আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি #নুসাইবা_জান্নাত_আরহা #পর্ব ৯

0
491

#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ৯

আকাশে সুয্যি মামা উঠে পড়েছে ঘন্টা খানিক হতে চলল। বেলা হয়েছে যথেষ্ট। মুখশ্রীতে তীব্র রোদ্দুর পড়তেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে মেহরুন। হাই তুলতে তুলতে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই দেখে ঘন্টা মিনিটের কাঁটা সকাল দশটা ছুঁই ছুঁই। তড়িঘড়ি করে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয় সে। পুরো রুমে চোখ বুলিয়েও আদ্রিশকে নজরে পড়েনা মেহরুনের। আপনা আপনিই তাই কপালে যৎ কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে তার।

এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে রান্নাঘরের দিকে চলে আসে মেহরুন। অরনী রান্না করছে। মেহরুনকে দেখতে পেয়ে অরনী বাঁকা হেসে বলল

-‘ ঘুম ভাঙল তবে মহারানীর?

মেহরুন ইতস্ততবোধ করে। তার বিবাহিতা বান্ধবীদের কাছ থেকে সে শুনেছে, ‘বাড়ির বউদের নাকি ঘরের সমস্ত কাজ একা হাতে সামলাতে হয়। পান থেকে চুন খষলেই নাকি তার খেসারতও দিতে হয়। শাশুড়িরা তো আছেনই, ননদরাও নাকি ভুল ধরার জন্য ওত পেতে বসে থাকে।’ আর এদিকে সে কি-না বাড়ির বউ হয়েও বেলা দশটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে! অথচ অরনী ননদ হওয়া সত্ত্বেও তার সাথে খারাপ ব্যবহারের পরিবর্তে ভালো ব্যবহার করছে! দুদিন হতে চলল মেহরুন এ বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছে, কিন্তু তাকে এ পর্যন্ত একটা কাজও করতে দেয়নি অরনী। সব নিজ হাতে সামলে নিয়েছে। এসব ভেবে মেহরুনের চোখে জল আসে। অরনীর মতো এমন একটা ননদ পেয়ে সে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেছে!

মেহরুনের দিকে এক পলক তাকিয়ে অরনী আবার বলল

-‘ চুপ করে আছো যে, মন খারাপ তোমার? আদ্রিশের সাথে আবার ঝগড়া হয়েছে বুঝি? দাঁড়াও, বাসায় আসুক বাঁদরটা, ওকে আচ্ছা করে বকুনি দিয়ে দিব। কষ্ট পেও না তুমি।

মেহরুন চোখের কোনে জমে থাকা পানিটুকু হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নেয়। হালকা হেসে বলল

-‘ না, না তেমন কিছু হয়নি আপু। তুমি না অনেক ভালো। তোমায় একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?

অরনীর কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার আগেই অরনীকে জড়িয়ে ধরে মেহরুন। সকাল সকাল মেহরুনের এমন পাগলামী দেখে হেসে ফেলে অরনী। মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল

-‘ হঠাৎ জড়িয়ে ধরছো যে, মতলবটা কি শুনি তোমার?

মেহরুন হেসে বলল

-‘ আজকের রান্নাটা আমি করি আপু?

ব্যস্ত হাতে পরটা ভাজতে ভাজতে অরনী বলল

-‘ আগে সকালের নাশতাটা তো সারো, তারপর পরেরটা পরে নাহয় দেখবে।

মেহরুন মাথা নেড়ে সায় জানায়। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই বলে উঠল

-‘ ওনাকে দেখছি না যে কোথায় গেছেন উনি?

-‘ আদ্রিশের কথা জিজ্ঞেস করছো?

মেহরুন ইতস্তত করে মাথা নাড়ে। অরনীর ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল

-‘ ডাক্তার মানুষ, গিয়েছে হয়তো হসপিটালে। ওটাই তো ওর ঘরবাড়ি। হসপিটাল ছেড়ে বাড়ি থেকেছে কতক্ষণ?

-‘ খেয়ে বেড়িয়েছেন উনি?

অরনী আক্ষেপের সুরে বলল

-‘ নাহ্ সকালের নাশতাটাও তো করে গেল না ছেলেটা। কতো করে বললাম, কে শুনে কার কথা। আজ নাকি তার ইমার্জেন্সি অপারেশন পড়েছে, সে জন্যই তো তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ল সকাল সকাল।

-‘ উনি তাহলে খাননি? না খেলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

অরনী মেহরুনের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। তা দেখে মেহরুন আমতা আমতা করে মুখে জোড়পুর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল

-‘ না মানে, আসলে সকাল থেকে দেখছি না তো এজন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম আরকি…

-‘ বুঝেছি থাক বলতে হবে না আর। সামনা সামনি তুমি যতোই আদ্রিশকে অপছন্দ করো না কেন, মনে মনে ঠিক-ই ওকে ভালোবাসো তুমি। তা তুমি স্বীকার করো আর না করো। এটাই সত্যি।

অরনীর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মেহরুন। মনে মনে সে বলে, ‘ ভালো তো বাসতাম তাকে, তবে কি সেই ভালোবাসা পাওয়ার আদৌও যোগ্য সে?’

অরনী আর মেহরুন টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে সকালের নাশতাটা সেরে ফেলে। অরনীর ফোন আসায় অরনী নিজের কক্ষের বেলকনিতে চলে যায়। এদিকে মেহরুন এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে দেয়ালে টানিয়ে রাখা ছবিটির দিকে। যেখানে মা বাবা আর ভাই বোনের একটি আদর্শ সুখী পরিবার দেখা যাচ্ছে। ছবিতে থাকা মেয়েটা অরনী আর ছেলেটা আদ্রিশ। অথচ ছবিতে থাকা বাকি দুজন গত হয়েছেন তো বছর খানিক আগেই। ধরনীর বুকে পড়ে রইল মা বাবাহীন এতিম দুই ভাই বোন আদ্রিশ আর অরনী।

.

নিজের রুমে থাকা জিনিসপত্র সব ভাংচুর করতে ব্যস্ত জারা। ক্রোধে তার শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে। তার প্রথম প্ল্যানে মাঝপথে এসে জল ঢেলে দিল আদ্রিশ। এবার দ্বিতীয় প্ল্যানে জল ঢেলে দিল মেহনত আকবর। নাজিয়া সুলতানা কিছুতেই মেয়েটাকে যেন শান্ত করতে পারছেন না। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে বলেন শান্ত হতে কিন্তু জারা শান্ত হয়না। রাতে কিছু না বললেও সকালে এসে জারা এবং নাজিয়া সুলতানাকে কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে যান মেহনত আকবর। তার কড়া নির্দেশ,

”রাতের বেলায় যেন ভুলক্রমেও আলভির কক্ষের ত্রিসীমানায় জারার ছায়াও না মেলে। যদি এ কথার নড়চড় বা অমান্য হয়, তাহলে তার পা ভেঙে দেওয়া হবে।”

এ কথা শুনে আরও বেশি রেগে যায় জারা। আর তারপরেই শুরু হয় তার এমন তাণ্ডব। নাজিয়া সুলতানার হাত ঝাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে জারা বলল

-‘ এবার কি হবে মা? শেষ পথটাও বন্ধ করে দিল ঐ বুড়োটা।

নাজিয়া সুলতানা গালে হাত দিয়ে ভাবেন। তার মাথাতেও এ মুহুর্তে কিছু আসছে না। জারা রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়। নাজিয়া সুলতানা চেয়েও আটকাতে পারেন না মেয়েকে।

.

বরাবরের মতো এবারও এই অপারেশনটাতে সাকসেসফুল হয়েছে আদ্রিশ। নিজের কেবিনে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে চেয়ারের উপর। সকাল থেকে পেটে দানা পানিও পড়েনি তার। এজন্য মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে রফিককে ডাকল।

-‘ সকালে কিছু খাওয়া হয়নি আমার। ক্ষুধা পেয়েছে তাই। খাবার নিয়ে এসো রফিক।

রফিক মাথা নেড়ে চলে যায় খাবার আনতে। পনেরো মিনিটের মধ্যে খাবার নিয়ে হাজির হয় রফিক। আদ্রিশ রফিককে দেখে হাসে। রফিক সারাদিন অনেক খাটাখাটনি করে। ছেলেটাকে দেখলে বড় মায়া হয় তার।

-‘ রফিক বসো, খেয়ে নাও।

-‘ না, স্যার। আমি খাব না। আপনি খেলেই আমার খাওয়া হয়ে যায়।

ভ্রু কুচকে তাকায় আদ্রিশ। গম্ভীর গলায় বলল

-‘ তুমি আমার মুখের উপর কথা বলছো রফিক। যা বলেছি তাই করো। কুইক ফাস্ট নাও।

অগত্যা রফিক আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আদ্রিশের সাথে খেয়ে নেয়। রফিক মনে মনে দোয়া করে আদ্রিশের জন্যে, ‘স্যারের যেন খুব সুখী হয়, যেন খুব সুখী একটা পরিবার হয়।’

বাকি পেশেন্টদের দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে যায়। রোগী দেখা শেষ করে রফিককে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আদ্রিশ। ‘এখন আর হসপিটালে ভাল লাগেনা তার। বাসায় সুন্দরী বউ রেখে কে-ইবা বাইরে থাকতে পারে।’ কথাটা ভেবেই আনমনে হাসল আদ্রিশ।

গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রফিককে সব বুঝিয়ে দিচ্ছিল আদ্রিশ, এমন সময় কেউ একজন এসে বলল

-‘ আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল, আদ্রিশ ভাইয়া।

ঘাড় ফিরিয়ে দেখে ভ্রু কুচকে তাকায় আদ্রিশ। এই অসময়ে এখানে জারাকে দেখে মেজাজ সপ্তম আকাশে চড়ে বসে তার। এই মেয়েটাকে দেখলেই প্রচণ্ড রাগ হয় আদ্রিশের। ততক্ষণে রফিকও চলে যায় নিজের কাজে। জারা আদ্রিশের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল

-‘ আমি আপনাকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবেসে ছিলাম, আদ্রিশ ভাইয়া। বিশ্বাস করুন। কিন্তু আপনি আমার ভালোবাসা কেন বুঝলেন না?

আদ্রিশ থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মেয়ে বলে কি এসব।এর মধ্যে কি বিন্দু মাত্র আত্মসম্মানের ছিটেফোঁটাও নেই নাকি? সেদিন যেভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দিল, তারপর তো আদ্রিশের সামনে আর আসাই উচিত না জারার। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে আদ্রিশ বলল

-‘ এই মেয়ে তোমার লজ্জা করে না, নিজের চাচাতো বোনের স্বামীকে উল্টা পাল্টা কথা বলতে?

-‘ ভালোবাসি বলতে লজ্জা কিসের? আমি আপনাকে আগে থেকেই ভালোবাসতাম, কিন্তু তা বলার সুযোগ হলো কই। তার আগেই তো আপনি মেহরুনকে বিয়ে করে ফেললেন। মেহরুনের মধ্যে কি এমন পেলেন যা আমার মধ্যে নেই? শুনুন, মেহরুন আপনাকে একটুও ভালোবাসে না, ওকে ছেড়ে দিয়ে…

নিজের রাগকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরে ঠাটিয়ে দুটো চড় বসিয়ে দিল জারার গালে। গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আদ্রিশের দিকে জারা। আদ্রিশ চিৎকার করে বলে উঠল

-‘ মেহরুন আমাকে ভালোবাসুক আর না বাসুক, আমি ওকে ভালোবাসি, এটাই সত্য। ওকেই আমি চাই সেটা যেকোনো মূল্যে হোক। আর তুমি ভাবলে কিভাবে ওকে আমি ছেড়ে দিব? নেভার। পুরো পৃথিবীও যদি আমার বিরুদ্ধে চলে যায় তবুও মেহরুনকে ছাড়ব না আমি। আর কি যেন বলছিলে, মেহরুনের মধ্যে কি এমন আছে, মেহরুনের মধ্যে আছে আত্মসম্মানবোধ, মান অপমানবোধ যা তোমার মতো থার্ড ক্লাস দু পয়সার নির্লজ্জ আশ্রিতা মেয়ের মধ্যে নেই। লজ্জা করল না মেহরুনদের বাসার আশ্রিতা হয়ে মেহরুনেরই ক্ষতি করার জন্য উঠে পড়ে লাগতে? তোমার মতো মেয়ের তো মেহরুনের পায়ের নখের যোগ্যতাও নেই। তুমি দশ বার জন্মালেও ওর মতো হতে পারবে না কখনোই।

আদ্রিশের কথা শুনে হাওমাও করে কেঁদে ওঠার বদলে ক্রুর হাসল জারা। চড়ের প্রতিশোধ তো নিয়েই ছাড়বে সে। আদ্রিশকে বরবাদ করতে পারলে তবেই তার শান্তি মিলবে।

.

বেলকনি হতে চাঁপা কান্নার আওয়াজ মেলে। অরনীর ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল মেহরুন, হঠাৎ এ কান্নার করুণ সুর কর্ণকুহরে ঠেকতেই পা থেমে যায় তার। সাত পাঁচ না ভেবে অরনীর রুমের পথে পা বাড়ায় মেহরুন…

#চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here