গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায় #পর্বঃ_১৬+১৭ #লেখাঃ_আফসানা_মিমি

0
344

#গল্পঃ_নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#পর্বঃ_১৬+১৭
#লেখাঃ_আফসানা_মিমি
——–
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ নয়নাকে ভাবনার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে তূর্য চলে গেলো। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে তার রাতের ডিউটি। অথচ সারা বিকেল বিশ্রামের নাম পর্যন্ত নেয়নি। রাত নয়টা বাজে, নয়না মাত্র গোসল সেরে বের হয়েছে। পরিধানে তূর্যের পছন্দ করা জামা। নয়না আয়নার সামনে দাড়ালো, ওড়না বিহীন শরীরে এখনো কালসিটে দাগগুলো বুঝা যাচ্ছে। নয়নার মনে পড়ে গেলো বাশারের কর্মকাণ্ডের কথা, মুহূর্তেই ঘামতে শুরু করলো মেয়েটা। বুকে ওড়না গুঁজে বিছানা ঘেঁষে আস্তে আস্তে বসে পড়লো নয়না, বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,” পৃথিবীর সকল পুরুষ অভিশপ্ত, নষ্ট। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না, কাউকে না।”

ভয় মানেই ভয়ংকর। একবার মনে ঢুকে গেলে ভয় কাটিয়ে উঠতে সময়ের প্রয়োজন হয়। এমন মানুষকে একাকী নয় বরঞ্চ সঙ্গী হয়ে একজনকে সারাক্ষণ পাশে থাকতে হয়। সারাদিন নয়নার পাশে কেউ না কেউ ছিল। দিনের অর্ধেক সময় তূর্যের সাথে কাটিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও কালো অতীত স্বরণে আসেনি নয়নার। কিন্তু অতীত! তা কী কখনো পিছু ছাড়ে? সর্বক্ষণ আঠার মতো মস্তিস্কে গেঁথে থাকে। একাকীত্বের সময় হানা দিয়ে বেড়ায়। বাশারের ছোঁয়া মনে হচ্ছে নয়নার সর্বাঙ্গে লেগে আছে। নয়না হাত, ঘাড়ে ইচ্ছেমতো হাত বুলাতে থাকলো। তার কাছে মনে হচ্ছে, এই জায়গাটুকু অপবিত্র হয়ে গেছে। মেয়েটা যেন নিজের মধ্যে নেই, মাথার চুল টেনে টেনে চিৎকার করে কাঁদছে।

রাত বারোটা ত্রিশ মিনিট,
তূর্য রোগীদের দেখে মাত্রই কেবিনে আসলো। আজকে রোগীদের সংখ্যা একটু বেশিই ছিল। ডিনার করারও সময় পায়নি সে। এখন খাবে কিন্তু একাকী খেতে কী আর ভালো লাগে? তূর্যের তিনজন সহকর্মী, সহকর্মী থেকে তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বেশী, মিনহাজ, মাহিন ভাবনা, এরা সারাদিন ডিউটি করে সন্ধ্যায় চলে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু রোগী বেশি থাকায় থেকে যেতে হলো। তূর্য খাবার সামনে রেখে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সে জানে আগামী পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিন বদমাশ এখানে এসে উপস্থিত হবে। শুধু তাই নয়, তূর্যকে লজ্জায় ফেলতে যা মুখে আসে তাই বলবে। গুনে গুনে তিন মিনিট পর তূর্যের কেবিনের দরজায় করাঘাত হলো। একে একে তিন মাথা ঢুকিয়ে একসাথে আওয়াজ করলো,” আসতে পারি, স্যার?”
তূর্য প্লেট সাজানোর মিথ্যা বাহানা করে বলল,” আয়!”

হুড়মুড় করে তিনজন প্রবেশ করে কে কার আগে চেয়ারে বসতে পারবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলো। আড়চোখে তূর্য দেখে কিছু বলল না। প্লেটে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করলো। তূর্য ছাড়া বাকী তিনজন রেলগেইটের বিখ্যাত হাজির বিরিয়ানি থেকে কাচ্চি নিয়ে এসেছে।বিরিয়ানির ঘ্রাণে সারা কেবিন ম ম করছে। মিনহাজ বিরিয়ানির প্যাকেট থেকে গন্ধ শুঁকে বলল,” মামার হাতের জাদু তো এই কাচ্চিতেই। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মামার হাতের জাদু বউয়ের উপর কীভাবে ফেলে, চ্যাপ্টা হয়ে যায় না?”

ভাবনা মিনহাজের পিঠে দুরুম করে কিল বসিয়ে বলল,” আজাইরা বকতে একদিনই নিষেধ করিনি! তোর সাথে আমার সম্পর্ক সব শেষ।”

মিনহাজ চুপসে যায়, ভাবনার এপ্রোনের কোণা টেনে ইনোসেন্ট হয়ে বলল,” মুখ আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না, জানেমান। প্লিজ রাগ করো না।”

তূর্য বন্ধুদের মজা দেখে হাসছে। এরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। আগামী দুই বছর ক্যারিয়ার গঠন করে বিয়ে পর্যন্ত এগোবে। তূর্য বিনাবাক্যে খেয়েই যাচ্ছে, কথা বলছে না। এদিকে তিন বন্ধু কীভাবে কথা তুলবে বুঝতে পারছে না। বুকে সাহস সঞ্চয় করে ভাবনা বলে উঠলো,” বাসায় নয়না একা, না জানি কী করছে!”

তূর্য খাওয়া বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে নিয়ে পুনরায় খেতে লাগলো। ভাবনা নড়েচড়ে মাহিন ও মিনহাজকে ইশারায় বলাবলি করে তূর্যের উদ্দেশে বলল,” নয়না কী বলল রে?”

” আমার গলার সুর নাকি শেয়ালের মতো।”

তূর্যের থমথমে কথায় পুরো কেবিনে হাসির বন্যা বয়ে গেলো। মিনহাজ হাসি থামিয়ে বলল,” তোর এ্যাটিটিউড একজনের কাছেই শেষ। শেষে কিনা তোকে শেয়াল বানিয়ে দিলো!”

তূর্যের খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে এসে তিন বন্ধুদের তাগাদা দিয়ে বলল,” বের হো তোরা। আমার কিছু প্রাইভেট কাজ আছে।”

তিন বন্ধু একসাথে সুর তুলল। ভাবনা প্যাকেট গুছিয়ে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” নয়নার নিয়ে ভানাই তো তোর এখন প্রাইভেট কাজ, তাই না?”

” বেশি বকবি না, তুই আজ চলে যা। নয়নাকে এখন একা রাখা ঠিক হবে না।”

” ওরে! কী চিন্তা নয়নার জন্য! এদিকে বন্ধুরা কতো না খেয়ে শুঁকিয়ে যাচ্ছে তার খবর নাই।”

মাহিনের কথা শেষ হতেই ভাবনা বা হাত ঢোকায়,” প্রেমিকাকে পেয়ে আজ বন্ধুদের ভুলে গেছে, আমাদের হ্যান্ডসাম তূর্য।”

” বাজে বকিস না, ভাবনা। মিনহাজকে নিয়ে বিদায় হো। আমি এদিকটা সামলে নিব।”

ভাবনা, মিনহাজ হেসে বিদায় নিলো। মাহিনের খাওয়াও শেষ পর্যায়ে। সে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তূর্যকে বলল,” মেয়েটার মেডিক্যাল কন্ডিশন কেমন মনে হলো তোর কাছে? ”

তূর্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,” বুঝতে পারছি না। তবে তাকে একাকী রাখা যাবে না। একবার বিশ্বাস উঠে গেলে দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। নয়নার সাথে যা ঘটেছে তারজন্য সে গোটা পুরুষজাতিকেই ভয় পাবে, ঘৃণা করবে। নয়নার মনে আদৌও বিশ্বাস জন্মাতে পারব কী না, জানি না।”

” ওর ফুফুর বাড়ির লোকেদের শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।”

ফুফুর কথা উঠায় তূর্যের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। হেলান ছেড়ে রূঢ় সুরে বলল,” তাদের ব্যবস্থাও করে ফেলেছি।”

রাত একটা বাজে পয়তাল্লিশ মিনিট,
মাহিনকে বসিয়ে তূর্য হাসপাতালের দক্ষিণ পাশে চলে আসলো। উদ্দেশ্য নয়নার সাথে কথা বলার। এতো রাতে ফোন দেয়া অবশ্যই ভদ্রতার কাজ নয় কিন্তু তার মন মানছে না। নয়নার গলার স্বর শোনার জন্য মন আকুপাকু করছে। নয়নাকে রেখে আসার সময় জোর করে এন্ড্রয়েড ফোন দিয়ে এসেছে সে। ফোন ধরবে কী না সন্দেহ! সাতপাঁচ ভেবে তূর্য ফোন করল, একবার দুইবার রিং হতেই ঘুম ঘুম কণ্ঠে নয়না ফোন ধরে বলল,” আপনারা ডাক্তাররা কী রাতেও ঘুমান না?”

ঘুম ঘুম স্বরেও কী আলাদা সুর আছে? তূর্য চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আপনমনে বলল,” ঘুমালেও মেয়েটার মস্তিস্ক সচল থাকে, ভবিষ্যতে জামাইকে ভাই ডাকার সম্ভাবনা থাকবে না।”

” শুনছেন?”

তূর্য এবার মুখ খুলল। ঠোঁটের আগায় দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল,” একজন মেয়ে এভাবে কখন ডাকে, জানো?”

নয়না ঘুমঘুম চোখে উঠে বসলো। ভাবনা পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পিঠে বালিশ চেপে বলল,” কখন?”

” বিয়ের পরে। আমার এখন বিয়ে বিয়ে ফিলিংস হচ্ছে, নয়ন!”
নয়নার চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেলো। কান থেকে ফোন সরিয়ে আচ্ছামতো তূর্যকে বকেও নিলো। অপরপাশে তূর্য বেহায়ার মতো হাসতে লাগলো। নয়না ফোন কানে রেখে শক্তকণ্ঠে বলল,” আপনার রোগীরাও কী আপনার মতো পাগল?”

তূর্য একধাপ এগিয়ে উত্তর দিলো,” আমার থেকেও মহা পাগল, নয়ন! মহা পাগল।”

নয়ন ফট করে কল কেটে দিলো। তূর্যের কথায় তারও ভীষণ হাসি পাচ্ছে। এমনসময় ভাবনা ঘুমঘুম কণ্ঠে বলে উঠলে, ” বাহ! নয়না দেখি হাসতেও জানে।”

ফোন বালিশের নিচে রেখে নয়না দ্রুত শুয়ে পড়লো। শুধু তাই নয়, চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখলো যেন ভাবনা ফের কথা বলার সুযোগ না পায়।

———————

সকাল সকাল আকলিমার ঘুম ভাঙে পাতিলের ঠাস ঠুস আওয়াজ শুনে। বেচারি রাতে কড়া ঘুমের ঔষধ সেবন করে ঘুমিয়েছিল। মাসুদা নামক মেয়েটার পরিচয় জেনে আকলিমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মাসুদা সেই মেয়ে যার পরিবার বাশারকে দেখতে এসেছিল। নয়নাকে এবাড়িতে দেখে বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। এরজন্য নয়না বিনা কারণে আকলিমার হাতে মা’র খেয়েছিল। আকলিমার ভদ্র, সুশিক্ষিত ছেলে সেই মেয়ের সাথে প্রেমালাপ করে বিয়েও করে নিয়ে এসেছে! এসব শুনে আকলিমার প্রেশার বেড়ে গেছে। বাশার রাতে বাড়ি ফিরলে আকলিমা কিছুক্ষণ জুতাপেটা করলো। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে নিজের ঘরে চলে গেলো। সকালের উচ্চ আওয়াজ আকলিমার সহ্য হচ্ছে না। ঘর ছেড়ে তাই আকলিমা বের হয়ে আসলো। রান্নাঘর থেকে শব্দ ভেসে আসছে। আকলিমা সেদিকেই গেলো। মাসুদা আকলিমার এতো বছরে গড়া পাতিলগুলো পুঁতা দিয়ে ভর্তা বানাচ্ছে। আকলিমা দৌড়ে মাসুদার হাত থেকে পুঁতা নিয়ে নিলো। পাতিলগুলোর দিকে মায়াভরা চাহনি দিয়ে রাগান্বিত স্বরে ধমক দিয়ে বলল,” একদিনের মেয়ে হয়ে আমার সংসারের জিনিস নষ্ট করছো কোন সাহসে।”

মাসুদা আকলিমার কথার প্রত্ত্যুত্তরে কিছু না বলে মরা কান্না শুরু করলো,” ও বেবিই! দেখে যাও তোমার মা আমাকে কথা শোনাচ্ছে।”

বাশারের মন আজ ফুরফুরে। এতো বছরের মনোবাসনা পূরণ হয়েছে। সুন্দরী বউয়ের সাথে ভালো সম্পদও ফ্রী হিসাবে পেয়েছে। এখন বউয়ের আহ শব্দও কী সহ্য করা যায়! বাশার ঘর ছেড়ে দৌড়ে আসলো। মাসুদার কান্না দেখে জিজ্ঞেস করলো,” কী হয়েছে আমার ময়না পাখির?”

” তোমার মা আমাকে নিজেই বলল, পাতিল গুলো ভাঙতে। আর এখন নিজেই এসে কথা শোনাচ্ছে।”

আকলিমা আকাশ থেকে টপকে পড়লো যেন। মুখে তা রা নেই। ইশারায় কথা বলবে শরীর সায় দিচ্ছে না। বাশার মুখ ফুলিয়ে বলল, ” ছেলের বউয়ের সাথে এ কেমন ব্যবহার,মা! তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি।”

আকলিমা স্তব্ধ হয়ে গেলো। থমকে গেলো তার পৃথিবী। যেই সন্তানের জন্য নিজের ভাইজিকে বিনা দোষে পিটিয়েছে সেই সন্তানই তার উপর আঙুল তুলছে! এটাই কী শাস্তি? বাশার সেই কখন চলে গেছে! আকলিমা নষ্ট করা পাতিল গুলোর দিকে চেয়ে গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

—————————

রবিবার তূর্যের ছুটির দিন থাকে। প্রয়োজন ছাড়া এই দিনে তূর্য ছুটি কাটায় না। আজ ছুটির দিনটা নয়নার সাথে কাটাবে বলেই দক্ষিণ ছায়াবীথি এলাকায় আসে। এখন বাজে সকাল সাতটা। এই সময়ে সবাই ঘুমে নিমগ্ন। তূর্য একটু বেশি সকালেই আলে আসলো নাতো! সময়ের চিন্তা মাথায় আসতেই তূর্য বিরক্তি প্রকাশ করলো। এই সময়টুকু সে কোথায় কাটাবে? ভাবনার বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো তূর্য। গাড়ি থেকে নেমে এদিকসেদিক পায়চারি করতে লাগলো।

নয়নার ঘুম সকাল সকাল ভেঙে গেলো। সকালের সতেজ হাওয়া গায়ে লাগানোর জন্য বারান্দায় আসে সে। চারপাশের মনোরম দৃষ্টি উপভোগ করে নিচে তাকাতেই তূর্যের দেখা মিলে। তূর্য অস্থির চিত্তে পায়চারী করছে তা দেখে নয়না ডেকে উঠলো তূর্যকে,” সকাল সকাল জগিং করতে বের হয়েছেন নাকি, ডাক্তার সাহেব?”

তূর্য মনে মনে খুব খুশি হলো। সে তো নয়নার জন্যই এখানে এসেছে। কিন্তু এভাবে যে পেয়ে যাবে কল্পনাও করেনি। মুখে হাসির রেখা টেনে তূর্য বলল,” ডাক্তার মানুষ তো! একটু নিয়ম মেইনটেইন করতে হয়! ডাক্তারের সঙ্গ লাগবে বুঝি!”

নয়না ভেংচি কেটে বলল, ” অমন হাতুড়ি ডাক্তারের সঙ্গ পাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই।”

অন্য কেউ শুনলে অপমানবোধ হতো কিন্তু তূর্য নির্লজ্জের মতো হেসে বলল,” এই ডাক্তারের উপরই কিন্তু একসময় ক্রাশ খেয়েছো, মেয়ে!”

মন্দ শোনা গেলেও কথাটা মিথ্যা নয়। নয়নার মনের দুর্বল একটা স্থান রয়েছে তূর্যের জন্য। যা সে কাউকে বলেনি, আর কখনো হয়তো বলতে পারবেও না। তবে তূর্য এভাবেই যদি নয়নার আশেপাশে সবসময় ঘুরঘুর করে তো কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। যা নয়না চায় না।
সে কিছু না বলে ঘরে ফিরে আসে। ভাবনা গোসল শেষ করে তাড়াহুড়োর মধ্যে আছে। বেচারি আজ রান্নাও করতে পারেনি। দশ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারলে মাহবুব শিকদার তার শিরচ্ছেদ করে ফেলবে। ভাবনার জলদি কাজ করা দেখে নয়না বলে উঠলো, ” আমার জন্য আপনার সমস্যা হচ্ছে, আপু। আমি না থাকলে আপনার সমস্যা হতো না। এরচেয়ে ভালো হয়, আমি চলে যাই। তাহলে আপনি চিন্তামুক্ত থাকবেন।”

ভাবনা গায়ে এপ্রোন জড়িয়ে উত্তর দিলে,” আপু ডাকছো কিন্তু মানছো না, নয়না। তুমি আমার ছোট বোনের মতো। তুমি থাকলে আমার বিরক্ত নয় ভালো লাগে। একাকী বাসায় আসার পর দুইখানা কথা বলার মানুষ পাই না এই শহরে। তোমাকে পেয়ে কথা বলার মানুষ পেয়েছি। এছাড়া তোমার এখন সেফটি প্রয়োজন। তোমার ফুফু, ভাই হায়েনার মতো তেমাকে খুঁজছে। তূর্য সবটা সামলে নিচ্ছে। পরিস্থিতি ঠিক হলে সেই তোমাকে বলে দিবে, কী করতে হবে।”

নয়না কী বলবে ভেবে পেলো না। এমন সময় সদর দরজায় করাঘাতের আওয়াজে শোনা গেলো।নয়না জানে, মানুষটা কে? ভাবনা ভেবেছে নয়না দরজা খুলে দিবে কিন্তু তাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেই এগিয়ে গেলো।
তূর্যকে এতো সকালে দেখে ভাবনার কোনে ভাবান্তর হলো না। বরং সে তূর্যকে তাগাদা দিয়ে বলল,” নয়নকে নিয়ে একবার স্যারের সাথে দেখা করিয়ে আনিস তো তূর্য! আমি বেরোলাম, কিছু লাগলে নয়নাকে বলিস।”

তূর্য নয়নার পাশে এসে দাঁড়ালো। এই মুহূর্তে নয়না তূর্যকে তার কাছাকাছি আশা করেনি। সে চলে যেতে নিলে তূর্য হাত ধরে ফেলে নয়নার উদ্দেশে বলল,” যে তোমাকে আগলে রাখবে তার কাছে নিজেকে নিরপদ মনে করবে। মনে রাখো, সব পুরুষ নারী লোভী হয় না।”

” গোটা পুরুষজাতি খারাপ হওয়ার জন্য দলবদ্ধ হতে হয় না। পুরুষজাতিকে চেনার জন্য একজন পুরুষই যথেষ্ট।”

তূর্য নয়নার হাত ছেড়ে দিয়ে শান্তস্বরে বলল,” সব পরুষ যদি খারাপ হতো, তবে পৃথিবীর কোনো মেয়েই-ই বাবার রাজকন্যা হতো না। তোমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে বিশ্বাস করতে না পারো, কষ্ট দিও না।”

তূর্য মুচকি হেসে নয়নাকে এক ঝলক দেখে চলে গেলো। নয়নার কী হলো জানে না। বারবার চোখের সামনে তূর্যের আহত মুখখানা ভেসে উঠলো। নয়নার ছলছল চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি ঝড়ে পড়লো। সে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো, ” তুই তো মানুষটাকে দূরে সরিয়ে রাখতেই চাইছিলি। তাহলে কাঁদছিস কেন?”
উত্তরটা নয়নার অজানা।

————–

ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। বারান্দায় চেয়ার পেতে বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ে নয়না বাহিরে দৃষ্টিনিপাত করে আছে। তূর্য চলে যাওয়ার পর থেকেই অনুশোচনায় ভোগছে মেয়েটা। হৃদপিণ্ডের যন্ত্রণায় পুড়ছে সে। সে তো মানুষটাকে কষ্ট দিতে চায়নি কথায় কথায় কী ভুলভাল বকে ফেলেছে! নয়নার মনে পড়ে যায়, তার বিধ্বস্ত সময়কার কথা। যখন সে মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে ট্রেনের নিচে ঝাপ দিচ্ছিল তখন এই মানুষটাই তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। সেই সময় থেকে এই পর্যন্ত মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে নয়নাকে আগলে রেখেছে। নয়নার মানসিক শান্তির জন্য শত ব্যস্ততার মাঝে সময় দিয়েছে। আজ নয়না তার হৃদয়ে কষ্ট দিলো!

টেবিলের উপর মুঠোফোন পড়ে আছে। নয়নার দৃষ্টিতে অনেক্ক্ষণ যাবত সেদিকেই। তূর্যকে কল দিবে কী না! সাতপাঁচ ভেবে তূর্যের নাম্বারে কল লাগালো নয়না। একটি ফোনকলের আশায় তূর্য হয়তে অপেক্ষায় ছিল। রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ করে বলল,” এখন আসতে বলবে না,প্লিজ! আমি নিজেকে আটকাতে পারব না।”

নয়না মুচকি হেসে তূর্যের নিষেধাজ্ঞা কাজটাই করলো, ক্ষীণ স্বরে বলল,” আসুন না?”

তূর্যের ছটফটে কন্ঠ থেমে গেলো। ভেসে উঠলো একচিলতে গভীর নিঃশ্বাস! থেমে থেমে উত্তর দিলো,” দরজা খুলো।”

অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে নয়না। তূর্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে? তারমানে সে যায়নি, এতক্ষণ দরজার পাশেই ছিলো? তাড়াহুড়োয় নয়না নিজের দিকে খেয়াল করলো না। সোজা দরজার কাছে এসে খুলে দিলো।

এলোমেলো কেশ, চিন্তিত মুখ, ভরাট চোখজোড়া চাঞ্চল্য মন! এতটুকুতেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তূর্য। তার অবাধ্য মন চলে যেতে চায়নি। সে জানতো নয়না তাকে খুঁজবে। হলোও তাই! তূর্য মুচকি হেসে বলল,” কী ব্যাপার ম্যাডাম! তাবরেজ তূর্যকে কী মনে ধরেছে?”

নয়না নতমুখী হয়ে উত্তর দিলো, ” অল্পস্বল্প মনে ধরেছে, কিন্তু পুরোটা না।”

” তা পুরো মন দখল করার জন্য ডাক্তারকে কী মনোবিজ্ঞ বিদ্যা পড়া শুরু করে দিতে হবে?”

নয়নার হাসি পাচ্ছে। গম্ভীর তূর্যের থেকে ঠোঁটকাটা তূর্য বড্ড অশান্ত। নয়নাকে নাস্তানাবুদ করতে এক পা এগিয়ে। দরজা ছেড়ে দাড়িয়ে উত্তর দিলো,” আপনার মনকে শক্ত করে বেঁধে আমাকে দিয়ে দিন, তাহলেই চলবে।”

চলবে………………
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়

(লেট হলো বলে দুই পর্ব দিলাম। এবার খুশি তো? সবাই সুন্দর সুন্দর কয়েকটা মন্তব্য করে যাবেন, ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here