#তোমাকে_চাই_নিরবধি
#পর্বঃ৩
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
জমিদার বাড়ির কর্তা’রা রাজকার্য শেষে, ইতোমধ্যে মহলে ফিরেছেন। এক্ষুণি তারা ভোজন কক্ষে আসবেন। বাড়ির গিন্নি’রা ও ভৃত্য’রা (কাজের লোক) মিলে টেবিলে খাবারের বিশাল আমেজ করছে। বাচ্চারা নিজেদের কক্ষে।
এরিমধ্যে জমিদার পিতা আকবর, জমিদার শাহজালাল, জাবেদ মল্লিক এসে নিজেদের নিদিষ্ট আরাম কেদারায় বসলেন। জমিদারদের আগমনে বাড়ির ভৃত্য’রা ওখান থেকে দ্রুত সরে গেলেন। গিন্নি’রা পাশে দাঁড়িয়ে খাবার পরিচালনা করছে। জমিদার বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে বাড়ির কর্তারা খাবেন।
দ্বিতীয় ধাপে বাড়ির ছেলে-মেয়েরা, তৃতীয় ধাপে, বাড়ির গিন্নি’রা বসবেন, সবশেষে মহলের দাস-দাসী ও কর্মচারী’রা খাবেন। এই নিয়মে চলে আসছে যুগযুগ ধরে। এই নিয়মের কোনো হেরফের নেই।
জমিদার পিতা খাবার সামনে নিয়ে ঝিমাচ্ছে, গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবছে। পিতা’কে পর্যবেক্ষণ করে জমিদার শাহজালাল বিনয়ী কণ্ঠে শুধালো,
“আব্বাজান! আপনি কোনো-কিছু নিয়ে চিন্তিত? কিছু কি হইয়াছে আপনার? শরীর খানা ঠিক আছে?”
বড় পুত্রের কথায় ঘোর কাটলো, পিতা আকবরে’র। ততক্ষণাৎ উনি রসভারী কন্ঠে বললো,
“বড় পুত্র আমি বড়ই চিন্তিত। ফারহান দাদাভাই’কে দক্ষিণ পাড়া গ্রামে পাঠাইয়াছি, এতো রাত্রি হইয়াছে তবুও সে আসছে না যে? কত ঘন্টা চলে গেলো অথচ এখন অবধি সে গ্রামের খোঁজ আমি পেলাম না। ”
বাবাকে আশ্বাস দিয়ে পুত্র শাহজালাল বললো,
“আপনি চিন্তা করিবেন না, আব্বাজান! সে সময় মতো সহিসালামতে পৌঁছে যাবে। পাশের গ্রামে বিশাল যাত্রাপালা’র আয়োজন করিয়াছে গ্রামবাসী, হয়তো সেখানেই আছেন, ফারহান। গ্রাম থেকে আমাদের ও নিমন্ত্রণ আসিয়াছে, কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ও জাবেদ সেখানে পৌঁছে যাবো।”
এ বিষয়ে আর কেউ কিচ্ছুটি বললো না । নিজেদের খাওয়াতে মনোযোগী হলো। এরিমধ্যে জাবেদ চারপাশে একবার পর্যবেক্ষণ করে দেখলো, তার আম্মাজান আজ ভোজন কক্ষে উপস্থিত হয়নি। প্রায় প্রতি বেলাই খাবারে সময় জমিদার মাতা আরাম কেদারায় বসে, গিন্নীদের তদারকি করে। স্বামী, পুত্রদের কার কি প্রয়োজন খেয়াল রাখে। আজ মাতাজানকে এখানে না পেয়ে জাবেদ মল্লিক গিন্নি’দের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো,
“আম্মাজান কোথায়? তাকে দেখছি না যে।”
পাশ থেকে রেণু বেগম নিচু কণ্ঠে শুধালো,
আম্মাজানে’র শরীর’টা একটু খারাপ লাগছে, তাই আসেনি এখানে। উনি নিজের কক্ষে বিশ্রাম করছে।”
“সে-কি! আম্মাজান অসুস্থ এটা তুৃমি আমাদের আগে বলবে না। কবিরাজ ডেকেছো? বেশি অসুস্থ, আম্মাজান?”
বলতে বলতে উওেজিত হয়ে খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, জাবেদ মল্লিক। পিতা আকবর তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“ছোট পুত্র! শান্ত হও, খাওয়া শেষ করো।
তোমার আম্মাজান ঠিক আছে, সামান্য হাঁটুতে ব্যথা। কবিরাজ’কে খবর পাঠানো হইয়াছে, আগামীকাল কবিরাজ এসে দেখে যাবেন তাকে।”
জাবেদ মল্লিক শান্ত হলো। প্রত্যুওর না করে, পুনরায় বসে পড়লো।
হঠাৎ করেই জমিদার বাড়ির গেইটে’র সামনে বিরাট শো’র’গো’ল শোনা গেলো। এরিমধ্যে জমিদার বাড়ির ভৃত্য বাসন্তী বানু, দৌড়ে এসে ভোজন কক্ষে’র মেজেতে বসে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিলাপ করে বললেন,
“আল্লাহ গো! কি স’র্ব’না’শ হইয়া গেলো’রে আমার। ও জমিদার হুজুর, কারা জানি আমার সোয়ামি’রে খু’ন করিয়াছে গো! হায় আল্লাহ গো! এখন আমার কি হবে গো!”
উপস্থিত সবাই দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, বাসন্তী বানু’র দিকে। মাঝ বয়সী, মোটাতাজা মহিলা বাসন্তী। স্বামী মৃ’ত্যু খবর শুনে মেঝেতে বসে, বিলাপ করে কাঁদছে। ততক্ষণাৎ তার দিকে এগিয়ে গেলো, জমিদারের বড় গিন্নি। কাঁধে হাত রেখে বললো,
“তুমি কি বলছো, বাসন্তী? আলতাফ আর বাঁইচা নাই!”
তান্মধ্যে, জমিদার বাড়ির এক কর্মচারী হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এসে মাথা নিচু করে বললো,
“ক্ষমা করবেন, জমিদার হুজুর! অনুমতি ব্যতিতোই আপনাদের ভোজন কক্ষে প্রবেশ করিয়াছি। জরুরী তলব নিয়া আসিয়াছি, হুজুর!”
জমিদার মশাই গুরুগম্ভীর কন্ঠে শুধালো, “কি তলব নিয়া আসিয়াছো, জাফর? নির্ভয়ে বলো।”
“হুজুর! কর্মচারী, আলতাফ আর বাঁ’ই’চা নাই। কারা জানি মা’ই’রা নদীর পাড়ে, ফালাইয়া রাখছে।”
উওেজিত হয়ে, উঠে দাঁড়ালো, জমিদার শাহজালাল। জমিদারের সব চেয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারী, আলতাফ। বাসন্তী’র স্বামী, আলতাফ। এভাবে স্বামী’র মৃ’ত্যু’র খবর শুনে কান্নার গতি বাড়লো, বাসন্তী’র।
চিন্তিত হলো, জমিদার শাহজালাল সহ সকলে। জমিদার বাড়ির কর্মচারী’কে হ’ত্যা করছে, কার এতো বড় সাহস? কি হচ্ছে এসব?
জমিদার বাড়ির একের পর এক বিশ্বস্ত কর্মচারী’র মৃ’ত্যু ঘটেছে। কিছুদিন আগেও দু’জন ম’রে’ছে। তারা অবশ্য খু’ন হয়নি। সেসব আগে স্বাভাবিক মৃত্যু মনে হলেও এবার বিষয় খানা জটিল মনে হচ্ছে, জমিদার শাহজালালের কাছে। তবে কি তাদের কোনো গোপন শত্রু রয়েছে? কে সেই শত্রু? উওর মিললো না!
রাতের খাবার আর খাওয়া হলো না তাদের। খাবার রেখেই দ্রুত মহল থেকে বেরিয়ে পড়লো, জমিদার শাহজালাল, জাবেদ মল্লিক, পিতা আকবর।
ইতোমধ্যে মহলের সবার নিকট ছড়িয়ে পড়েছে, খবর খানা। জমিদার বাড়ির কর্মচারী আলতাফ খু’ ন হয়েছে। কুহেলিকাও বদ্ধ কক্ষে বসে শুনেছে, সে খবর। আলতাফ চাচা’র জন্য দুঃখ হলো তার। আহারে আলতাফ চাচা! বড় ভালো মানুষ ছিলো। তাকে, আবার কে মা’র’লো?
___________
গভীর রাত। জমিদার মহল এখন নি’স্ত’ব্ধ! মহলে বাড়ির গিন্নি’রা ও বাচ্চারা ছাড়া কেউ নেই।
উনারাও সবাই যে যার শয়ন কক্ষে। মহলে’র ভৃত্য’রা ও নিজেদের নিদিষ্ট কক্ষে। জমিদার বাড়ির পুরুষেরা এখনো ফেরেনি, মহলে। এই সুযোগে জমিদার কন্যা কিরণমালা চুপিচুপি রসুই ঘরে প্রবেশ করলো। সাবধানতা অবলম্বন করে, পাএ থেকে বীণা’র জন্য প্লেটে ভাত তরকারি তুলছে।
বীণাকে নিজের কক্ষে লুকিয়ে রেখে দিয়েছে, কিরণমালা। তখন সখীর সাথে দেখা করে, আহত মন নিয়ে ফিরতে চেয়েছিল সে। কিন্তু, এই রাতে আর তাকে যেতে দেয়নি কিরণমালা।
বীণা কিরণমালা ও কুহেলিকা’র পাঠশালার সখি। এরা তিনজনই সমবয়সী। বীণা ওপাড়ে’র মাঝির মেয়ে। সে জমিদার বাড়ির কন্যাদের প্রাণ প্রিয় সখী হলেও, সচারাচর জমিদার মহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
বীণা প্রিয় সখী’র টানে আজ রাতে’র অন্ধকারে জমিদার বাড়ি এসেছে, সখির সাথে দেখা করতে। খুউব গোপনে পাহারাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছে মহলে। জমিদার মাতা যদি শুনে এ খবর, তুলকালাম ঘটিয়ে ফেলবে। কারণ, ওরা ছোট জাত। জমিদার মহলে তো আর যাকে তাকে প্রবেশ করানো যায় না!
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেট ভর্তি ভাত তরকারি নিয়ে সাবধানি পায়ে কক্ষে প্রবেশ করলো, কিরণমালা। ততক্ষণাৎ ভিতর থেকে দোর লাগিয়ে পালঙ্কে’র উপরে প্লেট খানা রাখলো। বীণা’কে বললো,
“তোর জন্য খাবার এনেছি, সখি। নে, ভাত খেয়ে নে। ”
বিনা পালঙ্কে’র এক কোণায় বসে মন খারাপ করে বললো,
“আমি খাবো না’রে। কুহেলিকা সখিও তো কিছু খায়নি। জমিদারের ছোট পুত্র বড় খারাপ লোক, উনি সখিকে আজ মে’রে’ছে।”
কিরণমালা সখির মুখ চেপে ধরে আতঙ্কিত স্বরে বললো,
“চুপ কর সখি, চুপ কর। কেউ শুনে ফেলবে। ছোট দাদাভাই এ কথা জানতে পারলে, তোকে মে’রে’ই ফেলবে।”
চুপ করলো না , বীণা। হঠাৎ করে খাবার প্লেট নিয়ে উঠে, দাঁড়ালো। তার সাথে কিরণমালা ও আসলো। আবারো চুপিচুপি সখির ঘরের জানালার কাছে গিয়ে মৃদু আওয়াজ করলো বীণা,
“সখি! ও সখি!”
কুহেলিকা জেগেই ছিলো। সখির কণ্ঠ স্বর শুনে দ্রুত পালঙ্ক থেকে উঠে, জানালার কাছে আসলো। ভীত কণ্ঠে বললো,
“তুই আবার এসেছিস, সখি। কেউ দেখে ফেললে কে’লে’ঙ্কা’রি ঘটাবে। ”
“তোর জন্য খাবার নিয়ে, এসেছি। জানালার ফাঁক দিয়ে, হাত ভরে খেয়ে নে। আমি প্লেট ধরে রাখছি।”
“না সখি না। আমি খাবো না। ফারহান ভাই জানতে পারলে, আমায় আবার মা’র’বে।
তুই এখান থেকে দ্রুত চলে যা, সখি। তুই এতো বড় সাহস করেছিস, জানতে পারলে তোকেও মে’রে ফেলবে উনি। উনি খুউব খারাপ লোক’রে সখি,খুব খারাপ!”
বলতে বলতে আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো, কুহেলিকা। ভয়ে সখির মুখের উপর জানালা আঁটকে দিলো। কিরণমালা ও ডেকেছে, বোনকে। দু’জন অনেক বার বলেছে,
“কপাট খোল কুহেলিকা। ভয় পাস না, কেউ দেখবে না। একটুখানি খেয়ে নে। ”
কিন্তু, কুহেলিকা খুললো না। আর সাড়াও দিলো না।
অগত্যা মন খারাপ করে চলে গেলো, বীণা ও কিরণমালা।
.
.
কিছুক্ষণের মধ্যে, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছে কুহেলিকা। এমন সময় দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করলো, ফারহান। কক্ষে খুটখুট শব্দে, ঘুম ছুটে গেল কুহেলিকার। চোখ মেলতেই, হারিকেনে’র আলোয় ভ’য়ংক’র রুপে ফারহান’কে দেখে ভয়ে কলিজা নড়বড়ে গেলো বোধহয়! মুখ থেকে তার শব্দ’রা হারিয়ে গিয়েছে, নিশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছে।
চোখের সামনে থাকা, ফারহান ভাই’কে মনে হচ্ছে এক দা’ন’ব!
মানুষটার সাদা পাঞ্জাবি’তে ছোপ ছোপ তাজা র’ক্তে’র দাগ। হাতে র’ক্ত’মা’খা ধারালো ত’র’বা’রী। ফর্সা মুখানায় লালচে আভা, চোখ দু’টো রক্তিম হয়ে আছে। না আর সহ্য করতে পারলো না, কুহেলিকা। উওেজিত হয়ে, শোয়া থেকে বসলো। এর আগে এহেন দৃশ্য আর কখনো দেখেনি সে। ততক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে জড়ানো কণ্ঠে শুধালো,
“ফারহান ভাই! আপনি, আপনি তাহলে আলতাফ চাচা’কে খু ন করেছেন। আপনি এতো খারাপ, ফারহান ভাই। আপনি মানুষ খু ন করেন। আপনাকে আমার বড় ভয় লাগে!”
বলতে বলতে ঢলে পড়লো, মেয়েটা। জ্ঞান হারিয়েছে। ফারহান হাতের ত’র’বা’রী’টা মেজেতে ফেলে দ্রুত নিজ বাহুবন্ধনে আগলে নিলো, অর্ধাঙ্গিনী’কে। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। কি বললো, কুহেলিকা?আলতাফ চাচা খু ন হয়েছে? কে মা র লো তাকে?
আপাতত এসব আর ঘাটলো না, ফারহান মল্লিক। বুকের মাঝে আগলে রাখা, ভয়ার্ত স্ত্রী’র মলিন মুখখানা পর্যবেক্ষণ করে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। পরমুহূর্তে কুহেলিকা’র শুকনো মুখখানায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“তুমি বড় অবুঝ, বালিকা! কবে বড় হবে তুমি? কবে বুঝবে সব?”
চলবে…..
[সবাই পেজে রেসপন্স। কেমন লাগছে গল্প? এই পর্বে আজ ১০০০ রিয়েক্ট হলে নেক্সট পর্ব রাতেই দিবো। #পর্বঃ২ যারা পড়েননি, পড়ে ফেলুন। #পর্বঃ২ এর লিংক কমেন্ট বক্সে পাবেন।]