#অতঃপর_তুমি_আমি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৮
‘আম্মু এই ছোট্ট পুতুলটা আমার না!বলো না।’
শেহতাজ শেখ দশ বছরের বাচ্চা শেহজাদের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠেন।সাথে হেসে উঠে খান পরিবার আর শেখ পরিবারের সবাই।শেখ পরিবারের ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আছে।বাচ্চা শেহজাদ পুতুলটাকে নিজের কাছে নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে।একবার আব্বু একবার আম্মু,তো একবার মামা মামির কাছে যাচ্ছে।শেহজাদের কান্ড দেখে মাহিম হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
‘আব্বু তোমার কি লাগবে এই পুতুলটাকে’
‘আম্মু এই পুতুলটা তো আমারই।আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করেছি। ও শুধু আমার।মাহিমের সাথেও খেলতে দিবো না ওকে।আমার সাথে খেলবে ও।আমি বিয়ে করবো ওকে’
মায়া বেগম ছোট্ট শেহজাদের কথা শুনে হেসে ফেললেন।মাহিম রাগি রাগি চোখ করে শেহজাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তোর মতো পচা ছেলের হাতে আমি আমার বনুকে দিবো না।ওর জন্য তো রাজপুত্র আনবো।রাজপুত্র চিনিস তো!তোকে তো একটা বিলাইয়ের মতো লাগে’
‘মাহিমের বাচ্চা বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।ওয়ামিয়ার রাজপুত্র আমি হুহ।ও আমার বউ ই হবে’
‘দেবো না বিয়ে আমার বনুকে তোর সাথে কি করবি’
‘দুনিয়া উল্টে ফেলবো’
ছোট্ট শেহজাদের কথায় উপস্থিত থাকা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো।একে অপরের দিকে তাকা তাকি করলো।এমন কথা কিভাবে শিখলো শেহজাদ বুঝলো না কেউই।মুনতাসিব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললেন,
‘ঠিক আছে আব্বু পুতুলটা তোমার।মাহিম কিছু বলবে না তোমাকে’
‘ও বললেও কি না বললেও কি।ওয়ামিয়া তো আমার বউ।ছোট্ট পুতুল’
শেহতাজ শেখ একটু চিন্তিত হলেন।এতো ছোট বাচ্চা এভাবে কথা বলছে।তার উপর ওয়ামিয়া মাত্র এক মাসের বাচ্চা।শেহজাদ দৌড়ে শেহতাজের কাছে আসে।নিচু হয়ে ছোট ছোট কতগুলো চুমু দিলো ওয়ামিয়ার গালে।ছোট ওয়ামিয়া বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকালো।শেহতাজ হাসলো দুজনের কান্ড দেখে।এক মাসও হয়নি এখন থেকেই শেহজাদ পাগলামি করছে ছোট্ট মেয়েটার জন্য।বড় হলে কি করবে ভেবে পেলো না শেহতাজ।তবে তিনি ভীষণ খুশি ওয়ামিয়াকে পেয়ে।মনে মনে ঠিক ও করে ফেলেছেন ওয়ামিয়াই হবে শেহজাদের বউ।
*****
‘ভাই মামু জিতে গিয়েছে নির্বাচনে।তৃতীয় বারের মতো আবারও সেই চেয়ারম্যান হলো’
শেহজাদের ঘোর কাটলো।অতীত থেকে ফিরে আসলো সে।সে এতো সময় ছোটবেলার কথা ভাবছিলো।হাতে থাকা সেদিনের ছবিটা পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলো যত্ন করে।নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
‘হ্যাঁ আব্বু আর ফুপি কোথায়?’
‘সবাই তো বাড়িতে ভাই।আপনি এখানে কেনো বসে আছেন।বাড়িতে চলুন ভাই’
শেহজাদ তাকালো বাড়িটার দিকে।এই বাড়িতে সে কতই না দুষ্টমি করেছে।ওয়ামিয়াকে জ্বালিয়েছে।মাহিম আর সে খেলেছে।এই বাড়িতেই তো তার শৈশব কেটেছে।তবে বাড়িটা পরিত্যক্ত এখন।এ বাড়িটাতে কেউ থাকে না।পাঁচ বছর আগেই বন্ধ হয়েছে এ বাড়ির দরজা।আজ খুললো শেহজাদ।এই দিনটাকে ভীষণ ভয় পায় শেহজাদ।কারণ এই দিনে সে সব থেকে প্রিয় জিনিস হারিয়েছে।নির্বাচন!
‘চলো ইফাজ’
দু’জন বাড়ি থেকে বের হলো।শেহজাদ একবার চোখ বুলিয়ে নিলো বাড়িটায় আবার।বাড়িটার আনাচে কানাচে ওয়ামিয়ার স্মৃতি রয়েছে।দরজা লাগিয়ে আগের মতো নিজেকে শক্ত করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।দুটো বাড়িই পাশাপাশি।একটা শেখ বাড়ি আরেকটা খান বাড়ি।তবে শেখ বাড়ি এখন আর শেখ বাড়ি নেই।এখন পরিত্যক্ত বাড়ি এটা।
বাড়ির সামনে আসতেই দেখলো সবাই হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত।তরুন ছেলেরা সব আনন্দ উল্লাসে মেতে আছে।শেহজাদ বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।মুনতাসিব খান সোফায় বসে আছেন।তবে চোখে মুখে খুশির রেশ নেই।মেহবুবা খান ভীষণ খুশি।শেহজাদকে দেখা মাত্র ছুটে আসেন।
‘আব্বু চল মিষ্টি খাবি।ভাইজান জিতে গিয়েছে।তৃতীয় বারের মতো চেয়ারম্যান হয়েছে’
‘ফুপি আমার ভালো লাগছে না আমি উপরে রুমে যাচ্ছি’
শেহজাদ হাঁটা ধরলো।ইফাজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।সে শেহজাদের থেকে ৪ বছরের ছোট।তবে ভাইকে ভীষণ ভালোবাসে।সম্মান করে।কখনো তুমি তো কখনো আপনি বলে ফেলে।এতে অবশ্য বকাও খায় ভীষণ শেহজাদের কাছে।মেহবুবা খান এগিয়ে আসেন ছেলের দিকে,
‘কিরে ইফাজ শেহজাদের কি হইছে।’
‘আম্মু শেখ বাড়িতে গিয়েছিলো ভাই।এমন একটা দিনেই তো মামী….!’
‘নিজের রুমে যা’
ইফাজ এক পলক মেহবুবা খানের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো রুমে।মেহবুবা খান চোখ মুছলেন।সে থাকলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো।সে থাকলে হয়তো আজ অন্যরকম হতো।ওয়ামিয়া মেহেনাজ এখন এখানে থাকতো।নিজের অধিকার নিয়ে।এই বাড়ির একমাত্র বউ হয়ে।তা এখন হওয়ার নয়।শেহজাদকে ভালো করেই জানেন তিনি।অশান্তি চায় না সে।তবুও যখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না তখন কি হবে!শত বাঁধা বিপত্তি থাকলেও সে ওয়ামিয়াকে নিজের কাছে আনবে।সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে সে কখনোই চুপ হয়ে বসে থাকবে না।চিনেন সে।সিংহ শান্ত আছে।যখন হিংস্র হবে তখন চারপাশ কাঁপবে।
*****
ওয়ামিয়া অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে পড়ার টেবিলে।পরীক্ষার আর একমাস বাঁকি।পড়াতে মন বসাতে চাইলেও মন বসাতে পারছে না।তার মন, মস্তিষ্ক জুড়ে যে শেহজাদ ইমতিয়াজ খানের বসবাস চলছে।ওয়ামিয়া কিছুতেই বের করতে পারছে না মাথা থেকে শেহজাদকে।আজ সারাদিনই বাড়িতে ছিলো।এই দিনে বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ তার জন্য।তার জন্য বরং শেখ পরিবারের সবাই এই নির্বাচনের দিনে বের হয় না।
ওয়ামিয়া জানে তার আব্বুজান এখন কি করছে।রুমে দরজা বন্ধ করে বোনের ছবি নিয়ে বসে আছে।এমন একটা দিনেই তো হারিয়েছে নিজের বোনকে।ওয়ামিয়া জানে হুমায়ন শেখ শেহতাজ শেখকে ভীষণ ভালোবাসে।নাহলে কি আর বেস্টফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্ক শেষ করতে পারো।তাও এতো বছরের।
‘আমাকে সেই ডাইরিটা বের করতে হবে।ফুপুআম্মুর প্রেম কাহিনী জানতে হবে যেভাবেই হোক।’
ওয়ামিয়া কিছু একটা ভাবলো।আগামী কাল যাবে সে সেই জায়গায়।সেখানে গেলেই ডাইরিটা খুঁজে পাবে।ফুপু আম্মু তার জন্য নাকি সেখানে অনেক কথা লিখেছে।তাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে।অজিফাকে মেসেজ করার জন্য ফোন হাতে নিলো।ফেসবুকে ঢুকতেই শেহজাদের একটা পোস্ট সামনে আসলো।পোস্টটা দেখে ওয়ামিয়ার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলেও নিচের কমেন্ট গুলো দেখে নিমেষেই ঠোঁটের কোনের হাসিটা মিলিয়ে গেলো।
ভীষণ রাগ লাগছে।তার শেহজাদ ভাইয়ের ছবিতে কেনো মেয়েরা হ্যান্ডসাম,কিউট,ওয়াও লিখবে।এগুলোই যথেষ্ট ছিলো ওয়ামিয়ার রাগ উঠাতে।ওয়ামিয়া ফেসবুক থেকে বেরিয়ে গেলো।রাগ লাগছে।এখন যদি সামনে শেহজাদকে পেতো কতগুলো কথা শুনিয়ে দিতো।
‘এতে সুন্দর সুদর্শন কে হতে বলেছিলো।লুচু মেয়ে গুলো সব আমার শেহজাদ ভাইয়ের দিকে নজর দেয়।’
কিছু একটা মনে আসতেই নিজের উপরেই তাচ্ছিল্য হাসলো ওয়ামিয়া।বিড়বিড় করে উদাস মনে বলল,
‘আদেও কি সে আমার!’
********
‘আব্বু আসবো’
শেহজাদ আনমনে বলল,,’এসো ফুপি’
মেহবুবা খান রুমে ঢুকে লাইট জ্বালালো।রুমের অবস্থা ভালো নাহ।শেহজাদ বিছানার এক কোনে মাথা নিচু করে বসে আছে।মেহবুবা খানের খারাপ লাগলো।ছেলেটা কেমন উদাস হয়ে পরেছে।সে কি তবে হার মানতে চাইছে?মেহবুবা খান শেহজাদের পাশে বসেন।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
‘আব্বু তোর কি খারাপ লাগছে’
শেহজাদ জড়িয়ে ধরে ফুপিকে।মেহবুবা চমকায়।আজকের দিনে যে কষ্ট হবে শেহজাদের তা আগে থেকেই জানতেন।পাঁচ বছর আগে যে এমন একটা দিনে সে হারিয়ে ছিল নিজের সব থেকে প্রিয় মানুষকে।সেই ভয়ংকর রাতের কথা এখনো মনে আছে মেহবুবার।শেহজাদকে সেদিন কাঁদতে দেখেনি মেহবুবা।হাজার বলার পরেও সেদিন শেহজাদের চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পরেনি।তারপর থেকে পাথরে পরিনত হয়েছে শেহজাদ।
‘আব্বু খারাপ লাগছে’
‘নাহ ফুপি আম্মুকে মনে পরছিলো শুধু আর কিছুই না।আব্বু খেয়েছে?’
‘হ্যাঁ আব্বু।ভাইজানকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছি।চলো খাবে চলো।অনেক রাত হয়েছে’
‘আমার ক্ষুধা নেই ফুপি।’
মেহবুবা খান কথা না বলে বের হয়ে যায় রুম থেকে।ফিরে আসেন খাবার নিয়ে।ছেলে বড্ড অনিয়ম করে খাওয়া দাওয়ায়।সাথে ইফাজও আসে।ধপ করে বসে পরে সোফায়।শেহজাদ শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় ইফাজের দিকে।ইফাজ মাথা চুলকে হাসে।
‘ভাই এভাবে তাকাচ্ছো কেনো?’
‘ইফাজ তুমি হয়তো আমাকে আপনি বলো না হয় তুমি।যেকোনো একটা বলো’
‘ভাই আপনাকে সম্মান করেই তো আপনি বলি’
‘তাহলে আর তুমি বলবে না’
‘তুমি না বললে পর পর লাগে’
‘ইফাজ পাগল বানিও না আমায়’
ইফাজ দাঁত বের করে হাসে।সে মূলত এখন শেহজাদকে হাসাতে চাইছে।শেহজাদের যে মনটা খারাপ তা ভালো করেই জানা।তবে এখন আর দুষ্টুমি করলো না।রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।মেহবুবা খানও খাইয়ে দিয়ে শেহজাদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমাতে বলে চলে গেলো।শেহজাদ দরজা লক করে আসলো।স্মৃতি গুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তাকে।শেহজাদ বাঁকা হাসে কিছু একটা ভেবে।তবে সে যেমন দেখায় আদেও কি সে তেমন?
#চলবে ইনশাআল্লাহ,,