#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৭
ছোটবেলার সব স্মৃতি মনে নেই ঝুমুরের। আবছাভাবে কিছু মনে আছে বাড়ির সেই দুর্বিষহ দিনগুলো। তখন ও বুঝতো না কিছুই। শুধু বড়মায়ের মৃত্যুতে ভয় পেয়ে কেঁদেছিলো সেদিন এটুকুই মনে আছে ওর। ঝুমুর তাখলিফের বুকে মুখ গুঁজে ম্লান গলায় বলল, “বড়মা থাকলে আমাকে ঠিকই মেনে নিতো, তাই না?”
তাখলিফ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর ভ্রু কুঁচকালো, “তুই তখন ছোট ছিলি। এতকিছু মনে আছে?”
ঝুমুর ভীতু গলা,
“একটু একটু মনে আছে। তাছাড়া দাদীর কাছে সব শুনেছি, মাও বলেছে।”
তাখলিফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অতীত মনে পড়তেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠলো। কেন? কেন সে এরকম হয়ে গেছিল? সুন্দর একটা জীবনকে সে নিজের হাতেই নষ্ট করে দিলো। নয়তো আজ তার সব থাকতো, মা থাকতো। আচ্ছা মাকে আবার ফিরিয়ে আনার কি কোনো উপায় নেই? কেন নেই? নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও সে তাহলে মা’কে ফিরিয়ে আনতো না ফেরার দেশ থেকে। ঝুমুরের থেকে বিদায় নিয়ে সে তিনতলায় চলে এলো। চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে মায়ের কথা মনে পড়তেই। কত কত অপরাধ আর ভুল তার! ছোটচাচীর সাথে, মা’য়ের সাথে, এখন আবার মেজো চাচীর আদরের কন্যার সাথে! সবথেকে বড় কথা নিজের সাথেই! তাখলিফ কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হলো এগারো বছর
আগের দিনগুলোতে!
★★★
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান তাখলিফ। ছোটবেলা থেকেই সে খুব মা ভক্ত ছেলে। একমাত্র সন্তান বলে সানওয়ার হক আর তমালিকা ছেলেকে চোখে হারাতেন। তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে আগলে রাখতেন ছেলেকে। সানওয়ার হক তখন চাকরি করতেন একটা বড় কোম্পানির বিশিষ্ট পদে। তমালিকা ছিলেন গাইনোলজিস্ট। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ক্যারিয়ারে ব্যস্ত থাকলেও তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন ছেলেকে সময় দেওয়ার, ভালো রাখার। বাবা হিসেবে সানওয়ার হক তেমন সময় দিতে পারতো না তবে সবটাই পুষিয়ে দিতেন তমালিকা। এরজন্য নিজের স্বপ্নের পেশাও ছেড়ে দেন। সেই থেকে তাখলিফের দিন-দুনিয়া হয়ে যায় তার মা তমালিকা। অসম্ভব ভালোবাসতো সে তার মা’কে। মা হয়ে ওঠে তার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু, সর্বোচ্চ প্রায়োরিটির জায়গা। যাকে নিদ্বির্ধায় সবকিছু খুলে বলা যেতো, যার হাতের ছোঁয়ায় নিমিষেই মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠতো। যার জাদুকরী সত্তায় চোখের পলকেই তাখলিফের সব কষ্ট দূর হয়ে যেতো। তেমনি সম্পর্ক ছিলো তমালিকার সাথে তার। এভাবেই দিন কাটতে থাকে। তাছাড়া বাড়ির
সকলেই প্রথম নাতি হিসেবে তাখলিফকে ভালোবাসতো, মাথায় করে রাখতো ছোট থেকেই। এভাবেই বড় হতে লাগলো সকলের ভালোবাসার ছায়াতলে। যা চাইতো তা-ই পেতো। কেউ ওকে কিছু করতে বাঁধা দিতো না। একমাত্র সন্তান বলে সানওয়ার হক আর তমালিকাও ছেলেকে চোখে হারাতেন। দিয়েছিলেন অবাধ স্বাধীনতা। সন্তানকে ভালোবাসার সে এক অন্য রুপ। তবে এই ভালোবাসাই পরবর্তীতে তাখলিফের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সবকিছুতে আস্কারা পেয়ে দিনদিন জেদি আর বেপরোয়া হয়ে গেছিলো সে। তবুও কেউ ওকে কিছু বলতো না, যা করতে চাইতো তা-ই করতে দিতো। ক্যারিয়ারে ব্যস্ত বাবা-মায়ের তখন ছেলেকে শাসন বারণের বালাই
নেই। গ্রাম থেকে ওঠে আসা পাখি বেগমই একমাত্র এই বিষয়টি ভালো চোখে দেখতেন না। তার মতে এই ছেলে নিয়ে এত আহ্লাদ করার কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা সে….বাকিটুকু অবশ্য মুখ দিয়ে বের করার অধিকার ছিলো না এ বাড়ির কারোরই। পাখি বেগমও বলতো না বড় জা কষ্ট পাবে ভেবে। শত হোক! বড় জা তার অন্যতম শ্রদ্ধার মানুষ!
বাড়িতে তখন ঝামেলা চলছিলো। জমিজমা নিয়ে বিরোধ চলছিলো আত্মীয়দের সাথে। শামসুল হকের ব্যবসা ভালো যাচ্ছিলো না। সাঈদ হক জড়িয়ে গেছিলেন রাজনীতিতে, সেইসূত্রে কোনো এক গন্ডগোলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় তাকে। স্বামীর শোকে সাতমাসের অন্ত:সত্তা প্রমিলা তখন কাতর৷ এরমধ্যেই একদিন তাখলিফ কারো সাথে রাগারাগি করে একজগ পানি উলটে ফেলে দিয়েছিলো মেঝেতে। আর অসাবধানতা বশত তাতে পড়ে গিয়ে মিসক্যারেজ হয়ে যায় প্রমিলার, সেইসাথে হারান মা হওয়ার ক্ষমতাও। এই দুরবস্থার পর প্রমিলা অনেকটা মানসিক রোগী হয়ে গেছিলেন। দুই জমজ মেয়ের পর বেবি প্ল্যান করেছিলেন তারা, একটি ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্যই। কিন্তু তা আর হলো না। এদিকে তাখলিফ নিজের কান্ডে এমনই আহত হয়েছিলো যে ছোটচাচীর পা পর্যন্ত ধরে মাফ চেয়েছিলো। প্রমিলা তাখলিফকে ভীষণ ভালোবাসতো, নিজের ছেলের মতো৷ নিজের সাথে হওয়া দুর্ঘটনার পর প্রথম প্রথম তাখলিফকে সে সহ্য করতে পারতো না। এই অবস্থার জন্য দায়ী করতো ওকে। কিন্তু পরবর্তীতে তাখলিফের অনুশোচনা, অপরাধবোধের তীক্ষ্ণতা দেখে প্রমিলা নিজের ছেলে ভেবেই ওকে মাফ করে দেয় এবং পরবর্তীতে আর কখনো দোষারোপ করেনি ওকে। কিন্তু ঘটনাটি তাখলিফকে মনে মনে খুব আঘাত করেছিলো। এছাড়া পাখি বেগম সুযোগ পেলেই এটা নিয়ে কথা শোনাতো ওকে, যার দরুন অনেকটা বিষন্নতায় ভুগতে থাকে ও। ফলসরুপ নবম শ্রেণির ইয়ারলি এক্সামে আশানুরূপ ফল আসেনি ওর। তুখোড় মেধাবী ছাত্রের এই দুরবস্থা স্কুল কর্তৃপক্ষ মানতে পারলেন না। তারা তমালিকার সাথে আলাদা করে কথা বললেন। ছেলের মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা লক্ষ্য করেছিলেন স্বামী-স্ত্রী। ফলে তমালিকা আর সানওয়ার হক ছেলের ভালোর কথা ভেবেই তাখলিফকে তখন হোস্টেলে তুলে দেয়। জীবনে মাকে ছাড়া একটি রাতও অন্য কোথাও না থাকা তাখলিফ আকস্মিক এই দূরত্বটা মেনে নিতে পারেনি। তাছাড়া স্বাধীনতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে কোনোক্রমেই হোস্টেলে থাকতে চাইছিলো না৷ রাগ, জেদ করছিলো ভীষণ। ছেলেকে অনেক বুঝিয়েও যখন লাভ হলো না তখন ওর অবাধ্যতায় রেগে গিয়ে গায়ে হাত তুলেছিলেন তমালিকা। সেই! জেদ করেই আর হোস্টেল থেকে বাড়ি যাবার নাম করেনি সে। এমনকি ঈদ বা অন্যান্য ছুটিতেও ও হোস্টেলই থেকে যেতো, নয়তো কোনো বন্ধুর বাড়িতে চলে যেতো। জোর করেও কয়েকবার বাড়িতে নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তারা। এভাবেই দিন ফুরোতে থাকে। তমালিকা বা সানওয়ার হক এসে নিয়ম করে ছেলেকে দেখে যেতেন। কিছুদিনের ব্যবধানে দু’জনের চোখেই ছেলের কিছু অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। তবে গুরুতর অবস্থাটা তখনো ধরতে পারেনি। ভেবেছে তাদের ওপর রাগ করে এমন অবস্থা। ছেলেকে দূরে রেখে কষ্ট হলেও তারা মানিয়ে নিচ্ছিলো ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। সামনে এসএসসি। রেজাল্ট তো ভালো করতে হবে! বাড়ি থেকে তো তা হচ্ছে না।
তবে একটা সময় ছেলের ওমন অস্বাভাবিকতা বেশ চোখে লাগে তমালিকার। তার জহুরি চোখ অনেককিছুই ধরে ফেলে। তিনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন৷
ব্যাপারটা বুঝতে না দিয়ে প্রথমে ছেলের সাথে খোলাখুলি কথা বলে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন।
মায়ের কাছে সেদিন অবশ্য তাখলিফ মিথ্যে বলেনি।
অসৎ সঙ্গে পড়ে সে মাদক সেবনে তীব্রভাবে জড়িয়ে গেছে। ছেলের মুখে এই স্বীকারোক্তি শুনে তমালিকার পায়ের নিচে মাটি সরে যায়। স্বামীকে সব জানান।হোস্টেলে থেকেও কীভাবে এই নেশায় জড়ালো তার খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল, হোস্টেলের কিছু অসাধু রক্ষকই তলে তলে এ ব্যবসা চালায় আর ছাত্রদের নেশার আসক্তি গড়ে তুলে। এখানে সব পয়সাওয়ালার ছেলে, পটিয়েপাটিয়ে একবার ফাঁদে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে। তমালিকা আর সানওয়ার হক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট এই ঘটনার বিচার চেয়ে ছেলেকে আর এক মুহূর্তও হোস্টেলে রাখলেন না, বাড়িতে নিয়ে আসেন। অবশ্য ততদিনে বেশ দেরি হয়ে যায়। তাখলিফ পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে ছেলেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করতে থাকেন। ছেলেকে অঢেল টাকা, স্বাধীনতা দেওয়া বন্ধ করে দেন, যা যা করার তার সবকিছুই করতে থাকেন। তাখলিফের মিডটার্মের রেজাল্ট খুব খারাপ আসে, এদিকে আসক্ত তাখলিফ বাবা-মা’কে বেশ জ্বালাতন শুরু করে দেয়। একমাত্র ছেলের এই পরিণতি মেনে নিতে না পেরে তমালিকা মুষড়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে তাখলিফকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে রেখে আসতে বাধ্য হন তারা। বুকে পাথর চেপে কাটতে
থাকে দিন!
সানওয়ার হক অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে সারাদিন, একমাত্র ছেলেটারও এই দশা। মানসিকভাবে ভাঙতে শুরু করেছে তমালিকা। বাড়িতে সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে বলে পাখি বেগমের ভালো লাগে না। বড় জা’কে তিনি খুব শ্রদ্ধা, ভালোবাসার চোখে দেখেন৷ তমালিকাই তাকে পছন্দ করে এ বাড়ির মেজোবউ করে এনেছিলো। কোনোদিন জা’য়ের মতো ব্যবহার করেনি। শহুরের শিক্ষিত মেয়ে হয়েও গ্রাম থেকে ওঠে আসা মূর্খ পাখি বেগমকে সবসময় নিজের বোনের ন্যায় আগলে রেখেছেন। ছেলের শোকে আজ তার এই দশা! তাও, এই ছেলের? পাখি বেগম অবশ্য মনে মনে একবিন্দুও পছন্দ করতেন না তাখলিফকে। তার অবশ্য গুরুতর একটা কারণও আছে।
১৩ই সেপ্টেম্বর। দিনটা ছিলো অন্যরকম। বৃষ্টির এক ক্লান্ত দুপুর। প্রায় এক সপ্তাহ পর কড়া রোদ ওঠেছিলো। তাখলিফকে পুর্নবাসন কেন্দ্রে পাঠানোর পর এরমধ্যে দিন পনেরো পেরিয়ে গেছে। জা’য়ের মন ভালো করার জন্য পাখি বেগম সেদিন দুপুরের খাওয়া সেরে হাতের কাজ রেখে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলেন তমালিকার সাথে। সুখ-দুঃখের গল্প করলেন। তাতে খানিকটা সময় ছেলের চিন্তা থেকে প্রশমিত হয় তমালিকার মন। একটা সময় দিনের রঙ পালটায়। মেঘের আড়ালে রোদ ডুবে চারদিক আঁধার নামতে শুরু করে। এতদিন পর রোদের দেখা পেয়ে পাখি বেগম কাপড়চোপড়, আচারের বৈয়াম দিয়েছিলেন রোদে শুকাতে। তমালিকার সাথে কথা বলার একপর্যায়ে তার মনে পড়ে এসব। গল্পে ইস্তফা দিয়ে তমালিকাকে বলে ছাদে যেতে চাইলে বাধ সাধেন তমালিকা। নিজেই যেতে চান৷ পাখি বেগমও না করতে পারেন না। তিনি হাতের কাজ গোছানোর জন্য রান্নাঘরে চলে যান। তমালিকাপ ছাদে চলে আসেন। বৃষ্টিতে ভিজে ছাদে শ্যাওলা জমে রয়েছে। পুরোনো বাড়ি বলে রেলিঙের পলেস্তারা খসে পড়েছে। বিপদজনক বলে সেগুলো ভেঙে একপাশে ফেলে রাখা হয়েছিলো। নতুন করে রেলিঙ দেওয়ার কাজ শুরু করা যাচ্ছে না এই টানা বৃষ্টির দিনে। তমালিকা শাড়ি খানিকটা উঁচু করে সাবধানে পা ফেলে ছাদের অন্যপাশে বেদির ওপর রাখা বৈয়ামগুলোর কাছে চলে যান। গিয়েই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেন। পানির ট্যাংকের সামনে হাত-পা ছড়িয়ে ছন্নছাড়া ভঙ্গিতে বসে ঢুলছিলো তখন তাখলিফ। তমালিকা ছেলেকে দেখে একছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন। এরপর হু হু করে কেঁদে ওঠেন। তাখলিফ বিরক্তিতে বিড়বিড় করে কিছু বলে ওঠে। তমালিকা ছেলের মুখ মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করে সে কীভাবে এখানে এসেছে? উত্তরে তাখলিফ ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলে সে পুর্নবাসন কেন্দ্রে দু’জনকে মেরে এখানে পালিয়ে এসেছে।
তমালিকার সন্দেহ হতেই তিনি ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন নেশার এসব জিনিসপত্র সে কোথায় পেয়েছে তাহলে? তাখলিফ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে ওখানকারই একজন ওকে এসব দিয়েছে। বিনিময়ে তাখলিফ তাকে টাকা দেবে বলেছিলো। আর সে টাকা নিতেই ও পালিয়ে এসেছে। নামে পুর্নবাসন কেন্দ্র হলেও মূলত সব ধান্ধাবাজি। সব শুনে তমালিকা হতবিহবল হয়ে পড়েন৷ আবারও ধোঁকা? এবার আর ছেলেকে কোথাও পাঠাবেন না তিনি। যত যাই হোক, কষ্ট হলেও নিজের কাছেই রাখবেন আর ফিরিয়ে আনবেন সুস্থ জীবনে। তাখলিফ মাকে সরিয়ে দিয়ে নেশার জিনিসপত্রগুলো পকেটে ভরতে থাকে। তমালিকা সেগুলো নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারেন না। তাখলিফের তখন অত হুঁশজ্ঞান ছিলো না। তিনি ছেলের অবস্থা দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেন না। পুরোপুরি ভেঙে পড়েন ভেতর থেকে, কেঁদে ফেলেন। ইচ্ছেমতো ছেলেকে মারতে থাকেন। তাখলিফ সেই অবস্থায়ই নিজেকে রক্ষা করতে এদিকওদিক সরতে থাকে। তমালিকা ক্ষুদ্ধ হয়ে নেশার জিনিসগুলো ওর থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়, কিন্তু মা’কে সেগুলো দিতে চায় না তাখলিফ। সে টলমল পায়ে এদিকওদিক ছুটতে থাকে। তমালিকাও ধস্তাধস্তি করতে থাকে ছেলের সাথে।
বোঝনোর সুরে বলতে থাকেন, “তুই এসব করে নিজের জীবন ধ্বংস করছিস। এসব বাদ দে বাপ, সুস্থ জীবনে ফিরে আয়, তোকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন! তুই ভালো না থাকলে কবরে গিয়েও শান্তি পাবো না আমি, মায়ের কথা শোন বাবা। আমি তো…”
ধস্তাধস্তির এ পর্যায়ে মায়ের থেকে জিনিসগুলো বাঁচাতে নিজের অজান্তেই মা’কে দূরে সরানোর চেষ্টা করে, ধাক্কা দেয় তাখলিফ৷ এরপরের শব্দগুলো সেখানেই থেমে যায়। শুধু একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়। তাখলিফ বিচলিত হয়ে দেয়াল ধরে সামলে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছাদ থেকে মা’কে পড়ে যেতে দেখে তাখলিফ। মুহূর্তেই হতভম্ব হয়ে যায় সে। প্রথমে ব্যাপারটা চোখের ভুল ভেবে নিলেও পরবর্তীতে বাস্তব বুঝে ওর সারা শরীর কেঁপে ওঠে। পা মাটিতে শক্ত হয়ে আটকে যায় যেন। নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে। হাতে থাকা নেশাদ্রব্যের জিনিসগুলো মাটিতে পড়ে যায়। আচমকা পাখি বেগমকে সিঁড়ি দিয়ে আসতে দেখে টলমল পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলে, “মা পড়ে গেছে মেজোআম্মা। একটু দেখো না…”
তমালিকার ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে পাখি বেগম দেখতে এসেছিলো ব্যাপার কি! কিন্তু এই অসময়ে তাখলিফকে ছাদে দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে গেছেন।তার ওপর ওর মুখে এসব শুনে ঘাবড়ে যায়। বিস্মিত কন্ঠে শুধায়, “কি কও এসব? ভাবি কই? তুমি এইহানে কেমনে আসলা?”
তাখলিফ শুধু ধীর স্বরে বলে, “আমি মাকে সরালাম আর দেখালাম মা পড়ে গেছে।”
বলে ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়ে। পাখি বেগম ঘাবড়ে যায়। ছুটে গিয়ে তমালিকার অবস্থা দেখে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। মুহূর্তেই শোরগোল পড়ে যায়। পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় তমালিকাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছু সময় বেঁচে থাকেন তমালিকা। তীব্র শ্বাসটানেও শেষ মুহূর্তে নিজের ছেলের জন্যই যতচিন্তা করেন তিনি, স্বামীকে দিয়ে যান প্রাণপ্রিয় পুত্রের সব দায়িত্ব! এরপরই সব শেষ! একটা সময় কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তমালিকাকে মৃত ঘোষণা করেন। সকলে এই ঘটনায় মূক বনে যান। সানওয়ার হক স্ত্রীকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়েন। তাখলিফ হাসপাতালের প্যাসেজের মেঝেতে শুধুমাত্র নির্বাক হয়ে বসে ছিলো।দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো খুব করে। পাখি বেগম বড় জায়ের মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছিলো না৷ মানুষটা কি সুন্দর আগ্রহ নিয়ে ছাদে আচার আনতে গেলো, ফিরলো লাশ হয়ে! তিনি তাখলিফের দিকে ঘৃণাভরে তাকান। ওর ধৃষ্টতা সহ্য করতে না পেরে কাছে এসে থাপ্পড় মেরে বলেন, “মানুষটা তো মা ছিলো তোর…কেমনে পারলি? একটুও বুক কাঁপলো না তোর? তোর জন্য যে মানুষটা দিনদিন শেষ হয়ে যাচ্ছিলো তাকে ছাদ থেকে ফেলতে হাত কাঁপলো না? শুধু ওই নেশা করার জন্য? ছিঃ! পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট সন্তান তুই। কোনোদিনও তোকে ক্ষমা করবো না, খু’নি…”
সকলেই তার চিৎকার শুনে বাকরুদ্ধ বনে যান। পাখি বেগম কেঁদে কেঁদে সব খুলে বলে সবাইকে। তমালিকার বাপের বাড়ির লোকেরা খুব ক্ষেপে যায়। ভাগ্নের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে মামলা করে দেন তমালিকার বড়ভাই। মামলা হয়, পরবর্তীতে পুলিশ আসে। আত্ম’হত্যা নাকি হত্যা তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। পাখি বেগমের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কিশোর অপরাধী হিসেবে তাখলিফকে সন্দেহ করা হয়। কিন্তু বাড়ির সকলেই এর বিরোধিতা করে, কারোর বিশ্বাস হয় না পাখি বেগমে এই অভিযোগের কথা৷ তাখলিফ নিজের মাকে খুব ভালোবাসতো! যতই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকুক, যত ভালো কাজ বা অন্যায় করুক মাকে সে মারতে পারে না। সানওয়াক হক স্ত্রীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন। ছেলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ শুনে তিনি পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে পড়েন।
তাখলিফ অবশ্য নিজের পক্ষে কোনো সাফাই গায়
নি সেদিন। সে মাকে হারিয়ে বিমূঢ় হয়ে গেছিলো একেবারে। শূন্য মনে হচ্ছিলো সবকিছু। তীব্র অপরাধবোধ ওর হৃদপিন্ড, মন-মস্তিষ্ক রক্তাক্ত করে ফেলছিলো। পৃথিবীটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো, থমকে গেলো এক নিমিষেই! ওর তখন মনে হলো, সত্যিই তো! সে নিজেই তো মাকে মেরে ফেলেছে। ওর জন্যই তো সব, সে দায়ী। ওর উচিৎ শাস্তি পাওয়া, পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাস্তি, মাকে মেরে ফেলার মতো জঘন্য অপরাধের শাস্তি!
______________
বেশ কয়েকমাস তীব্র চেষ্টার পর আইনি ঝামেলা সেরে তাখলিফকে মুক্ত করা হয়। কেননা, পুলিশের হাতে শক্ত কোনো প্রমাণ ছিলো না ওর বিরুদ্ধে। তাখলিফ তখন মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধস্ত। ওর দিনটা আটকে ছিলো সেই ১৩ই সেপ্টেম্বরের ট্র্যাজেডিতে, মায়ের মৃত্যু দিনে। ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকেন সানওয়ার হক, কিন্তু যৌথ পরিবারে থেকে তা সম্ভব হচ্ছিলো না৷ রাত-বিরেতে তাখলিফের চিৎকার, মায়ের জন্য পাগলামি, আর নিজের ব্যর্থতা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো৷ ভেতরে সে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলো। এদিকে সবাই মানসিকভাবে তাখলিফকে সাহায্য করলেও ঠিক ওর মতো খু’নিকে বাড়িতে সহ্য করতে পারছিলেন না পাখি বেগম।
সানওয়ার হক বিচক্ষণ মানুষ। পাখি বেগমের মনের অবস্থা ধরতে বেগ পেতে হলো না তার৷ তাছাড়া ছেলের মানসিক অসুস্থতার জন্য পুরো পরিবারকে তিনি ভুগাতে চান নি। তাই সিদ্ধান্ত নেয় তাখলিফকে নিয়ে আলাদা থাকার। সবার আপত্তি স্বত্তেও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। সানওয়ার হক ছেলেকে সামলাতে নিজের চাকরি ছাড়লেন। ব্যবসায় ইনভেস্ট করলেন। সাইকোলজিস্টের পরামর্শ মতো ছেলের ট্রিটমেন্ট, থেরাপি চালাতে থাকেন। পড়াশোনাটা আবারও চালু করেন তাখলিফের। ওকে সুস্থ একটা জীবনে ফিরিয়ে আনতে কয়েকটা বছর লেগে যায় সানওয়ার হকের। শুধুমাত্র বাবার কারণেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বাধ্য হয় তাখলিফ! তার অভিশপ্ত জীবনে বাবা ছাড়া তাই আর কাউকে জায়গা দিতে চায়নি সে! অথচ প্রকৃতির অদ্ভুত নিয়মে তাকে খু’নি বলে মেনে আসা নারীর অতি আদরের ছোট মেয়েটিই তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। কি আশ্চর্য প্রকৃতির খেলা…
’
__
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। একটু অগোছালো, বুঝে নেওয়ার অনুরোধ রইলো।]
চলবে…