অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৭+২৮

0
571

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭+২৮

ভাই আসবে, ব্যাপারটা যতটা না আনন্দ দিচ্ছে তার থেকেও বেশি পীড়া দিচ্ছে প্রিয়তাকে। সে কোন মুখে ভাইয়ের সামনে দাঁড়াবে, কোন চোখে তাকাবে ভাইয়ের দিকে? কী বলবে? বলবে যে, “তোমাদের সাথে অন্যায় করার শাস্তি এখন আমিও ভোগ করছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।” আদৌ কি তার এই ভুল ক্ষমার যোগ্য। সারারাত এই ভাবনাতেই কাটে প্রিয়তার।

রাতে দিলরুবা বেগম আর ফারজাদকে প্রিয়তার ভাই আসার খবরটা মৌমি জানায়। মৌমির কাছ থেকে ফারজাদ প্রিয়তার ভাইয়ের নাম্বারটা নেয়। যোগাযোগ করতে হবে।

_______

ফারজাদ তার ডেস্কে বসে কোনো এক ফাইলে চোখ বুলাচ্ছে। তখনই ঘটে জারার আগমন। সে দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করে,

‘আসব, ফারজাদ?’

ফারজাদ তাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সৌজন্যতার খাতিরে হেসে বলল,

‘আসুন, ম্যাডাম।’

ভেতরে প্রবেশ করল জারা। বলল,

‘আপনি দাঁড়িয়েছেন কেন, বসুন।’

ফারজাদ বসল। জারাও অপর পাশের একটা চেয়ারে বসল। অতঃপর ফারজাদের দিকে পূর্ণ মনোযোগে চেয়ে বলল,

‘আপনি আমাকে বলেছিলেন, আপনার সেই আত্মীয়ের ঘটনা সব খুলে বলবেন, কিছুই তো বললেন না আর।’

ফারজাদ ভেবেছিল, মেয়েটা হয়তো ভুলে যাবে, কিন্তু তা আর হলো কই। সে ইতস্তত সুরে বলে,

‘ম্যাডাম, অফিসের ভেতর এসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলাটা কি ঠিক হবে?’

‘অপ্রাসঙ্গিক কেন হতে যাবে? আপনার আত্মীয় যেখানে সেখানে অপ্রাসঙ্গিকতার কিছু নেই। আপনি বলুন।’

ফারজাদ প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করছে। ফাইলটা বন্ধ করে সাইডে রাখল সে। কীভাবে সমস্তটা না বলে ব্যাপারটা ধামা চাপা দেওয়া যাবে সেই প্রক্রিয়াটাই মাথার ভেতর সাজিয়ে নিচ্ছে। জারা অধৈর্য গলায় বলল,

‘বলুন না।’

ফারজাদ ইতস্তত সুরে বলল,

‘আসলে উনার একটু ব্যক্তিগত সমস্যার জন্যই উনি আপাতত আমাদের সাথে আছেন। আর সেদিনের ঘটনাটা অপ্রত্যাশিত ছিল। উনি এমনিতেই অসুস্থ, তার উপর উনার শত্রুপক্ষের কেউ একজন উনাকে আবার আঘাত করতে এসেছিলেন। সব মিলিয়ে ভীষণ কুৎসিত একটা মুহূর্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল।’

জারা এক পল ভেবে জিজ্ঞেস করল,

‘উনি আপনার কে হয়?’

ফারজাদ বুঝতে পারল না, হঠাৎ কী পরিচয় দিবে। চট করেই বলে ফেলল তাই,

‘কাজিন, আমার কাজিন হয়।’

পরিচয়টা বোধ হয় জারার খুব একটা পছন্দ হলো না। মুখটা কেমন যেন চুপসে গেল। ছোট্ট করে বলল,

‘ওহ।’

ফের আবার প্রশ্ন করল,

‘মেয়েটাকে দেখে তো অল্প বয়স মনে হলো, এই বয়সে এত শত্রু হলো কী করে?’

ফারজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘শত্রুতার জন্য কি আর বয়স লাগে, ম্যাডাম? উনার শত্রু উনার খুব প্রিয় একজন। আসলে আজকাল বয়স দেখে শত্রুতা হয় না, শত্রুতা হয় সম্পর্ককে পুঁজি করে। যাকগে সেসব, আমি আর উনাকে নিয়ে কথা বলতে চাইছি না। আশা করছি ম্যাডাম, আপনিও ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।’

জারা ম্লান হেসে বলল,

‘জি। বুঝতে পেরেছি।’

জারা বেরিয়ে যায়। ফারজাদ ফের ফাইলটা খুলে বসে। কিন্তু আনমনে অন্তঃস্থলে তখন প্রিয়তার মুখাবয়ব ফুটে উঠে। সে ভাবে, “ভাই এলেই মেয়েটা চলে যাবে, আবার নতুন একটা জীবন পাবে। হয়তো একসময় আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, হয়তো একসময় ভুলে যাবে তাদের।” ফারজাদ মাথা ঝাঁকাল। নিজেকে ধমকে বলল, “এতকিছু ভাবার কী আছে, ভুলে গেলে যাবে। এমনিতেও সে কি মনে রেখে বসে থাকবে না কি!”

_________

বাড়ি ফিরছে জারা এবং তার বাবা রওফিক জুবায়ের। জারার চোখে মুখে ছেয়ে আষাঢ়ের কালো অম্বুধর। রওফিক সাহেব ব্যাপারটা খেয়াল করছেন অনেক আগ থেকেই। মেয়েটার আজকাল একটু বেশিই মন খারাপ থাকে। তার কারণটাও হয়তো তিনি অনুধাবন করতে পারছেন। কিন্তু, বাবা হিসেবে করতে পারছেন না কিছুই। তিনি রুদ্ধশ্বাস ছাড়লেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,

‘মন খারাপ, মা?’

জারা চাইল বাবার দিকে। তার চোখে মুখের উপচে পড়া বিষন্নতা জবাব দিল, হ্যাঁ, মন খারাপ। ভীষণ মন খারাপ। তবে মুখে বলল,

‘না।’

রওফিক সাহেব বললেন,

‘মেয়েরা মুখ ফুটে না বললেও বাবারা বুঝতে পারে সব। কী লাগবে বলো?’

জারা থমথমে স্বরে বলল,

‘ফারজাদকে।’

রওফিক সাহেব স্তম্ভিত হলেন। যদিও জবাব জানতেন তিনি। গম্ভীর স্বরে বললেন,

‘অন্যকিছু চাও।’

‘এটাই লাগবে, আব্বু। অন্যকিছু না।’

‘এটা দেওয়ার সামর্থ্য যে তোমার বাবার নেই।’

জারা অস্থির হলো। বিচলিত সুরে বলল,

‘কেন নেই? তুমি ফারজাদের পরিবারের সাথে কথা বলো। পরিবার মেনে নিলে ফারজাদও মেনে নিবে।’

রওফিক সাহেব মেয়ের সুখের জন্য সবটুকু করতে পারেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর মেয়েটাকে আগলেই বেঁচে আছেন তিনি। সবসময় সব চাওয়া পূরন করে এসেছেন। এবারও করবেন, অবশ্যই করবেন। তিনি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘ঠিক আছে, মা। আমি ফারজাদের পরিবারের সাথে কথা বলব।’

আষাঢ়ের মেঘ সরে গিয়ে রোদ ঝলমলে হয়ে উঠে জারার মুখাবয়ব। প্রচন্ড খুশি হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ভালোবেসে বলে,

‘আই লাভ ইউ, আব্বু।’

রওফিক সাহেব মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

‘আই লাভ ইউ টু, আম্মিজান।’

__________

একপ্রকার জোর করেই আজ রান্নাঘরে ঢুকেছে প্রিয়তা। সে আজ সকলের জন্য চা বানাবে। দিলরুবা বেগম হাজার বারণ করেও তাকে ঠেকাতে পারেননি। শেষে ক্লান্ত হয়ে সোফার ঘরে বসে রইলেন। রান্নাঘরে প্রিয়তা আর মৌমি। মৌমি কিছু একটা নাস্তা বানাচ্ছে। আর প্রিয়তা বানাচ্ছে তার স্পেশাল মশলা চা। তার পরিবারে এই চায়ের জন্য বিখ্যাত সে।

ফারজাদ অফিস থেকে ফিরেই নিজের ঘরে। আজ মাথা ধরেছে। শুয়ে আছে সম্ভবত। দিলরুবা বেগম টি.ভি দেখছেন। খবরের চ্যানেলগুলোতে এখনো সেই নারী পাচার চক্র নিয়েই যত আলোচনা চলছে। সবাই এখন অধিক আগ্রহে বসে আছে ওয়াদির ধরা পড়ার জন্য। সে ধরা পড়লেই খোলাসা হবে পুরো ব্যাপারটা। সামনে আসবে বিস্তর কিছু। কিন্তু, এই নাটের মূল কোথায় ঘাপটি মেরে আছে কে জানে। দিলরুবা বেগম ভাবলেন, তিনি যদি আর একবার ছেলেটাকে দেখতে পেতেন, তবে অবশ্যই কষিয়ে একটা চড় মেরে আসতেন।

প্রিয়তা আর মৌমির চা নাস্তা বানানো শেষ। নাস্তাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বসার ঘরে আসে তারা। মৌমি বলল,

‘ভাইয়াকে ডাকব, আম্মি?’

‘না, ওর নাকি মাথা ধরেছে। ওর রুমেই বরং চা’টা দিয়ে আয়।’

মৌমি একটা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কী ভেবে যেন প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দিল সেটা। বলল,

‘আপু, তুমি একটু কষ্ট করে এটা ভাইয়াকে দিয়ে এসো না।’

দিলরুবা বেগম দ্বিমত পোষণ করে বললেন,

‘আহা, মেয়েটার হাতে ব্যথা, তুই যা না।’

প্রিয়তা প্রসন্ন হেসে বলল,

‘না না, আন্টি, সমস্যা নেই। আমি পারব।’

মৌমি তাকে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ, যাও যাও।’

প্রিয়তা পা বাড়াল ফারজাদের ঘরের দিকে। দিলরুবা বেগম ভ্রু কুঁচকে মৌমির দিকে চাইলেন। ক্ষিপ্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী সমস্যা তোর?’

মৌমি চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে আমোদ গলায় বলল,

‘নিজের ব্যবস্থা নিজে করতে না পারলে অন্যকে তো তা নিয়ে ভাবতেই হবে। তোমার ছেলের যা মতি গতি, মনে হচ্ছে না আমি কোনোদিন পিপি হতে পারব বলে। তাই নিজ থেকেই একটা ব্যবস্থা নিলাম, দেখি না কাজ হয় কি না।’

দিলরুবা বেগম হতভম্ব হলেন। মৌমির কথার অর্থ বুঝতে পাক্কা দু মিনিট লাগলেও, বোঝা মাত্রই চমকালেন তিনি। এমনটা কখনো চিন্তাও করেননি। তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বললেন,

‘আমি যা ভাবছি তুই কি তাই বোঝাতে চেয়েছিস?’

মৌমি হেসে ফেলে। বলে,

‘জি, আম্মিজান। তাই। প্রিয়তা আপু ভাবিজি হিসেবে একদম পারফেক্ট।’

দিলরুবা বেগম হকচকিয়ে উঠেন। কীসব আকাশ কুসুম ভাবছে মেয়েটা। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর আবার মনে হলো, প্রিয়তা মেয়েটা মন্দ নয়।

চলবে…..

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৮।

‘আসব?’

প্রিয়তার গলার স্বরটা প্রথমেই ধরতে পারল না ফারজাদ, সে মৌমি ভেবে তাই বলে উঠল,

‘হু।’

প্রিয়তা ভেতরে ঢুকে। ফারজাদ কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। এই প্রথম প্রিয়তা ফারজাদের ঘরে এসেছে। প্রচন্ড অস্বস্তি গা চারা দিয়ে উঠেছে যেন। স্বভাবতই আশেপাশে চোখ বুলাল প্রিয়তা। একটা বিছানা, ছোট্ট ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, পড়ার টেবিল আর একটা বুক শেলফ দিয়ে টিপটপ করে রাখা। সবকিছু গোছানো বেশ। দেয়ালে আছে আবার একটা বড়ো ফ্রেমের ছবি। ছবিতে দিলরুবা বেগম, ফারজাদ আর মৌমি। সকলের হাস্যজ্জ্বল মুখ। প্রিয়তা খেয়াল করল, এই বাড়ির কোথাও ফারজাদের বাবার কোনো ছবি নেই, চিহ্ন নেই; কিংবা এতদিন অবধি এই বাড়িতে আছে, কখনো এই মানুষটার কথা কেউ মুখেও আনেনি। ব্যাপার কী! তার এই গুরুতর ভাবনার সুতো কাটে ফারজাদের গলার স্বরে। ফারজাদ উঠে বসে অপ্রস্তুত স্বরে বলে,

‘আপনি এখানে কেন?’

আচমকা প্রশ্নে রা হারায় প্রিয়তা। কী বলবে ভাবতে ভাবতেই খানিক সময় পার করে দেয়। তারপর মনে পড়ে, সে তো চা নিয়ে এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই চায়ের কাপটা ফারজাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘আপনার জন্য চা নিয়ে এসেছিলাম।’

ফারজাদ চায়ের কাপ হাতে নিল। জিজ্ঞেস করল,

‘মৌমি কোথায়?’

প্রিয়তা ইতস্তত সুরে বলল,

‘নিচে।’

‘তাহলে ও না এসে আপনাকে পাঠাল কেন?’

এই প্রশ্নের জবাব কী দিবে সে। সে তো নিজেও জানে না মৌমি তাকে কেন পাঠিয়েছে। তাই অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠাই। ফারজাদ প্রিয়তার মুখখানা দেখে ঠাহর করতে পারল তার অবস্থাটা। বলল,

‘আচ্ছা, আপনি নিচে যান।’

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে পা বাড়ায়। ততক্ষণে ফারজাদ চুমুক বসায় চায়ের কাপে। প্রিয়তাকে ডাকে ফের। সে ফিরে চাইতেই জিজ্ঞেস করে,

‘চা’টা আপনি বানিয়েছেন?’

‘জি, কী করে বুঝলেন?’

‘আম্মি আর মৌমির হাতের চায়ের স্বাদ আমার মুখস্থ। এই স্বাদ নতুন মনে হলো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

প্রিয়তা একপল সময় নিয়ে মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘কেমন হয়েছে?’

ফারজাদ কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘ভালো।’

সামান্য ভালোতেই প্রিয়তা খুশি হলো বেশ। নিচে নামল খুশ মেজাজে। মৌমি তাকে দেখেই বলল,

‘আপু, চা’টা যা দারুণ হয়েছে না। আমাকে পরেরবার শিখিয়ে দিও তো।’

প্রিয়তা হেসে সোফায় বসল। বলল,

‘অবশ্যই শেখাব।’

দিলরুবা বেগম বললেন,

‘আমাকেও শেখাতে হবে কিন্তু।’

প্রিয়তা শব্দ করে হাসে এবার। বলে,

‘আচ্ছা, আন্টি।’

অনেকদিন পর একটু হাসতে পেরে যেন মনটা আজ অনেকটা হালকা লাগছে। অন্যদিনের তুলনায় আজ দিনটা ভালো কেটেছে প্রিয়তার। কিছুক্ষণের জন্য হলেও যেন মনে হচ্ছিল, তার কোনো দুঃখ নেই, সব দুঃখ হাওয়ায় মিশে গিয়েছে। কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও যেন শ্বাস নিতে পারছিল সে। একটু শান্তি অনুভব করছিল।

_______

রাত এখন দশটা ঠিক। মৌমির ফোন বাজছে। আবারও আননোন নাম্বার। তবে এবারের নাম্বারটা পাকিস্তানী। সে রিসিভ করে। সালাম দেয় বরাবরের মতোই। ওপাশ থেকে ভেসে আসে পুরুষালী এক স্বর। সালামের জবাব দিয়ে লোকটি বলে,

‘আমি নীহাল, প্রিয়তার ভাই। প্রিয়তার সাথে কি কথা বলা যাবে?’

পরিচয় পেয়ে মৌমি ফের ছুটে যায় প্রিয়তার ঘরে। ঘর খালি, প্রিয়তা নেই সেখানে। খুঁজতে খুঁজতে মায়ের ঘরে যায়। প্রিয়তাকে সেখানে পেয়ে সে দ্রুত ফোনটা তার হাতে দিয়ে বলে,

‘নীহাল ভাইয়া কল করেছেন।’

প্রিয়তা অস্থির চিত্তে দ্রুত কানে লাগায় ফোনটা। ভগ্ন সুরে ডাকে,

‘ভাইয়া!’

‘প্রিয়, প্রিয়, আমি এসেছি বোন। তুই কোথায় আছিস বল, আমি এক্ষুনি তোর সাথে দেখা করতে চাই।’

প্রিয়তার হাত কাঁপছে। গলা কাঁপছে। চোখ টলমল করছে উষ্ণ জলে। গলার স্বর আটকে আসছে বারংবার। ফোনটা লাউডস্পিকারে দেওয়া। দিলরুবা বেগমও শুনলেন সবটা। প্রিয়তা কিছু বলতে পারছে না দেখে তিনি নিজেই ফোনটা নিলেন। কানে লাগিয়ে বললেন,

‘আপনি এখন কোথায় আছেন?’

নীহাল গলার স্বর চিনতে না পেরে বলল,

‘আপনি কে বলছেন?’

‘আমি দিলরুবা বেগম, প্রিয়তা এখন আমার বাড়িতেই আছে। আপনি কোথায় আছেন, যদি একটু বলতেন।’

‘আমি তো এয়ারপোর্টে।’

‘আচ্ছা, সেখানেই থাকুন। আমার ছেলে আপনাকে এসে নিয়ে যাবে। ওর কাছে আমি আপনার ফোন নাম্বার দিয়ে দিব, ও পৌঁছে আপনাকে কল দিবে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, আমি অপেক্ষা করছি তাহলে।’

দিলরুবা বেগম ফোন রেখে ফারজাদকে ডাকলেন। ফারজাদ আসার পর সব খুলে বললেন তাকে। ফারজাদ আর দেরি করল না তাই। দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল, প্রিয়তার ভাইকে আনার জন্য।

________

প্রিয়তা শুকনো মুখে বসে আছে। ভাইয়ের সামনে কীভাবে যাবে সেই চিন্তাতেই অস্থির সে। মৌমি আর দিলরুবা বেগম তাকে বোঝাচ্ছেন। কিন্তু মেয়েটার চিন্তা আর অস্থিরতা কমার নাম নিচ্ছে কই!

ফারজাদ আধ ঘন্টার ভেতর এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। গিয়েই ফোন করল সে নীহালের নাম্বারে। কলটা সাথে সাথেই রিসিভ হলো। সালাম দিল ফারজাদ। নীহাল জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘আপনি কি দিলরুবা আন্টির ছেলে? এয়ারপোর্টে যার আসার কথা ছিল?’

‘জি, কোনদিকে আপনি?’

‘প্রথম গেইটের সামনে।’

‘আচ্ছা দাঁড়ান, আমি আসছি।’

ফারজাদ সেদিকেই যায়। কিন্তু সেখানেও মানুষ অনেক। এত মানুষের ভেতর নির্দিষ্ট ব্যক্তিটাকে চিনবে কী করে। সে আবার ফোন দেয়। নীহাল জিজ্ঞেস করে,

‘আপনি এসেছেন?’

‘জি, আপনি কোথায়?’

নীহাল বলল,

‘আমি হাত উঠিয়েছি, দেখুন।’

ফারজাদ দেখল, তার থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে একজন লোক হাত উঠিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। সে বুঝতে পারে, উনিই তার কাঙ্খিত ব্যক্তি। সে ফোন কেটে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,

‘আপনি নীহাল।’

লোকটা চমকে তাকায়। বিস্মিত হয়ে বলে,

‘জি জি, আমিই নীহাল।’

ফারজাদ প্রসন্ন হেসে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

‘হ্যালো! আমি ফারজাদ, দিলরুবা বেগমের ছেলে।’

নীহাল হাত মেলাল না, জড়িয়ে ধরল ফারজাদকে। ফারজাদ হকচকিয়ে উঠে। এমন কিছু হয়তো আশা করেনি। নীহাল ভেজা স্বরে বলে,

‘আপনাদের ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না। পুলিশ সব বলেছেন আমাদের। আপনি আর আপনার পরিবার না থাকলে হয়তো আমি আমার বোনকে কখনোই ফিরে পেতাম না। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। আমি চির কৃতজ্ঞ রইলাম।’

ফারজাদ বিব্রতবোধ করছে। সে জোরপূর্বক হেসে বলে,

‘এভাবে বলবেন না, দয়া করে। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোটাই মানুষের ধর্ম। আজ আমরা আপনাদের সাহায্য করেছি, কাল হয়তো আপনারা আমাদের সাহায্য করবেন। এখানে ঋণ শোধ করার কোনো ব্যাপার নেই। আপনাদের মেয়ে আপনাদের কাছে ফিরে যেতে পারছে, আমরা তাতেই খুশি।’

ফারজাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হলো নীহাল। পুলিশ বলেছিলেন, “আপনার বোন ভালো মানুষের কাছে আছেন, চিন্তা নেই।” কথাটা আজ চিরন্তন সত্য বলে মনে হলো তার।
ফারজাদ বলল,

‘চলুন এবার, আপনার বোন আপনার অপেক্ষায় আছেন।’

অতঃপর রওনা দিল দুজন।

বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ আসতেই প্রিয়তার অস্থিরতা ত্বরান্বিত হয়। সে হাত কঁচলাতে আরম্ভ করে। গলা শুকিয়ে উঠে তার। মৌমিকে বলে,

‘আমাকে পানি খাওয়াবে একটু।’

মৌমি পানি দেয়। পুরো গ্লাসের পানিটুকু খেয়ে নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা চালায় সে। দিলরুবা বেগম গিয়ে দরজা খুলে দেন। অপেক্ষা করেন আগন্তুকের। কিছু সময় বাদেই ফারজাদ আসে, সাথে এক অপরিচিত মুখ। দিলরুবা বেগম বুঝতে পারেন, এটাই নীহাল। নীহাল দরজার অভিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা গম্ভীর ভাবমূর্তির মহিলাটিকে দেখেই আন্দাজ করে ফেলে, উনিই দিলরুবা বেগম। নীহাল সালাম দেয়। সালামের জবাব দেন দিলরুবা বেগম। তাকে ভেতরে নিয়ে বসান। ভেতরে গিয়েই নীহালের অস্থির চঞ্চল দুই চোখ তার প্রাণপ্রিয় বোনকেই খুঁজতে আরম্ভ করে। ফারজাদও পাশে বসে তার। দিলরুবা বেগম প্রিয়তার কাছে ফিরে গিয়ে বলেন,

‘তোমার ভাই চলে এসেছেন, প্রিয়তা। এবার তোমাকে তার মুখোমুখি হতেই হবে। চলো, মা।’

চলবে….

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here