#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ষোল
নিজের বরকে প্রতিনিয়ত অন্য একটা মেয়ের জন্য কষ্ট পেতে দেখাও যে কোনো স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব না। তারিনের পক্ষেও সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাই মুখে যা আসছে বলে দিয়েছিলো। বাসায় আসার পর গোটা একটা দিন কেটে গেছে তবুও তারিন তামজিদের দিকে ফিরে অব্দি তাকায়নি। কথা তো একদম না। বর্ষা বেগমের সাথেও বেশ কড়া কন্ঠে কথা বলেছে আজ। বাড়িতে একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। সবকিছু মিলিয়ে দিনশেষে রাতের অন্ধকারে তারিন নিজেকে বড্ড ক্লান্ত অনুভব করলো। সবকিছুর সাথে মোকাবিলা করতে করতে মানুষ বুঝি দিনের শেষেই ক্লান্ত হয়ে উঠে! বিছানায় সুয়ে আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনায় মগ্ন থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের ও মনে নেই। হুট করেই ঘুমের চোখে তারিন টের পেলো কেউ ওকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর পেট কেউ শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। মুহূর্তেই অস্বস্তি নামক শব্দ গুলো তারিনকে আষ্টেপৃষ্টে ধরলো। ভয় নামক জিনিসটাও ছুঁয়ে গেলো হৃদয়। এই সময় কে জড়িয়ে ধরবে? কাঁদবেই বা কেনো? মাস্টার মশাই! নামটা মনে উঠতেই ফট করে চোখে খুলে ফেলল। আবছা আলোয় স্পষ্ট তামজিদের মুখখানা দেখতে পেলো। তারিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে মানুষটা। কেনো কাঁদছে? ছেলেরা এমন ফুঁপিয়ে কাঁদে বুঝি? কি জানি? তারিন অবাক আর বিস্ময়ে রোবটের ন্যায় শক্ত হয়ে আছে। কি হচ্ছে এসব? স্বপ্ন দেখছে? কই নাতো? সবটা সত্যি মনে হচ্ছে। মাথায় এমন হাজারখানেক প্রশ্ন, চিন্তা ঘুরতে শুরু করলো। নাহ! আর চুপ করে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তারিন এবার তামজিদকে দুই হাতে ঠেলে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল,
“এ কি! মাস্টার মশাই! কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেনো? দেখি, উঠুন। শরীর খারাপ করছে? কিছু হয়েছে? সবাই ঠিক আছে? মা, ঠিক আছে? বলুন না।”
তামজিদ চুপ করে আছে আগের মতো। তারিন ঠেলে তুলতে চাইলে ও আরো শক্ত করে প্যাচিয়ে ধরল তারিনকে। এবার তারিন তামজিদের বুকের মাঝে আটকে গেলো। হুট করেই তারিনের হৃদযন্ত্রটা ধড়ফড়িয়ে উঠল। ঢিপঢিপ শব্দ করে বাজতে শুরু করলো। আজকে কি তারিনের স্বপ্নের রাত? সব কিছু এমন স্বপ্নের মতো করে কেনো হচ্ছে? তারিন নড়াচড়া বন্ধ করে দিলো। তামজিদের চোখের পানি গড়িয়ে তারিনের পড়ছে। এভাবে তামজিদকে কাঁদতে দেখে এক আকাশসম কষ্ট তারিনের হৃদয়ে হানা দিলো। আজকে কি তবে বেশি বলে ফেলেছিলো? মানুষটা তো সত্যিই দিশাকে ভালোবাসতো। আর সত্যিকারের ভালোবাসা ভুলে যাওয়া এত সহজ না_____সেটা তারিন জানে। সব জেনেও মেয়েটা স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভেবেছে। তারিন নিজের ভাবনা চিন্তা সাইডে রেখে, কাঁপা-কাঁপি স্বরে প্রশ্ন করল,
”কি হয়েছে আপনার?”
তামজিদ এবার মুখ খুলল। কান্নারত স্বরে বলা শুরু করল,
“তারিন, আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। না, দিশা চলে গেছে, সে জন্য না।”
তারিন এবার অবাক স্বরে প্রশ্ন করল,
“তাহলে কিসের জন্য?”
“তোমার জন্য।”
তামজিদ এমন সরল বাক্যে তারিন অবাকের শেষ সীমানায় চলে গেলো। অবিশ্বাস্য স্বরে প্রশ্ন করে বসল,
“আমার জন্য! আমার জন্য কেনো কষ্ট হবে?”
তামজিদ এবার ছেড়ে দিলো তারিনকে। উঠে বসে পড়ল। তারিনকেও টেনে উঠালো। নিজের হাতের মুঠোয় তারিনের হাত দুটো নিলো। অনুরোধ বাক্যে বলে উঠল,
“তারিন, আমাকে ছেড়ে যেও না। প্লিজ, ছেড়ে যেও না।”
বিস্ময়ে তারিনের চোখের পাতা পড়ছে না৷ মনে মনে ভাবছে, ‘দিশার শোকে তামজিদের মাথাটা খারাপ হয়ে যায় নি তো?’। এমন আজগুবি ভাবনা মাথায় আসছে বলে মনে মনে নিজেকেই ঝাড়ি দিলো। শান্ত বাক্যে তামজিদের উদ্দেশ্যে বলল,
“কি বলছেন এসব?”
তামজিদ উত্তর দেওয়ার জন্য সময় নিলো না। শান্ত স্বরেই বলা শুরু করল,
“তুমি খুব বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে। আমি যা বলি মন দিয়ে শোনো। হ্যাঁ, আমি মানছি আমি দোষী। কিন্তু তুমি আমার জায়নায় নিজেকে বসাও তো। কি করতে তুমি? নিজের মৃত্যু পথযাত্রী মাকে ছেড়ে ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে চলে যেতে?”
“কখনোই না। যে মা আমাকে জন্ম দিয়েছে। পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে। আদর, যত্নে বড় করে তুলেছে। সেই মায়ের শেষ সময় তাকে ছেড়ে যাওয়ার মতো পাপ কেনো করবো?”
তামজিদ এবার হাস্যজ্বল বাক্যে বলল,
“তাহলে আমাকে কেনো বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক, কাপুরুষ বলছো? আমি কি চেষ্টা করিনি?”
তারিন চুপ হয়ে গেলো। সত্যিই তো! তামজিদের জায়গায় তামজিদ অবশ্যই ঠিক। তামজিদ পুনরায় তারিনকে প্রশ্ন করল,
“ধরো, তুমি এখন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তুমি একদম মনেপ্রাণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে আমাকে ছেড়ে যাবেই। তখন কি আমি হাজার চেষ্টা করেও তোমাকে ধরে রাখতে পারবো? তুমি যদি নিজের থেকেই আমার কাছে থাকতে না চাও, তাহলে আমি কি করে রাখবো?”
তারিন এবারো চুপ। তামজিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রশ্ন করল,
“ভালোবাসা কাকে বলে, জানো?”
তারিন প্রশ্নোত্তর চোখে তাকালো। কিছু বললো না। তামজিদের যা বুঝার তা বুঝা হয়ে গেছে। বুঝমান স্বরে বলা শুরু করল,
“ভালোবাসা হলো দুটি মনের মিল বন্ধন। বিশ্বাস, মায়া, অভিমান, অভিযোগ, রাগের সম্মেলনে এ বন্ধন টিকে থাকে। তুমি যদি কাউকে শুধু ভালোবাসো, তাহলে চেষ্টা করলে তাকে কোনো এক সময় ভুলে যেতে সক্ষম হবে। ভালোবাসা ভয়ানক। তবে তার থেকেও বেশি ভয়ানক ‘মায়া’। কারোর মায়ায় যখন তুমি মারাত্নক ভাবে জড়িয়ে যাবে তখন তুমি তাকে সহজে ভুলতে পারবে না।”
তামজিদ থামলো কিছুসময়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বলা শুরু করল,
“ দিশার সাথে আমার বন্ধুত্ব অনেক বছরের। বন্ধুত্ব শব্দটা মায়ার উপর ভিত্তি করেই টিকে থাকে। ভালোবাসার কয়েকটা মাস সাইডে রেখে, তুমি বন্ধুত্বের বছরগুলোর হিসেব করো। এত বছরের মায়া তুমি এই কয়েকদিনের কাটিয়ে উঠতে পারবে, তারিন? তোমরা এলোমেলো জীবনটা এত সহজেই গুছিয়ে নিতে পারবে? তোমাকে কে বললো আমি দিশাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি না? চেষ্টা করছি বলেই তোমাকে সহজেই মেনে নিয়েছি। যদি চেষ্টা না করতাম তাহলে তুমি আমার আদর, যত্ন, স্নেহের থেকে বঞ্চিত হয়ে যেতে। আমার মন থেকে দিশাকে ভুলিয়ে দেওয়া তোমার কাজ। তুমি আমার স্ত্রী। তোমার স্বামীকে কি করে সম্মান, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবে এসব তোমার ভাবা উচিত। তুমি নিজে কি এই কয়েকদিনে আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছো? আমাকে কাছে টানার চেষ্টা করেছো? করো নি। শুধু অভিযোগ করে গেছো। নিজের স্ট্রং ব্যক্তিত্ব দেখিয়ে গেছো। নরম তারিনকে দেখাও নি। আমার আর তোমার বয়সের প্রার্থক্যটা একবার দেখো। তোমার অনুভূতি গুলো সদ্য জন্ম নিবে। আর আমার অনুভূতি গুলো বড্ড পুরানো। তাই আমার অনুভূতির মায়াটাও বেশ শক্তপোক্ত। এত সহজে এই অনুভূতির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না তারিন।”
তারিন ছলছল চোখে তামজিদের দিকে তাকালো। তামজিদ মুচকি হাসলো। মেয়েটার ভেতরের নরম ব্যক্তিত্বকে কি সুন্দর যত্নে লুকিয়ে রাখে! এটাও একটা প্রশংসনীয় গুণ! কয়জন পারে নিজের কোমলতা, দূর্বলতা লুকিয়ে রাখতে? যে পারে সে নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। কারণ, যে মানুষ যত বেশি নরম, সে মানুষ তত বেশী অবহেলীত। তামজিদ আলতো করে তারিনের দুই গালে হাত রাখলো। তারিনের চোখে চোখ রাখলো সংগোপনে। আলতো স্বরে বলতে লাগলো,
“শোনো মেয়ে, আমি তোমার স্ট্রং ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়তে চাই না। আমি চাদের মতো কোমলবতী তারিনের প্রেমে পড়তে চাই। স্নিগ্ধ, সতেজ বাচ্চা মেয়েটাকে নিজের হাতে আমার উপযুক্ত করতে চাই। অতীত ভুলে যেতে চাই। আমার ঘরের চাঁদকে আমার বুকে যত্ন করে লুকিয়ে রাখতে চাই। যেনো আমি ছাড়া সে চাদের গায়ে আর কারোর নজর না লাগে। ভালোবাসতে চাই তোমাকে । ভালোবাসবে আমাকে? তুমি নামক চাদের দাগ হতে চাই আমি। সে চাদে আমি ব্যতিত দ্বিতীয় কোনো দাগ লাগার সুযোগ দিবো না, প্রমিস। একটু ভালোবাসবে আমাকে? তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমার যন্ত্রণা গুলো ভুলিয়ে দিবে, প্লিজ।”
তারিন কাঁদছে। কেউ এতটা আবদারের সুরে ভালোবাসা চাইতে পারে? শক্তপোক্ত বয়সের ম্যাচুর মানুষটা এভাবে বাচ্চাদের কতো আবদার করছে। তারিনের হাসিও পাচ্ছে বেশ। আনন্দ লাগছে। মানুষটাকে নিজের মতো গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা করলো। তামজিদ তারিনের কোলে মাথা রাখলো। তারিনের হাত দুটো ধরে নিজের মাথায় রাখলো। অসহায় স্বরে বলল,
“আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে, প্লিজ। আমি না আর পারছি না। কষ্ট হচ্ছে আমার। বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আমাকে ছেড়ে সবাই চলে যাচ্ছে। দিশা চলে গেছে। মাকেও কয়দিন কাছে পাবো ঠিক নেই। মাও সময়ের অতলে হারিয়ে যাবে। আমাকে এতিম করে দিয়ে চলে যাবে। তুমি অন্তত আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ। তোমরা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁঁচবো? কাদের আশায় বাঁচবো? প্লিজ যেও না।”
তারিন তামজিদের আকুতি দেখে, স্বান্তনা বানীতে বলল,
“যাবো না। কোথাও যাবো না, মাস্টার মশাই। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই। তবে মায়ের ভুল ধারণাটা আমি বদলাবোই। মাকে অন্তত এই ভুল ধারণা নিয়ে মরতে দিবো না। তাহলে সারাজীবন মায়ের প্রতি আপনার, আমার, দিশা আপু তিনজনের অভিযোগ থেকে যাবে৷ সেটা আমি কিছুতেই হতে দিবো না। আমি সবাইকে নিয়ে সুখে সংসার ও করবো, নিজের স্বপ্ন ও পূরণ করবো। আজ থেকে আমার স্বপ্নের পথ চলা শুরু। আমার সেই পথচলার সঙ্গী হিসেবে আপনাকে পাশে চাই। থাকবেন, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ তারিনের হাতে হাত রেখে দৃঢ় স্বরে বলে উঠল,
“ইন শা আল্লাহ। যতদিন বেঁচে আছি তোমার পাশে থাকবো।”
তারিন শান্তিতে চোখ দুটো বুঝে নিলো। অবশেষে দুষ্টু, মিষ্টির খুনশুটিতে ভরপুর সংসার শুরু হতে চলেছে। এতদিন পর নিজের চাওয়া, পাওয়া পূরণ হতে চলেছে। এতসব কিছু ভাবার মাঝে, নিজের মনে মনে বলে উঠল,
“যতদিন না আপনি আমাকে ভালোবাসতে পারবেন, ততদিন তারিনও আপনার কাছে ধরা দিবেনা। একদম দিবেনা। উঁহু! আপনি নিজের থেকে যেদিন আমার কাছে ধরা দিবেন, সেদিন তারিন আপনার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিবে। ততদিন তারিন নামক ঝাঁঝালো চাঁদকে সহ্য করতেই হবে। কাল থেকে আপনার আর আমার৷ নতুন যুদ্ধ শুরু হবে।”
#চলবে
[আমার মতো মন ভুলো মানুষ একজন ও নেই। বিশ্বাস করুন কাল গল্প লিখে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু আপলোড দিতে ভুলে গেছি🙂]
Story ta khub valo legeche…khub sundor vabe choritro gulo tule dhorechen
Next part kobe pawa jabe?
Khob taratari ♥️
Ok, Thank You So Much
Apuuu kobe pabo go 🥹
Sorry peye gechi
1st a aschilo na