#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_০২
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি
——–
– “আমার এতো বড়ো সর্বনাশ করো না, বাশার ভাই।”
নয়নার কোনো কথাই বাশারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। মেয়েটার আকুতিভরা টলমলে চোখদ্বয়ও বাশারের লোলুপ মনে বাঁধা সৃষ্টি করছে না। নয়না ঘামছে, ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। বাশারকে হিংস্র পশুর ন্যায় মনে হচ্ছে নয়নার কাছে। ভাই সমেত গুরুজন যখন ভক্ষক হয়ে দাঁড়ায় তখন প্রশ্ন উঠে, পৃথিবীর কোন পুরুষটির কাছে মেয়েরা নিরাপদ! বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে নারীরা বেশিরভাগই আপনজনের কাছেই যৌনতার শিকার হয়। কলঙ্কের ভয়ে কতো নারীরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে, তারা ভাগ্যের কাছে অসহায়।
নয়নার আকুতি, আহাজারি বাসারের মনমন্দিরে কামেচ্ছা বাড়িয়ে দিচ্ছে। নয়নার দিকেই সে ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। আজ কী কালরাত্রি? নয়নার তাই মনে হচ্ছে। আজ তার সম্মান হরণ হলে কেউই টের পাবে না, আকলিমা যে ঘুমের ঔষধ সেবন করে ঘুমাচ্ছে; তাকে রিহানের দেখবালের দায়িত্ব দিয়ে! যার মন অসৎ থাকে সে সুযোগের জন্য উৎ পেতেই থাকে। বাশারের ক্ষেত্রেও তাই। সে সুযোগের অসৎ ব্যবহার করতেই নয়নাকে নিজের ঘরে জোর করে নিয়ে এসেছে। নয়নার অনুনয়-বিনয় কিছুই শোনার ইচ্ছে মাত্র নেই তার।
– “আমাকে ছেড়ে দাও, বাশার ভাই। কথা দিচ্ছি, ফুফুর কাছে আজকের ঘটনার কিছুই বলবো না।”
বাশার অট্ট হাসে। উত্তর দেয়,
– “কখনো শুনেছিস, ক্ষুধার্তের সামনে খাবার আছে কিন্তু সে না খেয়ে আছে? তোকে পাওয়ার ইচ্ছে কী এজনমের?”
নয়না চোখের পানি মুছে নেয়। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে বিপদমুক্তির পথ খুঁজতে থাকে সে। বাশার গায়ের বস্ত্রে হাত বাড়াতেই নয়না ইস্পাতের তৈরী পানির পাত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করে। আকস্মিক আঘাতে বাশার টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। অল্প সল্প র’ক্ত ঝড়ছে সেখান থেকে।
চোখ, নাক, মুখ কুঁচকে ব্যথা সংবরণের চেষ্টা করতে থাকে। নয়না মুখ চেপে কাঁদে, একবার এগিয়ে বাশারকে ধরতে যায় কিন্তু পরমুহূর্তেই আপন জান বাঁচাতে ঘরের এদিকসেদিক পায়চারি করতে থাকে। বাশার নয়নাকে বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছে, নয়নার কানে কিছুই প্রবেশ করছে না। সে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্কুল ব্যাগে ভরে ঘর থেকে বের হয়ে আসে।
প্রধান ফটকের কাছে আসতেই পুনরায় বিপদের মুখোমুখি হয় নয়না। তালাবদ্ধ দরজার চাবি তো আকলিমার কাছে! সে বের হবে কী করে? ঘরে গেলে তো রাবণের হাতে পড়বে। উপায়ন্তর খুঁজে পাচ্ছে না নয়না। আকস্মিক খেয়াল হলো, রান্না ঘরের জানালা দিয়ে বের হওয়া সম্ভব হবে। সময় নষ্ট না করে সেদিকেই দৌড় লাগায় নয়না। বাশার মাথায় হাত চেপে তার দিকেই আসছে।
নয়না রান্না ঘরের দরজা আটকে দিয়ে বুকে স্কুল ব্যাগ চেপে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। তার আর এই জগত সংসারে বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। বাশার দরজায় কষাঘাত করছে, রাগে গর্জে উঠে বারবার। নয়না দুর্বল চিত্তে রান্নাঘরের জানালার দিকে এগোয়। অন্ধকারে সে কিছুই দেখছে না, জান বাঁচাতে লাফ দেয় অন্ধকার স্থানে।
—————————–
– “তোমার শরীরের প্রতি কী মায়া মহব্বত নেই, মা? এতো অত্যাচার কীভাবে সহ্য করো। বোবা নাকি? প্রতিবাদ করতে জানো না? পুরোনো ঘা শুকায়নি তারমধ্যে নতুনভাবে আঘাত পেয়ে বসেছো। এতো ধৈর্যশক্তি কোথায় পাও, শুনি?”
নয়নার আঁখি পল্লব বন্ধ করে রাখা। ডাক্তারের কথায় সে শাসনের আভাস পাচ্ছে। দীর্ঘ বছর পর বাবা ব্যতীত তাকে কেউ শাসন করছে। বিষয়টা তার নিকট উপভোগময়। বুজে রাখা চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নয়নার। দুর্বল চিত্তে উত্তর দেয়,
– “যাদের জীবন দুঃখের ছায়ার তলে গড়ে, তারা আবার নতুন করে আঘাত পাবে কী করে?”
মধ্যবয়স্ক ডাক্তার নয়নার পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিল। নয়নার কথা শুনে সে থমকে যায়, হাতজোড়া আপনাআপনি কাজ বন্ধ করে দেয়। কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় নয়নার অগোচরে।
স্নেহের আদরে মেয়েটাকে আগলে রাখতে ইচ্ছে করে ডাক্তারের। কী এক আলাদা টান! নয়নার প্রিয় বান্ধবী মিছিল, নামটা অদ্ভুত হলেও এটাই তার সার্টিফিকেট নাম। মিছিলের বাবা নুরুল ইসলাম শখ করে মেয়ের আনকমন নামটা রাখেন। মিছিলই নয়নাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ক্ষত শরীরে কুল-কিনারা না পেয়ে বান্ধবীর দুয়ারে কড়া নাড়ে সে।
– “পায়ে ভালোই আঘাত পেয়েছে, হাসপাতালে দুইদিন থাকলে ভালো হবে।”
হাসপাতালে থাকা মানে খরচ বেড়ে যাওয়া। যা নয়না কখনোই চায় না। এমনিতেও ফুফুর বাড়ি ছেড়ে চলে আসার ব্যপারে নয়নার বাবা কিছুই জানে না। আজ সে নিজেই বাবার কাজের জায়গায় যাবে। অনেক কাজ বাকী
আছে তার! ডাক্তারের কথার প্রত্ত্যুত্তরে চট করে বলে ওঠে,
– “একদমই না, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। চল মিছিল!”
কথা দীর্ঘ করতে পারলো না নয়না। তার পূর্বই তীব্র পায়ের ব্যথায় হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ে নয়না। মিছিল ধরার আগেই ডাক্তার নয়নার হাত ধরে দাঁড় করায়।
– “বড়োরা কখনো খারাপ চায় না, মা! দুইদিন থেকে যাও, সুস্থ হলেই তো বাড়ি ফিরে যাবে।”
অশ্রুসিক্ত আঁখিতে নয়না ডাক্তারের দিকে তাকায় বুকপকেটে মাহবুব শিকদার নাম ভেসে উঠে। নয়নার অশ্রুমাখা মুখশ্রী দেখে মায়া হয় মাহবুব শিকদারের। সে আস্বস্ত স্বরে বলে,
– “টাকার ব্যাপারটা মাথায় এনো না। সুস্থভাবে বাঁচতে শিখো, তোমার জীবন মাত্র শুরু এতো সহজেই ঝরে যেতে দিও না, মা।”
————–
হাসপাতালের চার দেয়ালের মাঝে অর্ধদিন অতিবাহিত হয় নয়নার। পুরোটা সময় মিছিল নয়নার সাথেই ছিল। দুর্বলতার জন্য সেলাইন দেয়া হচ্ছে। মাহবুব শিকদার রাউন্ডে দুইবার দেখে গিয়েছেন নয়নাকে। ফিনাইল ও স্যাভলনের গন্ধে মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে মৃত্যু পুরিতে চলে এসেছে নয়না।
জীবনের প্রথম হাসপাতালে থাকা। ইতিপূর্বে নয়নার মা ও ভাইবোনদের মরনকালে হাসপাতালে পা মাড়ানোর সুযোগ হয়নি তার পূর্বেই উপর ওয়ালার প্রিয় হয়ে যায়। নয়নার বয়স তখন কতোই বা ছিল! সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া নয়নার সম্মুখেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল আগুন। চোখের সামনেই মা, ভাই-বোনদের আর্তচিৎকার আজও কানে বাজে নয়নার। এখন সব অতীত, নয়নার অতীতও দুঃখ জর্জরিত ছিল বর্তমানও।
.
হাসপাতালে দুইদিন থাকার পর ডিসচার্জ মিলে নয়নার। হাসপাতালের সমস্ত খরচ মিছিলই বহন করে। আশ্চর্যজনকভাবে নয়নার খরচ কেউ অর্ধ পরিশোধ করে ফেলে। নয়নার বুঝে আসে না, সে বিড়বিড় করে বলে,
– “কে সেই মহামানব!”
মিছিলের বাড়িতেই নয়না উঠে। এবাড়িতে অনেক আদর পায় সে। এবাড়ির প্রতিটা সদস্যই নয়নার আপন। কিছু কিছু সম্পর্ক রক্তের না হলেও আপন হয়ে উঠে। মিছিলের মা নয়নাকে দেখে এগিয়ে আসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
– “এখন কেমন আছো,মা?”
– “ভালো, আন্টি।”
– “ঐ বাড়ি ছেড়ে এসেছো, এই সিদ্ধান্তটা আমি খুব পছন্দ করেছি। এবাড়িতে থাকলে সংকোচবোধ করবে না। মিছিল, মারুফের সাথে আজ থেকে তুমিও আমার মেয়ে।”
অমন মা নামক শান্তি কেন নয়নার নেই। আকলিমা তো তার বাবার বংশের তার কাছে কী নয়না আদর প্রাপ্য ছিল না! ফুফুরা ভাইজিদের মা বলে ডাকেন অথচ নয়নার ফুফু তাকে সহ্যই করতে পারে না। নয়না মিছে হেসে উত্তর দেয়,
– “তা হয় না, আন্টি। এই পৃথিবীতে আমার বাবা এখনো প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছেন, উনাকে ছেড়ে আমি অন্য কোথাও বসতি গড়তে পারবো না। আগামীকাল সকালেই আমি বাবার কাছে চলে যাব।”
অভিভাবক থাকা অবস্থায় চাপ প্রয়োগ করা অযাচিত। মিছিলের মা সায় দিয়ে বলেন,
– “আচ্ছা যেও, এখন ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও।”
মিছিল ঘরজুড়ে পায়চারী করছে। নয়নাকে নিয়ে নিজের ঘরে এসেই তার মুখে পুরো ঘটনা শুনেছে সে। মিছিল বুঝতে পারছে না, বাশার নয়নার আপন ফুফাতো ভাই হয়েও কীভাবে মনে এরুপ আশা পোষণ করে! সে উত্তেজিত কণ্ঠে নয়নাকে বলে,
– “তুই আর ফিরে যাস না, নয়ন! বাশার নামক জানোয়ার তোকে বাঁচতে দিবে না। সুযোগ পেলেই খুবলে খেতে চাইবে।”
সিলিং ফ্যানের দিকে নয়না এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মন মস্তিষ্কে একটা বাক্যই বাজছে,
– “বাশার ভাই আমাকে এত সহজেই কী ছেড়ে দিবে?”
উত্তরটা অপ্রকাশিত। নয়না নিজেও জানে, বাশার তার পিছু এতো সহজেই ছাড়বে না। আজ নয়তো কাল, নয়নার জীবনের কালো অধ্যায় হয়ে বাশার হাজির হবেই।
.
সন্ধ্যা লগনে নয়নার জ্বর আসলো, একশো তিন ডিগ্রি জ্বর। শরীরের উত্তাপে কাঁপছে নয়না। মা, মাগো বলে আর্তনাদ করছে অসহ্য শরীরের ব্যথায়। মিছিল ও তার মা সাময়িক চিকিৎসা করেছে শরীর মুছে, কপালে জ্বরের পট্টি দিয়ে দিয়েছে কিন্তু মেয়েটার জ্বর কমছেই না। ঔষধ পত্র আনতে হবে তো! উত্তেজিত মনে সে মুঠোফোন হাতে বের হয়ে যায় ঘর থেকে।
কিছুক্ষণ পর মিছিল দৌড়ে নয়নার কাছে আসে। মেয়েটা এখনে কাঁপছে। মিছিলের বড্ড মায়া হচ্ছে প্রিয় বান্ধবীর জন্য। গায়ে হাত রেখে আস্তে আস্তে ডাকে নয়নাকে। দুর্বল শরীরে আঁখি মেলে নয়না। কর্ণধারে মিছিলের বাণী তখন প্রবেশ করে,
– “তোর বাবা, আর ফুফু তোকে নিতে এসেছে নয়না।”
নয়না হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছাড়ে। ভয়ার্ত চেহারায় বিড়বিড় করে,
– “আমি ঐ নরকে যাবো না, মিছিল। বাশার ভাই, আমাকে মে’রে ফেলবে।”
(চলবে)…
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়