তোমাকে_চাই_নিরবধি #পর্বঃ২ লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

0
171

#তোমাকে_চাই_নিরবধি

#পর্বঃ২

লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

“জমিদার বাড়ির পুত্রবধূ হয়ে তুমি জমিদার পুত্র’কে অসম্মান করলে,বালিকা! উচ্চ শিক্ষিত জমিদার বাড়ির কন্যা হয়েও তুমি অসম্মান করলে তোমার সদ্য বিবাহিত স্বামীকে! তুমি অপমানিত করলে ভাত’কে।
খুউব খারাপ কাজ করলে তুমি বালিকা, খুব দুঃসাহস দেখিয়ে ফেললে। এর শাস্তি’তো তোমায় পেতেই হবে! আজ থেকে তোমার খাবার বন্ধ,কক্ষ থেকে বেরানোও নিষেধ। এটা তোমার স্বামী’র হুকুম! আমিও দেখবো, কতদিন তোমার এই তেজ থাকে।”

শক্ত হাতে নববধূ’র গলা চেপে ধরে দারুণ ক্রো’ধ নিয়ে কথাগুলো, বললো জমিদার পুত্র ফারহান মল্লিক। যা শুনে কেঁপে উঠলো ষোড়শী কন্যা, কুহেলিকা। তার ফারহান ভাই’কে কখনো এতোটা ক্রোধিত হতে দেখেনি সে। এতক্ষণের সবটুকু সাহসিকতা হারিয়ে গেলো,অবলীলায়।

গলায় প্রচন্ড ব্যথা পেয়ে কান্নার গতি বাড়লো, কুহেলিকা’র। গলা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। ছাড়লো না, ফারহান। একটু থেমে পুনরায় আবারো বললো,

“শোনো, মেয়ে! তোমার এই রুপে সবাই দিওয়ানা হলেও, জমিদার পুত্র ফারহান মল্লিক’কের নিকট তুমি বড়ই নগন্য!
তোমার প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমার সাথে এতো ভাব নেওয়ার কিছুই নেই, বুঝলে বালিকা! এই বিয়েটা কেন হয়েছে, সেটা তুমি ভালো করেই জানো। ইভেন শুনে রাখো, তোমাকে আমি দুইবছরের চুক্তিতে বিবাহ করেছি। এই দু’বছর তুমি আমার সকল কথা শুনতে বাধ্য। আমার কাজ হয়ে গেলে, তবেই তুমি মুক্তি পাবে।”

নিজের মুখোবাক্য শেষ করে পাষাণ পুরুষটি পালঙ্কে’র উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলো, মেয়েটাকে। শক্ত কাঠের পালঙ্কে’র কোণায় মাথা লেগে, খানিকটা কপাল কেটে গেলো কুহেলিকা’র। মুহূর্তেই কপাল বেয়ে গ’ল’গ’ল করে তরল র’ক্ত বেড়িয়ে ভিজিয়ে দিলো ষোড়শী’র চওড়া ললাট খানা। যন্ত্রণায়

ও “মাগো, ম’রে গেলাম! ম’রে গেলাম!

বলে কঁকিয়ে উঠলো কুহেলিকা। সে-সব শুনেও শুনলো না, ফারহান। নিজের ঝোল মাখানো কাপড় চেঞ্জ করে সাদা রঙের পাঞ্জাবি সুঠাম দেহ চা’পা’লো। পালঙ্কের উপরে ভাজ করা শুভ্র রাঙা চাদর খানা কাঁধে জড়িয়ে, আয়েশি ভঙ্গিতে আয়নার সামনে দাঁড়ালো সে। লম্বা চুলগুলোতে একবার চিরুনী করে, চোখে সুরমা, দেহে সুগন্ধী মাখলো। লম্বা সূচালো গোঁফটা একটুখানি বাঁকিয়ে নিজেকে আবারো একবার আয়নায় পর্যবেক্ষণ করলো। নিজেকে পরিপাটি করে এখানে আর একমুহূর্ত সময়ও ব্যয় করলো না, ফারহান মল্লিক। পালঙ্কের উপর বসে আর্তনাদ করা নববধূর দিকে একবার তাকালো না, অবধি। বড়বড় কদম ফেলে দাম্ভিকতা বজায় রেখে কক্ষ থেকে বেরোলো।

নবদম্পতি’র এতক্ষণে’র চিৎকার চেচামেচি শুনে দরজায় ভির করলো, ফারহানের দুই মা। বোন কিরণমালা। কুহেলিকা’র মা, রেণু, ছোট বোন বিন্দু, ছোটভাই তরিকুল।
এরিমধ্যে দোড়ে পুত্র’কে দেখে জমিদারের ছোট গিন্নি অর্থাৎ ফারহানে’র মা আয়শা খাতুন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“ভিতরে কি হয়েছে, ফারহান? কুহু কাঁদছে কেনো? তুই বা এতো রেগে আছিস কেন? কি হয়েছে, আব্বা।”

ফারহান জবাব দিলো না। কাঠের শক্ত দরজা খানা সশব্দে বন্ধ করে বড় একখানা বড় তালা ঝুলিয়ে চাবিটা নিজের পাঞ্জাবি’র পকেটে রাখতে রাখতে গুরুগম্ভীর কন্ঠে শুধালো,

“এই দরজার তালা খোলার মতো দুঃসাহস কেউ করবেন না! কুহেলিকা’র আশেপাশেও যেন আপনাদের কাউকে না দেখি আমি।”

ছেলের কথা শুনে, কপালে ভাজ পড়লো আয়শা খাতুনের। বাকিরাও চিন্তিত হলো, কি হয়েছে দু’জনার মাঝে? ছেলেটা রেগে আছে, মেয়েটা ভিতরে বসে কাঁদছে।
এর কারণ, তাদের বোধগম্য হলো না। পাশ থেকে বড় মা সালাম বেগম ছেলেকে আদুরে কণ্ঠে বললো,

“আব্বা! শান্ত হন আপনি। আম্মার উপর রাগ দেখাবেন, বাচ্চা মেয়ে একটা!”

“বড় আম্মা! আমি ঠিক আছি, কুহেলিকাও ঠিক আছে। দয়াকরে,আপনারা এখান থেকে চলে যান!”

আর একমুহূর্তেও এখানে দাঁড়ালো না, ফারহান। দাদাজানে’র বলা কার্যের উদ্দিশ্যে বেরিয়ে পড়লো, মহল থেকে।

বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান মহিলা,রেণু বেগম। যেহেতু, ফারহান এড়িয়ে যাচ্ছে তার মানে ব্যাপারটা তাদের ব্যক্তিগত, পার্সোনাল! স্বামী-স্ত্রী’র পার্সোনাল বিষয়ে না ঘাঁটাই ভালো। তার কন্যার বেয়াদবিপনা, দূরন্ত সাহসিকতা সম্পর্কেও তিনি অবগত। কন্যার দারুণ সাহসিকতা ভবিষ্যৎ বিপদের আভাস! যা পেয়েছে, রেণু।
নিজ কন্যার ভবিষ্যতে’র চিন্তা করে, সুযোগ বুঝে শ্বশুরের সাথে পরমর্শ করে ভাসুরে’র ভরসা যোগ্য ছোট পুত্রের হাতে আজ তার বড় কন্যা’কে তুলে দিলো। এই ভরসা যোগ্য পুরুষ’টি তার আদরের কন্যা’কে ভালো রাখবে, এ বিশ্বাস তার আছে। তবুও অজানা ভয়ে মায়ের বুক কেঁপে উঠে। সে কোনো ভুল করলো না তো…!

এসব ভেবে গোপনে চা’পা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো, রেণু। ততক্ষণাৎ উনি সবাই’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

“স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যকার ঝামেলায় আমাদের না জড়ানোই ভালো। তাদের ঝামেলা তারাই মিটিয়ে নিবে! বড় ভাবি, ছোট ভাবি উদ্বিগ্ন হবেন না। চলুন, রসুইঘরে (রান্না ঘর) যাই। রাতের খাবারের আমেজ করতে হবে, দেরী হলে শ্বাশুড়ি আম্মাজান রাগবেন। রাত অনেকটাই হয়েছে, উনারাও চলে আসবেন এখন।”

বাকিরাও আর কথা বাড়ালো না। বাড়ির মহিলারা রসুইঘরে গেলো। বাড়ির পুত্র-কন্যারা পাঠ্য পুস্তক নিয়ে যে যার ঘরে, পড়তে বসলো। রেণু বেগমের কড়া আদেশ,এখান থেকে উঠা যাবে না।
.
.
জমিদার বাড়ির বিশাল কারুকার্য গেইটের সামনে জমিদারের এক বিশ্বস্ত কর্মচারী “আলতাফ” ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে জমিদার পুত্রের আগমনের অপেক্ষা করছেন। এরিমধ্যে ফারহান মল্লিক’কে দেখে আলতাফ মাথা নিচু করে বলললো,

“সালাম, জমিদার পুত্র!”

ফারহান মল্লিক গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো। ততক্ষণাৎ ঘোড়ার গাড়ি’তে উঠে পায়ের উপর পা রেখে নবাবী ভঙ্গিতে বসলো। এরিমধ্যে কোথা থেকে ফারহানের ছোট ফুপুর ছেলে, সীমান্ত আসলো। শ্যাম সুন্দর গড়নের লম্বা চওড়া, দূরন্ত এক যুবক। মামা বাড়িতে থাকে সে। মাঝে মাঝে মামাদের জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করে থাকে। বাড়ির সকলে তাকে খুবই স্নেহ করে। ফারহান’কে এই সময় পাহারাদার ছাড়াই গাড়ি’তে দেখে সে বিনয়ী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“দাদাভাই! আপনি গাড়িতে চড়ে এই রাতের বেলায় কোথায় যাচ্ছেন?”

“এই রাতে বেলায়ই দাদাজান কার্য চাপালো, দক্ষিণ পাড়া গ্রামে যাচ্ছি।”

“একা যাচ্ছেন, আপনি?”

“সঙ্গে কাউকে কখনো নিয়েছি, আমি?”

ফারহানের উল্টো প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলো, সীমান্ত। জমিদারের ছোট পুত্র কখনো সবার মতো পাহারাদার সাথে রাখে না। এতে জমিদারের ঘোর আপত্তি থাকা সত্যেও ছোট পুত্র একাই চলাফেরা করে। যদিও কখনো তার কোনো বিপদ হয়নি। দক্ষিণ পাড়া গ্রাম ভালো না। আজকাল এলাকায় ডাকাতের উৎপত্তি ঘটেছে। জমিদারদের অহরহ গোপন শত্রু রয়েছে।
এই রাতের বেলা তাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। তাই সীমান্ত মিনমিন করে আবারো বললো,

“আমিও আপনার সাথে যাবো, দাদাভাই।”

তার সাবধানতা রক্ষার্থে ছেলেটার এহেন কার্য পছন্দ হলো বেশ। খানিকটা হাসলো, ফারহান। বললো,

“গাড়ি উঠে পড়। বোস পাশে।”

সীমান্ত অনুমতি পেয়ে ততক্ষণাৎ উঠে, বসলো। ফারহানের অনুমতি পেয়ে আলতাফ ঘোড়া’র পিঠে চাবুক মে’রে গাড়ি চালানো শুরু করলো।
_____________

বর্তমান জমিদার শাহজালালে’র ছোট ভাই জাবেদ। তারই বড় কন্যা, কুহেলিকা কুহু। হঠাৎ করে দাদাজান আকবরে’র ইচ্ছেতে আজই ঘরোয়া ভাবে খুব সাদামাটা ভাবে বিয়ে হয়ে যায়, ফারহানা ও কুহেলিকা’র। লোক জানাজানি করে পরে ধুমধাম করে আবারও বিয়ে হবে তাদের।
হঠাৎ এই বিয়েতে কুহেলিকা’র ঘোর আপত্তি থাকা সত্যেও দাদাজান আর আম্মাজানের ভয়ে টু-শব্দটি ও করতে পারিনি। এই বিয়েতে জাবেদ মল্লিকে’র ও বেশ আপওি। উনি বড় মেয়ের জামাই হিসেবে কখনো ফারহান’কে চাননি। দাম্ভিক ফারহান’কে তার কোনো কালেই পছন্দ না। তবুও পিতা আকবরের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস হয়নি।

বাড়ি কর্তা আকবরের সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। তার সিদ্ধান্তের ওপর স্বয়ং জমিদারও কথা বলার সাহস দেখান না। উনি বাবা’কে বেশ মান্য করে। তার পিতার সিদ্ধান্ত সবসময়ই সঠিক হয়। তিনি এ-ও জানে, তার পিতা সবসময় তাদের ভালোর জন্যই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়। উনি যখন হুট করে এই বিয়ের ইচ্ছে পোষণ করেছে তার মানে এর পিছনে অবশ্যই কোনো কারণ রয়েছে।

এদের ইচ্ছে অনিচ্ছার মধ্য দিয়েই অবশেষে আজ বিকেলে তাদের বিয়েটা হয়ে গেলো। বিয়ে হতে না হতেই মায়ের কড়া আদেশ, আজ থেকে তাকে থাকতে হবে ফারহানে’র কক্ষে। অগত্যা সন্ধ্যায় কাঁদতে কাঁদতে এই রুমে এসেছিলো সে। বিয়ে হতে না হতেই আজই তার গায়ে হাত তুললো তার, ফারহান ভাই।
.
.
রাত নয়টা। কক্ষের এক কোণে মেঝেতে বিপর্যস্ত অবস্থায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে কুহেলিকা। এতক্ষণ কাঁদতে কাঁদতে কান্না’রা হারিয়ে গিয়েছে, চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কপালে সদ্য স্বামীর দেওয়া আঘাতের চিহ্নে র’ক্ত জমাট বেঁধে সেটাও শুকিয়ে গিয়েছে। এতো কিছুর পরও হাঁটুতে মুখ গুঁজে প্রাণপ্রিয় মানুষটির কথা কল্পনা করছে, কুহেলিকা। এমন সময় কক্ষের জানালায় ঠকঠক আওয়াজ করলো কেউ। পরপর সেখান থেকে একটি মেয়েলী কণ্ঠ স্বরে ভেসে আসলো,

“সখি! ও সখি!”

হঠাৎ করে প্রাণ প্রিয় সখি “বীণা’র” কণ্ঠ স্বর শুনে তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে তাকালো মেয়েটা। ভাঙা কণ্ঠে শুধালো,

“সখি! তুই এসেছিস?”

“হ্যাঁ’রে। জানালার কপাট খোল সখি,দেখ তোর জন্য কি নিয়ে এসেছি।”

কুহেলিকা ততক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো। ভিতর থেকে কাঠের জানালা’র কপাট খুলে সখি’কে দেখে দুঃখী মুখ করে বললো,

“সখি গো! আমার স’র্ব’না’শ ঘটেছে, মাহাদ ভাইয়ের অনুপস্থিতে জমিদারের ছোট পুত্রের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে’রে।”

কিরণমালা আর বিন্দু’র থেকে সে খবর শুনেছে বীণা। হারিকেনের লালচে আলোয় প্রিয় সখির ফোলা ফোলা চোখ, বিপর্যস্ত মুখ, কপালে র’ক্ত দেখে আ’ত’ঙ্কে উঠলো সে। সখির জন্য কুড়িয়ে আনা বনফুল, বন্যফল গুলো আঁচল থেকে পড়ে গেলো। চাপা কণ্ঠে শুধালো,

“আহারে! চাঁদের ন্যায় রূপসী কন্যার একি হাল!”

জমিদার বাড়ির সবচেয়ে রূপসী কন্যা,কুহেলিকা।
যার জন্য পাগল কতশত যুবক। এই রুপে দিওয়ানা স্বয়ং জমিদার বাড়ির বড় পুত্র, মাহাদ মল্লিক। গোপনে দু’জনের মাঝে প্রণয়ের সম্পর্কও ঘটেছে। এ খবর আর কেউ না জানলেও বীণা জানে। দুই সখির মাঝে বড় ভাব।
বানিজ্যিক কাজে শহরে গিয়েছে, মাহাদ। আহারে! ছেলেটা জানেই না, তার প্রাণ প্রিয় প্রণয়ীনি আজ তার ছোট ভাইয়ের ঘরণী। ভীষণ আফসোস হলো বীণা’র! সখির জন্য মনও পু’ড়’ছে!

চলবে…….

[সবাই পেজে রেসপন্স করবেন। কেমন লাগছে গল্প? ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here