হিয়ার_মাঝে ৭. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
207

#হিয়ার_মাঝে ৭.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

সারাদিন কাটল দুশ্চিন্তায়। শুক্রবার বলেই আজ কোচিং নেই নুবাহর। তার ছোট্ট মাথায় অগোচরে একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কে এই অভদ্র লোক? তাকে অনবরত বিভিন্ন অপরিচিত নাম্বার থাকে বিরক্ত করে যাচ্ছে। আনমনে এক বাক্য উদয় হল। একবার কি তার নিরীহ টিচার ইমদাদকে বলে দেখবে। ভাবনামত দুপুর গড়াতেই ইমদাদের ছোট্ট বার্তা আসল।

“তুমি ফ্রি আছো?”

নুবাহ তড়িঘড়ি উত্তর দিল, হুম।

কয়েক সেকেন্ড মাঝেই কল আসল ইমদাদের। নুবাহ তড়িৎ কল রিসিভ করল। সালাম বিনিময় শেষে বলে উঠল,
‘একটা কথা বলব, রাগ করবেন না তো।’

ইমদাদ ছোট্ট করেই জবাব দিল, ‘হুমম। বল রাগ করব না।’

‘আসলে অপরিচিত বলতে আপনি ছাড়া আমার কন্ট্রাক্ট লিস্টে আর কেউ নেই। কিন্তু জানেন গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছে। আচ্ছা এমনটা নয়ত, আপনার কোন বন্ধু মজা করে আমাকে কল দিচ্ছে। আপনি জানেন না হয়ত।’

আচমকা ইমদাদ শুকনো ঢোক গিলল। তার পাশে পুরো বন্ধুমহল বসে আছে। তার মুঠোফোনে লাউড স্পিকার অন করা। সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল অপর পাশের কথা শোনার জন্য। সহসাই এমন কথায় তার বন্ধুমহলের মাথায় বজ্রপাত হল। তাদের অভিব্যক্তি শূন্য। একে অন্যের দিকে তাকাল। এত বড় অপবাদ তাদের বিরুদ্ধে। তাও কিছু না করেই। ইমদাদ নিজেই বিব্রতবোধ করল। সে জানে তার বন্ধুরা এমন নয়। কিছুসময় চুপ থেকে গলা খাঁকারি দিল।

‘আসলে আমার বন্ধুরা ভীষণ পেটুক। বেশি খাইতে পারে, বেশি বকবক করতে পারে, এক একটা কংকালের হাড্ডি হইতে পারে। তবে চরিত্র মাশা’আল্লাহ্ খারাপ না। বেশ ভালো। আর যেখানে আমি আছি, সেখানে তাদের এত দুঃসাহস হবে না তোমার সাথে কিছু করার। তাই তুমি নিশ্চিত থাকতে পার।’

বন্ধুমহলের মাথায় হাত। এটা প্রশংসা না’কি দুর্নাম। সবাই অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল ইমদাদের দিকে। ইমদাদ ফের বলে উঠল,
‘আমি তোমাকে আগেও বলেছি আমার বন্ধুরা এমন কিছু করবে না। কিন্তু তুমি যদি চাও আমাকে নাম্বার দিতে পার। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সেই নাম্বারের বায়োডাটা বের করে ফেলব।’

নুবাহ আকুলচিত্তে সব কিছুই শুনছিল। সহসাই রুকাইয়ার চিৎকার শোনা গেল।
‘নিশাত আয় তো, একটু জলদি আয়।’
নুবাহ তড়িৎ কল কাটল কিছু না বলে। দ্রুত ছুটল মায়ের ডাক শুনে। গিয়ে দেখে রুকাইয়া হন্তদন্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। তড়িঘড়ি নিজের কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে রাখছে। হুলুস্থুল অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘কি হয়েছে আম্মু, কোথাও যাচ্ছেন?’

রুকাইয়া নুবাহকে দেখে তড়িৎ বলে উঠল, তুই নিভানকে তৈরি করে দেয় জলদি। নুবাহ তখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ফের বলে উঠল, কোথায় যাচ্ছেন আম্মু’?

রুকাইয়া চটজলদি উত্তর দিল, তোর বড় মামা অ্যাকসিডেন্ট করেছে এখন হাসপাতালে যাচ্ছি। আচম্বিত এমন কথায় নুবাহ আৎকে উঠল। কিভাবে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বড় মামা?
রুকাইয়ার ভারী গলা। সেটা তো জানি না। গেলেই জানব সব। আচমকা বোনের দিকে দৃষ্টি পড়ল নুবাহর। নীলাভ তখন তৈরি হচ্ছে। নীলাভকে তৈরি হতে দেখে বলল, তুই কেন যাচ্ছিস? আম্মু হাসপাতালে যাচ্ছে, কোন বিয়ে বাড়িতে না। নীলাভ বোনের কথার বিশেষ পাত্তা দিল না। নিজের মত তৈরি হচ্ছে সে।

নুবাহ নিজমনে ফুঁসে উঠল। তার থেকে পাঁচ বছরের ছোট হয়েও তাকে পাত্তা দেয় না। এজন্য মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে নীলাভকে OLX এ বিক্রি করে দিতে। পুরাতন বোন বিক্রি করে নতুন একটা বোন কেনা যেত। অসহ্য একটা। নুবাহ নিজের রাগ প্রকাশ করল নীলাভের চুলের ঝুঁটি ধরে। ধমক দিয়ে বলল, কোথাও যাবি না তুই। আর ওমনি নীলাভের ন্যাকা কান্না। ভ্যা’ ভ্যা’ করে তার মায়ের কাছে নালিশ শুরু। রুকাইয়া উল্টো নুবাহকে ধমক দিল। ‘নিশাত তুই বাচ্চা, এখন কি বিরক্ত করার সময়।’

নুবাহ আর কিছু বলল না। নিভানকে তৈরি করা শেষ। নীলাভ নিভানসহ তার মা’ বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সে অপলক তাকিয়ে আছে মায়ের যাওয়ার পানে। নীলাভকে না নিলে এ মেয়ে এখন পুরো বাসা মাথায় উঠাইত। রাস্তার ধূলোময়লা সব ওর গায়ে থাকত। রুকাইয়া যাওয়ার আগে কিছু উপদেশ দিল নুবাহকে। দরজা,জানালা সব বন্ধ রাখবি। রাত এগারোটার মাঝেই তারা ফিরে আসবে। তাই চিন্তা না করতে। বেশি ভয় লাগলে বাড়িওয়ালার নাতনী রুম্পাকে নিয়ে আসতে। মেয়েটা নীলাভের বয়সী।

নুবাহ নিজের বিছানায় দপ করে বসল। পুরো ঘর ফাঁকা। জিনিসপত্র সব এদিক সেদিক ছড়ানো। রুকাইয়া যাওয়ার আগে পুরো ঘরের ওপর তান্ডব চালিয়ে গেছে। বসা থেকে উঠল সে। এলোমেলো সবকিছু গোছানো শুরু করে দিল। গোছানোর কাজ প্রায় শেষের দিকে। হঠাৎই তার মুঠোফোন কম্পিত হল। ভাবল তার মায়ের কল। তাই তড়িঘড়ি রিসিভ করতে মুঠোফোন হাতে নিল। কিন্তু দেখল, না এটা ইমদাদের কল। সালাম দিয়ে সে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে এক উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এল।
‘ওভাবে কল কেটে দিলে কেন? কি হয়েছে? কোন সমস্যা?’

নুবাহর শান্ত স্বর।
‘আসলে, আম্মু ডেকেছিল। সর‍্যিই স্যার এভাবে কল কাটার জন্য।’

আচমকাই নুবাহর মুখে স্যার শুনে ইমদাদ বেশ অবাক হল। নিজমনে খুশিও হল আবার কষ্টও পেল। কিন্তু তার তো কিছুই করার নেই। এইটুকুও বা কম কীসে? নিশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘কি করছো এখন?’

‘পড়তে বসেছিলাম। কিন্তু আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। তবে আপনার বাড়ি যদি আমাদের এখানে হত। তাহলে আমার জন্য অনেক সুবিধে হত। আপনার কাছে গিয়ে পড়তে পারতাম। কতই না ভালো হত, তাই না ‘স্যার।’

নুবাহর বার বার স্যার ডাকার শব্দে বেশ বিব্রতবোধ করল ইমদাদ। তাও মুখে ফিচেল হাসি। ছোট্ট করে বলল, তাই! কিন্তু তোমার এলাকার না হলেও সমস্যা কোথায়? যখন খুশি আমায় কল দিও। আমি আছি তো। তোমাকে সাহায্য করার জন্য।

‘জানেন স্যার’ আমার বান্ধবী আপনার লিখা দেখেই ফিদা। সে তো আপনার লিখা দেখে বার বার আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিল।’

ইমদাদ এতক্ষণে একটা সুযোগ পেল।
‘তোমার কেমন লেগেছে নুহাহ? তা’ তো বললে না।’

দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল নুবাহ। উত্তর হাতড়ে বেড়াল কিছুসময়। কিয়ৎসময় চুপ থেকে বলল, ‘হুমম’ ভালোই।’

‘তুমি ফিদা হওনি?’

উফফ! নুবাহ যেন অকূল পাথারে পড়ল। এই প্রশ্নই এড়িয়ে যেতে চাইছিল। আর ঘুরে ফিরে সেই প্রশ্নই। কি করে বলবে, আপনার লিখা দেখেই আমি শেষ। ফিদা হওয়ার কি বাকি রেখেছেন। কিন্তু মুখে বলল অন্য কিছু।
‘আপনার লিখা ভালোই, কিন্তু ফিদা হওয়ার কি আছে?’

‘তাহলে তুমি ফিদা হওনি। ভালো। আমি তো ভাবছিলাম ফিদা হয়ে আবার মরে টরে গেলে না’তো। যাই হোক বেঁচে আছ। শুকরিয়া।’

ইমদাদের কথা শুনে থ’ হয়ে খেল নুবাহ। তার কথা দিয়ে তাকে ফাসাতে চাইছে। সে কথা ঘুরালো। ‘আচ্ছা, স্যার’ আপনার বাড়ী ঢাকার কোথায়? আসলে আমার বান্ধবী জিজ্ঞেস করেছিল? তাই জানতে চাইছিলাম?’

‘তোমার বান্ধবী জিজ্ঞেস করেছে আমার ঠিকানা। অথচ তুমি কখনো জিজ্ঞেস করনি। তোমার বান্ধবী যখন জানতে চাইছে তখন ঢাকার যেকোন একটা নাম বলে দিও।’

নুবাহ কপট রাগ দেখাল। ঠিক আছে বলতে হবে না আপনার ঠিকানা।

‘আরে,, রেগে গেলে না’কি! আমি তো মজা করছিলাম। ঠিকানা শুনলে কি আর কথা বলবে। আমি তো ছা-পোষা মানুষ। তিতুমীরে ম্যাথ বিভাগে অধ্যয়নরত। বনানীর একটা মেসে থাকি। নিজের বাড়ি ফেনী। আবার বনানীতে একটা কোচিং সেন্টারে টিচিং করায়। এইটুকুই আমার ঠিকানা। আর কি জানতে চাও বল।

নুবাহর উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর। আপনি তিতুমীর কলেজে পড়েন?

‘হুম। কেন?’

নুবাহ কিঞ্চিৎ হাসল। আমি অনেক গল্প শুনেছি তিতুমীর কলেজের তাই।

এদিকে ইমদাদ বিস্মিত। প্রথমবার মেয়েটার হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে। নিশ্চুপ সে নুবাহর হাসি শুনে যাচ্ছে। হুট করেই জিজ্ঞেস করল, তোমাকে আজকে অনেক হাস্যোজ্জ্বল মনে হচ্ছে। প্রতিদিন তো কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিসিয়ে কথা বল। কিন্তু আজকে একবারে ভয়ডয়হীনভাবে কথা বলছ। তা কি ব্যাপার বলতো?

‘আজকে আম্মু বাসায় নেই তাই।’
ইমদাদ অবাক হল।
‘তোমার আম্মু কোথায় গেছে?’

নুবাহর করুণ গলা।
‘হাসপাতালে গেছে। আমার বড় মামা অ্যাকসিডেন্ট করেছে।’

‘অহহ, আর কেউ নেই বাসায়।’

‘নাহ, বাকিরাও গেছে। বাসা এখন পুরো খালি।’

‘তুমি বাসায় একা। তোমার ভয় করছে না।’

‘নাহ, ভয় করবে কেনো।

‘রাতে একা কিভাবে থাকবে। তখন ভয় করবে না।’

‘রাতে একা কেনো থাকব। আম্মু চলে আসবে তো।’

‘কখন আসবে তোমার আম্মু।’

‘এগারোটার মধ্যেই চলে আসবে।’

‘তাও তো অনেক রাত হবে। এতক্ষন একা থাকতে পারবে।’

‘হুমম, না পারার কি আছে।’

‘এরকম বাসায় একা থাকলে জ্বীন-ভূত ধরে বুঝলে, বোকা মেয়ে।’

‘জ্বীন-ভূত আমি ভয় পাই না বুঝলেন। উল্টো জ্বীন-ভূত আমাকে ভয় পায়।’

ইমদাদ হেসে উঠল। বাহ! তুমি তো অনেক সাহসী তাহলে। মুখে সাহসী বললেও নিজমনে ভীষণ ভয় লাগল। বাসায় একা আছে শোনার পর থেকে অধরের হাসি উবে গেল। এভাবে একটা কিশোরী মেয়েকে কেউ একা রেখে যাই।পরক্ষনেই তার একটা কথা মনে পড়ল। তাই হুট করে বলল,
‘আচ্ছা, এখন ঐ নাম্বারগুলো দাও তো।’

নুবাহ ঝটপট নাম্বার বলল। কিন্তু অন্যপাশে ইমদাদের গম্ভীর গলা।
‘জাষ্ট ১০ মিনিট, আমি আবার কল দেব। সাথে সাথে রিসিভ করবে কিন্তু।’

নুবাহ স্তব্ধ হয়ে গেল। লোকটা কত সিরিয়াস হয়ে গেছে। তার তো খুশি হওয়ার কথা কিন্তু সে কেন ভয় পাচ্ছে।

রুকাইয়া না থাকায় বিকেলের নাস্তা এখনও খাওয়া হয়নি তার। এদিকে সন্ধ্যা হতে চলল। রান্না ঘরে উঁকি দিল। ঘরে বিস্কুট, পাউরুটি কিছুই নেই। দোকান থেকে নিয়ে আসবে তারও উপায় নেই। অবশেষে খুঁজে ক্যানে মুড়ি পেল। হঠাৎ দেখল পাতিলে তালের রস ঝাল দেওয়া। নিশ্চয়ই আজকে পিঠা বানানোর কথা ছিল তার মায়ের। তাই ফ্রিজ থেকে তালের রস নামিয়ে জ্বাল দিয়ে রেখেছিল। মাথায় পরক্ষণে একটা বুদ্ধি আসল। ফ্রিজে নারিকেল কোড়ানো আছে। তাই ঝটপট নারিকেলসহ তালের রস মুড়ি দিয়ে মাখালো। সুপার একটা নাস্তা হয়ে গেল তার। আয়েশ করে মুঁড়ি মাখানো খাচ্ছিল। এসময় আবারও মুঠোফোন কম্পিত হল। ভেবেছিল ইমদাদ। কিন্তু দেখে তার খালামণি। কল রিসিভ করতে রুবি তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করল। নুবাহ বলল, আম্মু তো অনেক আগেই বের হয়েছে। এখনো পৌঁছায়নি? আচমকা রুবি বলে উঠল, এইতো মাত্র আসল তোর মা। আচ্ছা, তাইলে এখন রাখি।

রুবির কল কাটতেই আবারও তার মুঠোফোন কম্পিত হল। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন একটা কন্ঠস্বর ভেসে এল।
‘কি করছিলে? কল রিসিভ করতে দেরি হল কেন তোমার?’

নুবাহ পুরাই অবাক। অল্প একটুতে এত অস্থির কেন এই ছেলে। এত অস্থিরতা ভীষণ পীড়া দিচ্ছে তাকে। এ যেন এক অন্যরকম ভয়।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here