আশার_হাত_বাড়ায় |৮| #ইশরাত_জাহান 🦋

0
146

#আশার_হাত_বাড়ায় |৮|
#ইশরাত_জাহান
🦋
একা বাড়িতে একা থাকাটা তাও একটা মেয়ের জন্য কতটা কঠিন তা শ্রেয়া বুঝতে পারছে।ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে চারপাশে।টিনের চালে ঝিরঝির শব্দ হচ্ছে বৃষ্টির জন্য।ঠান্ডা হয়ে গেছে ঘর।টিনের ঘরগুলো একটু বৃষ্টি হলেই ঠান্ডা হয়ে যায়।জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে শ্রেয়া।বিদ্যুৎ চমকালে চোখ বন্ধ করে নেয়।কিছুটা ভয় কাজ করছে মনের ভিতর।কিন্তু ভয়টাকে জয় করছে সে বাধ্য হয়ে।একা থাকা ছাড়া উপায় নেই তার।এটাই যে এখন তার নিয়তি।

ল্যাপটপে কাজ সেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয় ফারাজ।ঠিক তখনই খটখট শব্দ হয় দরজা থেকে।দরজা খুলে ফারাজ দেখতে পেলো মিমিকে।প্রশ্ন করে,”তুমি ঘুমাওনি?”

ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে মিমি বলে,”একা ঘুমোতে ভয় করছে পাপা।বিদ্যুৎ চমকায় তো।”

“আজকে এখানে ঘুমাবে?”

মিমির সোজা উত্তর,”হ্যাঁ।”

ফারাজ দেখলো বাইরের আবহাওয়া।তারপর মিমিকে বলে,”আচ্ছা ঘুমাও।”

মিমি শুয়ে পড়ে বিছানায়।মিমির গায়ে কাঁথা দিয়ে দেয় ফারাজ।তারপর সে যেয়ে শুয়ে পড়ে সোফায়।মিমি ছোট করে বলে,”গুড নাইট পাপা।”

“সুইট ড্রিম প্রিন্সেস।”

বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে।কিন্তু শীতল আবহাওয়া রয়ে গেছে।পাতলা চাদরটা গায়ে মুড়িয়ে জানালা দিয়ে চাঁদ দেখছে শ্রেয়া।তারা নেই ওই আকাশে।শুধু মাত্র একটা চাঁদ আছে।তাও মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে।আস্তে আস্তে আবহাওয়াটা কেমন মনঃক্ষুন্ন পরিবেশ করে দিচ্ছে।কিছু হারানোর কষ্ট জাগিয়ে দিচ্ছে শ্রেয়াকে।কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলো শ্রেয়া।পানি গড়িয়ে পড়ছে এখন তার চোখ থেকে।নিজেকে নিজে বলে ওঠে,”কেনো আমাকে ভালোবাসতে পারলো না?কেনো আমাকে তার পছন্দের নারী করে তুলতে পারলো না?যখন তার পছন্দের নারী হয়ে উঠতে পারবো না জানে তাহলে কেনো করলো আমাকে বিয়ে?কেনো এভাবে ঠকে যেতে হলো আমাকে?”

শ্রেয়ার কথাগুলো ঘুরেফিরে শ্রেয়ার কানেই ভাসতে থাকে।কেউ নেই তার কথা শোনার জন্য।একটি মেয়ে কখনও তার সংসার ভাঙতে চাইবে না।বিয়ের পর টানা দেড় বছর এক ছাদের নিচে ছিলো তার স্বামীর সাথে।স্বামী মন দিতে না পারলেও সে তো স্বামী হিসেবে তাকে মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছে।স্বামী শব্দটার মান রাখতেই তো কতকিছু সহ্য করলো।কিন্তু সেই স্বামী তার ভালোবাসার তার বউ হওয়ার মূল্য দিলো না।জীবনে প্রথম পুরুষ বৈধ হয়ে এসেছিলো রনি।রনি মানুষটি খারাপ হলেও শ্রেয়ার কাছে সেই ছিলো মহান।আর এখন সেই হয়ে গেছে ঘৃণার পাত্র।

*******
রাতের বেলা ফেইসবুকে গল্প পোস্ট করছে রিমলি।সৃষ্টি বেগম ঘুমিয়ে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখালেখির কাজ করে সে।এখনও তাই করছে।এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর এই তিনমাস সে গল্প জগতে পা দিয়েছে। রিমলির প্রথম লেখাতেই সে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। এখনও তাই করছে।গল্পের সুন্দর সুন্দর কমেন্টগুলা দেখে মিটিমিটি হাসছে।পাশে সৃষ্টি বেগম ঘুমিয়ে আছে।তাই মন খুলে কিছু করতে পারছে না।রিমলির কমেন্ট পড়ার ভিতর খেয়াল করলো তার কাছে একটি ম্যাসেজ এসেছে।উপরে নোটিফিকেশন দেখা যাচ্ছে।ম্যাসেজটি ওপেন করতেই দেখতে পেলো একটি ছেলের অ্যাকাউন্ট থেকে ম্যাসেজ।ওখানে লেখা,”লেখিকা হিসেবে আপনি পারফেক্ট।অনেক সুন্দর শব্দচয়ন আপনি প্রয়োগ করতে পারেন মিস বা মিসেস লেখিকা।”

উৎসাহ পেয়ে রিমলি চলে গেলো আইডির ভিতরে।ফেসবুক থেকে দেখতে থাকলো তার প্রোফাইল।আইডি নাম ‘শিহাব হাসান’।আরো কিছু জানতে আইডির নিচে স্ক্রল করতেই দেখতে পেলো পুলিশ অফিসার।জব স্ট্যাটাস দেখেই রিমলি ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে। জোরে হাসার উপায় নেই।সৃষ্টি বেগম আছেন যে।রিমলির খুব হাসি পাচ্ছে।একজন পুলিশ অফিসার তাকে মিস বা মিসেস বানিয়ে দিলো।তারপর আপনি বলে সম্মধোন করছে।যেখানে রিমলি তার থেকে বয়সে ছোট।ম্যাসেজের কোনো রিপ্লাই না দিয়েই ডাটা অফ করে ঘুমিয়ে গেলো রিমলি।

******
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরের কাজ করছে রুবিনা রুহি আর রুমা।রনি অনেক জায়গায় সিভি জমা দিয়ে রেখেছে।এত তাড়াতাড়ি তার রেসপন্স পাবে না।তাই আরো কোম্পানিতে চেষ্টা করছে সে।হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো।পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো রুমাকে।তাই রুমাকে বলে,”যা দেখতো কে এসেছে?”

রুমা গিয়ে দরজা খুলতেই অবাক হয়ে দাড়িয়ে থাকে।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুই তিনজন পুলিশ।তাদের ভিতর একজন শিহাব।রুমাকে জিজ্ঞাসা করে,”মিস্টার রনি আছে?”

রুমা চুপ থাকে।রনি কিছু দেখতে পাচ্ছে না তাই রুমাকে প্রশ্ন করে,”কে এসেছে রুমা?”

রনির জোরে কথা বলার শব্দে শিহাব এবার ভিতরে আসে। রুমা ওখান থেকে দৌড়ে রান্নাঘরে এসে বলে,”মা মা পুলিশ এসেছে।ভাইয়াকে খুঁজছে।”

মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে রুবিনা মাথায় কাপড় দিতে দিতে বেড় হলো।পুলিশ এসে রনির সামনে দাড়ালো।রনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,”এত সকালে আপনারা আমার বাসায়?”

পকেটে হাত গুজে শিহাব বলে,”আমাদের কাজের জন্য কি সকাল বিকাল লেখা থাকে মিস্টার রনি?ক্রিমিনাল ধরতে আমাদের কারো বাসায় আসার ইনভেটিশন নেওয়া লাগে না।বিনা ইনভেটিশনে খালি পুলিশ আসে লোকেদের বাসায়।”

“তো কেনো এসেছেন?”

“হয়তো আমার কথা ভালোভাবে শোনেননি।আমি বলেছি ক্রিমিনাল ধরতে আসার কথা।”
বলেই রনির সামনে হ্যান্ডকাপ ধরে শিহাব।রনি প্রশ্ন করে,”আমার অপরাধ?”

শিহাব বলে ওঠে,”আপাতত একটাই বলি এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ার।বাকিটা পরে জানতে পারবেন।এখন চলুন আপনাকে আপ্যায়ন করতে হবে।”
বলেই রনির হাতে হ্যান্ডকাপ বেধে দেয় শিহাব।রনি নিজেকে বাঁচাতে বলে,”আপনাদের কাছে এফ আই আর আছে?”

“পুলিশ কি আমরা হুজুকে হয়েছি?সব ট্রেনিং পেয়েই না পুলিশ হতে পারি।এটুকু সেন্স আমাদেরও আছে যে কাউকে অ্যারেস্ট করতে হলে স্ট্রং এভিডেন্স বা এফ আই আর থাকা লাগে।সব ব্যাবস্থা আছে।বাকি কথা পুলিশ স্টেশনে হবে,চলুন।”

বলেই নিয়ে যেতে থাকে রনিকে।বাধা হয়ে দাড়ায় রুবিনা।বলে,”আমার ছেলে কি করেছে?ও তো কারো কোনো ক্ষতি করেনি।কেনো নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?”

শিহাব এবার রুবিনার দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনার ছেলে কি করেছে না করেছে ওটা আদালতে প্রকাশ পাবে।এখন আপনাদের হাতে সময় আছে উকিল দেখুন।আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে দিন।”

বলেই নিয়ে চলে যায় রনিকে। দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকে রুবিনা।কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না।আশেপাশে থেকে লোকজন দেখছে।পুলিশের গাড়ি আসতেই সবার উকি দেওয়া শুরু।বাড়িওয়ালা নেমে এসেছেন মাত্র।শিহাবের কাছে এসে প্রশ্ন করেন,”কি হয়েছে?ছেলেটার অপরাধ কি?”

রনিকে ধাক্কা দিয়ে অন্য পুলিশের কাছে পাঠালো শিহাব।তারপর বারিওয়ালাদের বলে,”ওনার নামে মামলা এসেছে।এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ারের জন্য ওনাকে আমরা অ্যারেস্ট করতে বাধ্য।”

বলেই চলে যায় শিহাব।বারিওয়ালা এবার রুবিনার কাছে এসে বলে,”আপনারা কি শুরু করেছেন বলুন তো?কাল বউমা গেলো আজ পুলিশ আসলো।এসব ক্রিমিনালদের আমার বাসায় জায়গা দিবো না।এক তারিখ আসলেই চলে যাবেন আপনারা।”

বলেই চলে গেলো তারা।আশপাশ থেকে লোকে ভিন্ন মন্তব্য দিয়ে যাচ্ছে।রুবিনা তার মেয়েদের দিকে তাকালো।রুহি আর রুমা আতঙ্কে আছে এগুলো দেখে।রুবিনা ভিতরে এসে বসলো।কল করলো তার আত্মীয়দের।সাহায্য চাইতে হবে এখন তাকে।

******
কম্পিউটার দোকান থেকে সিভি আর পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে বেড় হলো শ্রেয়া।রাস্তায় দাড়িয়ে আছে রিক্সা খোঁজার জন্য।ঠিক সেই সময় সেখানে হাজির হয় রনিদের এক প্রতিবেশী।শ্রেয়ার পাশে এসে জিজ্ঞাসা করে,”আরে শ্রেয়া তুমি এখানে?”

মহিলাটিকে দেখ শ্রেয়া বলে,”কাজে এসেছিলাম।”

“চাকরি পেয়েছো?”

“হ্যাঁ।”

“তা ভালোই করেছো।তোমার স্বামীকে তো আজ পুলিশে নিয়ে গেছে।”

স্তব্ধ হলো শ্রেয়া।প্রশ্ন করলো,”কেনো?”

“অতকিছু কিভাবে জানবো!যতটুকু শুনলাম পরকীয়ার জন্য।তবে আমরা তো ভেবেছিলাম তুমি করেছো।”

রাস্তার দিকে তাকিয়ে শ্রেয়া বলে,”না আণ্টি।আমি এসব কিছু জানি না।আমি তো শুধু ডিভোর্স এর জন্য চেষ্টা করেছি।”

“ওহ,আচ্ছা তাহলে যাও কাজে।”
বলেই বিদায় নিলো মহিলাটি।শ্রেয়া আকাশের দিকে তাকালো।নিজেকে নিজে বলে,”এই পৃথিবীতে জোর যার মুল্লুক তার।আমার জোর নেই মুল্লুকও নেই।কিন্তু প্রকৃতির বিচার ঠিকই হয়ে গেলো।না জানি যার জীবন আমার মতো নষ্ট করেছে তার আজ কি অবস্থা!”

বলেই জোরে নিঃশ্বাস নিলো শ্রেয়া।ঠিক তখনই একটি রিক্সা এসে বলে,”কই যাবেন আপা?”

শ্রেয়া জায়গার নাম বলতেই লোকটি রাজি হলো।ভাড়া ঠিক করে রিক্সায় উঠলো শ্রেয়া।কিছুটা শান্তি লাগছে তার মনে।কেউ তার হয়ে অন্যায়ের বিচার করছে।হয়তো এই শাস্তির কারণ ভিন্ন কিন্তু শাস্তি তো পাবে রনি।

অফিসে এসে নিজের কাগজপত্র জমা দিলো শ্রেয়া।তারপর এসে বসলো নিজের কেবিনে।ল্যাপটপে খুঁটিনাটি দেখতে থাকে।শ্রেয়ার কাজের মাঝেই ফারাজ এসেছে।সবাই ফারাজকে দেখে দাড়িয়ে বলে,”গুড মর্নিং স্যার।”
ফারাজ ওদের হাত দেখিয়ে বসতে বলে নিজের কেবিনের দিকে চলে যায়।শ্রেয়ার কেবিন ক্রস করতে যাবে ওমনি শ্রেয়া ফারাজের সামনে এসে বলে,”গুড মর্নিং স্যার।”

ফারাজ শ্রেয়াকে উত্তরে বলে,”গুড মর্নিং মিসেস শ্রেয়া।”
বলেই চলে যায় নিজের কেবিনে।কেবিনে ঢুকেই ল্যাপটপে কাজ করতে থাকে ফারাজ।শ্রেয়া এসে বসে তার চেয়ারে।কিছুক্ষণ কাজ করতেই শ্রেয়ার কেবিনে আসে লিজা।শ্রেয়া একটু ঘাবড়ে যায়।লিজা হালকা হেসে বলে,”আসতে পারি?”

শ্রেয়া কনফিউশনের সাথে বলে,”হ্যাঁ,আসো।”

লিজা দুই কাপ কফি নিয়ে এসেছে।এক কাপ শ্রেয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”নেও ভালো লাগবে তোমার।অনেকক্ষণ তো ফাইল চেক করলে।”

লিজার থেকে কফি নিয়ে শ্রেয়া বলে,”থ্যাংক ইউ।”

লিজা বলে ওঠে,”এক্সুয়ালি কালকে তোমার সাথে অনেক বাজে ব্যাবহার করা হয়েছে।এর জন্য আই এম সরি।ওটা অনেক এক্সপেন্সিভ ছিলো আর রিচ ফ্যামিলি থেকে ব্রাইডাল ড্রেসটি হায়ার করা হয়েছে।এই জন্য ঘাবড়ে যাই আমি। অনেস্টলি বলতে কোম্পানির লসের কথা মাথায় আসে তখন।”

লিজার ভালো ব্যাবহার দেখে শ্রেয়া নিজেও খুশি হয়।বলে,”ব্যাপার না।ওটা পরিস্থিতির চাপে হয়ে যায়।ভুল আমারই বেশি ছিলো।এবার থেকে বুঝে শুনে চলবো।”

লিজা তার হাত বাড়িয়ে বলে,”তাহলে আজ থেকে আমরা ফ্রেন্ড?”

শ্রেয়া হেসে দেয়।লিজার সাথে হাত মিলিয়ে বলে,”ওকে ফ্রেন্ড।”

নিজের কেবিন থেকে দেখলো ফারাজ।একটু চিন্তামুক্ত হলো সে।এনিকে বলেছিলো লিজার সাথে কথা বলে বুঝিয়ে দিতে। ফারাজকে সবাই ভয় পায়।তাই যতটুকু দরকার এনি সবার সাথে ফ্রেন্ডলি কথা বলে সলভড করে।এই যে লিজা আর ইভাকেও বুঝিয়ে বলল।ইভা এখন ব্যাস্ত তাই লিজা নিজের মতো সময় দেখে এসেছে।

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here