গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায় #পর্বঃ_২০ #লেখাঃ_আফসানা_মিমি

0
388

#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_২০
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি
——–

গাজীপুর থেকে প্রায় সাইত্রিশ কিলোমিটার দূর মাওনা চৌরাস্তায় অবস্থিত কাকলি ফার্নিচারের প্রধান শো রুম। বাশারকে তার স্ত্রী এক ঘণ্টার পথ জার্নি করে এখানে নিয়ে এসেছে। শো রুমে প্রবেশ করতেই নীচতলায় খাঁট, সেলফ, কেবিনেট ইত্যাদি সামগ্রী দেখতে পাওয়া গেলো। মাসুদার নীচতলায় কোনো কাজ নেই তাই বাশারকে নিয়ে সোজা দোতলায় উঠে গেলো। সোফা, খাট সহ নানারকম কাঠের আসবাবপত্র সাজানো গোছানো রয়েছে। মাসুদা এক লক্ষ টাকার পালঙ্কের কাছে এসে ছুঁয়ে দেখছে। বাশারও খুব খুশি! তাদের মতো মধ্যবিত্তদের ঘরে এক লক্ষ টাকার পালঙ্ক মানে কতো কিছু! আর টাকার বিষয়টাও বাশারকে ভাবাচ্ছে না কেননা টাকার থলিকেই তো বিয়ে করে এনেছে! এখন কী আর তার চিন্তা আছে?
শো রুমের মালিক মোঃ সোহেল রহমান বাশার এবং মাসুদাকে হাসিমুখে স্বাগতম জানিয়ে বলতে শুরু করলো,” আপনারা খুব লাকি বুঝলেন! পৃথিবীতে কতজন আর আছে! যারা পালঙ্কের উপর ঘুমায়! পৃথিবীতে আশি শতাংশ মানুষরা দামী গাড়ি,দামী পোশাক, কিনে টাকা উড়ায়, যা আজ আছে কাল নেই। কিন্তু আপনারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কাকলি ফার্নিচার বিশ্বের একমাত্র ভাইরাল ফার্নিচার। যা দামে কম কিন্তু মানে ভালো।”

ভদ্রলোকের বিশাল ভাষণ শুনে বাশার মনে মনে বলল,” বিক্রয় করার অভিনব কৌশল হলো, কথার আকর্ষণ। তুমি মিয়া বলতে থাকো।”

মাসুদা খুশিতে গদগদ হয়ে বাশারের উদ্দেশে বলল,” আমি আজই এক লক্ষ টাকার পালঙ্ক ঘরে নিয়ে যাবো। প্লিজ প্লিজ তুমি ব্যবস্থা করো!”

বাশার স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে মোঃ সোহেল রহমানের উদ্দেশে বলল,” আপনি সব ফর্মালিটি পূরণ করুন। আমরা এটাই নিব।”

” কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা আজই আপনাদের ঠিকানায় পৌঁছে দিব।”

ফর্মালিটি পূরণ করে বাশার ও মাসুদা শো রুম থেকে বের হয়ে আসে। সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামার সময় মাসুদা সোহেল রহমানের দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসে।

—————————————-

হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ!” গানটা ছাড়া বিয়ে বাড়ির আমেজ জমে উঠে না। ঊনিংশ শতকের সময়ে দাদী চাচীরা গলা ছেড়ে গান গাইতো, একজোট বেঁধে গীত গাইতো। বর্তমান জেনারেশনে গানগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে। বাংলা গানের পরিবর্তে হিন্দি বা ডি জে গান চলে হলুদের অনুষ্ঠানে। ময়মনসিংহ থাকতে নয়নারা ভাই বোনেরা হলুদের গান শুনে নাচতো। হৈ হুল্লোড়ে মাতিয়ে তুলতো সারা এলাকা। এখন সেগুলো স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ। মিছিলের সাথে কোনো একদিন হলুদের আনন্দ নিয়ে গল্প করেছিল। সেই সুবাদে আজ মিছিল একমাত্র বন্ধুর জন্য হলুদের গান বাজাতে বলল। নয়নার দেখা সেই স্টেজে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো হয়ছে। একপাশে সাউন্ড বক্সে হলুদের গান বাজছে অপরপাশে স্টেজে বাচ্চারা নাচছে।
বিকালের এই সময়টায় মানুষের আনাগোনা কম। অতিথিরা এখনো আসা শুরু করেনি। নয়না এই সুযোগে বাচ্চাদের আনন্দ উপভোগ করছে। বাচ্চাদের ভুলভাল নাচে করতালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে সে। মুখে তার ভুবন ভোলানো হাসি। দূর থেকে কেউ যে তার হাসিতে মাতোয়ারা হচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। নয়নার পাশে তূর্য এসে দাঁড়ালো। নয়নার সেদিকে খেয়াল নেই। তূর্যের ঐ বাচ্চাদের উপর হিংসে হচ্ছে। তাদের স্থানে সে কেনো থাকলো না? তূর্যের জন্য তাহলে নয়নার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠতো! নয়নার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বিষয়টা তখন খেয়াল হয় যখন তূর্য নয়নার হাতে একটি শপিং ব্যাগ তুলে দিলে। উৎসুক দৃষ্টিতে নয়না তূর্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” এটা কী?”
তূয নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,” শাড়ি।”
” আমি নিতে পারব না।”
নয়না শপিং ব্যাগ তূর্যের হাতে ধরিয়ে দিলো। সে আর তূর্যের কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চায় না। নয়না চলে যেতে নিলে তূর্য নয়নার হাত ধরে ফেললো। নয়নার হাত টেনে একদম নিজের কাছাকাছি এনে বললো,” আমার সব তোমার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি, তোমার দুঃখকে নিজের করে নিয়েছি। আজ আমার খুশির জন্য এটা নিতে পারবে না, নয়ন!”

নয়না শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে হাত ছাড়িয়ে নিলো। ছলছল চোখে বলল,” আমাকে ছোঁবেন না, তূর্য! অতীতের ঘা তাজা হয়ে উঠে। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি।আমি চাই না, দ্বিতীয়বার আপনাকে অবিশ্বাস করতে।”

তূর্য গাঢ় চোখে নয়নাকে দেখে নিলো। মেয়েটা কী তাকে ভয় পাচ্ছে! তূর্যের উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিলো না। অবশ্য সে এখনো নয়নার কাছে পরপুরুষ! নয়নার অনিচ্ছায় ছোঁয়া ঠিক হয়নি। তূর্য দুই হাতে মাথার চুল টেনে বললো,” আচ্ছা সরি, ছুঁবো না। কাছেও আসবো না। তবে আমার কথা শুনো! মানতে চাও না কেন? আমি কী তোমার দিকে বাজে উদ্দেশ্যে তাকিয়েছি! তোমাকে ভালোবাসি, বুঝতে চাইছো না কেন? ”

তূর্যের উচ্চ আওয়াজে নয়নার অন্তর কেঁপে উঠলো। তূর্যের বলা একটা কথাও ভুল নয়। সেই বেশি বেশি বুঝে। নয়নাই বা কী করবে! তার অতীত যে খুবই বিশ্রী। একজনের জন্য
সে তূর্যকে কষ্ট দিলো যে কী না নয়নার দুঃখে সুখে সাক্ষী হিসাবে আজীবন তার পাশে থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। তূর্য তাচ্ছিল্য হাসলো। নয়নার হাতে শপিং ব্যাগ তুলে দিয়ে চলে যেতে নিলো। নয়নার ঠিক সেই মুহূর্তে কী হলো! তূর্যের টি শার্টের পিছনের দিকটা খামচে ধরলো। নয়নার মাথা তূর্যের পিঠে ঠেকিয়ে বলল,” যাবেন না, প্লিজ!”
” থাকলে তো আমায় খারাপ ভাববে।”
” আমি নির্বোধ, এবারের মতো ক্ষমা করুন!”
” আমি কে ক্ষমা করার। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে কোনো সম্পর্ক নেই।”
” জিদ দেখাচ্ছেন কেন? আমার সম্পর্কে তো সবই জানেন।”
” বুকে হাত রেখে বলো তো! আমায় বিশ্বাস করো কী না!”
” মিথ্যা বলি!”
“হুম!”
” আপনার কাছাকাছি থাকলে শান্তি পাই না! দূরে গেলে ছটফট করি না। আপনার অনুপস্থিতিতে বুকে ব্যাথা হয় না। আপনার কথা ভেবে হাত পা নিশপিশ করে না। আপনার কথা শুনলে শুনতে ইচ্ছে করে না।”

তূর্যের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। চোখ বন্ধ করে সময়টাকে অনুভব করতে লাগলো সে। এদিকে নয়নাও নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। তূর্যের থেকে কিছুটা দূরে সরে বলল,” আজ সন্ধ্যায় থাকবেন না?”
তূর্য নয়নার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” যদি আমার জন্য সাজো, তবে আসবো। ”
নয়না নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” আমি অপেক্ষায় থাকবো।”
—————————

সন্ধ্যা লগ্নে আকলিমার বাড়ির সামনে উপচে পড়া ভীড় জমে আছে। লোকের মাথা লোকে খাচ্ছে। বড়ো বড়ো দুই দুইটা পুলিশের গাড়ি থেমেছে বাড়ির সামনে। আজ মাহবুব শিকদারের রেখে যাওয়া বডিগার্ডরাও উধাও। কোথায় গেছে কে জানে! নাকি পুলিশের ভয়ে পালিয়েছে? এতো মানুষের ভীড় সাথে পুলিশের আগমনের ব্যপারটা অদ্ভুত নয় কী? মাহবুব শিকদার মানুষ ডিঙিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেন। অতিরিক্ত মানুষেরা মিলে শব্দ দূষণের সাথে বায়ু দূষণ করছে। মুখে মাক্স চেপে মাহবুব শিকদার খুব কষ্টে ভেতরে ঢুকেন। নয়নার ফুফা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে আছেন। আকলিমা পাশেই জমিনে পড়ে আহাজারি করে কাঁদছে। মাহবুব শিকদার সঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। বাশারকে তার ঘর থেকে কয়েকজন ধস্তাধস্তি করে বাহিরে নিয়ে আসলো। বাশার বারবার বলছে, ছেড়ে দাও।” কে ছাড়বে বাশারকে? আর মাসুদাই বা কোথায়? কয়েকজনের মধ্যে কাকলী ফার্নিচারের মালিক সোহেল রহমানও ছিল। ভদ্রলোকের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। মাহবুব শিকদার বুঝতে পারলেন পরিবেশ খুবই গরম। তখন শুনতে পেলেন একজন ভদ্রলোক বলতে শুরু করলো,” টাকা দিতে পারবেন না, তাহলে লাখ টাকার খাট নিয়েছেন কেনো? নিয়েছেন তো নিয়েছেন, খাটটা ভেঙেও ফেলেছেন! আরে আস্ত থাকলেও তো বিক্রি করে টাকা উসুল করতে পারতাম!”
মাহবুব শিকদারের চোখে মুখে আশার আলো ছড়িয়ে পড়লো। সে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো,” ঘটনা কী ভাই?”

ভদ্রলোক বলল,” কি বলবো ভাই ব্যবসায়ীদের কষ্ট! এই ব্যাটা বলেছিল বাড়িতে যদি পালঙ্ক দিয়ে আসি তাহলে টাকা পেমেন্ট করবে। অগ্রীম ২০ হাজার টাকা দিয়েও এসেছিল কিন্তু বাড়িতে আসার পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মিল না হওয়ায় আমার লোকেদের ইচ্ছামত পিটিয়ে তাড়িয়ে দিল। টাকা চাওয়াতে আরো কয়েকটা মেরে বের করে দিলো। আবার কী বলল, আমার ব্যবসা নাকি একবার লাটে উঠেয়ে দিবে। এতোটুকু কথা কী কম ছিল?উপায়ান্তর না পেয়ে আমি পুলিশ নিয়ে আসলাম। হয় বেটা টাকা দিবে নাহলে পুলিশের মার খাবে।”

খুবই দুঃখের বিষয়। মাহবুব শিকদার তাদের কষ্টে কষ্টিত হলো। চোখ থেকে চশমা খুলে বললো,” বেয়ান সাহেবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।”

(চলবে)…
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়

[ একদল বলছেন গল্পটাকে আমি টেনে অযথাই লম্বা করছি। পাঠকদের নিকট আমার প্রশ্ন, এতকাল যাবত নয়নার দুঃখ দেখলেন নয়নের সুখ কী দেখবেন না? আমি যেকোনো একটি অজুহাতে নয়ন আর তূর্যের বিয়ে দিয়ে দিতে পারি। আগামী পর্বে কী এটাই করব? আপনাদের কী আর ধৈর্য হচ্ছে না?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here