#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪।
ফারজাদ আর প্রিয়তা দুজনেই দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুম দিয়েছে আর সেই ঘুম ভেঙেছে রাত দুটোই। ফারজাদের যদিও আরো আগেই ঘুম ভেঙেছে, তবে সে রুম থেকে আর বের হয়নি। প্রিয়তার উপর ক্ষুব্ধ সে। মেয়েটাকে না করার পরও সব বলে দিয়েছে। এবার মা দুশ্চিন্তা করে প্রেশার হাই করবেন নির্ঘাত।
দিলরুবা বেগম রাতের খাবারের জন্য কাউকেই রুম থেকে বের করতে পারেননি। প্রিয়তাকে জোরপূর্বক স্যুপ খাইয়েছেন, যেন খাবারের পরের ঔষধটুকু খেতে পারে। তবে ফারজাদের বেলায় সেটুকুও পারেননি। ফারজাদের খিদে নেই বলে যে দোর দিয়েছে আর খুলেনি। ছেলেটা যে কেন এত জেদী দিলরুবা বেগম তার কোনো ইয়ত্তা পান না।
এখন মাঝ রাত। বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে। “ক্যাত” করে শব্দ হয়ে দরজাটা খুলল। ঘর থেকে বেরিয়ে এল ফারজাদ। চোখ মুখ ফুলে আছে তার। ঘুমটা যে বেশ জমেছে তারই চিহ্ন। সে খাবার ঘরে যায়। তখন মা’কে নিষেধ করলেও এখন খিদে পেয়েছে বেশ। ফ্রিজ খুলে ভাত আর তরকারির বাটি বের করে রান্নাঘরে যায়, গরম করার জন্য।
খাবার খেয়ে সবকিছু গুছিয়ে ফের নিজের ঘরের কাছে ফিরে আসে ফারজাদ। তখন প্রিয়তার ঘরের দিকে চোখ যেতেই দেখে, আলো জ্বালানো। তারমানে মেয়েটা এখন জেগে আছে। ফারজাদ ভাবল, একবার কি যাবে তার ঘরে? পরক্ষণেই মনে হলো, এত রাতে একজন পুরুষ মানুষ হয়ে একটা মেয়ের ঘরে যাওয়া মোটেও কোনো ইতিবাচক কাজ হবে না। সে মত পাল্টে নিজের ঘরে প্রবেশ করে। দরজাটা আটকানোর আগেই প্রিয়তা দরজা খুলে। সে বের হতেই দুজনের চোখাচোখি হয়। প্রিয়তা অপ্রস্তুত মৃদু হাসে। ফারজাদ জিজ্ঞেস করে,
‘ঘুমাননি এখনো?’
‘না, আসলে..’
‘কিছু প্রয়োজন?’
প্রিয়তা হাত কঁচলাচ্ছে। ফারজাদ খেয়াল করল ব্যাপারটা। জানতে চাইল,
‘হাতে কি ব্যথা করছে?’
‘না না। আসলে, আমি দুঃখিত। আমি আন্টিকে কিছু বলতে চাইনি। কিন্তু, আন্টির এত এত দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা দেখে না বলেও থাকতে পারছিলাম না। তবে, আমি সবটা বলিনি, শুধু সেদিন রাতের ঘটনাটা বলেছি; পুরোটা শুনলে আন্টি আরো বেশি দুশ্চিন্তায় ভুগতেন।’
ফারজাদ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। মা সবটা জানে না, এইটুকুতে সে আশ্বস্ত। বলল,
‘ইট’স ওকে। আমার কথায় খারাপ লেগে থাকলে আমিও দুঃখিত। আসলে আম্মিকে আমি কোনোভাবেই দুশ্চিন্তায় রাখতে চাই না। প্রেশার হাই হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাই তখন ওভাবে বলে ফেলেছিলাম। আমিও স্যরি।’
‘না না, আপনার স্যরি বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি।’
‘বোঝার জন্য ধন্যবাদ।’
‘আ-আম খেয়েছেন আপনি?’
ভীষণ ইতস্তত সুরে প্রশ্নটা করল প্রিয়তা। ফারজাদ বলল,
‘জি, এখন খেয়ে এলাম। আপনি শুয়ে পড়ুন, রাত হয়েছে অনেক।’
প্রিয়তা কিঞ্চিৎ হেসে মাথা হেলিয়ে নিজের ঘরে গেল। ফারজাদও দোর আটকাল তখন।
_______
সকাল সকাল নাস্তা সেরে অফিসের দিকে রওনা দিল ফারজাদ। অফিসের গাড়িটা আজ পূর্বের ন্যায় গেইটের বাইরে দাঁড়ান। ফারজাদ তা দেখে হাসে। তাচ্ছিল্য প্রস্ফুটিত হয় সেই হাসিতে। হয়তো তার মতো এত সুভাগ্য কোনো অফিসের কর্মচারীর হয় না। চাকরি থেকে রিজাইন নেওয়ার পরেও এত খাতিরদারি; এর অঘোষিত কারণটাও যেন সে উপলব্ধি করতে পারছে।
গাড়িতে বসে সে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে,
‘গাড়িটা কে পাঠিয়েছে?’
‘জারা ম্যাম।’
ড্রাইভারের জবাব শুনে ফারজাদ ফের একই ভঙিতে হাসল; যেন উত্তরটা আগেই অবগত ছিল তার। বলল,
‘আচ্ছা, যান।’
________
মৌমি কলেজের জন্য তৈরি হচ্ছে। দু’মাস বাদে তার পরীক্ষা। তাই ইদানিং রোজ’ই কলেজ যেতে হচ্ছে তাকে। প্রিয়তা ঘুম থেকে উঠে মৌমির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল,
‘আসব, মৌমি?’
মৌমি তাকে দেখে চমৎকার হেসে বলল,
‘এসো না, অনুমতি নিতে হবে না।’
প্রিয়তা ভেতরে যায়। জিজ্ঞেস করে,
‘কলেজে যাবে এখন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওহ।’
মৌমি এক পল ভেবে ফিরে চেয়ে বলল,
‘তুমি আমার সাথে যাবে?’
প্রিয়তা অবাক সুরে বলল,
‘কোথায়?’
‘আমার কলেজে। চলো ঘুরে আসবে, ভালো লাগবে তোমার। আমার কলেজের সামনে একটা লেক আছে, অনেক সুন্দর জায়গাটা; ঐদিকে ঘুরে আসলে তোমার মনটাও হালকা হবে দেখবে।’
প্রিয়তার ইচ্ছে করছে না, তা না। ইচ্ছে করছে, এত এত ঝামেলার মাঝে দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে তার, একটু আশেপাশে ঘুরতে পারলে হয়তো কিছুটা হলেও চিত্তে শান্তি পেত। কিন্তু রাজি হবে কি হবে না তা নিয়ে চিন্তায় আছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে একা বাইরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
তাকে ভাবতে দেখে মৌমি জিজ্ঞেস করে,
‘যাবে না?’
‘আন্টি রাজি হবেন?’
‘আমি রাজি করাব আম্মিকে।’
প্রিয়তা প্রসন্ন হেসে বলল,
‘আচ্ছা, আন্টি রাজি হলে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
ডাইনিং এ নাস্তা করতে বসে মৌমি মা’কে তার আর্জি জানাল। দিলরুবা বেগম প্রথমে রাজি হলেন না কোনোমতেই। ওয়াদির ভয়ে তিনিও এখন ভীত। কিন্তু মৌমিও ছাড়ার পাত্রী নয়, মা’কে রাজি করিয়ে তবে দম নিল সে। দিলরুবা বেগম সতর্ক করলেন, কলেজ থেকে বের হওয়া যাবে না। কলেজের ভেতরেই ঘুরে চলে আসতে হবে, এদিক ওদিক কোথাও যাওয়া সাফ বারণ। মৌমি বাধ্যগত মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।
প্রিয়তা জামা পাল্টাল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক হাতে চুল বাঁধল কোনোরকমে। অন্যহাতে বেশি চাপ দিতে পারে না বিধেয় নিজের কাজগুলো করতেও বেশ কষ্ট পোহাতে হচ্ছে তাকে। মাথায় কাপড় দিয়ে মুখের বরাবরের মতো মাস্ক লাগাল। মৌমি দরজার কাছে, তার অপেক্ষায়। সে আসতেই দিলরুবা বেগম দোয়া পড়ে দুজনকে ফুঁ দিয়ে দিলেন। তারপর রওনা দিল দুজন।
মৌমির কলেজ বাসা থেকে বেশি দূরে না। অটোতে যেতে পনেরো মিনিট। কলেজে প্রবেশ করল দু’জন। প্রিয়তা আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। কত মানুষ, কত ছাত্রছাত্রী। তার মাঝেই হুট করেই একটা মেয়ে ছুটে এল। এসেই প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
‘আমি দু’দিন আসেনি এর মাঝেই নতুন বান্ধবী বানিয়ে ফেললি? এই তোর আমার প্রতি ভালোবাসা? এই আমাদের বন্ধুত্ব?’
মেয়েটা নাকি কান্না জুড়ল। মৌমি বিরক্ত হলো এতে। তবে প্রিয়তা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসল মনে মনে। মৌমি তার মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘এই মেয়ে একদম ঢং করবি না। তুই তো ভাই ছেলেদের থেকেও বেশি। কোনো ছেলেও বোধ হয় তার গার্লফ্রেন্ডের প্রতি এত পজেসিভ হয় না, যতটা তুই আমার প্রতি।’
মেয়েটা নাক টেনে বলল,
‘তো হবো না? আমি থাকতে তুই অন্য বান্ধবী বানাবি কেন?’
মৌমি মাথা চাপড়ে বলল,
‘আরে বোকা, ও এই কলেজের না। ও আমার কাজিন, আমার সাথে আমার কলেজ দেখতে এসেছে।’
মৌমির মিথ্যে কথা শুনে প্রিয়তা অবাক চোখে চাইল। মেয়েটা ঠোঁট গোল গোল করে বলল,
‘ওহ, তাই বল। আমিও আরো ভাবলাম তুই আমাকে ভুলে নতুন বান্ধবী করেছিস। বাই দ্য ওয়ে, আপু ভালো আছেন? আমি আয়েশা, মৌমির একমাত্র জানের জিগার।’
প্রিয়তা হেসে বলল,
‘জি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি ভালো আছো?’
‘জি, ভালো। আপনি এসেছেন ভালোই হয়েছে, আজ ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার আরেকটা সুযোগ পাব।’
প্রিয়তা হেসে বলল,
‘না না, ক্লাস ফাঁকি দিবে কেন? ক্লাস শেষ করেই ঘুরব আমরা। আমি না হয় ততক্ষণ কোথাও একটা বসে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব।’
মৌমি জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি একা থাকতে পারবে?’
‘হ্যাঁ, পারব। তোমরা ক্লাসে যাও।’
‘আচ্ছা চলো তবে, তোমাকে আমাদের মেয়েদের কমন রুমে নিয়ে যাই। ওখানে আরো অনেক মেয়েরা থাকবে, তোমার বিরক্ত লাগবে না।’
‘ঠিক আছে, চলো।’
প্রিয়তাকে কমন রুমে রেখে মৌমি আর আয়েশা গেল ক্লাসের উদ্দেশ্যে। কমন রুমে চুপচাপ বসে রইল প্রিয়তা। বেশ কয়জন মেয়ে আছে এখানে। সবাই যার যার মতো কাজে ব্যস্ত। কেউ গল্প করছে তো কেউ গেইম খেলছে, আবার কেউ হয়তো ব্যস্ত তার পড়াশোনা নিয়ে। এসব দেখে প্রিয়তার তার ভার্সিটির কথা মনে পড়ছে খুব। কতদিন ভার্সিটিতে যাওয়া হয় না, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া হয় না, কতদিন একসাথে ফুচকা খাওয়া হয় না, কতদিন…! কথাগুলো ভাবতেই চোখ জোড়া সিক্ত হয় তার। পাতা ঝাপটে সেই পানি আঁড়াল করে অতি সন্তর্পনে।
বেশ অনেকক্ষণ কমন রুমে বসে থেকে আর ভালো না লাগাই একটু বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় প্রিয়তা। এদিকে খুব একটা মানুষ না থাকায় মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে জোরে শ্বাস নেয়। তখনই পেছন থেকে কেউ রাশভারী স্বরে বলে উঠে,
‘আপনার কি ক্লাস নেই? ক্লাস না করে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?’
চলবে….
#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৫।
প্রিয়তা চমকে পেছন ফিরে চাইল। চোখে চশমা আঁটা বিধিবৎ সাজে লোকটাকে দেখে চিনতে ভুল হলো না, উনি একজন শিক্ষক। প্রিয়তা অপ্রস্তুত হেসে সালাম দিল। সালামের জবাব দিল লোকটি। চোখ থেকে চশমা নামিয়ে তাকে আপাদমস্তক পরখ করে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি কি এই কলেজের স্টুডেন্ট?’
প্রিয়তা ঢোক গিলে মাথা নাড়াল। ক্ষীণ সুরে বলল,
‘না।’
লোকটা খানিক ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘তো এখানে কী করছেন?’
প্রিয়তা ইতস্তত সুরে বলল,
‘আমার কাজিন এই কলেজে পড়ে, আমি তার সাথেই এসেছি।’
‘আচ্ছা। কোন ইয়ার?’
প্রিয়তা পড়ল মহা বিপদে। মৌমি কলেজে পড়ে সেটা জানে, তবে কোন ইয়ার সেটা তো জানে না। এবার কী বলবে? আন্দাজে একটা বলে দিবে না-কি?
লোকটি চশমাখানা ফের চোখে লাগাল। গম্ভীর স্বরে বলল,
‘আপনি আমার সাথে আসুন।’
প্রিয়তা বিচলিত সুরে বলল,
‘কোথায় যাব?’
‘অফিস রুমে।’
প্রিয়তা বুঝল, লোকটা তাকে সন্দেহ করছেন। করার’ই কথা। সে ঠিক মতো উত্তর দিতে পারছে না, তারউপর তার উর্দু ভাষাটা উনাদের মতো পরিষ্কার না। এমতাবস্থায় সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক।
প্রিয়তা অস্বস্তি নিয়ে হাসল। নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা চালাল সে। আজকার যেখানে যাচ্ছে সেখানেই ঝামেলা। ভাগ্যটাই খারাপ তার। সে ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আসলে আমি জানি না ও কোন ইয়ারে। ওর নাম মৌমি, আমি সত্যিই ওর কাজিন। আমাকে কমন রুমে বসতে বলে ও ক্লাস করতে গিয়েছে, আমি মিথ্যে বলছি না।’
প্রিয়তার কথা একেবারে বিশ্বাসযোগ্য না হলেও একেবারে অবিশ্বাসযোগ্যও মনে হলো না অবশ্য। লোকটি ভোঁতা মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,
‘কলেজে কোনো প্রয়োজন ছাড়া বাইরের লোক এলাউ করা হয় না, তার উপর আপনি আপনার কাজিন সম্পর্কে ঠিক মতো কিছু বলতেও পারছেন না। সেই জন্য আপাতত আপনাকে অফিস রুমে যেতেই হবে। সেখানে একটা স্বাক্ষর দিয়ে এসে আবার এখানে বসবেন।’
প্রিয়তার রাগ হলো। কেন আসতে গেল এখানে? এতকিছু হবে জানলে কখনোই আসত না। উপায়ান্তর না পেয়ে রাজি হলো সে। মনে মনে ঐ স্যারের গোষ্ঠীসুদ্ধ উদ্ধার করল। সব কলেজেই এমন একটা ঘাড়ত্যাড়া স্যার থাকবেই। তার কলেজেও ছিল। যাকে সে দু চোখেও সহ্য করতে পারত না।
স্যারের পেছন পেছন অফিস রুম অবধি গিয়ে থমকে দাঁড়াল প্রিয়তা। অফিস রুমের ভেতর ফারজাদকে দেখে স্তম্ভিত হলো। এই লোকটা আবার এখানে কী করছেন? তাকে থেমে যেতে দেখে স্যার পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী ব্যাপার, থেমে গেলেন যে?’
প্রিয়তা আমতা আমতা করে বলল,
‘আ-আমাকে কি যেতেই হবে?’
স্যার কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
‘জি, এটা নিয়ম। চলুন।’
প্রিয়তা ত্রস্ত পায়ে এগুল। ফারজাদের মুখোমুখি হয়ে এখন কী বলবে সে। তার উপস্থিতি মোটেও ফারজাদের পছন্দ হবে না, সেটা সে বেশ বুঝতে পারছে। প্রিয়তা ভেতরে প্রবেশ করে সালাম দিল। ফারজাদের তখনই এই গলার স্বর পরিচিত মনে হলো বেশ। সে একপলক পাশ ফিরে চেয়ে সামনে তাকাতেই টনক নড়ল তার। সে কি মাত্রই প্রিয়তাকে দেখেছে? সে ততক্ষণাৎ চোখ ঘুরিয়ে চাইল ফের। প্রিয়তাকে নিজ চোখের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অতি মাত্রায় চমকাল সে। জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি এখানে কী করছেন?’
স্যার মহাশয় অবাক হয়ে বললেন,
‘আপনারা কি পরিচিত?’
ফারজাদ কিছু বলার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই প্রিয়তা বলে উঠল,
‘জি জি। উনি মৌমির ভাই। মৌমি আমার কাজিন, তারমানে উনিও আমার কাজিন। তাই না?’
ফারজাদ কপাল কুঁচকাল। মেয়েটা কী বলছে উল্টা পাল্টা কথা! সে ফের কিছু বলার উদ্যত হতেই প্রিয়তা তাকে ইশারা দেয়। তার ইশারা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে ফারজাদ থামল। বলল,
‘ইয়েস, উই আর কাজিন।’
কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে বলল সে। তা দেখে ঢোক গিলল প্রিয়তা। লোকটাকে ফের ক্ষেপিয়ে দিয়েছে সে। স্যার পরিচয় পেয়ে প্রসন্ন হাসলেন। প্রিয়তার দিকে চেয়ে বললেন,
‘দুঃখিত, আপনাকে আমি চিনতে পারিনি।’
প্রিয়তা জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘না না, সমস্যা নেই।’
ফারজাদ প্রিন্সিপালের সাথে কথা সেরে বের হলো। তার সাথে বেরিয়ে এল প্রিয়তাও। ফারজাদ হেঁটে সামনে গেল কিছুটা। মাঠের এক কোণে দাঁড়াল। প্রিয়তাও বাধ্য মেয়ের মতো তাকে সঙ্গ দিল। বুকের উপর হাত ভাঁজ করে বিরক্ত চোখে প্রিয়তার দিকে চাইল ফারজাদ। রুষিত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘এসব কী, প্রিয়তা?’
প্রিয়তা মাথা নুয়াল। ভীত সুরে বলল,
‘বাসায় খারাপ লাগছিল বলে মৌমির সাথে কলেজে একটু ঘুরতে এসেছিলাম। মৌমি সবার সামনে আমাকে তার কাজিন’ই বলেছে, তাই আমিও আপনাকে আমার কাজিন বলে ফেলেছি। দুঃখিত।’
ফারজাদ দুহাত কোমরে রেখে এদিক ওদিক চাইল। নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা বোধ হয়। অতঃপর এক পল চুপ থেকে বলল,
‘আপনি এতটা নির্বোধ কেন, প্রিয়তা? সেদিন এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও আপনি আজ একা কী করে বের হয়ে গেলেন? পুলিশ কী বলেছিলেন আপনাকে? বের হতে নিষেধ করেননি? সাবধান থাকতে বলেননি? তাও আপনি আজ বের হয়ে গেলেন? এখন নিজের ভালো নিজে না বুঝলে আর কে আপনাকে বোঝাবে বলুন তো?’
প্রিয়তা অনুশোচনায় দগ্ধ। মাথা তুলে তাকানোর মতো সাহস নেই তার। ফারজাদ চোখ বুজে বড়ো করে নিশ্বাস নিল। তারপর কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,
‘আমি আপনার ভালোর কথা ভেবেই বলছিলাম, প্রিয়তা। আজকে বের হওয়াটা আপনার মোটেও উচিত হয়নি। বিপদ চারদিকে উঁত পেতে আছে। অন্তত ওয়াদি ধরা না পড়া অবধি আপনাকে বাসায় ভেতরেই থাকতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করল। ফারজাদ বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘সবসময়ই তো মাথা নড়ান, কাজে তো আর সেটা দেখি না।’
প্রিয়তা মিইয়ে যাওয়া সুরে জবাব দিল,
‘আজ থেকে কাজেও সেটা দেখবেন।’
‘মনে থাকে যেন।’
‘জি, থাকবে মনে।’
‘আর হ্যাঁ, থানা থেকে কল এসেছিল; বলেছে, আপনার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার পরিবারকে এখানে আনা হবে। আর আপনার ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে সরকারী ভাবে। এখন আপনার বাবা আর ভাইয়ের নাম্বারটা দিন, আমি থানায় পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
প্রিয়তা আহত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘পুলিশ নিশ্চয় আমার মা বাবাকে কল করে সব বলে দিবেন?’
‘তা তো বলবেন’ই, এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই।’
সব শোনার পর মা বাবা আর ভাইয়ের করুণ মুখটা যেন এখনই প্রিয়তা অবলোকন করতে পারছে। ভীষণ দুঃখ পাবেন উনারা। হয়তো মায়ায় পড়ে ক্ষমা করে দিবেন তাকে। কিন্তু তার দেওয়া কষ্টটা ভুলবেন না কখনোই।
ফারজাদ আর প্রিয়তা কমন রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে, মৌমির জন্য অপেক্ষা করছে। মৌমির ক্লাস শেষ। আয়েশাকে সঙ্গে নিয়ে হেলেদুলে আসছে সে। হঠাৎ আয়েশা থমকে দাঁড়ায়। অস্থির সুরে বলে,
‘এই দেখ দেখ, তোর ভাই না?’
মৌমি সামনে চেয়ে দেখল, তাই তো। ভাইকে এই মুহূর্ত এখানে দেখে মাত্রাধিক চকিত সে। প্রশ্ন করল,
‘ভাইয়া এখন এখানে কী করছেন?’
আয়েশা চট করে মৌমির হাত চেপে ধরে। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এই এই, ভাইয়ার সাথে কি ঐ আপুটার বিয়ে দিবি নাকি?’
মৌমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘কোন আপুটার?’
‘আরে তোর কাজিন। দেখ, পাশে যে দাঁড়িয়েছে দুজনকে কী সুন্দর লাগছে।’
মৌমি দেখল খেয়াল করে। আচমকা আবিষ্কার করল, আসলেই দুজনকে সুন্দর লাগছে। পরক্ষণেই ভাবল, এটা সম্ভব না। এমন চিন্তা করলেও ভাই তাকে বাড়ি ছাড়া করবে। তাই আয়েশাকে ধমকে বলল,
‘তুই এক ধাপ বেশি ভাবিস সব সময়। এমন কিছুই কোনোদিন হবে না।’
‘কেন হবে না? আমাদের এদিকে তো কাজিনদের মধ্যেই বেশি বিয়ে হয়। যেমন আমারও তো আমার কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, পরীক্ষার পরই বিয়ে।’
মৌমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘তোর আর ভাইয়ার ব্যাপারটা এক না। তুই বুঝবি না এতকিছু। চল।’
আয়েশা বিরক্ত হয়ে তার পাশে হাঁটা ধরল।
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/