গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায় #পর্বঃ_১৮ #লেখাঃ_আফসানা_মিমি

0
318

#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_১৮
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি
——–
মানুষের জীবনের মোড় কোনদিকে ঘুরে যাবে কারো জানা নেই। গল্প উপন্যাসের মতো যদি বাস্তবের জীবন হতো কতোই না ভালো হতো; কিন্তু হায়! বাস্তবতা খুবই কঠিন।
নয়নাকে অস্থিরতার মধ্যে রেখে তূর্য দরজা আটকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেই সকালে তূর্য এসেছে, নয়নার বলা কথা শুনে বেচারা বিশাল বড়ো ধাক্কা খেয়েছে তাইতো বলা নেই কওয়া নেই চট করে গেস্ট রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। নয়না অনেকবার ডাকার চেষ্টা করে না ডেকেই ফিরে আসে। দুপুর হতে চলল, তূর্য এখনো ঘুমাচ্ছে। নয়না ভাবছে, তূর্যের পরিবারের কথা। এই যে সকাল থেকে তূর্য বাড়ি ছাড়া তার খবর কী পরিবারের মানুষজন রাখে? চিন্তা করছে না বুঝি! আশ্চর্য মানুষটার আশ্চর্য পরিবার। কোনো চিন্তাভাবনা নেই। ভাবনায় বিভোর থাকা নয়নার সময়ের খবর নেই যখন ধ্যান হলো ততক্ষণে যোহরের আজান দিলো। নয়নারও কিছু খাওয়া হয়নি, মূলত অতিরিক্ত চিন্তায় কিছু খায়নি। কিন্তু না খেয়ে আর কতক্ষণ? তূর্য ঘুম থেকে উঠলেও তো কিছু দিতে হবে? সাতপাঁচ ভেবে দুই হাতে চুল প্যাঁচিয়ে খোঁপা করে নিলো নয়না। সাধারণত তূর্যের সামনে মাথায় ওড়না চেপে রাখে এখন যেহেতু তূর্য নেই তাই ওড়না শরীরে প্যাঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে।

ফ্রিজের মাছ,মাংস ছাড়া আর কোনো অপশন নেই নয়নার কাছে। অগত্যা দেশী মুরগী ফ্রিজ থেকে নামিয়ে পানিতে ডুবাল। ঝটপট চিকেন বিরিয়ানি রান্না করে নয়না ক্ষান্ত হলো। সময়ের হিসাব করলে নয়না দেখতে পেলো দুপুর দুইটা বাজে। এখনো মানুষটা উঠেনি! ডাক্তার মানুষের সময় নাকি অনেক মূল্যবান হয়, এই তার সময়ের হিসাব! নয়না অন্তরে সাহস সঞ্চয় করে গেস্ট রুমের দরজায় করাঘাত করলো। দুই মিনিটের মধ্যে তূর্য দরজা খুলে নয়নার চিন্তিত মুখখানা দেখে হেসে উঠলো। ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,” এক কাপ কফি করে দিবে, নয়ন? আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।”

তূর্যের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর নয়নার হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা বাড়িয়ে দিলো। সে বুকের বাম পাশটায় চেপে ধরে কফি বানাতে চলে গেলো। প্রায় পাঁচ মিনিট পর তূর্য ফ্রেস হয়ে বের হয়। তূর্যের ব্যপারে নয়না একটা বিষয় বুঝতে পেরেছে, তূর্য একদম ফিটফাট থাকতে পছন্দ করে। এই যে, ফ্রেস হওয়ার পর তূর্যের পোশাক থেকে শুরু করে মাথার চুল, হাতের ঘড়ি সব ঠিকঠাক করেই বের হয়েছে! তূর্য মুঠোফোন বের করে কাউকে ফোন করলো। নয়না এই সুযোগে কফির কাপ তূর্যের সামনে টেবিলের উপর রেখে সরে আসলো। ফোনে ব্যস্ত থাকলেও তূর্য সবটা খেয়াল করলো। কথা বলা শেষে জোরে নয়নাকে ডেকে বলল,” কোথায় গেলে?”

ইশ! মনে হচ্ছে বিয়ে করা বউকে আহ্লাদ করে ডাকছে। নয়না ঘর থেকে মাথা বের করে বলল,” কিছু লাগবে?”

কফির কাপ চুমুক দিয়ে তূর্য প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” উম! চিনি ছাড়া কফির সাথে তোমাকে লাগবে।”

নয়না ভেংচি কাটলো। একাকী পুরুষের সামনে থাকতে আপত্তি প্রকাশ করে বলল,” নুন ছাড়া যেমন তরকারিতে স্বাদ নেই, সম্পর্ক ছাড়া তেমন পুরুষের আশেপাশেও থাকতে নেই।”

” সকাল থেকে তাহলে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কী দরজার সামনে ঘুরঘুর করেছো?”

নয়না নাক সিটকে উত্তর দিলো,” ছিহ! কীসব কথা?”

তূর্য হাসলো। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,” উচিত কথা বললেই ছিহ! এদিকে যার মন নিয়ে নিতে চাইছো তাকেই অনাহারে রাখছো? এটা ঠিক নয়,নয়ন!”

নয়না জিহ্বায় দাঁত চেপে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো।
সে ভুলেই বসেছিল, তূর্য সকাল থেকে না খাওয়া। ভাবনার ফ্যাটটা খুবই ছোট। দুইটা বেডরুম, ডাইনিং ও পাকঘর; এতটুকুতে টুকটাক জিনিস নিয়ে মেয়েটা ফ্ল্যাট সাজিয়েছে। সোফার টেবিলে নয়না বিরিয়ানি রাখলো। বিরিয়ানির ঘ্রাণে সারাঘর ম ম করছে। তূর্য লম্বা করে নিঃশ্বাস টেনে নিজেই প্লেটে খাবার পরিবেশন করে নিলে। নয়না তখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তূর্য ততক্ষণে এক লোকমা মুখে পুরে নিয়েছে। নয়নার হাতের রান্নার তুলনা হয় না। তূর্য এই পর্যন্ত যা যা খেয়েছে অমৃত মনে হয়েছে। তূর্য এতোটাই এক্সাইটেড ছিল যে নয়নার কথা ভুলে গেলো। একাকী এক প্লেট বিরিয়ানি শেষ করে আরেকবার নিলো। তূর্যের তৃপ্তি সহকারে খাওয়া দেখে নয়নার ভালো লাগলো। সে হেসে বলল,” আরেকটু দিব?”

তূর্যের এতক্ষণ পর নয়নার কথা স্বরণে আসলো। সে নয়নাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,” দাড়িয়ে আছো কেন? এদিকে আসো, তুমি কী জানো! তুমি কতো মজার রান্না করো! কীভাবে জানবে, আসো এক লোকমা খাইয়ে দেই। আমার থেকে খেয়ে বলবে কেমন হয়েছে!”

বলতে বলতে তূর্য নয়নাকে বসিয়ে এক লোকমা মুখে ঢুকিয়ে দিলো। তূর্যের আকস্মিক কাজে নয়না নিশ্বাস নেয়ার মতো সময় পেলো না। মুখে খাবার নিয়ে হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলো। এক্সাইটেড হয়ে তূর্যের করা কাজে সেও বিস্মিত হলো! নয়না তাকে ভুল বুঝলো না তো! নয়নাকে স্বাভাবিক করার জন্য সে বলল,” আমার চাচ্চু বলে, আমার হাতের রান্না নাকি অনেক মজার। তোমার কী মনে হয়?”

মুখের খাবার কোনোমতে গিলে নয়না উত্তর দিলো,” ভালো।”

” ভালো তো হতেই হবে! আমি যে বিরিয়ানিতে বিশেষ কিছু মিক্সড করি।”

নয়নার জানতে ইচ্ছে করলো না কী মিক্সড করে তূর্য।দেখা গেলো তূর্য নিজেই বলল,” জানতে চাও বিশেষ জিনিসটা কী?”

মাথা সায় দিয়ে নয়না সম্মত জানালো। তূর্যের খাওয়া শেষ, প্লেটে পুনরায় বিরিয়ানি তুলে নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ” ভালোবাসা।”

বিস্মিত চোখে নয়না তূর্যের দিকে তাকালো। প্রত্ত্যুত্তরে কী বলবে সে! লজ্জা গ্রাস করছে নয়নাকে। তূর্য নয়নার হাতে প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,” পুরুষের এটো থালায় খাবার খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে। খেয়ে প্রমাণ করো তো! কথাটা সত্য নাকি মিথ্যা!”

———————–

দুপুরের খাবারের টেবিলে হরেক পদের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে আকলিমার বাসায়। আভিজাত্যপূর্ন আসবাবপত্র চিকচিক করছে টেবিলের উপর। আকলিমা মাথায় হাত রেখে ভাবছে,এই আসবাবপত্র সে কবে কিনেছিল? মনে নেই। এরমধ্যে মাসুদা ও বাশার ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। খাবারের টেবিল দেখে মুচকি হেসে বলল,” আসলে আমার পাতিলে রান্না করা খাবার পছন্দ না। সারাজীবন রান্নাঘরে দামী প্যান দেখে অভ্যস্ত। সকালে নোংরা পাতিল গুলো দেখে গা ঘিনঘিন করছিল। এখন ঠিক আছে। থ্যাঙ্কিউ জানু!”

বাশার খুশিতে গদগদ করছে। দুপুরেই মাসুদা মোটা অঙ্কের টাকা দিলো বাশারের হাতে। সেই টাকা দিয়েই এসব কেনা। থলে ভর্তি টাকা আর সুন্দরী বউ পেলে মা, ভাইকে কে চেনে? আকলিমা বাশারকে রামধমক দিলো,” টাকা পেয়েছিস কোথায়? এতো টাকা দিয়ে ইন্জিনিয়ার বানালাম, আমাদের তো একটা সুতা পর্যন্ত কিনে দিতে পারিসনি। আর বউ বলার সাথে সাথেই লাখ লাখ টাকা বের করছিস? টাকা কোথায় পেলি?”

” উফ মা! এতো কৈফিয়ত চাচ্ছো কেন? খেলে খাও, নয়তো আমাকে খেতে দাও। মাসুদাও সকাল থেকে না খেয়ে আছে।”

আকলিমা রাগে গজগজ করতে করতে না খেয়েই চলে গেলো। বাশার মাকে ফেরালো না। মাসুদার হাত ধরে বিশ্রী ভঙ্গিতে বলল,” এবার তো কাছে আসো, সোনা?”

মাসুদা খাবার খাওয়ার বাহানায় প্রত্ত্যুত্তর দিলে,” জানোই তো! পালঙ্ক ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না। টিভিতে দেখলাম, কাকলী ফার্নিচারে এক লাখ টাকার পালঙ্ক বিক্রি হচ্ছে। আমার সেটা চাই-ই চাই! আর যদি এনে না দাও, তাহলে কাছে আসতে পারবে না।”

বাশার মাসুদার গলার দুই ইঞ্চি নিচে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,” তুমি বললে এক লাখ টাকার খাঁট কেন? পুরো ফার্নিচারের দোকান তুলে আনবো, জানমান! আজই নিয়ে আসবো, আর রাতেই,,,,,!

মাসুদা লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। এদিকে বাশার মনে মনে এই বলে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে, ” টাকার থলে তো আমার ঘরেই, চাইলে এক লাখ কী দশ লাখ খরচ করলেও টাকা কমবে না।”

———————————–
বিকাল চারটায় মিছিল নয়নাকে নিতে আসলো। ভাবনা তখন বাড়িতে ছিল।আশ্চর্যজনকভাবে সেও নয়নাকে মিছিলের সাথে যেতে রাজি হলো। অথচ দুইদিন আগেও ভাবনা নিষেধ করেছিল। নয়না খুশিমনে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তূর্যের কথা মনে পড়ায়। তূর্য যাওয়ার আগে বলে গেছে সে আগামীকাল নয়নাকে নিয়ে তার চাচার কাছে যাবে। যদি আগামীকাল এসে নয়নাকে না পেয়ে মন খারাপ করে! তখন সে কী করবে? বিছানায় বসে নয়না হাজারো কথা ভাবছে। নয়নাকে বসে থাকতে দেখে মিছিল এগিয়ে আসলো। আঁজলা ভরা মুখখানা উঁচু করিয়ে বলল,” কী হয়েছে, আমার জানটার?”

” উনি যদি রাগ করে?”

নয়নর উনিটা যে কে, তা মিছিল খুব ভালো করেই জানে। তবুও নয়নাকে বাজিয়ে দেয়ার জন্য বলল,” তোর উনিটা কী ডাক্তার তাবরেজ তূর্য, নয়ন!”

লজ্জায় নয়নার গালদুটো লাল টমেটো হয়ে গেলো। মিছিল তা দেখে নয়নার কাছে এসে আরো খোঁচানোর উদ্দেশে বলল,” এসব কী নয়ন! কতদূর গড়লো শুনি? ইয়ে টিয়ে কী সব হয়ে গেছে?”

নয়না আশ্চর্য হয়ে যায়। এই মিছিলটা এতো দুষ্ট হল কবে থেকে? নয়নাকে নাস্তানাবুদ করার জন্যই বদটা আজ এসেছে? নয়না অকপটে উত্তর দিলো,” তুই একটু বেশিই ভাবছিস। ঐসব কিছু না।”

নয়না নার্ভাসের কারণে ঘামতে শুরু করে। মিছিল বিষয়টা খেয়াল করলে নয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আমার নয়নতারা! তুই কী জানিস! আকাশের বুকে তুই জ্বলন্ত একটা চাঁদ! তোকে যে পাবে সে খুব ভাগ্যবান হবে।”

নয়নার চোখের সামনে তূর্যের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। পছন্দের মানুষ বলে কী? লজ্জায় নয়না মিছিলকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,” সে ভাগ্যবান নয় মিছিল বরঞ্চ তাকে যেই মেয়ে পাবে সে ভাগ্যবতী।”

চলবে………………
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়

[ মনের সাথে যুদ্ধ করে আজ লেখেছি। কী যে কষ্ট হয়েছে বলে বুঝাতে পারব না। ভুল ত্রুটি হলে ধরিয়ে দিবেন। আমি পরবর্তীতে সংশোধন করে নেয়ার চেষ্টা করব। ভালো থাকবেন সবাই। আসসালামু আলাইকুম।[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here