#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬
তাখলিফ মেইন ডোর লক করে ড্রয়িংরুমের সোফায় নাস্তা করতে বসলো। নোটিফিকেশনর শব্দে চোখ তুলে ম্যাসেজ পড়লো, “ডিভোর্স না দিয়ে মৃত্যু দিলে খুশি হবো।”
বহুদিন পর ম্যাসেজ পেয়ে তাখলিফ রাগে ফোনটা
সোফায় ছুঁড়ে মারলো, “তোকে মৃত্যুই দেবো
অফিসে যাবে না ভেবেও জিএম স্যারের কল পেয়ে অগত্যা তাখলিফকে যেতেই হলো। এমনিতে অফিস কামাই করে না, তবে মাঝেমধ্যে মন-মেজাজ খারাপ থাকলে যায় না ও। বাড়িতে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমুয়। অফিসের কাজের চাপ সামলে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে কি মনে করে স্ট্রিট ফুড নিলো। ও নিজে এসব খেতে পছন্দ করে না। কিন্তু বাড়ির অন্য সদস্যরা বেশ পছন্দ করে। দোতলা পেরুবার পথে একবার ঢু মারলো তাখলিফ। এই ফ্ল্যাটে ওর তেমন যাওয়া-আসা নেই, দাদীর জন্যই আসা হয়। খাবারের প্যাকেটগুলো প্রমিলার কাছে দিয়ে ড্রইংরুমে সাজেদা বেগমের কাছে গিয়ে বসলো ও। সাজেদা বেগমও নাতিকে কাছে পেয়ে গদগদ ভঙ্গিতে বেশ গল্প জুড়ে দিলেন। ঝুমুর নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিলো। তাখলিফের অস্তিত্ব টের পেয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে চুপিচুপি কান পেতে ওদের কথা শুনার চেষ্টা করলো। ওর বিবাহ বিষয়ক কথাবার্তা চলছে। ঝুমুর কান খাড়া করে ফেললো সাথে সাথেই! পর্দার নিচ দিয়ে দুটো সাদা পা দেখতে তাখলিফ হাফ ছাড়লো। গাধাটা বাড়ি ফিরেছে তবে, লুকিয়ে লুকিয়ে কথা গিলছে!
সাজেদা বেগম নাতিকে বললেন, “সব তো শুনলা নাতি। সম্বন্ধটা খারাপ না। আমাগো ঝুমুরও আগে থেইকা অনেক বুঝদার, সংসারী হইসে।”
সব শুনে তাখলিফ বিজ্ঞের ন্যায় মাথা নেড়ে বলল, “ভালোই তো। তোমাদের মনমতো হলে বিয়ে করিয়ে দাও। আমি কি বলবো!”
সাজেদা গদগদ ভঙ্গিতে বললেন, “আচ্ছা সে কথা যাক। তোমার লাগি বউ দেখমু নি? আমারও তো
ইচ্ছা করে নাতি বউয়ের মুখখানা দেখতে। কত আর একলা একলা থাকবা, জীবনে বউয়ের প্রয়োজন আছে।”
তাখলিফ চলে যাওয়ার জন্য ওঠে দাঁড়িয়েছিলো
মাত্র। দাদীর কথা শুনে কাষ্ঠ হেসে বলল, “মন্দ
হয় না।”
সাজেদা খুশি হয়ে বললেন, “মতিগতি ঠিক থাকলে আলহামদুলিল্লাহ।”
তাখলিফ চা না খেয়েই বিদায় নিয়ে চলে গেলো। নিশি সন্দেহী গলায় বলল, “ভাইয়া তো ভাজাপোড়া খায় না। আমাদেরও তো কত ধমকায়, আজ নিজে থেকেই আনলো যে এসব? ব্যাপার কী?”
তিথি সমুচা খেতে খেতে বলল, “ব্যাপার কিছু না। আনতে মন চেয়েছে তাই এনেছে। সবকিছুর পেছনে কারণ খোঁজা বন্ধ কর!”
নিশি ক্ষণবাদে বলে, “কারণ ছাড়া এই পৃথিবীতে
কিছুই ঘটে না। ভাইয়ারও নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। নয়তো এই লোক রাস্তার ধারের এসব ভাজাপোড়া জীবনেও আনবে না।”
ঝুমুর অবশ্য ধরতে পারলো ব্যাপারটা। ভাজাপোড়ার ছুঁতোয় হয়তো ঝুমুরের পছন্দের খাবার দিয়ে গেছে অথবা ও বাড়ি ফিরেছে কি-না তা দেখতে এসেছে! পর্দার আড়াল হতে বেরিয়ে এলো ও। মুখ শুকিয়ে আছে ওর। সাজেদা বেগম নিজের কাছে বসিয়ে আবারও গল্প জুড়ে দিলেন। কিন্তু বিবাহ বিষয়ক এত আলোচনা ঝুমুরের পছন্দ হচ্ছে না। কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাখলিফের জন্য মেয়ে দেখার প্রসঙ্গ ওঠাতেই সাজেদার কথার পিঠে পাখি বেগম রুক্ষ স্বরে বললেন, “আমার মনে হয় না এই ছেলে বিয়ে বা স্ত্রী’র মর্যাদা বুঝবে।”
সাজেদা বেগম বিরক্তি নিয়ে বললেন, “তোমার সমস্যাটা কি বউ? সবসময় ওর পিঠপিছে কথা কও!
চাচী হও তো নাকি? বেফাঁস কথাবার্তা কইয়া নিজের সম্মানডা হারাইও না।”
পাখি বেগম মুখ কালো করে ফেললেন। সরলসোজা এই মহিলাটি সবদিক দিয়ে ভালো হলেও নাতির বিপক্ষে সবসময় লেগে থাকে বলে সাজেদা বেগম প্রচন্ড বিরক্ত মেজো বউয়ের ওপর! ঝুমুর নিজেও মায়ের কথা শুনে হতাশ হয়েছে। তবে রাগ করে বললেও পাখি বেগমের কথা ঠিক। তাখলিফ বিয়ের মর্যাদা বা স্ত্রী’র মর্যাদা ইচ্ছে করেই বুঝতে চায় না। ভাবনায় মত্ত ঝুমুর। এদিকে সবাই আগ্রহ নিয়ে ঝিনুকের দেবরের সাথে ঝুমুরের বিয়ের প্রস্তাবটা তুলেছে আবার। কথাবার্তা এগিয়ে গেলো, ঝুমুর শুধু চুপচাপ বসে শুনলো। কিন্তু আড়ালে ভিজে যাওয়া চক্ষুদুটো কেউ দেখলো না। মন পুড়ার গন্ধটাও কেউ টের পেলো না।
গভীর রাত! ঝুমুরের ভীষণ মন খারাপ লাগছে, চোখে ঘুম নেই। ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো। ম্যাসেজ দেবে কিনা ভাবলো! দোটানা কাটিয়ে লিখলো, “আমি কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করবো না ”
সিন হলো দীর্ঘক্ষণ পর, উত্তরও এলো না। ঝুমুর
আবার লিখলো, “সত্যি বলছি কিশোরীর আবেগে
নয়, একজন স্ত্রীর মতোই ভালোবাসি আপনাকে।”
________________
গোধূলির শেষভাগ। আকাশে জমেছে কালো মেঘ। সাদা বকের দল ডানা মেলে ওড়ে বহুদূর পথ পাড়ি দিচ্ছে। দৃশ্যটি সুন্দর! একেবারে মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু ঝুমুরের মন ভালো নেই। ইচ্ছে করেই সে পাষাণ লোকটাকে ম্যাসেজ দিচ্ছে না দু’দিন ধরে। খোঁজও নিচ্ছে না। একতরফা ভালোবাসা কতটা কষ্টদায়ক তা হারে হারে টের পাচ্ছে সে। কয়েকটা বছর আগেও দিনগুলো এমন ছিলো না। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ঝুমুর চঞ্চল হলেও বোকা ছিলো খুব। খেলাধুলা করাটাই ছিলো ওর প্রধান
লক্ষ্য, তেমনি পড়াশোনায় ছিলো গোল্লা। টেনেটুনে পাশ করাটাই ছিলো ওর কাছে স্বস্তির বিষয়। প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে নামক সম্পর্কের মানে পুরোপুরি বোঝার আগেই একটি দুর্ঘটনায় বাঁধাপড়ে যায় সে তাখলিফের সাথে।ছোট থেকে ভাই বলে মেনে আসা মানুষটাকে হুট করে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়ার ব্যাপারটা প্রচন্ড কষ্টদায়ক ছিলো। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন সবকিছু বোঝার ন্যায় সক্ষম হলো, তখন থেকেই ঝুমুরের মনটা স্থির হয়ে গেলো এক পুরুষে। প্রেমিক পুরুষ বা স্বামী, চোখ বন্ধ করলে এই তাখলিফের চেহারাটাই ভেসে ওঠতো ওর মন-মস্তিষ্কে। এরপর কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একদিন! নিজের অনুভূতি, মনের কথা চাপা না রাখতে পেরে চিরকাল ভাই বলে জেনে আসা লোকটার কাছে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রেম নিবেদন করেছিলো ঝুমুর। সেদিন অবশ্য এক চড়ে ওর ফর্সা গাল লাল করে দিয়েছিলো তাখলিফ। রাতে জ্বর এসেছিলো ঝুমুরের, প্রেমের জ্বর! চড় খেয়ে অবশ্য ওর ভয়টা সেবার কেটে গিয়েছিলো। এরপর যতবার তীব্র অধিকারবোধ নিয়ে তাখলিফকে নিজের অনুভূতি জানাতো, তাখলিফ বিস্মিত হলেও আর কখনো হাত তুলতে পারেনি ওর গায়ে। পাগল বলে দূরছাই করতো ঝুমুরকে! জানালার পাশে বসে এসব ভাবতে ভাবতে হেসে ফেললো ঝুমুর। আনমনে বলে ওঠলো, “জ্বর হলে রাত তিনটায় ফার্মেসি ওয়ালাকে মেরে ঔষধ এনে দেওয়ার দিনটা ভুলি নি এখনো। তিথি যেদিন অজ্ঞান হয়ে
গেছিলো সেদিন তো এমন করেন নি! এরপরেও বলেন
বউ ভাবি না? মিথ্যুক।”
বৃষ্টি শুরু হয়েছে বাইরে। ঝুমুরে লোভ হলো বৃষ্টিতে ভেজার। মাথার ওড়না ঠিকঠাক করে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপিসারে ছাদে চলে এলো সে। পাখি
বেগম দেখতে পেলে অবশ্য ওকে উত্তম-মধ্যম দিতো।
___________________
অফিস থেকে ফিরে চেঞ্জ করে ছাদে এসেছিলো তাখলিফ। কালচে অন্ধকার আকাশ আর বৃষ্টিভেজা কামিনীর সুঘ্রাণ তার বড়ই প্রিয়। ছাউনির নিচে বসে কফি খেতে খেতে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা উপভোগ করছিলো সে। তখনি গেইটের কাছে শব্দ হলো। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই দেখলো ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা নারীমূর্তিটিকে। চারপাশের টিমটিমে হলদে আলোয় অবশ্য চিনতে ভুল হলো না ওর
এই মানবীকে৷ খেঁকিয়ে ওঠে বলল, “মাথা খারাপ হয়েছে তোর? এই অসময়ে এখানে কি করছিস?”
ভয় পেয়ে প্রায় লাফিয়ে ওঠলো ঝুমুর। ভয়ার্ত চোখে পিছনে তাকাতেই লম্বা-চওড়া দেহের তাখলিফকে নজরে পড়লো ওর। ধরা পড়ে দু’মিনিট স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ও। তাখলিফ হনহন কাছে এসে টেনে ছাদ থেকে বের করে
দিতে দিতে ধমকে বলল, “বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধানোর মতলব? যা নাম।”
সিঁড়িঘরের হলদে আলোয় ঝুমুক তখন তাখলিফকে
হতভম্ব করে দিয়ে জাপ্টে ধরলো ওকে। কথা না
বলার প্রতিজ্ঞা ভুলে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
“না, যাব না।”
তাখলিফ ওর কান্ডে বিস্ময়াভূত হয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “দিন দিন নির্লজ্জ হচ্ছিস। ছিঃ ছিঃ। বেহায়া মেয়ে, একটুও লজ্জা নেই।”
ঝুমুর নির্বিকার কন্ঠে বলল, “আপনার জন্য বেহায়া
হয়েছি। আপনিও ছিঃ ছিঃ’র ভাগীদার।”
তাখলিফের ইচ্ছে করলো এক থাপ্পড়ে এই মেয়ের সব আক্কেল জ্ঞানহীনতা মনে করিয়ে দিতে। ও দূরছাই
করে এক ঝটকায় ওকে সরিয়ে দিলো। ঝুমুর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কড়া চাহনি নিক্ষেপ করে ছাদে চলে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। আবছা অন্ধকারে ওর একটুও ভয় করলো না৷ তাখলিফ সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো। কাছে গেলে আবার না জাপ্টে ধরে এই দ্বিধাবোধ থেকেই সে আর গেলো না। মনে মনে একশো একটা গালি আওড়ে বলল, “শালা, শান্তিতে ম’রতেও দিবি না তুই।”
কিন্তু পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেলো। বৃষ্টির এই সন্ধ্যেতে লাস্যময়ী ঝুমুরকে দেখতে ওর মনের কোণে কোথাও একটা ভালোলাগা জ্বলে ওঠলেও দপ করে নিভিয়ে ফেললো সে নিজেই। মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে একপ্রকার জোর করেই ঝুমুরকে টেনে সরিয়ে আনলো। তবে সিঁড়িঘরে আসতেই দেখতে পেলো, পাখি বেগম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দু’জনের দিকে!
_______
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কবে, কখন,
কি পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছিলো সেটা এখনো
খোলাসা হয়নি। তাই একটু ধৈর্য্য ধরুন।]
চলবে…