#মোহ_মায়া
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_ ৭
বাড়ির প্রতিটি জিনিসের উপর নিজের রাগ ঝেড়ে নিজের রুমে ফ্লোরে বসে আছে সম্রাট। রাগ, কষ্ট, হতাশা ঘিরে ধরেছে তাকে।একদিকে নিজের বোন, অন্য দিকে নিজের ভালবাসা।দু দিকের টানপোরনে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে সে।
সাইফ মাহতাব (সম্রাটের বাবা) এসে ছেলের পাশে বসলেন। ছেলের এই কষ্ট জর্জরিত চেহারা দেখে কলিজা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু আপাতত তার হাতেও কিছু নেই। মেয়েকে বাচাতে হলে তার এখন স্বার্থপর হতে হবে।
– নিজেকে সামলান আব্বা।আমি আপনার উপর ভরসা করে এখনো নিজেকে সামলে রেখেছি।আপনি এভাবে ভেঙে পরলে আপনার আম্মুর কি হবে।সাফার এখনো কোন খোঁজ পাই নি।নিজেকে একটু শক্ত করেন আব্বা।
কান্না আটকে কথা গুলো বললেন সাইফ সাহেব। পুরুষ মানুষের কাদতে নেই। না হলে আজ সে তার হাহাকার গুলো চোখের পানি করে বের করে দিতো।এ কোন পরিক্ষায় ফেললেন আল্লাহ তাকে!
বাবার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দু ফোটা অস্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল। নিজের ভালবাসার মানুষ আজ তাকে তার জীবন থেকে মুছে দিয়েছে। তার আদুর চোখে আজ নিজের জন্য ঘৃণা আর আফসোস ছাড়া কিছুই দেখতে পায় নি নিজের জন্য। এর চেয়ে কস্টের আর কি হতে পারে।
– ও আমাকে ভুল বুঝেছে বাবা।আমি ওকে খুব নোংরা পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছি।যেখানে ওকে প্রোটেক্ট করার কথা সেখানে আমি ওকে অন্ধকারে একা ছেড়ে দিয়েছি।আজ ও বলেছে, ও নাকি আমাকে নিজের মন থেকে মুছে ফেলেছে! (নিজের বাবার হাত ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সম্রাট)
– নিজেকে সামলান আব্বা।সময় হলে আমি বোঝাব আদওয়া কে।আপনি চিন্তা করবেন না।
বাবার হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো সম্রাট।নিজেকে কিছুটা শান্ত করে উঠে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে ফিরে তাকালো।
– সাফার আর কোন খবর পাওয়া গেছে?
সাফার কথা মনে হতেই আবার বিষাদে ভরে উঠলো সাইফ সাহেবের চেহারা।মেয়েটা তার বিশ দিন ধরে নিখোঁজ। এর পিছনে মারিয়ার বাবার হাত আছে। নিজের মেয়ের পাগলামির কাছে ন্যায় অন্যায় সব ভুলতে বসেছেন।
সাফা প্যারিস থাকে তার বড় ভাই যুবরাজ এর সাথে।সে ওখানেই পড়াশোনা করছে।কয়েক দিন আগে সাফা বন্ধুদের সাথে হ্যাংওভারে গিয়েছিল। তারপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মারিয়া সম্রাটের বন্ধু ছিল। তারা এক সাথেই পড়াশোনা করেছে। মারিয়া সম্রাট কে ভালবাসতো।পরে তা পাগলামি তে পরিনত হয়।মারিয়ার বাবা মেয়েকে শাসন না করে উল্টো তাকে সাপোর্ট করেছেন। তার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্যারিসে সাফা কে কিডন্যাপ করেছেন। আর সম্রাটকে মারিয়া কে বিয়ে করার জন্য বাধ্য করছেন।
সম্রাট কখনো মারিয়া কে বিয়ে করবে না। তার কিছু সময় দরকার সাফা কে খুজে পেতে। ততদিন তাকে ওদের কথা মতো চলতে হবে। না হলে ওরা সাফার ক্ষতি করে দিতে পারে।
– না।কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো?
বাবার কান্না মাখা চেহারা দেখে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে সম্রাটের। আদরের ছোট বোনটা না জানি কি অবস্থায় আছে। তবে আর চুপ করে বসে থাকার সময় নেই।পানি মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে।এখন ওরা আদওয়ার ক্ষতি করতে চাইছে। তাই এতদিন এতো কিছু হওয়ার পরেও সম্রাট আদওয়ার পাশে থাকতে পারে নি।যাতে মারিয়ার বাবা বিশ্বাস করে নেয় সম্রাটের সাথে ওর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তবুও ওরা আদওয়ার পিছু ছারছে না।এখন তো ও নারায়ণগঞ্জ চলে গেছে। সম্রাট ওকে চোখে চোখে রাখতে পারবে না।তাই আরো ভয় বেশি হচ্ছে।
– বাবা,আমি ঢাকা যাচ্ছি। এখন আমাদের চুপ করে থাকার আর সময় নেই।ভাইয়াকে বলো মামা কে নিয়ে পুলিশকে ইনফর্ম করতে।আমি মারিয়ার কাছে যাচ্ছি।
সাইফ সাহেবের উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বেরিয়ে গেলো।
ছলছল চোখে ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো সাইফ সাহেব।
🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁
অন্ধকার রুমে হাত পা বাধা অবস্থায় পরে আছে একটা মেয়ে।জ্ঞান না থাকায় সে বুঝতেও পারছে না পরবর্তী মুহুর্ত গুলো তার জিবনে খুব একটা সুখ নিয়ে আসবে না।
আকস্মিক তার উপর পানি পরায় পিটপিট করে চোখ খুললো সে।প্রথমে কিছু ঠিক করে না বুঝলেও পরে সব পরিস্কার হয়ে গেলো তার কাছে।বন্ধুদের সাথে নাইট ক্লাবে পার্টি করছিলো সে।ড্রিংক করার পর আর কিছু মনে নেই তার।কে বা কারা তাকে তুলে এনেছে কোন আইডিয়া নেই।
– মারিয়া বেপি।আর ইউ ওকে।
টেনেটেনে কথা গুলো বলে মারিয়ার সামনে এসে দাড়ালো সম্রাট। একটা ছেলে কে ইশারা করতেই একটা চেয়ার এনে রাখলো মারিয়ার সামনে। চেয়ারে আয়েশ করে বসে দুই হাত ঘারের নিচে দিয়ে কিছুক্ষন সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রইলো।
মারিয়ার সম্রাটকে দেখেই হাত পা কাপা শুরু হয়ে গেছে। সে জানে সম্রাট ঠিক কতটা ভয়ংকর।
– কি হলো বাবু।তুমি এমন কাপছো কেন?ভয় লাগছে বুঝি?(বাকা হেসে)
– আ আমাকে এখানে কেন এনেছো সম্রাট? এসবের মানে কি?
কাপা কাপা গলায় কথা গুলো বলতেই মারিয়ার দিকে ঝুকে তাকালো সম্রাট। শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকেই প্রশ্ন করলো,
– সাফা কোথায়?
সাফার কথা শুনতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো মারিয়ার।সম্রাট কি ভাবে জানতে পারলো যে সাফা কে ওরা কিডন্যাপ করেছে! নিজের মস্তিষ্কে ভাবনা গুলো আওরিয়েও কোন কুল কিনারা করতে পারলো না সে।ভয়ে ভয়ে সম্রাটের দিকে তাকাতেই সম্রাট কে বিয়ে করার পাগলামি জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামি মনে হলো। সাফার সাথে কি হয়েছে এটা যদি সম্রাট জানতে পারে তাহলে ওকে ভয়ংকর মৃত্যু থেকে কেউ বাচাতে পারবে না।
– আমি এক কথা বার বার বলতে পছন্দ করি না মারিয়া।সাফা কোথায় (চিল্লিয়ে)
– আ আমি জানি না।
– আমাকে রাগাস না। আমার রাগ সহ্য করতে পারবি না।(ভয়ংকর ভাবে)
সম্রাটের এমন রুপ দেখে কিছুটা পিছিয়ে গেল মারিয়া।ভয়ে সে থরথর করে কাপছে।
– সুমন, সাপ গুলো এই রুমে ছেড়ে দে।
কাওকে ডেকে কথাটা বলে চলে যেতে নিতেই শব্দ করে কেদে দিলো মারিয়া।
– সা সাফা আর বেচে নেই সম্রাট।
পা গুলো আপনা আপনি থেমে গেল সম্রাটের। নিশ্বাস টাও যেন বন্ধ হয়ে গেছে।
– আব্বু ভাইয়াকে প্যারিস পাঠিয়েছিল সাফা কে কিডন্যাপ করতে।সাফা কে ভাইয়া আগে থেকেই পছন্দ করতো। কিন্তু সাফা ভাইয়াকে পাত্তা দিত না।তাই সুযোগ পেয়ে…
সম্রাট ঘুরে তাকালো মারিয়ার দিকে। চোখ গুলো ভয়ংকর লাল হয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর যেন রক্ত বেরিয়ে আসবে।
সম্রাটের তাকানো দেখে মারিয়া জোরে কান্না করে বললো,
– আমি জানতাম না ভাইয়া এমন কিছু করবে।ভাইয়া সাফা কে নিজের করে পাওয়ার আশায় ওকে ধর্ষন করেছিল। ভাইয়া ভেবে ছিল এবার সাফার কোন রাস্তা থাকবে না ওকে মেনে নেয়া ছাড়া। কিন্তু ওর সাথে থাকা ছেলে গুলো ও সাফাকে ধর্ষন করে। ভাইয়া তখন বাইরে ছিল। অতিরিক্ত পাশবিক নির্যাতনের ফলে সাফা তখনই মারা যায়। তবু্ও ওরা সাফা কে ছারে নি।ওর লাশের সাথেও…..(একটু থেমে)
বিশ্বাস কর,আমরা কেউ এমন চাই নি। ভাইয়া সত্যি সাফা কে ভালবাসতো।
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মাথায় প্রচন্ড আঘাতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হলো মারিয়া কে।
পিছন থেকে কেউ কাধে হাত রাখতেই হাটু গেরে ফ্লোরে বসে পরলো সম্রাট। তার গগনবিদারী কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে উঠলো।
পিছন থেকে জাপটে ধরলো সুমন তাকে।
– আমার পুতুল কে ওরা মেরে ফেলেছে সুমন। কে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে বল।আমি আমার বোন কে কোথায় পাব এখন?আমার তো একটাই বোন ছিল। আমি আমার পুতুল কোথায় পাব?ওরা ওকে কেন মেরে ফেললো। আমাকে মেরে ফেলতো।আমার বোন কে কেন মারলো।(আহাজারি করে) না জানি আমার বোনটা কতো কষ্ট পেয়েছে। (অস্থির হয়ে)
আমি আমার পুতুল ছাড়া কি করে থাকবো?
সম্রাটের চিতকার করে কান্নায় সবার চোখে পানি চলে এসেছে। ওর বন্ধুরা সবাই জানে সম্রাট তার বোন কে কতটা ভালবাসে।কিন্তু ওদের সম্রাটের চেয়ে সুমনের জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে। কারণ এই প্রেমিকের তো চিৎকার করে কান্না করার ও অবস্থা নেই। সে নির্বাক হয়ে শুধু শুন্য চোখে তাকিয়ে আছে।
চলবে,,,