#হিয়ার_মাঝে ৯.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
ইমদাদ নিজ কাজে মগ্ন। ল্যাপটপে এক ধ্যানে তাকিয়ে বরিশালের লোকেশন দেখছে। অধরকোণে ঈষৎ হাসি। হঠাৎই ধ্যান ভাঙ্গল মুঠোফোনের কর্কশ ধ্বনিতে। চোখ বুলাতেই দেখল তার প্রিয় বন্ধুর ফোনকল। রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে চেঁচানোর শব্দ কানে এল।
‘আরে শালা তুই কোথায় ডুবে আছিস। এদিকে আমি ব্রেকিং নিউজ নিয়ে বসে আছি।’
ইমদাদ কপাল কুঁচকাল।
এই ভোর সকালে কীসের ব্রেকিং নিউজ’রে। আর আমাকে একদম শালা ডাকবি না। প্রথমত আমার কোন বোন নাই। দ্বিতীয়ত তুই যতই হিরো হোস না কেন, তোর কাছে বিয়ে দেব না।
ভ্যাবাচ্যাকা খেল ওপাশে থাকা তার প্রিয় বন্ধু। টিপ্পনী মেরে বলল, ‘এজন্য লোকে বলে কারও ভালো করতে নেই। সত্যিই কপাল দোষ! কি আর করা।’
‘দেখ! এত ভণিতা না করে সোজাসাপ্টা বল না কি বলতে চাস।’
ওপাশ থেকে কিঞ্চিৎ হাসির শব্দ ভেসে আসল।
‘এইতো এবার লাইনে আসলি। কিন্তু তোর সব ধৈর্য্য কি ঐ পিচ্চি ভাবির জন্যই আসে। আর আমাদের বেলায় যত অধৈর্য্য তোর!’
ইমদাদ কপট রাগ দেখাল। ‘তুই বলবি নাকি কল কাটব।’
‘তুই যে নাম্বারগুলো দিয়েছিলি তারমধ্যে একটার পুরো ডিটেইলস পেয়েছি। একজন ছেলের নামে রেজিষ্ট্রেশন করা। ছেলেটার নাম বাবলু মির্জা। বাকি তথ্য কিন্তু হাবিলদার ইউনুস আমাকে দিয়েছে। ছেলেটা এস.এস.সির গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠে পড়া ছেড়েছে বছর দু’য়েক আগে। বর্তমানে বাবার দুই নাম্বার ব্যবসা সামাল দেয়। বাবার নাম জাফর মির্জা। সাবেক এমপি প্রার্থী ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক ভোটের সময় তিনি মাত্র পাঁচটা ভোট পান। তবে এলাকায় খুব দাপুটে মানুষ জাফর মির্জা। ঐ লোকের বিশাল সুদের কারবার আছে। বড় অংকের ঋণ দিয়ে থাকে মানুষজনকে। এছাড়াও কয়েক’টা দুই নাম্বার ব্যবসাও আছে। কীর্তনখোলা নদীতে তার লঞ্চ আছে দুইটা। আবার বিয়েও করেছে দুইটা। বাবলু মির্জা কিন্তু দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে। তারা তিন ভাই দু’বোন। এক বোনের বিয়ে হয়েছে। আর একটা আছে ছোট, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বাবলু মেঝো ছেলে। তার বড় ভাই কাতার থাকে। এইটুকু জানতে পেরেছি। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইনি আমাদের পিচ্চি ভাবিকে ভীষণ বিরক্ত করেন।’
ইমদাদ ভাবুকচিত্তে বলে উঠল, দুই নাম্বার ব্যবসা মানে?
‘আরে পিচ্চি ভাবীর জামাই, দুই নাম্বার ব্যবসা মানে মাদকদ্রব্য আর কি?’
_____________
শীতের হিমেল হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সময়ের গতি। প্রবাহমান জীবনের সাথে ছুটে চলছে তা দ্রুতই। হাতের মাঝে গুণে গুণে আর মাত্র একমাস আছে এসএসসি পরীক্ষার। ফোৎ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নুবাহ। ইমদাদের দেয়া সাজেশন শেষ করতে পারবে কি’না তাই ভাবছে। টুংটাং করে নিজের মুঠোফোন ক্ষুদেবার্তার জানান দিল। চোখ বুলাতে দেখল এই মেসেজ ইমদাদ নয়, তমা দিয়েছে। কোচিং যাওয়ার আগে তাদের বাড়ি যেতে অনুরোধ করেছে আজ। বিষয়’টা খুব একটা মন্দ নয়। তাই অত কিছু ভাবল না সে। স্কুলে যাওয়ার পথে বান্ধুবীর বাড়ি যাবে তাতে কি? তৈরি হয়ে কোচিং যাওয়ার উদ্দেশ্য বের হল।
তমাদের বাড়িতে এসে নুবাহর চক্ষু চড়কগাছ। বেশ হৈচৈ আর হুলুস্থুল আয়োজন। তমাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, এত আয়োজন কিসের? তোদের নতুন অতিথি আসবে না’কি? তমা দীর্ঘশ্বাস টানল। আরে কিসের অতিথি? আমার মায়ের আদরের দুলাল ঢাকা থেকে আজ বাড়ি ফিরবে। এজন্য এত আয়োজন। তড়িৎ চক্ষুদ্বয় গোল গোল করে তাকাল নুবাহ। আজকে তমাল ভাইয়া আসবে? তমা ভেংচি কাটল। এ আর নতুন কি? তবে ভাইয়ার সাথে আব্বুও আসবে। তাই আম্মু ফুফুদেরও আসতে বলেছে দুপুরে।
দু’জনের কথার মাঝে তমার মায়ের আগমন ঘটল। নুবাহ তাকে দেখে সালাম দিল। কাকলি সালাম নিলেন হাসিমুখে। নুবাহকে দেখে কাছে ডাকলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন, দুপুরে কিন্তু আমাদের বাসায় আসবে। খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে বাসায় যাবে। নুবাহ দোটানায় পড়ল। তার মা’কে জানাতে হবে আগে। নয়ত বাড়ি গিয়ে গালি খেতে খেতে পেট ফুলে যাবে। তাই অকপটে বলে উঠল, কিন্তু আন্টি আম্মুকে জানাতে হবে আগে। নয়তো আসা যাবে না। কাকলি হেসে উঠল। ফের কড়া করে বলে উঠল, তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি রুকাইয়াকে ফোন দিব। কিন্তু তুই সময় মত তমার সাথে এসে পড়বি। মনে থাকে যেনও। নুবাহ কিঞ্চিৎ হাসল। আলতো করে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।
____________
ক্লাসে আসতেই দেখল মেয়ে’রা বেশ মনোযোগ দিয়ে লিমার কথা শুনছে। গোল হয়ে বসে আছে সবাই। তমার থেকেও নুবাহ বেশ অবাক হল। জিজ্ঞেস করার আগে লিমাই বলে উঠল তার সেই কাহিনী। শপিং করতে গিয়ে কোন এক ছেলে তাকে পছন্দ করেছে। এজন্য বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে। পরে তার বাবা মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু তার বাবা তৎক্ষণাৎ নিষেধ করে দিয়েছে। তাও ছেলে নাছোড়বান্দা। লাগাতার তাদের বাড়ি আসা যাওয়া করছে। বিয়ে করলে তাকেই করবে নয়তো আর কাউকে সে বিয়ে করবে না। লিমা কথা শেষ করে বলে উঠল, জানিস ছেলে’টা কি হ্যান্ডসাম। বেশ লম্বা, গোলগাল চেহারা দেখতে একদম শাকিব খান।
পাশ থেকে তমা বিড়বিড় করল, অপু বুবলির মত ক্যারেক্টার হলে তো শাকিব খানই আসবে। পরে বাচ্চা একটা পেটে দিয়ে ফুড়ুৎ। তমার কথায় আচমকাই নুবাহ ফিক করে হেসে দিল। লিমাসহ বাকিরাও হাসল। অথচ তারা জানলই না নুবাহ কেন হাসল?
ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরতে অটোরিকশার জন্য তমা, নুবাহ একসঙ্গে অপেক্ষারত। নুবাহ তমার বাড়ি যাবে তাই দু’জনেই একসাথে দাঁড়ানো আছে। শীতকাল হলেও মধ্যাহ্নের গগন বক্ষের রৌদ্রেরঝাঁজ বেশ। দু’জনেই মধ্যাহ্নের উষ্ণতা থেকে বাঁচতে বৃক্ষের ছায়াতলে দাঁড়াল। আচমকাই পারফিউমের সুগন্ধ বাতাস থেকে নাকে এসে ঠেকল দু’জনের। চকিতে মুখ ঘুরে তাকাতে দেখল তাদের থেকে কয়েক গজ দূরত্বে অবস্থান বাবলু মির্জার। নুবাহ কিঞ্চিৎ ভয় পেল। অতর্কিত আসা বাবলু মির্জাকে দেখে চোখমুখ কুঁচকালো। তবে তার আজকের পোশাক বেশ ভিন্ন। গায়ে নীল রঙা ফতুয়ার সাথে কালো জিন্স প্যান্ট। চুল জেল দিয়ে উঁচু করে খাড়া করে রেখেছে। শরীর থেকে ভেসে আসছে পারফিউমের তীব্র গন্ধ। নুবাহ হাত দিয়ে নিজের নাক ঢাকল। পারফিউমের তীব্র গন্ধ একদমই সহ্য হয় না তার। নিজমনে গালি ছুঁড়ল, ইয়াক! এই মদনা কোন টয়লেট থেকে বের হয়ে আসছে। কি বাজে গন্ধ’রে বাবা!
তমা শুধু অপলক দেখে যাচ্ছে বাবলু মির্জাকে। তার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছে সে।
হুট করে দূরত্ব কমিয়ে নুবাহর সামনে এসে দাঁড়াল বাবলু। চোখ দুটো রক্তিম লাল। চোয়াল শক্ত করে গর্জন করে উঠল,
‘দেখও নিশারানী, আমি যত ভালা ঠিক ততটাই খারাপ পোলা কিন্তু। তাই ভালো ভালো কইতাছি, আমার কল রিসিভ করবা। সামনে কথা কইলে তো উত্তর দাও না। হেরলাইগা তোমারে কল দেয়। কিন্তু তুমি আমার কল ধর না ক্যান।’
নুবাহ হতবিহ্বল। আপনমনে বিড়বিড় করল, মদনার বাচ্চা তারে কল দেয়। তাহলে অপরিচিত নাম্বার গুলো কি সব তার? সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। হুট করে জবাব দিল, আপনি আমারে কখন কল দিছেন?
বাবলুর মুখে লাজুক হাসি। চোখ পিটপিট করে জবাব দিল, ‘তোমারে রোজই কল দিই। কিন্তু তুমি রিসিভ কর না, উল্টো গালি দেও। ক্যান এমন করও। আমারে তোমার ভালা লাগে না।’
নুবাহ পুরাই থ’। জবাব দেয়ার জন্য মনঃস্থির করল মাত্রই। তার আগে তমা আলতো হেসে বলল, ‘কি যে কন বাবলু ভাই, আপনারে ক্যান পছন্দ হবে না। সে তো লাজুক মেয়ে। তাই লজ্জায় কথা বলতে পারে না। বুঝেন না আপনে।’
বাবলুর মুখে তখনো লাজুক হাসি। একহাত নিজের চুলে বুলিয়ে যাচ্ছে বার বার। জবাব দিল বেশ মিষ্টিস্বরে। এত শরম পায়। তয় গালি দেয় ক্যান? তহন শরম করে না। নুবাহ, তমা দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এই মদনা তো বেশ চতুর। তমা ফের হেসে উঠল। কি যে কন না। আপনার লগে মশকরা করে আর কি? বাবলু ভাই অহন যাই। বাবলু কিঞ্চিৎ ভাবল। জবাবে বলল, ঠিক আছে যাইতে দিমু এক শর্তে। আমার লগে কথা কইতে কও। নুবাহ বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে আছে। ইচ্ছে করছে মদনার বাচ্চাকে পাশের ডোবার পানিতে চুবাইতে। কত শখ তার লগে কথা কইতে হবে!
তমার অধরকোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। সান্ত্বনার বাণী ছুঁড়লো বাবলুর উদ্দেশ্য। বাবলু ভাই এখন কত পড়ার চাপ। আপনি তো জানেন সব। এখন একটু ছাড় দেন। পরীক্ষা শেষ হোক তারপর না হয় এসব নিয়ে কথা বলিয়েন। বাবলু নাছোড়বান্দা। সে এত অপেক্ষা করতে রাজী নয়। গজগজ করে উঠল, একটু কথা কইলে কি সমস্যা! আমি কি সারাদিন কথা বলমু না’কি।
তমা বেশ বিরক্তিবোধ করল। নুবাহ এতক্ষণ চেপে রাখা ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করল। কোপিত গলায় বলে উঠল, আমি কথা বলব না। কি করবেন আপনি?
সহসাই এমন কথায় বাবলু চমকাল। তেতে উঠল গলারস্বর। ‘আমার লগে বেশি তেজ দেখাইলে একবারে উঠায় নিয়ে বিয়ে কইরা নিমু। তহন তোমার তেজ দেখমু কেমনে থাকে।’
পাশে থাকা তমা শুকনো ঢোক গিলল। নুবাহর হাতে আলতো চাপড় দিল। ফিসফিস করে বলল, কেনও মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ছিস? চুপ যা নিশিরাত। নুবাহ থামল না। বাবলুর থেকে দ্বিগুণ গর্জন করল। চোখে চোখ রেখে জবাব দিল।
‘সামনে থেকে সর মদনার বাচ্চা।’
বাবলু এবার তেড়ে আসল। কিন্তু হঠাৎই অটোরিকশা তাদের মাঝে এসে পড়ল। বাবলু লোকজন দেখে থেমে গেল। নুবাহ, তমা চটজলদি গাড়িতে গিয়ে বসল। তমার ভয়ার্ত দৃষ্টি তখনও। অথচ নুবাহর চোখে অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। আর কত সহ্য করবে এই বে,য়াদবকে। গাড়ি চলছে তাদের। পিছনে রেখে গেছে এক হিংস্র মানব। যার দৃষ্টিতে দাউদাউ করে জ্বলছে প্রতিশোধের স্পৃহা।
______________
দুপুরের খাবার খেতে একসাথে বসেছে নুবাহ, তমা আর তার পরিবার। তমাল নুবাহকে দেখে বেশ অবাক হল। মেয়েটা আগের থেকে বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবে সেই নাক, চোখ, ঠোঁট রয়ে গেছে। মুখে তার ঈষৎ মিষ্টি হাসি। বারংবার আঁড়চোখে নুবাহকে দেখছিল। খাওয়ার মাঝে নুবাহর পাতে বড় চিংড়ি মাছ তুলে দিল। মেয়েটার বেশ পছন্দের মাছ সে জানে। তমা ভাইয়ের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল। এক ভ্রু উঁচিয়ে ভাইকে ইশারা করল। তমাল বোনের সন্দিহান দৃষ্টি দেখে নিজেকে দ্রুতই সংযত করল।
তমার বাবা মুনতাসীর মামুন একজন আর্মি সার্জেন্ট। তাই বাড়িতে নিয়মিত আসতে পারেন না। উনাকে আসতে হয় মাস দু’য়েক পর পর। নুবাহকে দেখে পড়াশোনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। এস.এস.সির পর কোথায় পড়ার ইচ্ছে আছে জানতে চাইলেন? জবাবে নুবাহ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আমতা আমতা করল প্রথমে। আসলে সে নিজেও জানে না কোথায় পড়বে? জবাবে ঈষৎ মাথা নাড়িয়ে বলল, আসলে আঙ্কেল এখনো ভাবিনি। মুনতাসীর নুবাহর জবাবে হতাশ হলেন। তবে তমার ব্যাপারে বলে উঠলেন। তিনি তমাকে ঢাকা ভর্তি করাবেন। নুবাহর হঠাৎই মন খারাপ হল। প্রিয় বান্ধুবী তার থেকে দূরে চলে যাবে ভেবে। আচমকাই টুংটাং করে নুবাহর মুঠোফোন মেসেজের বার্তা দিল। চোখ বুলিয়ে দেখল তার অধম টিচারের।
‘ফ্রি হলে মেসেজ দিও।’
চলবে,,,,,,