অপ্রিয়_রঙ্গনা #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-১৫

0
215

#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫

ঘন নীল আকাশে শুভ্র মেঘের চাঁদোয়া। নির্মল
বাতাসে কানের পাশের একগাছি চুল ওড়ছে
ঝুমুরের। ওর জন্য দিনটি আজ বিশেষ। ভার্সিটিতেও কোনো এক প্রোগ্রাম আছে। দু’টো দিক চিন্তা করেই ঝুমুর আর ওর বান্ধবীরা আজ শাড়ি পরে ভার্সিটি এসেছে। ঝুমুরকে দেখে সবাই হৈ হৈ করে শুভেচ্ছা জানালো, ওর সৌন্দর্য দেখে এটাসেটা বলে ওকে ক্ষ্যাপাতে লাগলো। ঝুমুর ভীষণ লজ্জা পেলো। বান্ধবীদের নিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালে যখন প্যান্ডেলের দিকে এলো দেখলো আশেপাশের সবাই ওকে আপাদমস্তক দেখছে। ছেলেগুলোর লালসা পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর ভীষণ অস্বস্তি শুরু হতেই ও সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমলকি গাছের নিচে বসলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তাখলিফকে লিখলো, “আমি ভার্সিটিতে। আমলকি গাছের নিচে অপেক্ষা করছি। একটু কি আসবেন…”

তাখলিফ ম্যাসেজ পেয়ে কিছুক্ষণ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করলো যাবে কি যাবে না! অবশেষে মস্তিষ্কের কথা না শুনে মনের কথা শুনলো সে। অফিসের কাজে ইস্তফা দিয়ে ঘন্টার মধ্যেই চলে এলো। দূর থেকে ঝুমুরকে দেখে সে বিষম খেলো। খোলা চুলে, সোনালী সুতোর কাজ করা সাদা ফুলেল জামদানিতে এই মেয়েকে মারত্মক লাগছে। চোখ ফেরানো দায় হয়ে গেছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতেও পারলো না এই বি’ষকন্যার দিকে। চোখের সাথে হৃদযন্ত্রেও কেমন অদ্ভুত ব্যথা ঝিলিক মেরে ওঠে। ওদিকে ঝুমুর ওকে দেখতে পেয়ে একপ্রকার ছুটে এলো। খোলা চুল আছড়ে পড়ে ওর চোখেমুখে। সেগুলো সামলে নিতে নিতে ঝুমুর বলে, “এসেছেন তাহলে?”

রিনরিনে কন্ঠস্বর শুনে তাখলিফের ঘোর কেটে যায়। নিজেকে সামলে অন্যদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ডাকলি কেন?”

ঝুমুর কোনো ছুঁতো ভেবে না পেয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
“ছেলেগুলো কেমন করে তাকাচ্ছিলো তাই ভাবলাম আপনি থাকলে ভালো, তাকাবে না।”

“আমাকে বর্ডিগার্ড মনে হয়? এভাবেই তো ফাঁসিয়ে দিয়েছিলি!”

ঝুমুরের মুখে মেদুর ছায়া পড়লো,
“আমি বলেছিলাম যেতে? বাঁচিয়েছিলেন কেন আমায়?”

তাখলিফ কটাক্ষ করে বলল,
“দেখে তো হুঁশ ছিলো না৷ পায়ে ধরতে বাকি ছিলি। ছোটবাচ্চা তাই বাঁচিয়েছি। বিনিময়ে একগ্রাম লোক ধরে তোকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো। সাংঘাতিক মেয়ে তুই।”

ঝুমুর সেই কথাগুলো মনে করে কেমন কুঁকড়ে গেলো ভেতরে ভেতরে। ওমন বিভৎস, কুৎসিত স্মৃতি ও মনে রাখতে চায় না, তবুও মনে পড়ে যায় কখনো কখনো। আচমকাই ওর বুক কাঁপতে লাগলো, চোখদুটো কেমন জ্বালা করতে শুরু করলো। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিলো। সেদিন এই মানুষটা ওকে না বাঁচালে ঝুমুর হয়তো এতদিনে এই পৃথিবীতেই থাকতো না। মানুষটার কাছে ওর আজন্ম কৃতজ্ঞতা! ওকে এমন ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাখলিফ একটু ভড়কে গেলো। এই মেয়ে তো আবার ট্রমায় ভুগে এই কাহিনী মনে করে। কেন যে বলতে গেলো! ও ঝুমুরের কাঁধ ধরে ঝাঁকা দিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “খারাপ লাগছে?”

ঝুমুর ওর দু-বাহু শক্ত করে খামচে ধরে চোখদুটো
বুজে শ্বাস টেনে বলল, “উহু।”

“কোথাও যাবি?”

“আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন।”

তাখলিফ আরকিছুই জিজ্ঞেস করলো না। রিকশা
ভাড়া করলো। উদ্দেশ্যহীনভাবে শহর চষে বেড়ালো। ঝুমুরের ভালো লাগছে, সেইসাথে মনে মনে অভিমান জন্মালেও প্রকাশ করে না। ভাবে, তাখলিফ হয়তো জানেই না আজ ওর জন্মদিন! না জানলে বলবে কি? তাছাড়া তাখলিফের দ্বারা জন্মদিন নিয়ে আদিক্ষেতা আশা করাটাও ভুল। ঝুমুর বিষন্ন চেহারা নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। ওর চোখেমুখে ফুটে ওঠে বিমর্ষভাব। তাখলিফ দেখেও না দেখার ভান করে। বকবক করে মাথা খাওয়া পাগল আজ চুপ! সে জানে আজ ঝুমুরের জন্মদিন। কিন্তু প্রকাশ করে না। কেমন সংকোচ হয়। নিজের সত্তার পরিবর্তন ঘটিয়ে বুকভরা ভালোবাসা দিতে অস্বস্তি হয়। তবুও আজ সে অফিস ফেলে ছুটে এসেছে, কেন এসেছে জানে না। বিগত বছরগুলোতেও সে ঝুমুরের জন্মদিন মনে রেখেছে। সেদিনটাতে ঝুমুর অস্বাভাবিক আচরণ করতো। জন্মদিনের কেক, মিষ্টির ভাগ রাখতো তাখলিফের জন্যেও। মায়ের কাছে ধরা না খাওয়ার জন্য কত ছুঁতো, লুকোচুরি যে করতো তা ভাবনার বাইরে। ভীতুর মতো লুকিয়ে তিনতলায় তাখলিফের জন্য নিয়ে যেতো। এসবের কারণ জিজ্ঞেস করলে তাখলিফকে মিনমিন করে নানান বাহানা দিতো। ভুলেও বলতো না আজ তার জন্মদিন। কথাগুলো মনে করে হাসি পায় তাখলিফের। রোদ পরে আসতেই সে ক্লান্ত গলায় ঝুমুরকে বলে, “এবার বাড়ি যাই? চল…”

“না যাবো না।”

তাখলিফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”

“আপনার জানতে হবে না।”

ঝুমুরের ভীষণ অভিমানে গালভারী হয়ে যায়। চোখ ছলছল করে ওঠে। উল্টোদিকে ফিরে হাতের তালুতে চোখ মুছে। ও জানে, তাখলিফ অজ্ঞাত ওর জন্মদিনের বিষয়ে। এরপরেও অভিমান হচ্ছে, রাগ হচ্ছে। একটুও বোঝে না? এ কেমন মানুষ! অন্তত একবার ওর গালে হাত রেখে “শুভ জন্মদিন” বললেই ঝুমুর পৃথিবী জেতার মতো আনন্দ পেতো। অথচ? অথচ? তাখলিফ হতবিহ্বল ভঙ্গিতে আরও কিছু বলতে যাবে ঝুমুর আচমকা ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। তাখলিফ থতমত খায়, “এই তোর হলো কি? এভাবে কাঁদছিস কেন?”

ঝুমুর কোনো উত্তর দেয় না, থামেও না। রিকশাওয়ালা সন্দেহী চোখে পেছনে তাকাতেই তাখলিফ তাকে ধমক দেয়। এরপর ঝুমুরের হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে নিচু স্বরে বলে, “কাঁদিস না বাবা। সমস্যাটা কি বল তো? আমি কি কিছু করেছি? কি ভুল, বল আমায়!”

“আ আপ আপনি… ”

কান্নার দমকে কথা বেরুয় না ঝুমুরের। কিছুতেই
বলতে পারে না সমস্যা কোথায়! ওর ইতস্ততবোধ,
নাক ফুলিয়ে অভিমানের কান্না দুপুরের রোদে ঝলমল করছিলো। তাখলিফ ভেতরে ভেতরে হেসে খু’ন হয়। তবুও সে কিছু না জানার ভান করে। তবে একসময় আর পারে না। বউটাকে কাঁদতে দেখতে ভালো লাগছে না। ও একহাত গলিয়ে ঝুমুরের শাড়ির নিচ দিয়ে কোমড় চেপে ধরে বসে। অন্যহাতে ওর গাল মুছে দিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “শুভ জন্মদিন গর্দভ।”

ঝুমুর শিউরে ওঠে। কান্না থামিয়ে নাক মুছে বোকার মতো বলে, “আপনার মনে ছিলো?”

“না।”

“তাহলে?”

তাখলিফ বলে,
“তোর ঢং দেখে মনে পড়লো। সামান্য একটা জন্মদিন নিয়ে কেঁদে বুক ভাসাতে তোরা মেয়েমানুষরাই পারিস…”

ঝুমুর ওর কথায় একটুও মন খারাপ করে না হাসে। আগ্রহী গলায় জানতে চায়,
“আমাকে কিছু দেবেন না?”

তাখলিফ একটু চুপ থেকে ভ্রু কুঁচকে বলে,
“সময় দিলাম এটাই বেশি না?”

“তার মানে আমি যা চাইবো তা-ই হবে?”

তাখলিফ যথাআজ্ঞাপন জানাতেই ঝুমুর ওর দু’গাল টেনে ধরে নাকের ওপর চুমু দিয়ে বসে। রিকশাওয়ালা পেছনে কি হচ্ছে তা আন্দাজ করে খুকখুক করে কেশে ওঠতেই তাখলিফ কিছুটা কড়া সুরেই বলে, “আমার বউ চাচা।”

পরক্ষণেই ঝুমুর বলে,
“ওনি আমার বর হয়, চাচা। আমরা অশালীল কিছু করছি না তো।”

রিকশাওয়ালা লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ে। বেচারা অস্বস্তিতে পড়ে গেছে ভীষণ। তাখলিফ ওর কান্ডে অবাক হয়ে ফিসফিস করে বলল, “এই তোর লজ্জা করে না?”

ঝুমুর শান্ত স্বরে বলে,
“না। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলবো দরকার হলে, আপনি আমার সব। জীবন, মৃত্যু সব…”

বলে মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে। তাখলিফ ওর দিকে নিজের অজান্তেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। শহর চষে বেরিয়ে ওরা এসে থামে রমনার সামনে। ঝুমুরের বায়নাতে বাধ্য হয়ে ওকে নিয়ে পার্কে ঢুকে সে। চারদিকে অগণিত মানুষ। কপোত-কপোতীর অভাব নেই। কেউ কেউ চুপিসারে, গাছের আড়ালে, ঝোপের পেছনে বসে অদ্ভুত, আশালীন প্রেমলীলা চালাচ্ছে । এই প্রথম বউ নিয়ে এমন অসুস্থকর প্লেসে এসেছে ভেবেই তাখলিফ কেশে ওঠে। ঝুমুর ব্যাপার বুঝে হেসে ফেলে। তাখলিফ চোখ গরম করে তাকাতেই ওর হাসি মিলিয়ে যায়। মিনমিন করে বলে, “আর হাসবো না।”

“মনে থাকে যেন।”

“থাকবে…”

তখনি ক্যামেরা হাতে ক্রেতা খুঁজতে থাকা একজন ফটোগ্রাফার এসে ওদের ছবি তুলবে কি-না জানতে চায়৷ ঝুমুর ‘হা’ বলতে নেবে তার আগেই তাখলিফ সোজা-সাপটা না করে বিদায় করে দেয় ফটোগ্রাফারকে। ঝুমুর সাথে সাথেই গাল ফুলিয়ে দেয়, শক্ত হয়ে বসে থাকে, কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। তাখলিফের ধমক, রাগারাগিও কাজ হয় না। সূর্যের তেজ দীপ্ত আলোতে বসে থেকে চোখমুখ রক্তিম করে ফেলে। একসময় ওর জেদ নিতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাখলিফ ছবি তোলার জন্য রাজি হয়। ফটোগ্রাফার ঝুমুরের অনেক ছবি তুলে দেয়। ঝুমুরের অত্যাচারে শেষমেশ তাখলিফকেও কাপল ছবি তুলতে হয়, আইসক্রিম, ফুচকা, চটপটি খেতে হয়। শাহবাগের ফুলের দোকান থেকে ঊনিশটা গোলাপ কিনে দিতে হয়।

পড়ন্ত বিকেলে দু’জন বাড়ি ফেরে। গেটের সামনে ডালপালা মেলে সৌন্দর্য ছড়ানো বাগানবিলাস গাছখানি গোলাপি হয়ে আছে। বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঝুমুরকে আটকায় তাখলিফ। একটা খাম দিয়ে ঝুমুরের দু’গালে, কপালে চুমু এঁকে সে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত ওপরে ওঠে যায়। ঝুমুর খাম হাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অজানা আশঙ্কায় ওর বুক কেঁপে ওঠে। এটা কিসের খাম? এখানে আবার ডিভোর্স পেপার নেই তো? ঝুমুরের মন একইসাথে কৌতূহলে এবং উৎকন্ঠায় কাঁপতে থাকে। দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে খাম খুলে দেখে সেখানে একটা বিশাল এমাউন্টের চেক আর ছোট্ট চিরকুট।

ঝুমুর,
তোর দেনমোহর, আর জন্মদিনের উপহার।
একসাথে দিলাম। দেরি হওয়ার জন্য আমাকে বকে লাভ নেই৷ তুই তখন ছোট ছিলি, এতবড় চেক
সামলাতি কি করে? তাই আজ দিলাম।
বিগত আঠারোটা জন্মদিনের শুভেচ্ছা হিসেবে আঠারো লক্ষ্য চুমু, আগত জন্মবর্ষের জন্য কোটি আলোকবর্ষ ভালোবাসা….
বাই দ্যা ওয়ে, আজ থেকে তুই আমার অফিশিয়ালি বউ…

–তাখলিফ হাসান তূর্য।

চিরকুট বুকে নিয়ে ঝুমুর কেঁদে ফেলে। এই চাপা লোকটা ওকে অনেক ভালোবাসে, শুধু প্রকাশ করতে পারে না। তাতে কি? ঝুমুর তো বুঝতে পেরেছে!

______________

শামসুল হক আশ্চার্যান্বিত হয়ে বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার কাছে সবকিছু কেমন দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। কান দিয়ে শা শা শব্দে ধোঁয়া বেরুচ্ছে যেন। কয়েক মুহূর্ত তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। চিন্তাভাবনা, বোধশক্তি হারিয়েছেন। ঝুমুর! তার সবচেয়ে আদরের ছোট
মেয়ে ঝুমুর? সে তাখলিফের বিয়ে করা বউ? তাও দুই বছর আগের সেই বিভীষিকাময় কিডন্যাপারের মাধ্যমে? মানে কি? এসব কি শুনছেন তিনি? শামসুল হকের মস্তিষ্ক আস্তেধীরে সচল হয়ে ওঠলো। পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো মুখ। পাশে বসা ছোট ভাই সাঈদ হকও হতবাক। কেশে ওঠে এবার বললেন, “বড়ভাই আপনি মজা করতেসেন আমাদের সাথে?”

সানওয়ার সাহেব শক্ত গলায় বললেন,
“না।”

“এটা কীভাবে সম্ভব? না ভাই কোথাও ভুল হচ্ছে।”

ছোটভাই সাঈদের কথায় এবার বেশ বিরক্তি অনুভব করলেন সানওয়ার হক। তিনি ছোটভাইয়ের কথায় জবাব না দিয়ে শামসুল হকের উদ্দেশ্য গলা ঝাড়লেন।
শামসুল হক দৃঢ় গলায় বললেন,
“সম্ভব না। কিছুতেই না। মাফ করবেন বড়ভাই, এরপরেও আমি বলছি এটা সম্ভব না।”

সানওয়ার হক তাজ্জব বনে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন পাখি বেগম বেঁকে বসবেন, এখন তো দেখছেন তার ভাইও! তিনি গলা ঝেড়ে বললেন, “সম্ভব না বললেই তো হয় না শামসু। আইন এবং শরীয়ত দুই মোতাবেকই ঝুমুর তাখলিফের স্ত্রী। সেটা আমরা কেউ মানি আর না মানি তাতে কিন্তু সত্য পালটে যাবে না।”

শামসুল সাহেব কিছু ভাবতে পারলেন না৷ তবে তিনি অকপটেই বলে দিলেন, “পাল্টানোর জন্য যা করার বাবা হিসেবে আমি সেই ব্যবস্থাই করবো।”

সানওয়ার হক ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তুই কি ওদের আলাদা করার কথা বলছিস? ডিভোর্স করাবি নিজের মেয়েকে?”

শামসুল হকের বুক কেঁপে ওঠলো। এই বংশে এমন ইতিহাস নেই, তিনি কীভাবে পারবেন করতে? কিন্তু তাই বলে তাখলিফের সাথে তার মেয়ে? নাহ! তার মাথা কাজ করছে না। পাশে বসা সাঈদ হক বললেন,
“যা করার ভেবেচিন্তে করবেন। যাতে কাউকেই পস্তাতে না হয়।”

শামসুল হক অভিযোগের সুরে বললেন,
“কিন্তু আপনি এতদিন এসব জানান নি কেন ভাইজান? আমার মেয়েটার এতবড় ক্ষতি হয়ে গেলো…”

“আমি নিজেও জানতাম না। তাখলিফ আমাকে বললো সেদিন, আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না তোদের কিভাবে বলবো!”

শামসুল হক কাষ্ঠ হেসে এবার বলল,
“ভালোই খেলোয়াড় আপনের পোলা বড়ভাই। বলতে বাধ্য হইলাম। আমার মেয়ের দিকে সে কেমনে হাত বাড়ায়?”

সানওয়ার সাহেব ভাইয়ের গলা শুনে থম মেরে গেলেন। সাঈদ হকও মেঝোভাইয়ের কথায় কনফিউজড।

শামসুল হকের মুখ থমথম করছে। ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,
“আমি তাখলিফরে কিন্তু আলাদা চোখে দেখিনাই। কিন্তু এবার আর পারছি না বড়ভাই। ঝুমুর আমার সবচেয়ে আদরের মেয়ে, ওর সাথে এমন কান্ড করে ও কীভাবে চুপচাপ দুই বছর কাটাই দিতে পারলো? এখন যখন মেয়েটার জন্য ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ আসছে তখনই কেন এসব স্বীকার করলো? তার মানে কি এটাই নয় যে ও ওর স্বভাবগত কাজটাই করছে? সুযোগ নিয়েছে?”

তাখলিফ বাইরে ছিলো। দরজা দিয়ে ঢুকতেই কিছু কথা ওর কানে গেলো। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ও ভেতরে পা রাখতে রাখতেই বলল, “তার জন্য কি আমাকে পুলিশে দেবেন? আমার আপত্তি নেই। আমি কেন জানাইনি এটা আমি আপাতত বলতে পারছি না, তবুও একটা কারণ বলি? আমার, এই আমার ভীষণ চক্ষুলজ্জা করছিলো, নিজেকে কাপুরুষ মনে হচ্ছিলো। যাইহোক, আপনি বরং আপনার মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন, এই দু’বছরে ওর সাথে কোনোদিন স্বামী হিসেবে আচরণ করেছি কিনা! এরপর আমাকে পুলিশে তুলে দিলেও আমি নিজেকে জাস্টিফাই করবো না চাচাজান।”

শামসুল হক ওকে দেখে কতক্ষণ চুপ থাকলেন৷ এরপর বললেন, “এই দু’বছর অনেক সময়। তুমি পারতে আমার মেয়েটাকে ছাড়তে। যেহেতু বিয়েটা একটা দুর্ঘটনা। কেন করলে না?”

তাখলিফ সত্যিটাই বললো,
“আমি বিষয়টা নিয়ে সত্যিই এতো ভাবি নি। তাছাড়া ঝুমুর ছোট ছিলো। ওর মানসিক অবস্থার কথা ভেবেই চেপে গিয়েছি, যেটা আমার আরেকটা ভুল।”

শামসুল হক বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি চাচ্ছো তুমি?”

চাচার প্রশ্নের ধরণ ভালো লাগলো না তাখলিফের। সে কিছুটা কড়া গলায় বলল, “আমি কিছুই চাচ্ছি না। বরং আপনার মেয়ে যেটা চায়, আমিও সেটাই চাইবো। আগে আপনার মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন চাচাজান।”

শামসুল হক বিষাদভরা মুখটা অন্ধকার করে ওঠে চলে গেলেন৷ তাখলিফ বাড়িতে একটা অশান্তি শুরু হওয়ার আনাগোণা টের পেলো। পোড়া স্মৃতি, পোড়া গন্ধ, উফ চারপাশটা কেমন পুড়ছে! তাখলিফের বুকের ভেতরটাও!

শামসুল হক অসাড় হাত-পা নিয়ে তিনতলা থেকে নেমে এলেন। পাখি বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে স্বামীকে পানি এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,
“বড়ভাই ডাকছিলো কীজন্য আপনারে?”

পানির গ্লাসটা ঢকঢক করে শেষ করে তিনি উত্তরে বললেন, “বিয়ের জন্য।”

“কার?”

“ঝুমুরের।”

পাখি বেগম সন্দেহী চোখে তাকালেন,
“কার সাথে?”

“তাখলিফের।”

পাখি বেগম আঁৎকে ওঠলেন,
“কি কন আপনে? এইডা হইতে পারে না, স্বপ্নেও না।”

শামসুল হক হতাশ গলায় তখনি স্ত্রীকে দুঃসংবাদটা দিলেন, “স্বপ্নে আর কি! বাস্তবেই হয়ে গেছে। তোমার মেয়েকে ডাকো, জিজ্ঞেস করো।”

পাখি বেগম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালেন। যেন স্বামীর কথাবার্তার আগামাথা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। তার পা দুটো জমিনে আটকে গেছে। মাথাটা ঘুরছে। তিনি ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। সন্দেহ তাহলে মিথ্যে ছিলো না? খানিক সময় গড়ালো। শামসুল হক একসময় ধৈর্য্যহারা হলেন। চিৎকার করে ঝুমুরকে ডাকলেন তিনি। বাবার এমন আকস্মিক চিৎকার শুনে গায়ে ওড়না চাপিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো ঝুমুর। ইয়াসিফ-তুসি, নিশি-তিথি সহ প্রমিলাও ছুটে এলেন। সাজেদা বেগম কোমড় ব্যথায় হাঁটাচলা করার শক্তি হারিয়েছেন। তিনিও ছেলের ওমন গলার স্বর শুনে চেঁচামেচি শুরু করলেন। শামসুল হক কেন জানে না রাগ সামলাতে পারলেন না। মেয়ের গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিয়ে বললেন, “কতুটুকু বয়স তোমার? এতবড় কথাটা কীভাবে লুকাইলা? তুমি কি
আমার সত্যিই আমার মেয়ে? ছিহ‌্!”

ঝুমুর গালে হাত দিয়ে পাথর বনে গেলো। বাবা তাকে মারলো? বাবা? ওর এতবছরের জীবনে মনে পড়ে না বাবা কখনো গায়ে হাত তুলেছে। আজ কি করে পারলো? ঝুমুর পরক্ষণেই মায়ের রণচণ্ডী গলা শুনে কেঁপে ওঠলো, “মুখপুড়ী, কলঙ্কীনি। বাপের কথার জবাব দে সাহস থাকলে। তুই… তুই কেমনে পারলি? ছিহ্! আমার সব শেষ হয়ে গেলো। শেষমেশ তুই….”

শামসুল হক স্ত্রী’র কথার মাঝেই দ্বিতীয়বার বললেন,
“বলো। তাখলিফের সাথে বিয়ের কথাটা তুমি লুকালে কেন আমাদের থেকে? কেন?”

ঝুমুর হতবিহ্বল, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগছে। ও দেয়ালে ঠেস দিয়ে নিজের ভর সামলালো। ইয়াসিফ বাদে বাড়ির সবাই তাজ্জব বনে গেলো। এসব কী শুনছে তারা? বিয়ে? তাও ঝুমুর-তাখলিফ? তুসি ইয়াসিফের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাতেই ও ইশারায় জানালো সে সব জানে। তুসি মুখে হাত চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতর থেকে সাজেদার চেঁচামেচি শুনে একছুটে সেখানে চলে গেলো। ইয়াসিফ এবার মুখ খুললো, “ওকে বলে লাভ নাই আব্বা। আমিই মানা করেছিলাম।”

পাখি বেগম আর শামসুল হক দু’জনেই দ্বিতীয়বারের মতো ধাক্কা খেলেন এই কথাটা শুনে৷ ঝুমুর তখনো গালে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াসিফ বোনকে নিজের কাছে এনে বাবাকে বোঝানোর উদ্দেশ্য করে বলল, “শ্রীমঙ্গলের সেই বিশ্রি ঘটনাটা নিশ্চয়ই আপনাদের সবারই জানা? সেদিন যদি ভাইয়া ঝুমুরকে বাঁচাতে না যেতো তাহলে নিজের মেয়েকে আপনারা আর দেখতে পারতেন না। তখন সিচুয়েশনটা এমন ছিলো যে ভাইয়া যদি ঝুমুরকে বিয়ে না করে তাহলে তাদের পাথর ছুঁড়ে মেরে দেওয়া হবে। এতে হয়তো ঝুমুরের, ভাইয়ার বা আমাদের কিছু ভুল ছিলো, কিন্তু কারোরই দোষ নেই। আর তখন বলার মতো পরিস্থিতিও ছিলো না৷ আমি তো চিনি আমার মা’কে, ভাইয়াকে কি পরিমাণ অপছন্দ করে তা তো জানি! আম্মা বরংচ ভাইয়াকেই ভুল বুঝতো কারণ ঝুমুরের তখন এতসব বোধগম্যতা ছিলো না।”

একটু থেমে দম টেনে নেয় ইয়াসিফ। এরপর
বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে সে দৃঢ় গলায় বলে,
“আমি ওদের বিয়েটাকে সমর্থন করছি। কেউ করুক বা না করুক।”

বলে ঝুমুরকে একপ্রকার টেনেই সেখান থেকে নিয়ে গেল। পাখি বেগমের দু’হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে মেঝেতে বসে পড়েন। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একসময় কিড়মিড় করে ওঠলেন। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন,
“মানি না। আমি এই বিয়ে কিছুতেই মানি না। ইয়াসিফের আব্বা, আমি কিন্তু এই অন্যায় কিছুতেই মানুম না। আমার জান থাকতে ওই পোলার কাছে আমার মাইয়া দিমু না। এবার যা হইবার হউক…”

বাকিরা তখনো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। এসব কি হচ্ছে?
প্রথমে ইয়াসিফ-তুসির বিয়ে নিতে কত ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হলো এখন আবার তাখলিফ-ঝুমুর? তাও দুই বছরের বৈবাহিক জীবন! অথচ কেউ কোনোদিন বুঝতেই পারলো না?

.

ঝুমুরের ঘরে আলো জ্বলছে না। বাইরে থেকে একফালি চাঁদ এসে ঢুকছে জানালা দিয়ে। আলোটা মায়াময়, ধোঁয়াটে। ঝুমুরের ভীষণ বুক ভার হয়ে আছে। মা-বাবা স্রেফ বলে দিয়েছে এই বিয়ের কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে, শ্রীঘ্রই ডিভোর্সের ব্যবস্থা নেবেন। ঝুমুরও সাহস করে বলে দিয়েছে সে ডিভোর্স চায় না। কিন্তু এরপরে মা তাকে যা শুনিয়েছে তাতে ঝুমুরের কেবল ভয় হচ্ছে তাখলিফকে নিয়ে। মানুষটা ওকে ছেড়ে চলে যাবে না তো? ঝুমুর তাহলে বাঁচবেই না।

_________________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
বাকিটা পরের পর্বে।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here