হিয়ার_মাঝে ১৩. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
180

#হিয়ার_মাঝে ১৩.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

মুঠোফোন রেখে পড়ায় মনোযোগ দিল আবার। আর কিছু সময় পর কোচিং এর উদ্দেশ্য বের হবে। হঠাৎই টুংটাং করে ক্ষুদে বার্তার জানান দিল তার মুঠোফোন। নুবাহ অবাক হল না। ভাবল ফের তার অধম টিচারই হবে। লোকটার আজ কি হয়ে গেল। অধরকোণে ঈষৎ লাজুক হাসি। নিজের মনে অনেক কিছুই ভেবে নিল। কিন্তু স্ক্রিনে চোখ পড়তেই তার কল্পনার অবসান হল। মুখের হাসি মূহুর্তে উবে গেল। দেখল তমার মেসেজ। ওপেন করতেই তার চোখ কপালে। আবার কি হল?

‘নিশিরাত জলদি স্কুলে আয়। সর্বনাশ হয়ে গেছে। মদনার অবস্থা ভালো না’রে। কি হবে কে জানে?’

নুবাহ আৎকে উঠল। দ্রুতই তৈরি হল স্কুলের উদ্দেশ্য। আলমিরা খুলতে চোখ পড়ল ইমদাদের দেয়া হিজাবের উপর। অধরকোণে লাজুক হাসি। একটা হিজাব হাতে নিল। খুব ইচ্ছে হল আজ পরে দেখতে। মেরুন রঙা হিজাব নিজের মাথায় বাঁধল। রুম ছেড়ে বের হতেই চোখে পড়ল নীলাভ নিভানের ঝগড়ার দৃশ্য। দু’জনেই একে অপরকে খোঁচাবে। আবার একে অপরকে উদোম কেলানি দিয়ে কিছু সময়ের মাঝে একদম শান্ত। মনে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত, ভদ্র বাচ্চা। এই ভালো তো এই খারাপ। কলহ বিবাদ হলেও তাদের দু’জনের মাঝে আবার বেশ গলায় গলায় ভাব। নুবাহ নিজমনে হাসল। ফের পায়ের কদম বাড়াল। মায়ের রুমের সামনে আসতেই থমকালো। বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনে বেশ চমকে উঠল।

রশিদ বেশ উদ্বিগ্ন মুখে বসা। রুকাইয়াকে ব্যাগে কাপড় গুছিয়ে রাখতে বলল। দুপুরের খাবার খেয়ে সে চট্রগ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দিবে। সেখানে দু’দিন থাকবে। রুকাইয়া কিছু বলল না। শুধু হ্যাঁ বলে মাথা নাড়াল।

নুবাহ ঘর থেকে বেরুলো। কিন্তু মনের মাঝে একটাই চিন্তা ঘোরপাক খেল। তার বাবা হঠাৎই চট্রগ্রাম কেন যাবে? কার কাছেই বা যাবে?

ক্লাসে প্রবেশ করতেই লিমার সাথে দেখা। আজ মেয়েটার মুখে হাসি নেই। তার দিকে কেমন নিরেট দৃষ্টিতে তাকাল। খুব বেশি মাথা ঘামালো না। সোজা তমার পাশে গিয়ে বসল। বসতেই তার হতশ্রী মুখ ভেসে উঠল। তমা ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘বইন দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কি হবে এবার? বাবলুর অবস্থা না’কি বেশ সিরিয়াস।’
সেও তমার মত ফিসফিস করল,
‘অবস্থা সিরিয়াস, মরে’টরে যাবে নাতো আবার?’

মূহুর্তে তমা চোখ রাঙালো।
‘আস্তাগফিরুল্লাহ পড় বদ মাইয়া। বাবলুর কিছু হইলে আমাদের কি হবে একবার ভেবে দেখ।’
নুবাহ টিপ্পনী মেরে বলল।
‘কি হবে আর, জেলে যাব। তারপর, আমাদের ফাঁ,সির দণ্ডাদেশ দিবে। এরপর আমরা মরে যাব। ‘ইয়া আল্লাহ’ আমাদের কি হবে?’
তমা চোয়াল শক্ত করল।
‘তুই মজা করছিস, নিশিরাত।’

নুবাহ ফোৎ করে নিশ্বাস ছাড়ল।
‘তুই শুধু শুধু চিন্তা করছিস। এতটাও মারিনি যে মরে যাবে। তবে বেচারার ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে পারে এটা আমি শিউর।’
তমা অশান্ত মনে বসল। নুবাহ নরম সুরে বলল, ‘বইন যা হওয়ার তা দেখা যাবে। এখন এত চাপ নিস না’তো। তুই ভয় পেলে আমার কি হবে বল?

ক্লাসের ঘন্টা পরতেই কিছু সময় পর ওবায়দুল স্যারের আগমন ঘটল। নুবাহ চটজলদি বলে উঠল, স্যার আমাদের বোন কেমন আছে? স্যারের মুখে প্রশস্ত হাসি। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ভালো, তোদের সবার দোয়ায়।
তারপর পুরো ক্লাসে দৃষ্টি বুলালেন। নমনীয় সুর গলার মাঝে। ‘আগামীকাল কিন্তু তোমাদের ক্লাস টেস্ট। মনে আছে তো। সবাই কালকে তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু।’

ছাত্রী’রা সমোচ্চরে বলে উঠল, ‘জ্বী স্যার।’

নুবাহর মুখে প্রাণবন্ত হাসি। আজকাল ম্যাথ সে অনেক ভালো পারে। এখন আগের মত তেমন বিরক্তি আসে না। এই অসাধ্য সাধন, সবই তার অধম টিচারের কামাল। ধন্যবাদ অধম টিচার। আমার পাশে এভাবে থাকার জন্য।

ক্লাস শেষ হতেই লিমার আগমন। তার চাউনি বেশ বিস্ময়কর। হুট করে এসে নুবাহর হিজাবে হাত বুলালো। আচমকাই বলে উঠল, তুই হিজাব’টা কোথায় থেকে নিয়েছিস?
দৈবাৎ প্রশ্নে নুবাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। হালকা করে মিনি হার্টঅ্যাটাক এল তার। এতক্ষণ পর বুঝল লিমার ঐ নিরেট দৃষ্টির কারণ। পরক্ষণেই ধাতস্থ করল নিজেকে। অকপটে বলল, ‘আমার খালামণি পাঠিয়েছে।’

তমার দৃষ্টিও বিস্মিত। হুট করে সেও বলে উঠল, ‘আসলেই তোর হিজাবটা অনেক সুন্দর আর পিনগুলোও। এজন্যই ভাবতেছি, তোকে আজ এত সুন্দর কেন লাগছে। তোর খালামনির চয়েস আছে বলতে হবে।’

লিমা কেমন ঘোরের মধ্যে। বিশ্বাস করল কি’না কে জানে। ফের বলে উঠল, ‘কিন্তু এত সুন্দর হিজাব তোর খালামনি কোন শপিংমল থেকে নিয়েছে। আমাকে বলবি।’

নুবাহ পড়ল বিপাকে। লিমা গড়গড় করে বলেই যাচ্ছে, ‘বইন তোর হিজাব’টা অনেক সুন্দর। কাজগুলোর ফিনিশিং কত দারুণ।’ শেষে হুট করে এমন একটা বাক্যে বলল তার জন্য নুবাহ পুরাই বাকরুদ্ধ। লিমা হিজাবের পাড় ধরে বলে উঠল, ‘এখানে ইংরেজি বর্ণ ই আর এন দিয়ে কাজ করা। নিশাত তুই খেয়াল করেছিস।’

নুবাহ হিজাবের দিকে নজর দিল। অতি সূক্ষ্মভাবে ই আর এন শব্দ দিয়ে কাজ করে গেছে। সে’তো খেয়ালই করেনি। লিমার কথায় তার মুখের হাসি উবে গেল। তমাও নজর দিল। ‘হ্যাঁ’রে ই, এন দু’টো শব্দই আছে। এন দিয়ে নুবাহ কিন্তু ই দিয়ে কি হবে’রে?’

তমা লিমা দু’জনেই একসাথে হেসে উঠল। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লিমা এখনো হিজাবে চোখ বুলাচ্ছে, ‘তোর হিজাব’টা বেশ দামী। কাপড়’টা কত মোলায়েম, দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কোন শপিংমল থেকে নিয়েছে তোর খালামনিকে জিজ্ঞেস করিস। ‘

নুবাহ নিজমনে প্রতিজ্ঞা করল আর কোনদিন অধম টিচারের দেয়া হিজাব পরবে না। লোক’টা মহাবদ। কিভাবে আগে থেকেই নিজের নাম জুড়ে দিয়েছে তার সাথে।
______________

রুকাইয়া মাত্র দুপুরের রান্নার জন্য সবজি কেটে কিচেন থেকে বের হল। তৎক্ষনাৎ দরজায় কারো ঠকঠক করার শব্দ শুনতে পেলেন। কলিংবেল নষ্ট গত দু’বছর ধরে কিন্তু সেটা আর ঠিক করা হয়নি। অনেকটা ইচ্ছাকৃত ভাবে এ কলিংবেল ঠিক করেনি। কলিংবেল থাকা অবস্থায় বাড়িওয়ালার নাতি সারা’টা দিন কারণে অকারণে বেল বাজাতো। অনেকটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অনেকবার বাড়িওয়ালার কাছে বিচার দিয়েও এর কোনো সুরাহা হয়নি। পরে কলিংবেল নষ্ট হওয়াতে সর্বপ্রথম সেই সবচেয়ে খুশি হয়েছে। এখন পুরোদমে শান্তিতে আছে।

দরজা খুলে দেখল বাড়িওয়ালার বউ শরিফা দাঁড়িয়ে আছে। রুকাইয়া তাকে দেখে সালাম দিল। ‘আরে খালাম্মা আপনি। আসেন ভিতরে আসেন।’
শরিফা হাসি মুখে সালাম নিল। ‘কেমন আছো রুকাইয়া? আজকাল নিচে যাওনা একদমই। তাই তোমারে দেখতে আইছি।’

রুকাইয়ার মুখে তখনও হাসি।
‘কিভাবে যামু খালাম্মা, আজকাল সময় পাইনা। সারাদিন কাজ থাকে। মেয়েটারও পরীক্ষা সামনে। তাই বাইরে যাওয়ার সময় হয় না।’

শরিফা কিঞ্চিৎ হাসলেন। ‘তা নিশাতের কি অবস্থা? ওরে আজকাল দেখিনা।
রুকাইয়া ফের বলে উঠল, ‘আছে ভালো। কিছুদিন পরেই পরীক্ষা, তাই পড়ালেখার চাপে আছে।’

শরিফা অতি সন্তর্পণে একটা কথা জিজ্ঞেস করলেন। ‘রুকাইয়া তোমার ম্যাইয়া’রে বিয়া দিবা। আমার হাতে একটা ভালো ছেলের সন্ধান আছে। ছেলেরা বরিশাল সদরে থাকে। উত্তরণ শপিংমলে ছেলের বাবার দুই’টা দোকান আছে। তিন ছেলে দুই মেয়ে। বড় ছেলে ইতালি থাকে।মেঝো আর ছোট ছেলে বাবার সাথে দোকান সামলায়। দুই ছেলেই বিবাহিত। এখন ছোট ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজতেছে। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে আর ছোট মেয়ে আছে অবিবাহিত। জেলা সদরে নিজেদের দু’তলা বাড়ি। নিচতলায় নিজেরা থাকে ওপরে ভাড়া দেওয়া। পরিবারে খুব বেশি ঝামেলাও নাই, ভেবে দেখতে পার কিন্তু।’

রুকাইয়া প্রসন্ন হলেন। মেয়েকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয় আজকাল। সব সময় দোয়া করে মেয়েটার যাতে শহরে বিয়ে হয়। গ্রামে ঘর-গৃহস্তের কাজ একদমই করতে পারবে না। খুব বেশি কাজ করতেও জানে না। ছোট থেকেই শহরে বড় হয়েছে। গ্রামের পরিবেশ সম্পর্কে ওর ধারণাও নাই। শরিফার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খালাম্মা নিশাতের বাপ আইলে আমি কথা বইলা দেখমু।’
শরিফা খুশি হলেন। মুখে প্রশস্ত হাসি।
‘ঠিক আছে, নিশাতের মা আমি এখন যাই। তুমি ওর বাপের লগে কথা বইলা জলদি আমারে জানাও।’
রুকাইয়া মাথা উপর নিচ করলেন। ‘ঠিক আছে খালাম্মা।’

শরিফা যেতেই রুকাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তাদের মত ছাল-চুলাহীন যাযাবর পরিবারের মেয়েকে পছন্দ করবে তো?
___________

দুপুরে টুংটাং শব্দ হল মুঠোফোনের। নুবাহ শোয়া থেকে তড়িৎ উঠে পড়ল। মুখের কোণে মুচকি হাসি। মেসেজ পড়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হল।
‘ফ্রি আছো।’
ফিরতি মেসেজ দিয়ে অপেক্ষা করল। এক,দুই গণনার আগেই ফোনকল আসা শুরু হল। রিসিভ করে সালাম বিনিময় করল প্রথমে।

ওপাশ থেকে এক মুগ্ধময় কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
‘নানু আমার অসুবিধে দেখে নিজের মুঠোফোন হাতে দিয়ে দিল। বাইরে আর যেতে হবে না। ঘরে বসেই কথা বলতে পারব এবার।’
নুবাহ অবাক হল।
‘এই নাম্বার আপনার নানুর।’
ইমদাদ ফের বলল, ‘হ্যাঁ, সকাল বেলায় কথা বলার সময় আমার মামাতো ভাই দেখেছিল। সেই বলে দিয়েছে সব। তখন নানু বলল, আমার ফোন নিয়ে যা। এটা তো পড়েই থাকে। আমার অত জরুরি কল তো আর আসে না।’

নুবাহ কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। ইমদাদের নানু তাকে নিয়ে কি ভাবছে কে জানে? নিজমনে দোটানায় ভুগল। কিয়ৎক্ষন পর বলে উঠল,
‘আচ্ছা, আপনার মামাত ভাই কি বলেছে আমার সাথে কথা বলতে দেখে?’
ইমদাদ আমতা আমতা করল, ‘আসলে তেমন কিছু না। জিজ্ঞেস করছিল আর কি? কার সাথে কথা বললাম?’

‘আপনি কি বলেছেন জবাবে?’

‘বলেছি ফেন্ডদের সাথে।’

‘তাহলে নানু কিভাবে বুঝল।’

‘জানি না, হয়তো নানুর পুরনো অভিজ্ঞতা আছে। তাই চট করে বুঝে গেছে।’

‘বন্ধুদের সাথে কথা বলেছেন বলার পরও আপনার মামাত ভাই নিশ্চয় সন্দেহ করেছে। তখন সত্যি’টা বলে দিতেন।’

ইমদাদ বেশ অবাক হল। সত্যিই তো! সে কেন মিথ্যে বলেছে। লজ্জা কেন পাচ্ছে বার বার। তার নানু কি তার মুখ দেখেই বুঝে গেছে। আনমনে কপালে হাত ঠেকাল। মহা সর্বনাশ! এত জলদি সবাই যদি জানে। তাহলে তো বিপদ। ফোৎ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফের বলে উঠল,
‘জানি না, কেন সত্যি বলিনি। আর সত্যি বললেও বিশ্বাস করতো না। উল্টো আমার মজা উড়াতো।’

নুবাহর মুখে লাজুক হাসি।
‘আচ্ছা, আপনার মজা উড়াবে কেন?’

‘সত্যি বললেও জোঁকের মত গন্ধ শুঁকত। বলত, কি চলছে তোমাদের মাঝে। আমার মামাত ভাই আমার থেকে মাত্র দু’বছরের বড়। কিন্তু এই লোকের পেটে একদমই কথা হজম হয় না। এখন ভয় লাগছে, কা’কে কি বলে বেড়ায়? আম্মু জানলে বকাবকি করবে। কারণ আম্মু সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে, বিয়ে তার পছন্দ ছাড়া করা যাবে না।’

নুবাহ তড়িৎ বলে উঠল, ‘এখানে বিয়ের কথা কেন আসছে স্যার।’

ইমদাদ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। হায় হায়! কি বলতে কি বলে ফেলেছে। আমতা আমতা করল,
‘স,, স,,সর‍্যিই। কি,,কিসব আবোল তাবোল বকছি। আচ্ছা, প,পরে কল দিচ্ছি।’

কল কাটল দ্রুতই। ইমদাদ নিজের কপালে নিজেই চাপড় মারল। কি লজ্জার ব্যাপার! ছিঃ! এই মেয়ে তাকে নিয়ে কি ভাববে এখন।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here