প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৯

0
270

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৯
________________________

ডিনার শেষে শাবিহা চুপচাপ সোফায় বসে৷ অরু তার চারপাশে বিড়াল ছানার মতো ঘুরঘুর করছে৷ মুখে যা আসছে বলছে৷ এটাসেটা নিয়ে তর্ক বিতর্ক করছে৷ কিন্তু শাবিহা কিছুই শুনছে না৷ অন্যমনস্ক হয়ে আছে৷ অরু একসময় সুমিতা বেগমের পিছু লাগলো৷ শাবিহা এই সুযোগে উঠে চলে এলো নিজের রুমে৷ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে রইলো৷ দেয়াল ঘড়িতে রাত দশটা তেত্রিশ৷ বাড়ির মানুষ এখনো সজাগ৷ শাবিহা বই নিয়ে টেবিলে বসলো৷
পড়ায় মনোযোগী হবার চেষ্টা করছে৷ আধঘন্টা খানেক পড়েও, মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে৷ বই বন্ধ করে বেলকনিতে দাঁড়ালো৷ ঠান্ডা বাতাস বইছে৷ আকাশ ডাকছে! বৃষ্টি আসবে মনে হয়৷ অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের পানে, বিষন্ন চোখমুখ নিয়ে তাকিয়ে রইলো৷ এক অসহায় যন্ত্রণা বুকে তোলপাড় সৃষ্টি করছে৷ খেয়াল করলো বাড়ির লাইটসোর্স ওফ হয়ে গিয়েছে৷ তারমানে সবাই নিজেদের রুমে চলে গিয়েছে৷ বাড়িটা এখন শান্তশিষ্ট৷ সম্পুর্ন নিঃস্তব্ধতায় ঘেরা৷ মুহুর্তেই শাবিহা বৃষ্টির ফোটা অনুভব করলো মুখমন্ডলে৷ বৃষ্টি হচ্ছে৷ ঝুম বৃষ্টি৷ বাতাসে উড়ে বৃষ্টি তার শরীর স্পর্শ করছে৷ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিজে যাবে দেখে কার্টেইনস লাগিয়ে, দরজা ছেটে ভেতরে চলে এলো৷ ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা৷ বৃষ্টির মধ্যে তো অয়ন আসবেনা৷ শাবিহাকেও যেতে হবেনা৷ মনেমনে নিজেকে মানিয়ে ঘুমানোর জন্য তৈরি হচ্ছিলো৷ তবুও মন আকুপাকু করছে৷ এই ঝুম বৃষ্টিতে অয়ন আসবে নাকি? না আসবেনা! অয়ন একদম আসবেনা৷ আর আসলেও শাবিহা যাবেনা৷ মনমানসিকতা শক্ত করে শুয়ে পড়লো। বিছানায় এদিকসেদিক ঘুরেও ঘুমাতে পারছেনা। বৃষ্টির শব্দ বেলকনি থেকে ভেসে আসছে৷ হুট করে শাবিহা লাফিয়ে উঠলো৷ ছাতা হাতে দৌড় লাগালো ছাঁদে৷ হাঁপাতে হাঁপাতে দমবন্ধ হবার জোগাড়৷ অন্ধকার সঙ্গে প্রখর বৃষ্টির মধ্যে অয়নকে দেখতে শাবিহার সময় লাগলো না৷ টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ছেলেটা এতো তেজী! এই ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয়? শাবিহা এগিয়ে আসলো না৷ ছাতা মাথায় দিয়ে এখান থেকেই বলল,
– বাসায় যাও!
অয়ন ঠাই দাঁড়িয়ে৷ কথা শুনছে না একদম।শাবিহার রাগ লাগলো৷ ইচ্ছে করছে চলে যেতে৷ পা ও বাড়িয়েছে কিন্তু যেতে পারছে না৷ ফিরে তাকিয়ে দেখল অয়ন লাফিয়ে তাদের ছাঁদে চলে এসেছে৷ তাকে এগিয়ে আসতে দেখে শাবিহার বুক কেঁপে উঠলো৷ নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে বলল,
– কি এমন জরুরি কথা যে এই বৃষ্টির মধ্যে বলতে হবে?
– ভালোবাসি৷
শাবিহার হাতের ছাতা নড়ে উঠলো। শক্ত করে না ধরলে হয়তো পড়ে যেতো। অয়ন আবারো বলল,
– আমি আপনাকে ভালোবাসি৷
– বাচ্চামো ছেড়ে দাও অয়ন৷ তোমার সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে সামনে৷ আমাকে ভালোলাগা এটা তোমার কিচ্ছুক্ষণের মোহ৷ একসময় কেটে যাবে৷
– পাঁচ বছর তো হলো৷ আর কতো?
বৃষ্টির মধ্যে ভেজা অবস্থায় দাঁড়ানো অয়ন উচ্চস্বরে প্রশ্ন করলো,
– কাটে না কেন এই মোহ? আরও পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে? নাকি সারাজীবন?
শাবিহার মাথা ঘোরাচ্ছে৷ আর একমুহূর্ত এখানে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে৷
– ফিরে যাও৷
এটা বলেই শাবিহা পা বাড়ায় চলে যাবার জন্য৷ পেছন থেকে অয়ন তার হাত চেপে ধরে৷ পরপর মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরে যায়৷ মুহুর্তেই ভিজে গেল সে৷ অয়ন হাত ছাড়ল না৷ কাছে এসে দাঁড়ালো৷ কন্ঠ যথাসম্ভব শান্ত করে বলল,
– আমাকে ভালোবাসা যায়না শাবিহা?
– এটা অসম্ভব! আমরা একটা সমাজে বসবাস করি অয়ন৷ এখানে কিছু রীতিনীতি আছে৷ মানুষ কী বলবে এটার গুরুত্ব দিতে হবে৷
আচমকা শাবিহা নিজেকে অয়নের বাহুডোরে আবিষ্কার করলো৷ শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে৷
– রীতিনীতি, সমাজ, লোকজন আমি কিছুর পরোয়া করিনা৷ আমি শুধু আপনার পরোয়া করি৷ আমি শুধু আপনাকেই ভালোবাসি৷ আমি চাই আপনিও আমাকে ভালোবাসুন৷
শাবিহা নিশ্চুপ হয়ে অয়নের বুকে পড়ে রইলো৷ নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করছেনা৷ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে৷ অয়নকে কীভাবে বোঝাবে তার মনের কথাগুলো? কীভাবে বোঝাবে এই সমাজ তাদের মেনে নিবেনা৷ পরিবার মেনে নিবেনা৷ শাবিহা অস্পষ্ট স্বরে বলল,
– কেউ মেনে নিবেনা৷
– আপনি যদি চান সবাই আমাদের মেনে নিক, আমি সবাইকে মানতে বাধ্য করবো৷
শাবিহা কাঁদতে শুরু করেছে৷
– তোমার সাথে আমাকে মানাবে না৷ তু..
– আমি মানিয়ে দেব৷ ম্যাচুরিটি বাড়াতে হবে তো? বাড়াব৷ এখন থেকেই দুনিয়ার সম্মুখীন হতে হবে? হবো! আপনার দায়ভার নেওয়ার জন্য কাজ করতে হবে তো? আমি কাজ করতে শুরু করবো শাবিহা৷ আপনি শুধু আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করুন৷ আমার অপেক্ষা করুন৷ আমাকে কিছু বছর সময় দিন৷
শাবিহা কেমন গলে গেল৷ চোখজোড়া বন্ধ করে অয়নের মিষ্টি কথাবার্তা শুনতে থাকলো৷ এগুলো শুনতে কতটাই না ভালো লাগছে৷ আসলেই কী সম্ভব? অয়ন এখনো অনার্সে৷ সম্পুর্ন পৃথিবী দেখা বাকি তার৷ বাইরের সুন্দর পৃথিবী ঘুরে এসে কি শাবিহাকে তখনো ভালোবাসবে? এভাবেই তার জন্য পাগল থাকবে?
———
অরুর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট আউট হয়েছে।
ভালো করেছে৷ চার-পাঁচ দিনের মাথায় ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হয়ে এসেছে৷ রেগুলার ক্লাস অ্যাটেন্ড করছে আর সন্ধ্যায় দৌড়ে তন্ময়ের কাছে হায়ারম্যাথমেটিকস করার ছুতায় চলে আসে৷ তন্ময় দৈনন্দিনের মতো একই ব্যবহার করে৷ অরুর আবেগী মন, ব্যাকুলতা, তীক্ষ্ণ নজর কিছুই যেমন সে চোখে দেখেনা৷ কিন্তু দিন যাচ্ছে আর অরুর অস্থিরতার মাত্রা বেড়ে চলেছে৷ যেমন মাস খানেক আগে হুট করে বালিশ বুকে জড়িয়ে কেঁদেকেটে টিস্যু দিয়ে ঘর ভর্তি করে ফেলেছে৷ এখন কান্না কেন করেছে নিজেই জানেনা৷ সেদিন তন্ময় তার ম্যাসেজ সিন করেনি দেখে অরু সারাদিন খাওয়াদাওয়া করলো না৷ পরশু কল করেছে তার কল রিসিভ করেনি দেখে, সারাদিন চোখের কোণে জল নিয়ে পুরোটা বাড়ি ঘুরেছে৷ গতকাল ভাত খেতে বসে হুট করে কেঁদে ফেললো৷ কাঁদতে কাঁদতে সর্দি চোখের জল দিয়ে চোখমুখ ভরে ফেলেছে৷ মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব সকলেই চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করেছেন, ‘ কী হইছে আম্মা? ‘ প্রতিত্তোরে অরু নাক টেনে বলেছিল,
– আমাকে ভালো ডাক্তার দেখাও না কেন তোমরা! আমাকে কি ভালোবাস না? আমার সারাটা বছর ঠান্ডা লেগে থাকে কেন!
আনোয়ার সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,
– আম্মা তুমি সারা রাত এসি ছেড়ে শুয়ে থাক৷ শরীর কাঁথা জড়াও না৷ তো ঠান্ডা তো লাগবোই৷ তুমি চলো আমরা এখনই ডাক্তারের কাছে যাব৷
বাবার আদূরে কথাবার্তায় অরুর মন ঠান্ডা হয়েছে ঠিকই৷ তবে আজকে আরেক কান্ড ঘটতে চলেছে৷ অরুর বেশকিছু ক্লাসমেটদের বয়ফ্রেন্ড আছে৷ এবং তাদের থেকে শুনেছে কাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে৷ ভালোবাসা দিবস৷ এই দিন ভালোবাসার মানুষদের উৎসবের দিন৷ প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘুরতে যায়। অরুও যেতে চায় তন্ময়ের সাথে৷ কিন্তু তন্ময় আর সে তো প্রেমিক-প্রেমিকা না৷ তাহলে? এখন অরু চায় প্রেমিকা হতে আর তার প্রেমিক হিসেবে তন্ময়কে চায়৷ দরজার ছিটকানি আটকে সেলফোন হাতে অরু বিছানার মধ্যে বসলো৷ সাথে এনেছে টিস্যু বক্স। যদি তন্ময় তার সাথে যেতে না চায় তাহলে অরু কাঁদবে৷ কেঁদেকেটে তন্ময়কে শোনাবে৷ শুনিয়ে রাজি করাবে৷ প্রথম কলে রিং বেজেছে কিন্তু ধরেনি৷ দ্বিতীয় কলে তন্ময় রিসিভ করেছে৷ অরু চুপ হয়ে রইলো৷ ওপাশ থেকে তন্ময়ের গভীর রাতের গম্ভীর স্বরে শোনা গেল,
– কি হয়েছে?
অরু মিনমিনে সুরে বলল,
– আপনি কি কাল ফ্রি!
– বুঝিনি৷
অরু এবার উচ্চস্বরে বলল,
– আপনি কি কালকে আমাকে নিয়ে বেরোবেন?
– কেন?
– আমি ঘুরতে যেতে চাই৷
– কাল নয় অন্য একদিন যাস৷ শাবিহাকে বলে দিব নিয়ে যাবে৷
– না!
তন্ময় ধমকের সুরে বলল,
– কী না?
ধমক খেয়ে অরুর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল৷ ইনিয়েবিনিয়ে বলল,
– আমি আপনার সাথে যাবো৷
– অফিস আছে৷
– আপনি কী ছুটি নিতে পারবেন না একটা দিন?
– পারবো না৷
অরু নাক ফুলিয়ে চলেছে৷ চোখের কোণ লাল হয়ে গেছে তার৷ কেঁদে দিবে দিবে ভাব৷
– আপনার কি আমার প্রতি একটুও মায়া নেই?
আপনি আমাকে দেখতেই পারেন না তাই না? আপনার ওসব মেয়ে ভালো লাগে৷ আমাকে ভালো লাগে না৷
– চাচ্চুরে ফোন দে তো!
অরু কল কেটে দিলো ভয়ে৷ এগুলো যদি তার বাবাকে বলে, অরু অনেক কষ্ট পাবে৷ বাবা কী ভাববে তাকে? ছোট থেকে যাকে ভাই বলে গেছিস, এখন তাকে বিরক্ত করিস? এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে? ভয়ে অরু কাঁদতে বসল৷ তন্ময় কল করেছে৷ অরু কান্না থামিয়ে ধরলো৷ নাক টানার মধ্যে বলল,
– আর বলবো না হ্যাঁ? এগুলো একদম বলবো না৷ আপনি বাবাকে কিছুই বলিয়েন না৷ এইযে কান ধরেছি!
তন্ময়ের গলার স্বর মুহুর্তেই নরম শোনা গেল৷ একটু তাড়াহুড়োও শোনাল বটে,
– কান্না থামা কথা শ….
অরুর ফোনের চার্জ চলে গেল৷ ফোনও চাচ্ছেনা অরু কথা বলুক৷ কথা বললেই বিপদ! সেলফোন চার্জে দিয়ে অরু ঘুমাতে গেল৷ তার শুধুই কান্না পাচ্ছে৷ বালিশ ভিজে ছারখার৷ তন্ময় তাকে বোনের নজরে দেখে৷ আর সে? অরু আসলেই নির্লজ্জ৷
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে চোখমুখ ফুলে কলাগাছ৷ আয়নায় নিজেকে নিজেই দেখে লাফিয়ে উঠলো৷ এই চেহারা নিয়ে নিচে গেলে তাকে সবাই আস্ত খেয়ে ফেলবে৷ গোসল নিলে নিশ্চয়ই ফোলা ভাব চলে যাবে? অরু সকাল সকাল গোসল নিল৷ নাহ, চোখমুখ ফোলাই রয়ে গেছে৷ কলেজ ড্রেস পরে, মাথা সহ মুখ স্কার্ফ দিয়ে পেঁচিয়ে নিচে নেমে এলো৷ দীপ্ত তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে৷ অরু তার পাশে বসে ধীরেসুস্থে খেয়ে বেরোলো৷ সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে বিদায় রাস্তাঘাটে নজর বোলাতে বোলাতে যাচ্ছে৷ সবখানে গোলাপফুল আর গোলাপফুল৷ যেমন সম্পুর্ন বাংলাদেশে ফুল ছাড়া আর কিছুই নেই৷ কলেজের সামনে ফুলের মেলা বসেছে আজ৷ অরু একশো টাকা দিয়ে একটা গোলাপ কিনেছে৷ এবং সেটাকে নিয়ে পুরো ক্লাস জুড়ে কাহিনী করলো৷ যেমন তার পার্সোনাল ডায়রির এক পেইজে দুটো ছেলেমেয়ে এঁকেছে৷ উপরে সুন্দর ভাবে লিখেছে ভালোবাসা দিবস৷ ছেলেটার মাথার উপর লিখেছে তন্ময় আর মেয়েটির মাথার উপরে লিখেছে অরু৷ তারপর গোলাপ ফুলটা মধ্যে লাগিয়ে দিলো৷ পাশে বসা মারজি ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে এগুলো দেখছে৷ ঘুমন্ত কন্ঠে বলল,
– তন্ময় ভাই এগুলো দেখলে তোরে এক থাপ্পড়ে সুইজারল্যান্ড পাঠাই দিবে৷
– এভাবে বলবিনা৷ আমি কষ্ট পাই৷
– আহারে আমার শোনাটা৷ কষ্ট তো পাবাই৷ ফাঁদে যে পড়ছ৷
সবগুলো ক্লাসে অমনোযোগী ছিলো অরু৷ শেষ ক্লাস সেড়ে ক্যাম্পাসে পা ঝুলিয়ে বসে থাকলো৷ এহসান বাদাম এনেছে৷ সেগুলোই খাচ্ছে হেলেদুলে৷ এহসান কথায় কথায় বলে ফেলল,
– এই অরু তন্ময় ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড নাই রে? আমার মনে হয় তার গার্লফ্রেন্ড আগুন সুন্দরী হইবো৷ তিনি নিজেই যেই সুন্দর৷ সেদিন সন্ধ্যায় একটা মাইয়ার সাথে দেখছিলাম৷ ওইটা মাইয়া ছিলো না পরী বুঝতে পারিনি, এতো সুন্দর!
মারজি ঠোঁট কামড়ে আঁড়চোখে অরুর দিক তাকাল৷ অরু ঠোঁট, নাক ফোলাচ্ছে৷ কেঁদে দিবে৷ ভাবতে না ভাবতেই দেখল অরুর গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে৷ মারজি এহসানকে বুঝতে না দিয়ে আলগোছে অরুকে নিয়ে সরে এলো৷ চোখমুখ মুছে দিয়ে বলল,
– বোকা তো তুই! ভাইয়া কাজ করে সেখানে শতশত মেয়েরা আছে৷ যেমন তোর আশেপাশে কতশত ছেলেরা৷ তুই দুই একজনের সঙ্গে তো কথা বলিস তাই না? তো, তেমন সেও বলে৷ এটাকে সিরিয়াস নেওয়ার কী আছে?
অরুর কান্না থেমে গেল৷
– তাই তো৷ আমিতো সেভাবে ভেবে দেখিনি
মারজি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল৷ এরমধ্যে সুমনা এসে সামনে দাঁড়ালো৷ তার সাথে এসেছে সাঙ্গপাঙ্গ৷ সুমনার হাতে গোলাপফুলের বাগান৷ অরুকে দেখিয়ে বলল,
– এগুলো সব পেয়েছি৷ চকলেট ডে, টেডি সব ডে’তেই আমার বাড়িঘর ভরিয়ে ফেলে ছেলেরা গিফট দিয়ে৷ কী একটা অবস্থা! তা তুই একটাও পাস নি?
অরু যেতে যেতে বলল,
– খোলা বাজারে মাছি বেশি থাকবেই ।
সুমনা রেগে গেল৷ দৌড়ে তাকে ধরবে তার আগেই মারজি সামনে এসে দাঁড়ালো৷ চোখ রাঙিয়ে তাকাল সুমনার দিক৷ তারপর অরুর সাথে চলে এসেছে।যে যার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে৷ গেইটের সামনে আসতেই চমকে গেল অরু৷ তন্ময় দাঁড়িয়ে৷ অরুর চোখজোড়া পিটপিট করছে৷ সত্যি দেখছে তো? তন্ময় ভীষণ রেগে৷ তার চোখমুখ থেকে আগুন বেরোচ্ছে যেমন৷ অরু ভয় পেল৷ গতকালের জন্য লোকটা এখনো রেগে নাকি? অরুকে কী মারতে এসেছে? অরুর পেছনে দাঁড়ানো মারজি আর এহসান একটু পেছনে চেপে গেল৷ তন্ময় তাদের দিক এসে নিজেকে শান্ত করল৷ অরুর হাতের সাইকেল নিয়ে এহসানে হাতে দিয়ে বলল,
– বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারবেনা?
– জি ভাই পারবো৷
– ধন্যবাদ৷
তারপর শক্ত করে অরুর হাত ধরে নিয়ে চলেছে৷ অরু ভ্যাবলার মতো পিছুপিছু যাচ্ছে৷ মোর থেকে তন্ময় রিকশা নিয়েছে৷ অরু উঠে বসতেই সেও পাশে উঠে বসেছে৷ কন্ঠে তীব্র রাগ নিয়ে বলল,
– তুই ফোন বন্ধ করেছিস কেন?
– আমি করি নাই ত৷ চার্জ ছিলোনা৷
– চার্জ ছিলোনা যেহেতু আমায় কল দিছিস কেন?
তারপর ফোন চার্জ দিয়ে কল ব্যাক করিস নি
কেন?
তন্ময়ের ঝাড়ি খেয়ে কেঁপে উঠেছে দৃশ্যমান রুপে৷
চোখমুখ অন্ধকার করে বলল,
– আমি ভেবেছি আপনি কথা বলতে চাচ্ছেন না৷
তন্ময় অরুর মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
– এই ভাবনা কল দেবার আগে কই ছিল?
– কি জানি! আপনি কি বাবাকে বিচার দিতে যাচ্ছেন?
– হ্যাঁ৷
– আমিতো বললাম আর বলবো না।
তন্ময়ের জবাব নেই৷ অরু ফ্যালফ্যাল নয়নে তন্ময়ের দিক তাকিয়ে৷ সেই চেনা পারফিউমের ঘ্রাণ৷ অরুর বুক কাঁপছে৷ শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে চলেছে৷ ইচ্ছে করছে তন্ময়ের শক্ত বড় হাতটা ধরতে কিন্তু সাহসে কুলালো না। রিকশা থেমেছে ধানমন্ডি বত্রিশের লেকের সামনে৷ তন্ময় নামতেই অরুও নামলো৷ চারপাশে তাকিয়ে হঠাৎ অরুর চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো৷ তন্ময়ের দিক ফিরে বলল,
– আপনি আমাকে ঘুরতে এনেছেন?
তন্ময়ের জবাব নেই৷ তবে আঁড়চোখে ঠিকই অরুর হাস্যজ্বল চেহারায় কয়েকবার তাকিয়েছে৷ অরু তখন খুশিতে গদগদ৷ তন্ময়ের আঁড়চোখে তাকানো লক্ষ্য করার সময় নেই৷ মান অভিমান, মন খারাপ সবকিছু উধাও তার৷ একসময় অরুর কাঁধের ভারী ব্যাগটা তন্ময় নিজে হাতে নিল৷ মানুষের ভিড়ে অরু হারিয়ে যাচ্ছে দেখে ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে ধরে রাখল৷ মধ্যবয়সী চাচা ফুলের ডালা নিয়ে বসেছে মাঝরাস্তায়৷ অরু সেখানে দাঁড়িয়ে বলল,
– একটা কিনে দিবেন আমায়?
তন্ময় একটা না বরং দশ বারোটা মিলিয়ে একটা বুকে বানিয়ে নিয়েছে৷ গোলাপফুলের বুকে হাতে নিয়ে অরু হাসতে লাগলো৷ হাসিতে তার চোখজোড়া ছোটছোট হয়ে গেছে৷ দুজন হেঁটে পৌঁছেছে পশ্চিমের রেস্টুরেন্টে৷ অরুকে দুপুরের খাবার খাইয়ে সম্পুর্ন বিকেল জুড়ে ঘুরিয়েছে তন্ময়৷ অরু মাঝেমধ্যে রাস্তায় থেমে এটাসেটা খাচ্ছে ত, কিছু একটা কিনছে৷ পৃথিবীর সকল ধৈর্য যেমন তন্ময়ের কাছে৷ আজ সে কিছুতেই অরুকে না বলেনি৷ অরু যা চাচ্ছে দিচ্ছে, যা বলছে করছে৷ বলা যায় আজকের দিনটা অরুর জীবনের সবথেকে সুন্দর দিন৷ আজকের তন্ময় অরুর জীবনের দেখা সবথেকে সুন্দর তন্ময়৷

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here