই হাত ফসকে পড়ে যায় চৈতি। পড়ে যাওয়ার সময় গলা ফাটিয়ে বলে,
“মাটিতে পড়লেই মরে যাবো আমি। আমাকে ধরোওওও।”চৈতির কথা সবাই বুঝে উঠার আগেই ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে চৈতির দিকে। সরদার সাহেব ছুটে এলেন মেয়ের কাছে। বাবাকে দেখেই আহ্লাদে কেঁদে উঠলো চৈতি।গাল ফুলিয়ে নাক টেনে টেনে কান্না করছে। প্রহন আরেক দফা অবাক হয়ে কান্নারত চৈতি কে দেখছে।
সরদার সাহেব পরম মমতায় চৈতি কে দাড়ঁ করিয়ে বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরলেন।একটু আগেই বয়ে যাওয়া ঝড়ে অশান্ত মনটা এক নিমিষেই শান্ত হয়ে গেলো। মেয়ের কান্না থামাতে আদুরে গলায় বললেন,
“কিচ্ছু হয়নি আম্মা। কাঁদে না।”

চৈতি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোট ফুলিয়ে ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,”কেটে গেছে।”

চৈতির কথা শুনে প্রহন হাত ধরে দেখতে লাগলো। সত্যিই হাতের কনুই ছিলে গেছে। সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে।

“বেশ হয়েছে।বানরের মতো আরো গাছে গাছে লাফা।যা,,নামলি কেন? গাছের ডালেই রাতে থেকে যেতি। শয়তান মেয়ে।”

“আহ জুনাইদা! আমার আম্মাকে আর চিল্লিও না তো। এমনিতেই হাতের কনুই ছিলে গেছে।যাও বাড়ির ভেতরে যাও।”

“ছোট থেকে এই আপনার আশকারা পেয়ে পেয়ে এত বেপরোয়া হয়েছে।আদরে আদরে বাঁদর করে তুলেছেন।”
জুনাইদার কন্ঠে যথেষ্ট রাগ। চৈতির দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন তিনি। তার পেছন পেছন রুপা আর সিফা ও চললো।

সরদার সাহেব মুচকি হেসে প্রহনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বুঝলে বাবা এই মেয়ের জন্য তোমার শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে যেতে হয় আমার।আর এত এত কথা মুখ বুজে শুনতে হয়। মেয়ের রাগ সব আমার উপর ঝারে।”

__________

ঘড়ির কাঁটায় তখন সময় ৭টা বেজে ২৫ মিনিট। চৈতির ডান হাতের কনুইয়ের রক্ত পরিষ্কার করে বেশ দক্ষ হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয় প্রহন। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে চৈতি। তার পাশেই বসে মোবাইলে কিছু একটা করছে প্রহন।

টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা বই গুলোর দিকে চোখ পড়তেই নড়েচড়ে বসলো চৈতি।তাকে এত নড়তে দেখে প্রহন জিজ্ঞেস করলো”কি হয়েছে পিচ্চি?”

“আমার আসলে বই পড়তে খুব ইচ্ছে করছে।”

“কোন ধরনের বই?”
চৈতি টেবিলের উপর রাখা বই গুলোর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“পাঠ্য বই।”

“গল্পের বই ছেড়ে পাঠ্য বই পড়তেও কারো ইচ্ছে জাগে?বাহ বেশ ভালো তো।কোন বিষয় নিয়েছো নবম শ্রেণীতে?”

“সাইন্স।”

“গুড স্টুডেন্ট। তাহলে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো, ভিনেগারে কোন ধরনের এসিড থাকে?”

এই প্রশ্নের উত্তর টা জানা আছে চৈতির।স্কুলে একদিন স্যার বলেছিলেন।সেটাই মাথায় রেখেছিল সে।তাই দেরি না করে চট করেই উত্তর দিয়ে দিলো,
“ইথানয়িক এসিড।”

প্রহন মুচকি হেসে বললো,
“রাইট। তুমি খুব ভালো ছাত্রী পিচ্চি। পড়ালেখার প্রতি এত আগ্রহ দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু এখন পড়তে হবে না। কয়েক দিন পর থেকেই শুরু করে দিও।”

চৈতি ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”আচ্ছা।”
অন্যদের সাথে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসা চৈতি প্রহনের সামনে কতই না শান্ত।

“পিচ্চি বা পা টা দাও তো।”
প্রহনের কথা মতো বিনা বাক্যে প্রহনের দিকে পা বাড়ায় চৈতি। পকেট থেকে একটা পায়েল বের করে সযত্নে চৈতির পায়ে পড়িয়ে দিয়ে প্রহন বললো,
“ভাবিদের দেখিয়ে দিও। এই পায়েলটা তোমার হাসব্যান্ড তোমাকে দিয়েছে।পা টা বড্ড খালি খালি লাগছিলো।একটা পায়েল এর প্রয়োজন ছিল।”

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here