#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_১৫
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি
——–
কারো ঘরে সুখ নামে তো কারো ঘরে দুঃখ। ভালো খারাপ মিলিয়েই মানুষের জীবন। এই জীবনে দুঃখ যখন নেমে আসে সুখের ঠিকানা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যায়। আকলিমা ভাত রান্না করছিলো, পাতিলের উপর খুন্তি দিয়ে ঠিকই নাড়াচাড়া করছিল কিন্তু তার ধ্যান ছিলো অন্যদিকে। ভাতের মাড় হাতে ছিটকে আসায় ধ্যান ভাঙলো। কলের পানি ছেড়ে কিছুক্ষণ হাত ধরে রাখলো, আহ! পুড়ে যাওয়ার কী যন্ত্রণা! জ্বলছে খুব কিন্তু ঔষধ লাগিয়ে দেয়ার মতো কেউ নেই। আকলিমার মনে পড়ে নয়নার কথা! একদিন মুরগি কা’ট’তে গিয়ে হাত কে’টে ফেলল আকলিমা। গলগল করে র’ক্ত বের হচ্ছিল। নয়না সোফা পরিষ্কার করছিল, ফুফুর আর্তচিৎকার শোনা মাত্রই কাজ ফেলে চলে আসে। কাটা জায়গায় চেপে ধরে ফোপাঁতে থাকে। সেদিন আকলিমার কাছে নয়নার কান্না নেকামি মনে হয়েছিল কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছে নয়না তাকে কতোটা আপন মনে করতো।
আকলিমার চিন্তার শেষ নেই! একদিকে নয়না নিখোঁজ অন্যদিকে নতুন আপদ এসে জুটেছে আকলিমার সংসারে। দুই ডাক্তারের যন্ত্রণায় আকলিমা বিরক্ত সাথে চিন্তিত। রাত নাই দিন নাই সময়ে অসময়ে যাকে ভদ্রলোক ভেবেছিল সে মিসড কল মারে। নাম্বার কোথায় পেয়েছে কে জানে! আকলিমা প্রথম ভেবেছিল দুধ ওয়ালা কিন্তু ফোনে কথা বলার পর ভদ্রলোক বলে উঠলো, ” বেয়াইন সাহেবা! পুদিনা পাতার ভর্তা করতে পারেন? সেই স্বাদ, জিভে লেগে থাকার মতো। আমি খুব ভালো বানাতে পারি। একদিন আপনার জন্য নিয়ে আসবো। পুদিনা পাতার সাথে কাঁচা মরিচের কম্বিনেশনটা দারুণ। মনে রাখবেন, কাঁচা মরিচ পুদিনা পাতার থেকে পরিমানে বেশি থাকতে হবে, নয়তো স্বাদ পাবেন না। সর্বশেষে যা বলতে ফোন করেছিলাম, আমার বউমাকে খুঁজে পেলেন?”
ভদ্রলোকের কথার আগা মাথা আকলিমা বুঝলো না। সে প্রত্ত্যুত্তরে বলেছিল, ” আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন? আমার ভাইজি কোথায় কীভাবে আছে তা আমাদের ব্যাপার। আপনাকে যেন আর নাক গলাতে না দেখি।”
এই কথাগুলো আকলিমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপর থেকে ভদ্রলোক সরাসরি কল নয় মিসড কল দিতে থাকে। বিরক্ত হয়ে সকাল থেকে আকলিমা ফোন বন্ধ করে রেখেছে। হাতের জ্বালা কমছেই না। বাশার সারাদিন কানে ফোন রেখে ঘরের কোণায় পড়ে থাকে। আজ সকাল থেকে কোথায় গেছে কে জানে? সকাল সকাল বেশ তাড়াহুড়ায় বের হয়েছিল, এখন বিকাল প্রায়! বাশার ফিরে আসেনি। এদিকে একাকী আকলিমা দুপুরের খাবারও খায়নি। রান্না করতে বসলো আর হাত পুড়ে গেলো! বেসিন থেকে হাত সরিয়ে ঘরের দিকে আগাচ্ছিল আকলিমা। উদ্দেশ্য বান ক্রিম পুড়ে যাওয়া স্থানে লাগিয়ে দিবে। কিন্তু তা আর হলো না, কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দুয়ারের সামনে থেকে ঘুরে আসতে হলো আকলিমার। বিরক্তি তার চোখেমুখে, অসময়ে কারো আসার কথা নয়। বিড়বিড় করতে করতে আকলিমা দরজা খুলল। দরজার অপরপাশে মাহবুব শিকদার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। একহাতে শপিং ব্যাগ। আকলিমা কাচুমাচু হয়ে দরজা অবরোধ করে দাড়িয়ে বলল,” ভদ্রলোক বলে চিল্লাপাল্লা করছি না, বাধ্য করবেন না।”
মাহবুব শিকদার আহত হওয়ার নাটক করে বললেন, ” আমরা আপনার জন্য পুদিনা পাতার ভর্তা বানিয়ে এনেছিলাম, বেয়াইন।”
আকলিমা বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলো চারপাঁচ জন ছেলে দাড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে। আকলিমা শুঁকানো ঢোক গিলে পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। মাহবুব শিকদার খুশিতে গদগদ হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
” এক কাপ চা হবে বেয়াইন সাহেবা?”
আকলিমা দাঁতে দাঁত চেপে চা বানাতে চলে গেলো। মাহবুব শিকদার আরামে সোফায় বসলেন। রিটায়ার্ডের সময় হয়ে এসেছে। শেষ বয়সে নাটক ফাটক করতে বেশ লাগছে তার কাছে। আকলিমা চা আনলো, শব্দ করে মাহবুব শিকদার চুমুক দিয়ে বলল,” এক ফ্যাক্স চা করে দিতে পারবেন, বেয়াইন সাহেবা! রোদে পুড়ে যাওয়া আমার ছেলেদের জন্য! তারা আজ থেকে আপনার বাড়ির বাইরে ঘুরাফেরা করবে, আপনার নতুন অতিথি হিসাবে।”
আকলিমা চমকালো। ঐ ‘গু’ণ্ডা’র মতো ছেলেপেলেরা তার বাড়ির সামবে থাকবে? কিন্তু কেন? মাহবুব শিকদার চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর বিড়বিড় করছেন। আকলিমা বুঝতে পারলো এই লোককে কিছু বলে লাভ হবে না। আসলে এখন তার সময় খারাপ।
এক ফ্যাক্স চা হাতে মাহবুব শিকদার উঠে দাঁড়ালো। অন্য হাতে রাখা শপিং ব্যাগ আকলিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” পুদিনা পাতার ভর্তা অবশ্যই ট্রাই করবেন। চায়ের প্যাকেট দিয়ে গেলাম দিনে সাতবার কিন্তু ছেলেদের খোঁজ নিবেন। কিপ্টামি করবেন না বলে দিলাম, বেয়াইন সাহেবা! আমার ছেলেরা কিন্তু যেমন ভালো তেমন খারাপ। সময়ে চা নাস্তা না পেলে আমার মতো ঘরে চলে আসবে।”
দুষ্ট হাসিতে মাহবুব শিকদার আকলিমার গলা শুঁকানোর কাজ করে গেলো। দরজা পেরোনোর পূর্বে সিরিয়াস হয়ে বলল,” ক্ষমতা আপনিও দেখিয়েছেন, আমরাও দেখাবো। ভুলে যাবেন না, এতিমরাও মানুষ। তাদের উপর অত্যাচার উপরওয়ালাও সহ্য করেন না। প্রতিফল কিন্তু সবারই একদিন পেতে হবে।”
মাহবুব শিকদার হেসে চলে গেলো। আকলিমা দরজা বন্ধ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। ভাবতে লাগলো, তার সুখের দিনগুলো এভাবে শেষ হয়ে গেলো!
কতক্ষন আকলিমা বসেছিল, জানা নেই। পুনরায় কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে উঠে সে। এবার কে এলো? গু’ণ্ডা’দ’লে’র লোক নয়তো! কাঁপা হাতে দরজা খুলে দেয় আকলিমা। দরজার অপরপাশে অচেনা মেয়েকে দেখে প্রশ্ন করলো,” তুমি কে,মা!”
মেয়েটা আকলিমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঠেলে বলল, ” আমি মাসুদা, আপনার ছেলের বউ!”
এমনিতেও আকলিমা দৈহিক অসুস্থতার মধ্যে ছিল তার উপর এতো বড়ো সংবাদ পেয়ে নিজেকে সামলাতে পারলো না; লুটিয়ে পড়লো জমিনে। মাসুদা শাশুড়িকে পড়ে যেতে দেখে ধরলো না বরং ডিঙিয়ে নিজের ঘর খুঁজতে চলে গেলো।
——————————-
উত্তরার রাজলক্ষ্মীর নিচতলায় অবস্থান করছে নয়না। দুইহাতে তার শপিং ব্যাগ। তূর্য দশমিনিট ধরে তাকে এখানে দাঁড় করিয়প কোথায় যেন চলে গেছে ফেরার নাম নেই। এদিকে ভয়ে,চিন্তায় নয়নার হাত পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। প্রায় দশ মিনিট পর তূর্য হাসিমুখে এগিয়ে এলো। নয়নার ধারণা ডাক্তররা সুন্দর হয়। কারণ ঘাঁটলে জানা যাবে, ডাক্তাররা সব সময় পরিষ্কার পরিপাটি থাকে বলেই সুন্দর মনে হয়। তূর্যও তাই! সুন্দর সাথে সুদর্শন। এই যে চোখে সানগ্লাস, মুখে হাসিতে ঘায়েল হবে যে কেউ। নয়না চোখ ফিরিয়ে নেয় তার অবাধ্য চোখজোড়া আজ বাধ্য করেই ছাড়বে। ভুলেও তাকাবে না। তূর্য নয়নার কাছে এসে তাগাদা দিয়ে বলল,” আমার সাথে চলো।”
নয়না বিরসমুখে উত্তর দিলো,” চলা ছাড়া কী আর উপায় আছে?”
তূর্য হাসলো, নয়নার বাঁকা কথাও তার ভালো লাগে। অবশ্য সে যেই পরিস্থিতিতে ছিল তূর্যকে মেনে নিতে বেশ কষ্ট হবে। তূর্য সেইদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে যেদিন নয়না নিজ ইচ্ছায় তূর্যের পাশে এসে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে মনের কথা বলবে।
আজীমপুরের পাশে লাল রঙের প্রাইভেট কার দাড় করানো আছে। তূর্য নয়নাকে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়।নয়নার হাত থেকে শপিং ব্যাগ গুলে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে রাখে। নয়না তূর্যকে বাঁধা দিয়ে বলতে শুরু করলো,” কার গাড়িতে ব্যাগ রাখছেন, নিয়ে চলে যাবে তো?”
তূর্য তখন শরীর ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয়,” আস্ত তাবরেজ তূর্যকে দেখো না মেয়ে! তোমাকে রাণীর মতো সাজিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে, তাবরেজ তূর্য। গাড়িটাও আমার, পাশের সুন্দরী আমার।”
” ফালতু কথা না বলে বাড়ি চলুন। আমার এখানে ভালো লাগছে না।”
তূর্য হাতের বন্ধনীতে নজর দিয়ে একটি রিকশা ডাকলো। প্রথমে তূর্য উঠে বসলো। কিন্তু নয়নার কোনো নড়চড় নেই সে দ্বিধায় দাঁড়িয়ে রইলো। তূর্য নয়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,” উঠে এসো, আমার নিয়ত খারাপ থাকলে বেলাই বিলেই অনেককিছু করতে পারতাম।”
মনে মনে নয়না ভীষণ লজ্জা পেলো। তূর্যের হাত না ধরেই রিকশায় চড়ে বসলো। দুজনের মাঝে যথেষ্ট ফাঁকা রয়েছে। এর মধ্যে দুর্যোগ গুনগুন করে গান ধরল,
“এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো!”
মুখে না বললেও নয়না মনে মনে উত্তর দিলো,” খুব খারাপ হতো, ঠিক আপনার গানের গলার মতো।”
চলবে………………
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
[ আজকের পর্বটা অনেক ছোট হয়ে গেলো। মাগরিবের পর লেখতে বসে এতটুকুই পেরেছি। ভুল ত্রুটি হলে বলবেন আমি পরবর্তীতে সংশোধন করার চেষ্টা করব। ভালো থাকবেন সবাই। আসসালামু আলাইকুম।]