প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৪

0
134

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৪
_________________________
তন্ময়ের ফোনে লাগাতার কল আসছে৷ তাকে কল করছে পরিবারের সবাই৷ যেমন বড় চাচ্চু তাকে দুবার কল করেছে৷ ছোট চাচ্চু করেছে চারবার৷ ছোট চাচি ছয়বার৷ তার মা করেছে নয়বার৷ মোট কথা শতশত মিসডকলস এসেছে৷ কিন্তু তন্ময় দেখেনি৷ সাইলেন্ট করা ছিলো তার ফোন৷ এখন হাতে নিয়ে কল দেখেও কাউকে কল ব্যাক করেনি৷ সবাই অরু এবং দীপ্তর চিন্তায়৷ স্কুল থেকে হয়তো এতক্ষণে বাড়িতে ফোন গিয়েছে তাদের অ্যাবসেন্সের৷ তন্ময় শাবিহাকে বললো,
— তোর ফোন কই?
— ফোন অফিসে৷
— ধর কথা বল৷ জানিয়ে দে ওরা তোর কাছে৷
তন্ময় তার ছোট চাচ্চুকে কল ব্যাক করে শাবিহাকে ধরিয়ে দিলো৷ শাবিহা সবকিছু খুলে বললো। এগুলো শুনে রেগে গেল বাড়ির সবাই৷ আজ বাড়িতে গেলে অরু এবং দীপ্তর খবর আছে৷ দীপ্ত শীতে এবং ভয়ে কাঁপছে অরুর পাশে৷ তার পাছায় আজ ড্রাম বাজাবে তার বাবা৷ অবশ্য অরুর কপালেও শনি আছে সেটা ভেবে ভয় কিছুটা কমে গেল তার। সে তো আর একা মাইর খাবেনা৷ অরুও খাবে সাথে৷ আপাতত রাতের বাজছে আটটা৷ বৃষ্টিও থামছে না৷ এদিকে কমবেশি সকলের কাপড়চোপড় ভিজেভিজে। অরু সমানে হাচি দিচ্ছে৷ দীপ্তর নাক লাল হয়ে গিয়েছে৷ এই বাচ্চার জ্বর আসবে বলে৷ কপাল ছুঁয়ে দেখল গরম৷ রাগান্বিত তন্ময় ডিসিশন নিল তার বাইকের চাবি অয়নকে দিয়ে, এখনই অরুদের নিয়ে বাসে করে রওনা হবে৷ অয়ন তন্ময়কে বললো,
— ভাই এখানকার বাস গুলো পুরো ভর্তি হয়ে যাচ্ছে৷খালি বাস পাওয়া একটু মুশকিল৷
— অপেক্ষা করি!
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দু সিট ফাঁকা রয়েছে এমন একটি বাস পেল৷ সামনে গেলে আরও সিট খালি হবে বলা হয়েছে৷ তন্ময় সাইকেল গুলো বাসের ছাঁদে তুলতে বললো হেল্পারকে৷ অয়নের সাইকেল সহ সবগুলো সাইকেল তোলা হয়েছে৷ তারপর অরুদের নিয়ে উঠে গেল বাসে৷ খালি দুটি সিটে দীপ্ত এবং মারজি বসেছে৷ ওদের দুজনের অবস্থা বেশ নাজুক৷ অবশ্য মারজি বলেছে সে দাঁড়াবে বরং অরু বসুক৷ কিন্তু অরু না করে দিল৷ সে দিব্বি স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়িয়ে৷ আরও প্যাসেঞ্জার উঠছে দেখে তন্ময় অরুর পেছনে দাঁড়ালো৷ একপ্রকার সে তন্ময়ের দু’হাতের ভেতর৷ ভেজা শরীরে তন্ময়ের সাথে লেগে থাকতে অরুর অদ্ভুত লাগছে৷ কেমন যেনো তার ঘনঘন শ্বাস ফেলতে হচ্ছে৷ আঁড়চোখে পিছু ফিরতে নিলে তন্ময় তার ঘাড় চেপে ধরে সোজা করে৷ রক্তিম চোখে তাকিয়ে বলে,
— চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক!
অরু তার কথামতো একদম সোজা হয়ে দাঁড়ালো৷ কখন দুহাত স্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে দিলো তার মনে নেই৷ হঠাৎ বাস ঝাকিয়ে উঠলো৷ অরু সামনে পড়ে যেতে নিচ্ছিলো৷ নিজেকে বাঁচাতে পেছনের যা পেয়েছে টেনে ধরেছে৷ তন্ময়ের বুকের দিকের শার্টের দুটো বোতাম শব্দ করে ছিঁড়ে গেল৷ অরু হতবাক হয়ে গিয়েছে৷ বড়বড় চোখ করে ফিরে তাকাল৷ সে তন্ময়ের বুকের শার্ট টেনে ধরেছিল৷ মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল, তন্ময়ের চোখ জোড়া রাগে লাল হয়ে গেছে৷ ভয়ে অরুর গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ৷ সে নিচে তাকিয়ে বোতাম খুঁজতে লাগলো৷ পেল না৷ না পেয়ে শার্ট গুঁছিয়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো,
— আমি সেলাই করে দিব হ্যাঁ ভাইয়া?
তন্ময় রাগে বাকরুদ্ধ৷ সে ঠিক কী করবে এই মেয়ের সাথে বুঝে উঠতে পারছে না৷ একটা মানুষ এতটা মেসি কীভাবে হয়? ইচ্ছে করছে থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিতে এর৷ নিজেকে কোনোরকমে সামলে অরুকে ঘুরিয়ে ফেললো৷ অরুর হাত দুটো পেছন থেকে পেঁচিয়ে ধরে রাখল ৷
— এভাবেই পুরোটা রাস্তা যাবি৷
চোখজোড়া ভিজে উঠেছে অরুর৷ খুব ব্যথা পাচ্ছে৷ সে কী ইচ্ছে করে করেছে নাকি? লোকটা শুধু অরুকে বকাঝকা করে৷ ছোট্ট মনের তাকে এভাবে বকাঝকা করলে হয়? কয়েকবার হাত ছাড়াতে চাইল৷ তন্ময় আরও শক্ত করে ধরলো৷ উপচে পড়া চোখের জল নিয়ে অরু এক অদ্ভুত অনুভূতি পেতে শুরু করেছে৷ তার বুক এতো দ্রুত বেগে ছুটছে কেন? মাথা ব্যথা নিয়ে দীপ্ত পাশে মুখ লুকিয়ে হাসছে৷ একসময় শব্দ করে হাসতে লাগলো৷ তার হাসি দেখে অরু রেগে গেল৷ চোখ রাঙিয়ে তাকাল৷ তাতে দীপ্তর হাসি বেড়ে গেল শতগুণ৷ মারজির অবস্থাও একই৷ সে নিজের হাসি লুকোতে জানালার বাহিরে তাকাল৷ আধঘন্টার মধ্যেই বাস পৌঁছে গিয়েছে গন্তব্যে৷ তন্ময় অরুর হাত ছেড়ে দিতেই সে কুঁকড়ে উঠলো৷ ব্যথায় হাত অবশ হয়ে গিয়েছে একপ্রকার৷ নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে৷ তন্ময় তাকে ফেলেই দীপ্তকে নিয়ে নেমে গেল৷ অরু নিজের হাত চেপে নেমে এসেছে একটু পর৷ তার চোখের পাতায় তখনো জল৷ হেচকি তুলে তন্ময়ের দিক তাকাল৷ তন্ময় তখন বাস হেল্পারের সাথে সাইকেল নামাতে ব্যস্ত৷ অয়নের সাইকেল নিয়ে মারজি দৌড় লাগালো৷ সে দ্রুত পায়ে অয়নদের বাড়িতে সাইকেল রেখে এসে নিজেরটা নিয়ে চলে যাচ্ছে৷ মোরেই তার জন্য তার ভাই এহসান অপেক্ষা করছে৷ তন্ময় ধমকের সুরে বললো,
— দ্রুত ঘরে যা!
অরু এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো না৷ সাইকেল নিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে৷ হুট করে ফিরে তন্ময়কে ভেঙিয়ে গেল৷ তারপর আরেকটু গিয়ে আবারো মাথা ঘুরিয়ে জিহ্বা দেখিয়ে চলে গেল ভেতরে৷ দীপ্ত চাচ্ছিল তন্ময়কে টেনে বাড়ির ভেতরে নিবে৷ তবে যেই রাগী ভাবে তন্ময় তাকিয়ে আছে৷ তা দেখে দীপ্তর গলা দিয়ে কোনো শব্দই বেরোলো না৷ আলগোছে চলে এসেছে সেও৷ যেতে নিয়ে বেশ কয়েকবার পিছু তাকাল৷ তন্ময় তখনো দাঁড়িয়ে৷ যতক্ষণ বাড়ির গেইটে না ঢুকেছে ততক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিলো৷
ড্রয়িংরুমে মোস্তফা সাহেব বসে৷ সদরদরজা সামনে দাঁড়িয়ে আনোয়ার সাহেব৷ সুমিতা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন চিন্তিত চেহারা নিয়ে৷ মুফতি বেগম রান্নাঘর থেকে বারবার চলে আসছেন৷ কোনো কাজেই মন লাগছেনা৷ বাচ্চাগুলো এই প্রথম এমনটা করেছে৷ আগে একটু লুকোচুরি করেছে তবে কিছু সময়ের জন্য৷ এমন পুরোটা দিন পাড় করে দেয়নি৷ অরু ঢুকতেই আনোয়ার সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন৷ ভেজা কাপড়চোপড় লক্ষ্য করতেই বললেন,
— কী করছ এগুলো মা?
সুমিতা বেগম তেড়ে এসেছেন৷ অরুর কান টেনে বললেন,
— কীসের মা? ওর পা দুটো ভাঙব আজ৷
দীপ্তকে ওহী সাহেব হাতের কাছে পেতেই পাছায় উদোম চড় বসালেন৷ তবে একটাই চড় মেরেছেন৷ ছেলের গরম শরীর উপলব্ধি করে মারার সাহস পেলেন না আর৷ মুফতি বেগম ছেলেকে কোলে নিয়ে উপরে চলে গেলেন৷ অরুকে মাথায় কয়েকটা চড় দিয়েছে সুমিতা বেগম৷ তবে আনোয়ার সাহেবের উপস্থিত থাকায় মারতে পারেন নি৷ মোস্তফা সাহেব প্রশ্ন করলেন,
— কে দিয়ে গিছে তোমাদের অরু?
— তন্ময় ভাই৷
মোস্তফা সাহেব থমকে গেলেন৷ তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন৷ আশা নিয়ে শুধালেন,
— চলে গেছে?
— দেখেছিলাম দাঁড়িয়ে৷
মোস্তফা সাহেব বললেন,
— যাও দ্রুত কাপড়চোপড় পরে নাও৷ ঠান্ডা লেগে যাবে৷
— আচ্ছা বড় চাচ্চু৷
অরু নাক টানতে টানতে উপরে উঠছে৷ পিছু ফিরে দেখল মোস্তফা সাহেব বাহিরের দিক যাচ্ছেন৷ নিশ্চয়ই তন্ময় ভাইয়ের আশায়? কিন্তু তন্ময় ভাই কী এখনো আছে? মোস্তফা সাহেব বেরিয়ে মোরের মাথায় তাকালেন৷ তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে তখনো৷ তার দৃষ্টি বাড়ির দিকই ছিলো৷ বাবা ছেলের দৃষ্টি মুহুর্তেই এক হয়ে গেল৷ অপ্রস্তুত ভাবে নড়ে উঠলেন মোস্তফা সাহেব৷ এগিয়ে যাবেন নাকি বাড়ির ভেতরে চলে যাবেন? ছেলেকে কী তিনি ফেইস করতে পারবেন? তন্ময় এগিয়ে আসল না৷ তবে সেখানকার একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো৷ এবং দুটো চায়ের অর্ডার দিল৷ মোস্তফা সাহেব এগিয়ে যাচ্ছেন ছেলের দিক। দোকানের সামনে এসে পৌঁছে তিনি সময় নিয়ে ছেলের মুখের দিক তাকিয়ে রইলেন৷ তন্ময় ও তাকাল৷ ভাবলেসহীন ভঙ্গিতে বললো,
— বসো বাবা!
মোস্তফা সাহেব বসলেন৷ তন্ময়ও তার পাশে বসলো৷ দোকানদার একটা চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই সেটা নিয়ে তন্ময় মোস্তফা সাহেবের দিক এগিয়ে দিল৷ আর একটা নিজে নিল৷ গরম গরম চায়ে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে সমানে৷ বাবার দিক তাকাচ্ছে না৷ মোস্তফা সাহেব তখনো ছেলেকে দেখতে ব্যস্ত৷ ছেলেটা তার শুকিয়ে গেছে৷ ক্লান্ত, বিষন্ন চেহারা হয়ে আছে৷ তার বুকটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে লাগলো৷ এতো কষ্ট করে এমন বড় রাজ্য দাঁড় করিয়ে কী হলো? এতো টাকাপয়সা কামানের কি মানে দাঁড়ায় যখন সন্তানেরা সেই টাকা ব্যবহার করেনা৷ শাবিহা রিক্সা, বাস, অটো দিয়ে চলাফেরা করে, বাড়িতে দু তিনটা গাড়ি থাকতেও৷ আর ছেলের কথা কী বা বলবেন! নিজেদের ফ্যাক্টরি, বিজনেস ছেড়ে অন্যের কোম্পানিতে চাকরি করে৷ হতাশায় তিনি নির্বোধ হয়ে গিয়েছেন৷ তন্ময় জমিন থেকে নজর সরিয়ে বাবার দিক তাকাল৷ খুব আদুরে কন্ঠে প্রশ্ন
করলো,
— কেমন আছো বাবা?
মোস্তফা সাহেবের চোখজোড়ায় জ্বালা করছে৷ তিনি ছেলের থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। নিজের লালচে চোখজোড়া লুকানোর বৃথা চেষ্টায় পড়ে রইলেন৷ অসহায় গলায় বললেন,
— সন্তান বাবাকে ফেলে রেখে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে কেমন আছে তার বাবা!
— চা’টা ঠান্ডা হচ্ছে! খেয়ে নাও৷
— ভিজে কাপড়চোপড় পরে আছো এখনো৷ ঠান্ডা লেগে যাবে৷ বাসায় আসো৷
— মা অপেক্ষায় আছে৷ ফিরতে হবে আমায় বাবা৷
মোস্তফা সাহেব ছেলের দিক তাকালেন৷ তন্ময় উঠে দুকাপ চায়ের টাকা পরিশোধ করল৷ যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও দাঁড়িয়ে রইলো৷ যেতে পারছে না৷ মোস্তফা সাহেব নিজেই বাড়ির দিক চলে যাচ্ছেন৷ সে সেভাবে বসে থাকলে ছেলে তার যাবেনা৷ ভিজে কাপড়চোপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে৷ ছোট থেকেই খুব নাজুক স্বভাবের৷ অল্পতেই ঠান্ডা, জ্বর লেগে যায় ছেলেটার৷ রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়বে ছেলেটা৷ চিন্তায় মোস্তফা সাহেবের বুকটা ব্যথা করছে৷
——-
অয়ন ভেজা কাপড়চোপড় পরে এখনো বাস স্ট্যান্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে৷ তার সামনে বাইক৷ শাবিহার ছুটি হতে পাচ মিনিট বাকি এখনো৷ অয়ন হুট করে হাচি দিয়ে উঠলো৷ ঠান্ডা লেগে গিয়েছে তার৷ নাক টানটান করছে৷ বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল৷ এখন আবার পড়ছে৷ টুপটাপ বৃষ্টির ফোটা পড়ছে৷ অয়ন এক ধ্যানে রাস্তায় তাকিয়ে রইলো৷ তার অদ্ভুত এক ইচ্ছে জেগে উঠলো৷ যদি শাবিহা শাড়ি পরে এমন বৃষ্টির রাতে ল্যাম্পপোস্টের রেখা অনুসরণ করে তার হাতে হাত রেখে হাঁটে কেমন হবে? বৃষ্টিতে ভেজা স্নিগ্ধ শাবিহাকে তখন কেমন দেখাবে? অয়ন কিছুক্ষন আগে দুটো সিগারেট কিনে এনেছিল৷ সেটা ধরাল৷ বড়বড় কয়েকটা টান মেরে ধুঁয়া ছুড়ে মারল মাথা উঁচু করে৷ আঁড়চোখে খেয়াল করলো শাবিহা বেরোচ্ছে৷ আজ আর সিগারেট সরালো না৷ টেনেই যাচ্ছে৷ এক সময় চোখে চোখ পড়লো৷ আলগোছে সিগারেট পাশেই ফেলে দিলো৷ শাবিহা হুট করে রেগে গেল৷ কিন্তু তার রাগ কী নিয়ে আন্দাজ করতে পারছে না৷ অয়নের উপর সে চরম বিরক্ত৷ এই ভেজা কাপড়চোপড় পরে এখনো দাঁড়িয়ে৷ ছেলেটা কী পাগল? আঁড়চোখে তাকাল৷ অয়নের টাই ঝুলে বুকের মাঝখানে দুলছে৷ চুলগুলো কপালের সামনে লেপ্টে আছে৷ আশ্চর্যজনক ভাবে ভার্সিটির কোড ড্রেসে অয়নকে একদম বাচ্চাবাচ্চা লাগছে না৷ বয়স তুলনায় বেশ বড়বড় ভাব নিয়ে রেখেছে৷ শাবিহার চোখের সামনে অয়ন বাইকে উঠে বসেছে৷ বাইক স্টার্ট করে বসে৷ যাচ্ছে না৷ যেমন শাবিহার উঠে আসার অপেক্ষায়৷ শাবিহা না দেখার ভান করে দাঁড়িয়ে৷ মাত্রই বাস এসে থেমেছে শাবিহার সামনে৷ শাবিহা একবার বাসের দিক তাকাল তো একবার অয়নের দিক৷ অয়ন সামনে তাকিয়ে৷ তার দিক তাকাচ্ছে না৷ শাবিহা বাসের দিক এগিয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু তার মন বিচলিত৷ ভেজা কাপড়চোপড় পরিহিত অয়নকে দেখে তার ইচ্ছে করছে না আর বাসে যেতে৷ বাস আর অপেক্ষা করলো না৷ চলে গেল৷ শাবিহা দাঁড়িয়ে তখনো৷
— বৃষ্টি হচ্ছে৷
শাবিহার কথায় তাকাল অয়ন৷ তার উপরেই তো বৃষ্টি পড়ছে৷ সে কীভাবে না জানা যে বৃষ্টি পড়ছে? শাবিহা আকাশের দিক তাকাল৷ মৃদু বৃষ্টি৷ এই বৃষ্টিতে বাইক চড়ে গেলে এক আলাদা অনুভূতি কাজ করবে৷ এই অনুভূতি শাবিহা উপভোগ করতে চায়৷ এগিয়ে গেল বাইকের দিক৷ যখন অয়নের কাঁধে হাত রেখে পেছনে উঠে বসলো, অয়নের ঠোঁটে বিশ্ব জয়ের এক অমায়িক হাসি ফুটে উঠলো৷ সে একটানে বাইক নিয়ে দূর দূরান্তে ছুটে চললো৷ শাবিহা প্রস্তুত ছিলো না মোটেও৷ শক্ত করে ধরলো অয়নের কাঁধ৷
— ধীরে চালাও৷
অয়ন বললো,
— আমাকে শক্ত করে ধরুন শাবিহা৷
শাবিহার হৃদয় কেঁপে উঠলো৷ সে এই প্রথম তার নাম অয়নের মুখে শুনেছে৷ আগে কখনো নাম ধরে বলেনি৷
— আমি তোমার বড়৷
অয়ন বৃষ্টির মধ্যে চেঁচিয়ে উঠলো নিজের সর্বশক্তি দিয়ে, ‘ শাবিহা ‘! শাবিহা ক্রোধের ভান করে শাসাল,
— অয়ন!
অয়ন আরও জোরে তার নাম উচ্চারণ করলো৷ নিজের নাম যেনো চারপাশ থেকে শুনছে সে৷ এই ব্যাকুল অনুভূতি কীভাবে অস্বীকার করবে? অয়ন শব্দ করে হাসছে৷ তার হাসির শব্দে শাবিহার ঠোঁটের কোণ উঁচু হয়ে আসছে৷ পরপর চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললো৷ বৃষ্টির ফোটা তার চোখমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে৷ চুলগুলো খুলে গিয়েছে ততক্ষণে৷ ওড়না ছুটাছুটি করছে বিদায় সেটা পেঁচিয়ে নিলো৷ অয়ন শব্দ করে বললো,
— আমাকে শক্ত করে ধরুন৷
— এই না না৷ আমি ভয় পাই৷
— ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন আমিতো তো তাই চাই৷
— আমি কিন্তু নেমে যাবো৷
— আমি নামতে দিব না আপনাকে৷
বাইক আরও স্পিডে চলছে৷ ভয়ে শাবিহা কখন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে খেয়াল করেনি৷ তার দু হাত অয়নের দু’কাঁধে৷ ভয়ে খামচে ধরে আছে সেখানটায়৷ অয়ন বৃষ্টির মধ্যে উচ্চস্বরে একটি গানের সুর তুললো,
সে বৃষ্টি ভেজা পায়ে
সামনে এলে হায়, ফোটে কামিনী
আজ ভিজতে ভালো লাগে
শূন্য মনে জাগে প্রেমের কাহিনী
আশ্চর্যজনক ভাবে অয়নের গলা খুব সুন্দর৷ গান গাওয়ার ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে সে প্রায়শই গান গায়৷ শাবিহার খুব করে ইচ্ছে হলো, একটা সম্পুর্ন গান অয়নের থেকে শুনতে৷ পরক্ষণেই নিজেকে মনেমনে বকল৷ লজ্জার মাথা খেয়েছে৷ বুড়ো বয়সে একটা একটুখানি ছেলের মুখ থেকে গান শুনতে ইচ্ছে করে তার৷ নিজেকে নিজেই ভেঙাল শাবিহা৷ তারপর রাস্তায় নজর রাখল৷ তবে এই বৃষ্টির রাতে বাইকে বসে অয়নের মুখে শোনা এই গান মনে হয়না সে কখনো ভুলতে পারবে৷ তার বুকের ভেতরে ধুকপুক করতে থাকা হৃদয় তাকে ভুলতে দেবেনা৷ অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তারপর বাড়ির সামিল বাইক থামিয়েছে অয়ন৷ শাবিহা নেমে দ্রুত পায়ে বাড়িতে ঢুকে গেল৷ ফিরে তাকাল না৷ অয়ন তাকিয়েই রইলো৷ তার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি৷ তার মন বলছে সে একটু হলেও শাবিহার মন নাড়াতে সক্ষম হয়েছে৷ হঠাৎ শাবিহা ফিরে এলো৷ ধমকের সুরে বললো,
— এই ছেলে যাচ্ছ না কেন!
ধমক দিয়েই সে ঘরে ঢুকে গিয়েছে৷ এবার অয়ন শব্দ করে হাসতে লাগলো৷ হাসতে হাসতে সে বাইক স্টার্ট করে একটানে চলে গেল৷ আপাতত বাইক সে তন্ময়ের বাসার সামনে পৌঁছে দিয়ে, তারপর বাড়ি যাবে৷ একটা লম্বা ঘুম দেবে৷

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here