প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৩

0
333

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৩
________________________
অরুর নামের একটা ডাস্টবিন আছে৷ ডিজাইনার ডাস্টবিন৷ যেটার ডিজাইন সে নিজেই করেছে৷ এই ডাস্টবিনের উপরে লেখা ‘ অরুর পার্সোনাল ডাস্টবিন ‘৷ এবং ডাস্টবিনটার অবস্থান ড্রয়িংরুমের কোণে৷ আসতে যেতে নিলে সবার নজর প্রথমে এই ডাস্টবিনে চলে যাবে৷ আগের সময় গুলো হলে এটা দেখলেই তন্ময় একটা লাথি মেরে যেতো৷ আবার লাথি মেরে আসতো৷ কয়েকবার এটাকে ফেলে দিতেও নিয়েছিলো৷ ড্রয়িংরুমের কোণায় এমন হলদেটে একটা ডাস্টবিন কেউ রাখে? তার উপর ডাস্টবিনটা বিচ্ছিরি ভাবে ডিজাইন করা৷ তন্ময় ফেলতে নিয়ে অরুর কান্নাকাটির ঠেলায় পেরে উঠেনি ফেলতে৷ এখন এই ডাস্টবিনের কাজ কী? ডাস্টবিনের কাজ অরুর টিস্যু নেওয়া৷ আপাতত ডাস্টবিন অর্ধেক টিস্যু দিয়ে ভর্তি৷ কারণও আছে৷ গত পরশু একটি জনপ্রিয় নাটক হয়েছিল আরটিভিতে৷ নাটকের নাম ‘ বড়ো ছেলে ‘৷ অরু সেই নাটক দেখে কেঁদেকেটে শেষ৷ টিস্যুর প্রয়োজনে সেদিন ডাস্টবিন অর্ধেক ভর্তি হয়ে গেল৷ এইযে সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই, হাতে টিস্যু নিয়ে এসেছে সে৷ আকাশ ডাইনিংয়ে বসে ব্রেকফাস্ট করছে৷ অরুর হাতের টিস্যু দেখে নাক কুঁচকে বললো,
— ছিঃ! এই তুই আমার সামনে থেকে সর৷
— এমন ভাব নিচ্ছ যেমন তোমার নাক পিটপিট করেনা!
— না করেনা৷ আমার নাক শক্তপোক্ত৷ এসব পিটপিট হয়না৷ তোর নাক পাতলা তাই পিটপিট করে৷ এক কাজ কর তোর নাক নিয়ে আমার ক্লিনিকে আয়৷ সেলাই করে দেই৷ নাক পিটপিট দূর হয়ে যাবে৷
অরু কষ্ট পেল৷ মনের দুঃখ এবং নাকের পিটপিট নিয়ে মুখ গোমড়া করে ফেললো৷ মুফতি বেগম আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে আসছেন৷ আকাশকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
— এই তুই খেয়ে তাড়াতাড়ি ভাগ৷ মেয়েটার পিছু লেগে থাকবি না একদম৷ অরু তুই বোস৷
খেয়ে নে৷
আকাশ ব্রেড চিবুচ্ছে৷ চিবানোর ফাঁকে বললো,
— ও এখনো দাঁত ব্রাশ করেনি মা৷ খাচ্চোর মেয়ে৷
অরু রেগে গেল৷
— মাথা গরম করে দিবেনা বলে দিলাম৷
— বলে দিয়ে আমাকে উদ্ধার করে দিলি৷
বলেই হাসতে লাগলো৷ অরু রেগে সেখান থেকে চলে এলো৷ বারান্দায় ঝুলানো টিয়াপাখিটি ঝিমিয়ে পড়েছে৷ অরু দাঁত মাজতে মাজতে উঁকি দিল৷ পাখিটিকে চোখ বন্ধ করে রাখতে দেখে এগিয়ে আসলো৷ তারপর বেসামাল ভঙ্গিতে খাঁচা খানা নেড়ে দিল৷ পাখিটি চেঁচিয়ে বন্দী খাঁচার মধ্যে ধড়ফড় করে উঠলো৷ তারপর অরুর বত্রিশ দাঁত দেখে শান্ত হয়ে গেল৷ আবারো নিজের যায়গায় বসে ঝিমাচ্ছে৷ অরু পাখিটিকে কিছুক্ষণ বিরক্ত করার প্রত্যাশায় রইলো৷ তবে পাখিটি বিরক্ত হচ্ছেনা৷ নিজের মতো ঝিমিয়ে রয়েছে।
— আনইন্টারেস্টিং টিয়াপাখি তুই৷ ধুর!
সম্ভবত তিন বছর হবে পাখিটি তার কাছে৷ ছোট টিয়াপাখিটি এখন বড় হয়ে গেছে৷ কথা বলতে জানে টুকটাক৷ তবে বলেনা৷ খুব অলস! একদম অরুর মতো৷ নিজের মতো পাখিটিকে হতে দেখে অরু বেশ হতাশ৷ পাখিটিকে আত্নবিশ্বাসী, সাহসী, কর্মজীবী করতে চাওয়া তার মন এখন বেশ হতাশ৷
টিয়াপাখিটি তাকে তন্ময় এনে দিয়েছিল৷ অরুর স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটির কথা৷ হয়েছে এমন অরুকে সুমিতা বেগম মেরেছেন৷ মারার অবশ্য কারণ রয়েছে৷ সুমিতা বেগম আটা গুলিয়ে রেখেছিলেন৷ রুটি বানাবেন৷ অথচ তিনি এসে দেখেন আটাতে এক গামলা পানি ঢেলে তা মতে যাচ্ছে অরু৷ পাকনামি করে মায়ের সাহায্য করতে নেমেছিল বেচারি। ব্যস, রাগের মাথায় অরু বেশকিছু মাইর খেয়েছে মায়ের থেকে। মা’র খেয়ে পেট ভরে গিয়েছে বিদায় সারাদিন কিছুই খেল না৷ মূল কথা সে রাগ করেছে৷ দরজা আটকে ঘরে পড়ে আছে৷ কারো ডাকের সারাশব্দ করলো না৷ রাতে বাড়ি ফিরে তন্ময় তাকে গম্ভীর স্বরে ডাকে৷ অরু মনেমনে তন্ময়কে খুব ভয় পায়৷ যা সে কখনো দেখায়না৷ শুনেছে ভয় দেখালে ভয় বেশি পেতে হয়৷ তাই যখন তন্ময় ডাকল দৌড়ে বেরোয়নি৷ তবে সময় নিয়ে ঠিক দরজা খুলে বেরোলো৷ তখন তন্ময় তার হাতের পাখি সহ খাঁচাটি অরুকে দিল৷ তারপর ধমকের সুরে বললো,
— এক্ষুনি গিয়ে খেতে বোস, যা!
পাখি পেয়ে খুশিতে অরু দু’প্লেট খাবার একাই খেয়ে নিয়েছিল৷ হা হা!
স্কুল ড্রেস পরিহিত অরু কাঁধে ব্যাগ চেপে নিচে নেমে এলো৷ দীপ্ত তখন ডাইনিংয়ে বসে৷ তৈরি হয়ে গিয়েছে জনাব৷ অরু তার পাশে বসে দ্রুত ব্রেকফাস্ট করতে শুরু করেছে৷ বাইরে থেকে মারজির কন্ঠ শোনা যাচ্ছে৷
— অরু! তাড়াতাড়ি!
মারজির ডাকে সে ব্রেড হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো৷ পেছনে দীপ্তও অরুর দেখাদেখি একই কাজ করলো৷ দুজনের পেছনে সুমিতা বেগম বললেন,
— আরে ঠিক ভাবে খেয়ে যাবি তো!
তার কথা দুজনের একজনও শুনল না৷ মারজি সাইকেল হাতে দাঁড়িয়ে৷ পাশে তার ভাই এহসানও এসেছে৷ তাদের বাড়ি পাশের লাইনে৷ হাতে সময় থাকলে যাওয়ার সময় মাঝেমধ্যে অরু দীপ্তকে সাথে নিয়ে যায়৷ তারা প্রায়সময় এক সাথেই যাতায়াত করে৷ এমন সময় পাশের বিল্ডিং থেকে অয়ন বেরিয়েছে৷ অয়নকে দেখে এহসান হেসে এগিয়ে গেল৷ তাদের সাথে যোগদান হলো দীপ্ত৷ তাদের তিনজনের পেছনে মারজি আর অরু হাঁটছে৷
— নাকটা এমন লাল হয়ে আছে কেন?
— আর বলিস না!
— মজার ব্যাপার ঘটেছে শুনেছিস?
অরুর নিরাশ চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো৷
— কী?
— মুবিন স্যার সুমনার নামে প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ দিয়েছেন৷ তাকে নাকি সুমনা বিরক্ত করে৷
বলেই হো হো শব্দে হাসতে লাগলো মারজি৷ অরু চিন্তিত সুরে বললো,
— শুনেছিলাম তো তাদের রিলেশন চলছে!
— আর রিলেশন৷ মুবিন স্যার হয়তো এই মেয়েকে চিনে ফেলেছেন৷ তাই আগাতে নিয়ে ফিরে এসেছেন৷
— তারপর? প্রিন্সিপাল কোনো অ্যাকশন নিয়েছে?
— বাবামা আনতে বলেছেন৷ হয়তো আজ তোর মামা মামী আসবে কলেজ৷
অরুর কপাল জোড়া কুঁচকে গেল৷ সে তার মামা মামীকে একদম পছন্দ করেনা৷ নানি বাড়ির কাউকে পছন্দ না তার৷ সবাই ওঁৎ পেতে থাকে তার মা-বাবার মধ্যে ঝামেলা পাকানোর জন্য৷ কিন্তু তার মা সেটা একদম বোঝেননা৷ ভাইদের সাপোর্ট টেনে যান৷ তাই অরু নানি বাড়ি আজকাল আর যায়না৷ নানা-নানি বেঁচে নেই নানির বাড়িও নেই তারজন্য। আজ সে সোজা ক্লাসে ঢুকে বসে থাকবে৷ একদম সামনে পড়বে না ওই দুজনের৷ মারজি অরুর চিন্তিত চেহারা দেখে টপিক পরিবর্তন করার জন্য বললো,
— তন্ময় ভাই আর তোর বড় মা এখনো বাড়ি ফেরেনি? দু’বছর তো হয়ে গেল। আর কতো? তোর চাচ্চু কোনো স্টেপ নিচ্ছে না কেন এখনো? বাবার থেকে শুনলাম তন্ময় ভাইদের বিজনেস খুব ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছে৷
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো অরু৷ পারিবারিক ব্যাপার গুলো সে সবসময় এভোয়েড করে৷ আজও একই কাজ করেছে৷ মারজির কাঁধে মাথা রেখে চুপ রইলো৷ তার চাচ্চুর কষ্ট সে নিতে পারছেনা৷ সে জানে তার বড় মাও খুব কষ্টে আছে৷ তন্ময় ভাইও খুব যন্ত্রনায়৷ বাড়ির সবাই জানে তন্ময় ভাই তার বাবাকে কতটা ভালোবাসে এবং সম্মান করে৷ ছোট থেকেই সে বাবার পাগল৷ বাবার আদরের ছেলে হুট করে বাবার থেকে সরে গিয়েছে৷ সেটা কতটা যন্ত্রনা দায়ক বাবা-ছেলের জন্য, তা অরু উপলব্ধি করতে পারছে একটু হলেও৷ কিন্তু এখানে কারো কিছু করার নেই৷ তারা নিজেরা যদি এই দ্বিধা, ক্ষোভ, অভিমানের দেয়াল না ভাঙে তাহলে অন্যকারো ভাঙার সাধ্য নেই৷ কলেজের সামনে পৌঁছে অরু লুকিয়ে পড়লো৷ মারজি অরুর পেছনে৷ সেও দেখছে কল্লা বের করে৷ সুমনা তার মা-বাবার সাথে দাঁড়িয়ে কাঁদছে৷ তাদের ঘিরে ধরেছে শত স্টুডেন্টস৷
দীপ্ত চোখমুখ অন্ধকার করে ফেলেছে৷ বিরক্ত নিয়ে বললো,
— তাদের দেখে কি এভাবে লুকিয়ে থাকবে নাকি? ঘন্টা বেজে যাবে৷ চলো ভেতরে দেরি হবে নাহলে৷
— দাঁড়া একটু৷ যেয়ে নেক৷
— যাবে বলে মনে হয়না৷ তোর জন্যই দাঁড়িয়ে৷
মারজির কথায় যুক্তি আছে৷ অরুর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো৷ গোলগাল চোখ করে প্রশ্ন করলো,
— বাংক দিবি? চল ঘুরতে যাই৷
দীপ্ত চেঁচিয়ে উঠলো,
— খবরদার৷ আমি কিন্তু বিচার দিব চাচ্চুকে।
— দিস! আপাতত তুই যা ভাগ৷
দীপ্ত চোখ রাঙাল৷
— তোমরা না গেলে আমিও যাচ্ছিনা৷
আচমকা তাদের পেছনে অয়ন এসে দাঁড়ালো৷ নীচু সুরে বললো,
— আমিও তাহলে আজ বাংক দিব ভাবছি৷
খুশিতে অরু সাতসকালে চাঁদ দেখতে পারছে ৷ কিন্তু কথা হলো, কোথায় যাবে? দুশ্চিন্তায় থাকা সে হুট করে বললো,
— আপুকে সারপ্রাইজ দিতে যাই আপুর অফিসে? এটা কেমন হবে? আশপাশ ঘুরতে ঘুরতে যাবো৷ আমাদের ঘুরাফেরাও হয়ে যাবে৷
রাজি হলো সবাই৷ সঙ্গে সঙ্গে অরু, অয়ন, দীপ্ত মারজি একই গন্তব্যের জন্য রওনা হলো৷ নিজেদের সাইকেল নিয়ে স্টেশনের সামনে এসে থামলো৷ অরু বললো,
— অয়ন ভাইয়া তুমি রাস্তা চেনো? আমি কিন্তু চিনি না৷
— সমস্যা নেই আমি চিনি৷ চল!
——
সাইকেল করে এতটা পথ অতিক্রম করা সহজ বিষয় নয়৷ মাঝরাস্তায় অরুর খিদে পেয়েছে৷ দীপ্ত বললো তারও খিদে পেয়েছে৷ অয়ন তাদের নিয়ে একটা হোটেলে ঢুকল৷ তখন অলরেডি বারোটা বেজে গিয়েছে৷ সাড়া রাস্তায় তারা যেভাবে হৈচৈ করতে করতে এসেছে সময় তো যাবেই৷ পরোটা ভাজি অর্ডার করলো সবার জন্য৷ খেতে নিয়ে তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে৷ মারজি বললো,
— অয়ন ভাই তোমাকে নাকি সুমনা পছন্দ করে?
— তো?
দীপ্ত বললো,
— তন্ময় ভাইকেও পছন্দ করে এই মেয়ে৷ পছন্দ বললে ভুল হবে৷ একদম আমার ভাইয়ের গলায় ঝুলে পড়তে চায়৷ সেবার অরু আপুর মামামামী আমাদের বাড়িতে এসে, বড়ো চাচ্চুর সামনে একটু বাজিয়ে গিয়েছে৷ মানে তারা নিজের মেয়ে আমাদের বাসায় দিতে চায়৷
অয়ন নাক ছিঁটকে বললো,
— ক্যারেক্টরল্যাস মেয়ে৷
হুট করে অয়নের চোখ হোটেলের বাইরে চলে গেল৷ সুমনা সহ বেশকিছু ছেলেমেয়েদের একসাথে যেতে দেখল৷ সেটা সে অরুকে বললো৷ অরু সঙ্গে সঙ্গে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ তার পিছুপিছু বাকিরাও বেরিয়ে এসেছে৷ অয়ন ঠিক দেখেছে৷ সুমনার সাথে দুটো মেয়ে আর চারটা ছেলে রয়েছে৷ অরু নাকমুখ কুঁচকে ফেললো৷ অয়ন বললো,
— ওরা মনে হয়, পার্কের দিক যাচ্ছে৷
মারজি বললো,
— আমরাও যাই গিয়ে দেখি কী করে? সুমনা কি সেইফ ওদের সাথে? এখানকার একটা ছেলেমেয়েও ভালো না৷
অয়ন শেষে ছেলেটাকে দেখিয়ে বললো,
— এই ছেলেটা বেশকিছু মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে৷
মেয়েদের সাথে খারাপ কাজ করে তা ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল করে৷
অরু চিন্তিত সুরে বললো,
— তাহলে তো সুমনা সেইফে নেই৷ আমরা ফলো করে কিছুটা দেখি?
অয়ন মাথা দোলাল৷ সুমনাদের ফলো করতে করতে দুপুর তিনটা বেজে গেল৷ আপাতত সুমনারা পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে৷ ভেতরে যাবে মনে হয়। ওদের দলের একজন দৌড়ে দোকানের দিক ছুটেছে৷ ফিরেছে বেশকিছু সিগারেট নিয়ে৷ অরু আর মারজি মুখে হাত দিয়ে রয়েছে৷ তারা দুজন অবাকের সপ্তমে৷ তারপর দেখল সুমনারা সবাই গোল হয়ে একটা গাছের পেছনে বসেছে৷ এবং লুকিয়ে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে৷ অরু ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
— আমরা চলে যাই চলো!
ঘুরেফিরে আবারো স্ট্যান্ডের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তারা৷ মেইন রোড ধরে সবাই সাইকেল করে পাল্লা লাগালো৷ যে যত দ্রুত যেতে পারে৷ অয়ন সর্বপ্রথম৷ তারপর অরু তারপর দীপ্ত৷ পেছনে মারজি৷ তাদের সাইকেল পাল্লা থেমেছে তৃতীয় বাস স্ট্যান্ডের সামনে৷ আর তিন চারটা বাস স্ট্যান্ড পাড় করতে হবে৷ অয়নের পেছনে তারা আবারো চললো৷ শাবিহার অফিসের সামনে পৌঁছাতে নিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে৷ পৃথিবী অন্ধকার৷ চাঁদ ডুবে গিয়ে আকাশে মেঘ জমেছে৷ বৃষ্টি হবে মনে হয়৷ আবহাওয়া খারাপ৷ আশ্চর্যজনক ভাবে শাবিহাও তখন বেরিয়েছে খেতে৷ তার ব্রেক-টাইম৷ রোজকার মতো তন্ময়ও সেই মুহুর্তে বাইক নিয়ে থেমেছে শাবিহার সামনে৷ আর তন্ময়ের সামনে চার সাইকেল৷ তন্ময়ের নজর পেয়ে অরু ঘাবড়ে গেল৷ সাইকেল ধরে রাখা তার হাত শক্ত হয়ে গেল৷ শাবিহাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়৷ সে অরুদের দিক যেতে নিচ্ছিলো, আর তখনই নেমেছে তুমুল বৃষ্টি৷ ভিজিয়ে দিচ্ছে উপস্থিত সবাইকে৷ তন্ময়ের চোখমুখ শক্ত৷ বাইক থেকে নেমে এগিয়ে আসলো৷
— এখানে কেন তোরা?
দীপ্তর কোনোকিছুরই পরোয়া নেই এখন৷ সে তার সাইকেল ফেলে তন্ময়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো৷
কেঁদেকেটে তন্ময়ের শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে৷ ঠিক কতমাস পর সে তন্ময়কে দেখছে হিসেব নেই৷ এদিকে বৃষ্টির মধ্যে হুট করে ঝাকড়া চুলের দীপ্তকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে তন্ময়৷ তার রাগ কিছুটা কমে গেল দীপ্তর কান্ডে৷ এখন অরুকে চোখ রাঙাবে নাকি দীপ্তকে শান্ত করবে বুঝে উঠতে পারছেনা৷ শাবিহা সবাইকে তাড়া লাগালো৷
বললো,
— স্ট্যান্ডের ভেতর দাঁড়া৷ ভিজে যাচ্ছিস৷
সবাই নিজেদের সাইকেল চাপিয়ে স্ট্যান্ডের ভেতর দাঁড়ালো৷ কমবেশি সবাই ভিজে গিয়েছে৷ তবে অয়ন ভেতরে আসলো না৷ সে খোলা আসমানের নিচে দাঁড়িয়ে৷ অয়নের দেখাদেখি মারজিও বৃষ্টির মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো৷ ভালো লাগছে এখানকার বৃষ্টি৷ তন্ময় তাদের দিক নজর কীভাবে রাখবে? সে অরু এবং দীপ্তর সাহস দেখে হতভম্ব৷ দীপ্তকে কোল থেকে নামিয়ে ধমকে উঠলো,
— এখানে কী করছিস?
— সাইকেল দিয়ে আপুর সাথে দেখা করতে
আসছি৷ আমি কিন্তু আসতে চাই নাই৷ অরু আপু জোর করে নিয়ে আসছে৷
এসবকিছুর গুরু কে বুঝতে বাকি রইলো না তন্ময়ের৷ সে তেড়েমেরে অরুর দিক এগিয়ে গেল৷ ভয়ে অরু দৌড়ে বৃষ্টির মধ্যে চলে গিয়েছে৷ ঠিক অয়নের পেছনে গিয়ে ভিজতে লাগলো৷ তন্ময় তখন রাগে থরথর করে কাঁপছে৷ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— সাহস আকাশ ছুঁয়েছে না?
— এই দীপ্ত মিথ্যে বলছে বিশ্বাস করুন! ও উল্টো বললো যে আপুকে খুব মিস করছে৷ দেখতে চায় একটু৷ আমি ভাবলাম বেচারা কষ্ট বুকে চেপে কতক্ষণ রাখবে৷ তাই নিয়ে আসলাম৷
শাবিহা হেসে বললো,
— আমরা কিন্তু একই বাসায় থাকি মনে রাখিস! তবে আমাকে এমন সারপ্রাইজ দিয়েছিস যে এখনো হজম করতে পারছিনা৷ তা কী খাওয়াবো তোদের? কি খাবি? এসেছিস তাও এমন ওয়েদারে!
দীপ্ত বললো,
— এই ওয়েদারে চা হয়ে যাক? ওইতো টং৷
অয়ন বললো,
— আমি এনে দিচ্ছি৷
অরু আর মারজি দ্রুত স্ট্যান্ডের ভেতর চলে গেল৷ তন্ময় খোলা আসমানের নিচে যেতেই বৃষ্টিতে সম্পুর্ন ভিজে গেল৷ লেপ্টে থাকা শার্ট ভেদ করে তার সুঠাম দেহ দেখা যাচ্ছে৷ অরুর চোখজোড়া আঁড়চোখে সেখানে চলে গেল৷ এবং চোখজোড়া কিছুক্ষণ পিটপিট করে চেয়ে রইলো৷ তারপর মাথা ঘুরিয়ে ফেললো৷ আবারো আঁড়চোখে তাকাল৷
মোট ছয় কাপ চা এনেছে৷ একেকজন একেকটা কাপ হাতে নিয়েছে৷ গরম ধুঁয়া উড়ছে চায়ের থেকে৷ কাপে চুমুক দিয়ে মারজি বললো ,
— চা’টা বেশ মজা৷
অয়ন আনমনে বললো,
— হ্যাঁ৷ এই চাচার দুধ চা অসম্ভব স্বাদের।
— যেভাবে বলছ যেমন তুমি প্রত্যেকদিন এসে খাও অয়ন ভাই।
অয়ন চমকে গেল৷ তারপর ছুতো ধরে বললো,
— বন্ধুকে মাঝেমধ্যে ড্রপ করি এখানে তো!
তন্ময়ের মেজাজ তুঙ্গে৷ তাই তাকে কেউ বিরক্ত করছে না৷ টাই অর্ধেক খুলে ঝুলিয়ে রেখেছে৷ গরম চায়ে কয়েক চুমুক দিয়ে অরুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ অরু তাকে দেখতেই চায়ের কাঁপ হাতে হাচি দিয়ে উঠলো৷ ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে তার৷ কপাল কুঁচকে পকেট থেকে ভেজা রুমাল এগিয়ে দিলো তন্ময়৷ অরু সেটা নিয়ে আলগোছে নাক পরিষ্কার করে বসলো৷ নাক পরিষ্কার করে মনে পড়লো এটা তন্ময়ের রুমাল, টিস্যু না৷ রুমালের দিক তাকিয়ে অরুর চোখজোড়া ভিজে উঠলো৷ এতো সুন্দর রুমালটা নষ্ট করে ফেলল৷ এটা এখন ঘষেঘষে পরিষ্কার করে দিলেও তো তন্ময় আর ব্যবহার করবে না৷ দীপ্ত চায়ের কাপ হাতে হাসছে৷
— আজ আমাদের অরু আপুর হাচি কাশি থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবেনা।
বৃষ্টিতে ভিজেছে যেহেতু এবার অরু ঠান্ডায় পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে৷ এভাবেই এর হাচি কাশির শেষ নেই৷ এবার ঠান্ডার ছুতোয় তো তছনছ করে দিবে সবকিছু৷

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here