#তোমাকে_চাই_নিরবধি (৯)
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
Story Link-গল্পের লিংক (রিভিউ+আলোচনা)💓
স্নিগ্ধ একটি ভোর। বিশাল তিনতলা বিশিষ্ট জমিদার বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে পুষ্প ভরা একটি বাগান। বাগানে ফুটেছে নাম জানা-অজানা বাহারি ফুল। ফুলের গন্ধে চারপাশ জুড়ে মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ইতোমধ্যে। বাগানের মাটিতে দুর্বা ঘাস। ঘাসের উপর হালকা শিশির বিন্দু, সাথে রয়েছে মৃদু মৃদু ভোরে হাওয়া। সবমিলিয়ে জায়গাটা চমৎকার! খালি পায়ে সেখানে ধীরগতিতে প্রবেশ করলো জমিদারের বড় গিন্নি, সালমা বেগম। উনি প্রতিদিন ভোরে এখানে আসেন, হাঁটাচলা করেন। মাঝেমধ্যে দূরন্ত বালিকার ন্যায় ঝড়ে যাওয়া বেলি ফুল কিংবা শিউলী, বকুল ফুল গুলো আঁচলে পেতে কুড়িয়ে নেয়। মধ্য বয়স্ক শ্যামময়ী নারীটি এখনো বড়ো শৌখিন। ফুল সে এখনো ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু আজ তার মধ্যে পূর্বের সেসব আনন্দ কিংবা উচ্ছাস নেই। কপালে তার সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ। অস্থির চিত্তে বাগানের আনাচ-কানাচে বারবার পায়চারী করছে সে। শহর থেকে উনি খানিকক্ষণ আগে টেলিফোন পেয়েছে, তার পুত্র মাহাদ আসছে বাড়িতে।
গতকাল রাতেই না-কি তার আসার কথা। কিন্তু সে এখনো ফেরেনি মহলে। তাছাড়া ছেলের প্রণয় সম্পর্কে সে কিছুটা অবগত। তবুও নিজ পুত্রের জন্য সাফাই গাইতে পারেনি, আটকাতে পারেনি কন্যার বিবাহবন্ধন। শ্বশুর আব্বাজানের কার্যে তার হঠাৎ সিদ্ধান্তে বাঁধা দেওয়ার মতো দুঃসাহস তাদের কারোই নেই। যা হওয়ার তো হয়েই গেলো। তার পুত্র মহলে ফিরলে কি লঙ্কার কান্ড বাঁধিয়ে ফেলে কে জানে! তবে কি এবার ভাইভাই দ্বন্দ লাগবে? তাদের শান্তিময় মহলে কি একটা বি’শ্রী বিশৃঙ্খলা কান্ড সৃষ্টি হতে চলছে। রমনী নিয়ে ভাই-ভাই দ্বন্দ! মাতা হয়ে সে-কি পুত্রকে মানাতে সক্ষম হবে? যদিও তার পুত্র তাকে বড়ই শ্রদ্ধা করেন, মান্য করেন। কিন্তু, কিন্তু এবারের বিষয়টা বড্ড জটিল। পুত্রকে নিয়ে অজানা এক চিন্তায় ঘাম ছুটছে মায়ের।
দূর থেকে সেসব লক্ষ্য করে সেখানে উপস্থিত হলো, জমিদারের ছোট গিন্নি আয়শা খাতুন। নম্র কণ্ঠে শুধালো,
আপা! আপনি কোনোকিছু নিয়ে কি চিন্তিত? আপনাকে কেমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। কি হয়েছে, আপা?
সম্পর্কে উনারা দু’জন সতীন হলেও ছোট গিন্নি তাকে সবসময় বড় আপা বলে সম্মোধন করে। সতীন কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ! এই শব্দটি সচারাচর কোনো নারী সহ্য করতে পারে না। কিন্তু জমিদারের দুই গিন্নি এই শব্দটির বিপরীতমুখী। উনারা দু’জন সতীন হলেও সবার মতো চুলোচুলি কিংবা একজন আরেকজনকে অসম্মান করে না কখনো। মিলেমিশেই থাকছে। হয়তো মনেমনে ঈর্ষা হয় প্রিয় স্বামীকে ভাগাভাগি করতে। তবে সেই সূক্ষ্ম ঈর্ষা কেউ সামনাসামনি প্রকাশ করে না।
পিছন থেকে হঠাৎ করে কারো কণ্ঠ স্বর কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই সেদিকে দৃষ্টি বুলালো, সালমা বেগম। ছোট গিন্নিকে দেখে উদাস কণ্ঠে বললো,
“আমি বড়ই চিন্তিত ছোট!”
“সে আমি আপনাকে দেখেই বুঝিয়াছি। কি নিয়ে আপনার এতো চিন্তা? কারণ কি আপা?”
থমথম খেয়ে গেলেন সালমা বেগম। ব্যাপারটা লোক জানাজানি করা ঠিক হবে? আপাতত থাক না। জমিদার বাড়ির সম্মান জড়িয়ে আছে এখানে। কি একটা বিশ্রী কান্ড। ছি! ছি! লোকে শুনলে জাত যাবে। সাতপাঁচ ভেবে চট করে নিজেকে ধাতস্ত করে সালমা বেগম বললো,
“আমি তোমাকে মিথ্যাও বলিতে পারিবো না আবার সত্যও স্বীকার করিতেও পারিবো না আয়েশা। দয়া করে, আমাকে আর প্রশ্ন করো না!”
আয়শা খাতুন চুপ হয়ে গেলেন। আপা নিজ ইচ্ছেতে না বলিলে সে জোর করবে না কখনো। এই স্বভাব তার নীতির বিরুদ্ধে। তবে তার মুখে আঁধার নেমেছে। আপা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে এটা ভেবেই তার কিঞ্চিৎ মন খারাপ হলো। সরু চোখে সেসব পর্যবেক্ষণ করলো সালমা বেগম।
ও প্রসঙ্গ বাদ দিতে উনি পুনরায় আবার বললো,
“রসুইঘরে গিয়াছিলে? খাবার-দাবারের আয়োজন কতদূর হইয়াছে?”
“খাবার-দাবারের আয়োজন ইতোমধ্যে শেষ হইয়াছে আপা। ভৃত্যরা বাকিটা গোছগাছ করছে।”
“আচ্ছা, চলো ভিতরে যাই। উনারা ভোজন কক্ষে আসিবার সময় হইয়াছে।”
সম্মতি জানিয়ে দু’জনই একসাথে অন্ধর মহলে প্রবেশের জন্য উদ্যাত হলো। এমন সময় পিছন থেকে পুরুষালী শীতল কণ্ঠ শোনা গেলো,
“আম্মাজান!”
পুত্রের কণ্ঠ স্বর শুনে কেঁপে উঠলো, আম্মাজান। তার পা থেমে গিয়েছে, বক্ষ ধুকপুক করছে। এক্ষুণি বোধহয় ইলাহি কারবার শুরু হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণের ঘন্টা বাজলো জমিদার বাড়িতে। ফাঁকা ঢোক গিললো, সালমা। এরিমধ্যে মাহাদকে দেখে আয়শা খাতুন একগাল হেসে বললো,
“ভালো আছো তুমি, আব্বা? শহর থেকে মাত্রই ফিরেছো বুঝি?”
“ভালো আছি আমি, ছোট আম্মা। আপনি ভালো আছেন?”
“জ্বি। আমিও ভালো আছি। চলো ভিতরে চলো আব্বা। কতপথ পাড়ি দিয়ে আসলে।”
মাহাদ তাকালো নিজ মাতার মুখপানে। আম্মাজানকে ভীষণ রকমের উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। যা লক্ষ্য করে গাল ছুঁয়ে আম্মাজানকে আবারো ডাকলো,
“আম্মাজান? কি হইয়াছে আপনার? মুখখানা এতো শুকনো দেখাচ্ছে কেনো?”
“তোমার সাথে কথা আছে আমার। ছোট তুমি ভেতরে যাও আমরা আসছি।”
আয়শা খাতুন বিনাবাক্যে ভিতরের দিকে অগ্রসর হলো। তান্মধ্যে মাহাদ বললো,
“পরে আপনার কথা শুনবো, আম্মাজান। আমি বড্ড ক্ষুধার্ত। আমার জন্য এক্ষুণি খাবারের আমেজে করুন, আম্মাজান।”
সালমা বেগম সরাসরি তাকালো পুত্রের মুখপানে। ছেলেটাকে কত কতো স্বাভাবিক লাগছে। তবে কি সে এখনো শুনতে পায়নি মহলের ভেতরের খবরা-খবর? নিশ্চিত হতে উনি চাপা কণ্ঠে শুধালো,
“তোমার ছোট ভাইয়ের সাথে কুহেলিকা’র বিবাহ কার্য সম্পূর্ণ হইয়াছে। সে খবর কি তুমি শুনেছো?”
“শুনেছি।”
স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো মাহাদ। দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে পিছনে পিছনে ছুটে আসলো মা। সালমা বেগম যা ভেবে ছিলো তার কিচ্ছুটিই ঘটলো না। মাহাদ খুব স্বাভাবিক। একে একে বাবা,চাচা-চাচি, দাদা-দাদির সাথে স্বাভাবিক ভাবে আলাপ করে নিজ কক্ষে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য আরো একবার আম্মাজান’কে বলে গেলো,
“আমার খাবারটা দ্রুত তৈরী করেন, আম্মাজান।”
ছেলের এতো স্বাভাবিক আচরণ পছন্দ হচ্ছে না মায়ের। তার অচেতন মনে আরো ভয় বাড়লো। ছেলের এতো স্বাভাবিক আচরণ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস।
____________
মহলে চাপা একটা হৈচৈ চলছে। বাচ্চারা উল্লাস করছে, তাদের মাহাদ ভাই এসেছে, মাহাদ ভাই এসেছে। কুহেলিকা নিজ কক্ষে। বিবাহের দ্বিতীয় রজনীটাও তার কেটেছে ফারহানের সঙ্গে একই কক্ষে। এরমধ্যে ফারহান তার সাথে কোনো জোরজবরদস্তি কিংবা স্বামীর অধিকার দেখায়নি।
তবুও তার মুখটা শুকনো থাকে সবসময়। মানুষটাকে বড়ো ভয় হয়।
দু’দিনে চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে তার। স্নিগ্ধ চেহারায় মলিনতার ছাপ। আজও ভোরে উঠে শুকনো মুখে পালঙ্কে বসে রইলো কুহেলিকা। তার চোখ ছলছল করছে। ফারহান কক্ষে নেই এখন। ভোরে উঠে তাকে দেখা যায়নি একবারও। এই ফাঁকে কিরণমালা এসে মলিন মুখে বললো,
“মাহাদ ভাই মহলে ফিরেছে, কুহেলিকা।”
মাহাদ ভাই নামটা শুনেই মেয়েটার ভিতরটা হুহু করে কেঁদে উঠলো। তার দুঃখও লাগছে, আনন্দও লাগছে! ভেজা কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“মাহাদ ভাই! মাহাদ ভাই, আমাকে খুঁজেছে একবারও?”
“আমি জানি না।”
ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো, কুহেলিকা। মন চাচ্ছে সকল লোককে উপেক্ষা করে এক ছুটে গিয়ে মানুষটার বুকে ঝাপিয়ে পড়তে। অভিমান নিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়,
“আপনি কেনো আমায় একা রেখে ওই দূর শহরে গিয়েছিলেন, মাহাদ ভাই? আপনি আমার পাশে কেন থাকলেন না? আপনি থাকলে এতোটাও দুর্দিন আসতো না আমার। গল্পটা অন্য রকমেরও হতে পারতো। আপনি কেন থাকলেন না?”
কিন্তু বলা হলো না সেসব। শরীর অবশ হয়ে আসছে তার। মনে হচ্ছে তাকে কেউ অদৃশ্য বাঁধনে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে।
এমন সময় কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করলো, ফারহান মল্লিক। ভাইকে দেখে ততক্ষণাৎ সুড়সুড় করে কক্ষ ত্যাগ করলো কিরণমালা। ফারহান মাত্রই বাহির থেকে ফিরেছে। তার শরীর ভেজা। নদীর ঘাট থেকে স্নান করে এসেছে বোধহয়।
নিজ বধূর কান্নায় ভেঙে পড়া দৃশ্যটি দেখে মোটেও বিচলিত হলো না সে। সেদিকে একবার তাকালো না অবধি। শক্ত মুখে নিজের ভেজা শরীর মুছে দফেদফে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে নিলো। অতঃপর, ধীরপায়ে এগিয়ে মুখোমুখি হলো কুহেলিকার। কুহেলিকার মুখে শব্দ নেই, চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।
এই কান্না সম্পর্কে অবগত ফারহান মল্লিক।
চটজলদি পাঞ্জাবির পকট থেকে রুমাল বের করে মুছে দিলো মেয়েটার চোখের জল। অতঃপর গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“চোখের এই লোনাজল ভীষণ দামী! আর তুমি সেই দামী জল পরপুরুষের জন্য খরচ করছো, বালিকা? পরপুরুষের জন্য তোমার এতো দরদ! আমি তো সেখানে তোমার স্বামী, স্বামী’র জন্য মোটেও কি দরদ হয় না তোমার?”
কুহেলিকা ফ্যালফ্যাল চোখে তার মুখের দিকে একবার তাকালো কেবল। আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তার চোখের জল বাঁধা মানছে না আজ। দুনিয়ায় কোনো কথা তার বোধগম্য হচ্ছে না। সে আবারও নিজের মতো করে কান্নায় মনোযোগী হলো। ফারহান তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। উঠে দাঁড়ালো। কক্ষের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে গটগট পায়ে নিচে চলে গেলো।
ভোজন কক্ষের টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে কেবল বসেছে, মাহাদ। এরিমধ্যে তার পাশের চেয়ারটায় বসলো, ফারহান মল্লিক! ভাইকে দেখে মাহাদ মল্লিক মৃদু হেসে শুধালো,
চলবে……..
[আমি একটু অসুস্থ গত পর্বে বলে রেখেছি আপনাদের, তাই গল্প আসতে একটু দেরী হচ্ছে। কেউ প্লিজ অভিযোগ রাখবেন না। এবার থেকে আবারও আমি নিয়মিত হবার চেষ্টা করছি। সবাই রেসপন্স করবেন। ]
#কালেক্ট_গল্প_কথা
Story Link-গল্পের লিংক (রিভিউ+আলোচনা)💓https://facebook.com/groups/329590663119170/