#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১২
কালবৈশাখী ঝড় আর প্রকৃতিতে কি তান্ডব চালিয়েছে তার থেকে বেশি তান্ডব শুরু হয়েছে জারিফের মনে।ইট পাথরের এই শহরে বড়বড় বাড়ি গাড়ির বহরে সব কিছুই ঠিক আছে।অথচ কিছুই যেনো ঠিক নেই জারিফের কাছে।গতকালকের কাল বৈশাখী সাথে অঝোর বৃষ্টি যেনো জারিফের জীবনকে থমকে দিয়েছে।এই পৃথিবীতে কখন কার জীবনে কি ঘটে কেউ কি তা বলতে পারে? উঁহু!তা মোটেও সম্ভব নয়।একটা রাত যা জারিফের জীবনকে দাড় করিয়েছে কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থায়।কাল অব্দি বিয়ে নিয়ে যে উৎফুল্ল রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ছিলো জারিফ।তা যেনো মূহূর্তেই দুঃস্বপ্নে রুপান্তরিত হয়।জারিফ চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে।কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।দিক দিশেহারা। বিষন্নতায় ছেয়ে গিয়েছে জারিফের মনমস্তিষ্ক। অনুশোচনায় জড়জড়িত, অপরাধ বোধ বুকের মধ্যে কেড়েকেড়ে খাচ্ছে।আগের মতো সবকিছু স্বাভাবিক হবে কি?আর না সম্ভব?এই প্রশ্নের কোনোই উত্তর জানা নেই জারিফের।ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত্রি একটা বাজে। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা নিস্তব্ধতায় ঘেরা।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুই হাত বুকে গুঁজে স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে আছে জারিফ। দৃষ্টি দূরে অন্ধকারে নিবদ্ধ।কালকে রাতের কথা মানসপটে ফের ভেসে উঠতেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। রা’গ ক্ষোভে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,,
“যা কিছু ঘটেছে সবকিছুর জন্য ঐ মেয়েটা দায়ী।ঐ মেয়েটা আজ দুইরাত আমার চোখের ঘুমকে হারাম করেছে।আমার স্বাভাবিক জীবনটাকে অস্বাভাবিক করে তুলেছে।সবার কাছে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।”
দীর্ঘ হতাশার শ্বাস ফেলে।একহাত মুঠো পাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফের মনেমনে আওড়ালো,, উফ্!ঐ মেয়েটার কথামতো চুপচাপ বসে থাকা বোধহয় মোটেই উচিত হবে না।সবাইকে সত্যিটা বলতে হবে।সবাই আমাকে ভুল বুঝলেও করার কিছুই নেই।তবুও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কোনো কিছু করা মোটেও ঠিক হবে না।এমনিতেই একদিন লস হয়ে গিয়েছে।কালকে হলুদ পরশু বিয়ে।আর বিয়ের আগেই আমাকে বিষয়টা সবাইকে জানাতে হবে।আর সত্যিটা ঐ মেয়ের মুখ থেকেই সবাই জানবে।এখন ফাস্ট আমার ওর সাথে কথা বলা জরুরী।
.
আজকে বৃহস্পতিবার। শহরের আভিজাত্যপূর্ণ রুচিশীল একটা কমিউনিটি সেন্টারে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে।একসাথে বর কনের হলুদ হবে।সবাই কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য রেডি। সেখানে জারিফ এখনো রুমে বসে হতাশার মধ্যে আছে।কিভাবে সত্যিটা সবাইকে বলবে এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে ।এরমধ্যে জারা এসে জারিফকে তাড়া দিয়ে যায়।সাথে হলুদের জন্য কেনা পোশাক রেখে যায়।জারিফ শাওয়ার নিয়ে সাদা পাঞ্জাবি আর উপরে হলুদ কোটি পড়ে নেয়।জারিফের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।আগে লিয়ার সাথে কথা বলতে হবে।লিয়ার কথামত এতবড় বিষয় গোপন রাখা জারিফের পক্ষে পসিবেল নয়।
.
ওদিকে লিয়া যেনো জীবন্ত লা’শে পরিণত হয়েছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো। এখনো তা লিয়ার বুঝে আসছে না।লিয়া বিষন্ন মন নিয়ে রুমে বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিলো।সেই মুহূর্তে রাজিয়া সুলতানা এসে লিয়াকে এখনো রেডি হতে না দেখে কিছুটা শক্ত গলায় বললেন,,”একি লিয়া।তুই এখনো রেডি হোসনি।ওদিকে তুষার ফোন করেছিলো ওরা তো প্রায় চলে আসলো।আমাদের তো এখন কমিউনিটি সেন্টারে যেতে হবে।আর ওখান থেকে সরাসরি তোর দাদুবাড়িতে যাবো। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।এমনিতেই রাহবারের মানথলি এক্সাম থাকায় আগে থেকে যেতে পারিনি।এজন্য তোর বড়মা ভীষণ আক্ষেপ করছে।যা আর দেরি করিসনা।”
লিয়া শোয়া থেকে উঠে বসে।মাথাটা নিচু করে রাখে।লিয়ার মন মস্তিষ্ক বিষাদে ছেয়ে আছে।নিজেকে জড় বস্তুর ন্যায় মনে হচ্ছে।একদম অনুভূতিহীন লাগছে।রাজিয়া সুলতানা লিয়ার কোনো ভাবান্তর নেই দেখে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ কপাল কুঁচকে ফেললেন।ফের সন্দিহান গলায় বললেন,,”বুঝলাম না।কি সমস্যা তোর?সেদিন যে তোর দাদুবাড়ি থেকে রাত করে বাসায় ফিরলি।তারপর থেকে আমি খেয়াল করছি তোকে কেমন যেনো বিষন্ন লাগছে।শরীর খা’রাপ?নাকি কোনো সমস্যা?আর এটাও বুঝতে পারছিনা সেদিন অতো লেইট হলো কিকরে?”
মায়ের সন্দিহান গলার স্বর শুনে লিয়া অপ্রস্তুত হয়ে যায়।লিয়া ঘনঘন চোখের পলক ফেলে। বুকের ভেতর ব্যাথায় মোচড় দিয়ে উঠলো। সেকেন্ডই চোখের কোল নোনাজলে ভরে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকে আমতা আমতা করে বলে উঠলো,,”সে সেদিনই তো বললাম।গাড়ির সমস্যা হয়েছিলো।”
রাজিয়া সুলতানার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে উনি লিয়ার কথা এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি। চোখ মুখ স্পষ্ট সন্দিহান।লিয়া মনেমনে আওড়ায়,এখন যদি বলি আমি যাবো না।তাহলে আম্মুর সন্দেহ বাড়বে বৈ কমবে না।তাই কষ্ট হলেও অনিচ্ছা হলেও আমাকে হলুদে যেতে হবে।লিয়া হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে যায়। রাজিয়া সুলতানা লিয়ার পোশাক বের করে বিছানায় রাখে।আর হাঁক ছেড়ে বলেন,,”লিয়া জারিফদের বাড়ি থেকে যে লেহেঙ্গা দিয়েছে বের করে রেখেছি।আর সময় টেন মিনিটস। এরমধ্যে ফাস্ট রেডি হয়ে নিবি।কেমন?”
.
ছেলে পক্ষ আগে উপস্থিত হয়েছে।মেয়ে পক্ষ এখনো উপস্থিত হয়নি।তবে কাছাকাছি চলে এসেছে।জারা হলুদ শাড়ি পড়েছে।সাথে হলুদ ফুলের কৃত্রিম অর্নামেন্টস।জারা শাড়িটা একহাতে ধরে ভিতরে যেতে থাকে।নীল কমিউনিটি সেন্টারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো।নীলকে দেখে জারা এগিয়ে যায়।গিয়ে চঞ্চল গলায় বলে,,” এই নীল ভাইয়া আমার কয়েকটা পিক তুলে দে তো।”
নীল বড়বড় চোখ করে জারার দিকে তাকায়। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।নীলের হাসি দেখে জারার মেজাজ খা’রাপ হয়ে যায়। জারা ধমক দিয়ে বলে,,”এরকম হে হে করে হাসার কি হলো?মাথা খা’রাপ হলো নাকি?নাকি ভুতটুত ভর করলো ?কোনটা?”
নীল ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠলো,,”ভুত আসবে কোথা থেকে?সামনে যে পেত্নী দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে তো ভূত মহাশয় পাঁচশো গজ দূর দিয়ে হাঁটবে।একি সেজেছিস একদম পেত্নী পেত্নী লাগছে।”
নীলের এহেন কথা শুনে তরতর করে জারার ফুরফুরে মেজাজটা খা’রাপ হয়ে যায়।জারা রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায়। কত সুন্দর করে হলুদ শাড়ি পড়েছে। ছোটোমা তো বলছিলো একদম হলুদ পরি লাগছে। সেখানে নীলের এমন কথায় জারার রা’গ আকাশসম হয়।
সবার মুখেই হাসি। দারুন আনন্দঘন পরিবেশ।তবুও একফোঁটাও আনন্দ নেই জারিফের মনে।জারিফ লিয়ার সাথে কথা বলবে সেই চিন্তায় লিয়ার অপেক্ষায় আছে।যেভাবেই হোক লিয়ার সাথে কথা বলতেই হবে।এমন সময় নীল জারিফের পাশে এসে দাঁড়ায়।সুক্ষ নজরে নোটিস করে মুচকি হেসে গমগমে স্বরে বলে উঠলো,,”তা ব্রো এতো অধীর আগ্রহে কার জন্য অপেক্ষা করছিস? নিশ্চয় তোর বউয়ের জন্য।”
জারিফ হঠাৎ করেই ক্ষীন আওয়াজে বলে উঠলো,,”হুম।”
‘হুম’ কথাটা বলার পরপরই জারিফের হুঁশ হয়।জারিফ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়। নীলকে এড়িয়ে যেতে বলে,,
“আমার একটা কল করার আছে।”এটা বলেই জারিফ ওখান থেকে প্রস্থান করে নিরিবিলি একজায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়।
এরমধ্যে কনে পক্ষের সবাই চলে এসেছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হবে। তাসনিমকে হলুদ শাড়ি সাথে হলুদ গাঁদা ফুলের গহনা দিয়ে সাজানো হয়েছে।হলুদ সাজে তাসনিমকে খুব সুন্দর লাগছে। তাসনিমকে স্টেজে বসানো হয়।এতো সুন্দর পরিপূর্ণ সাজগোজ।তারপরেও তাসনিমের মনের মধ্যে কিছুর যেনো অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছে।আজ হলুদ কাল বিয়ে।এতে তো তাসনিমের খুশি হওয়ার কথা।মনটা প্রফুল্ল থাকার কথা।এসবের জায়গায় তাসনিমের মনে বিষন্নতা ঘিরে ধরেছে।জোর করে মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।নিজেকে রোবট রোবট লাগছে। অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে।
লিয়া সবার ভিড় থেকে একটু দূরে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে।নীল লিয়াকে দেখে এগিয়ে আসে।নীল প্রথম থেকেই লিয়াকে নোটিস করছে।লিয়া কিছু নিয়ে চিন্তিত।আর সবার থেকে কেমন দূরে দূরে আছে।হলুদ লেহেঙ্গায় লিয়াকে চমৎকার লাগছে।তবে মুখটা মলিন।লিয়ার ভারী মুখশ্রীতে একনজর তাকিয়ে নীল ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে,,”এই মিস লিয়া। আপনার কি মন খা’রাপ?আপনাকে কেমন জানি বিষন্ন লাগছে।”
লিয়া ছোট শ্বাস ফেলে। চোখের কোণের অশ্রুটুকু এক আঙ্গুল দিয়ে আড়ালে মুছে নেয়।ম্লান স্বরে বলে,,”নাহ্।ঠিক আছি তো।কোনো সমস্যা নেই।”
নীল মৃদু হাসলো। একটু সময় নিয়ে সুন্দর করে আবদার করে বললো,,”এই লিয়া জানেন। আমার না এই আপনি টাপনি।এসবে কমফোর্টেবল ফিল হয়না।তাই বলছি আমি কি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি। আর আপনি চাইলে আমাকে ফ্রেন্ড হিসেবে ট্রিট করতে পারেন।”
লিয়া ছোট করে বলে,,”ইটস্ ওকে।”
নীল স্মিত হাসলো। কিয়ৎক্ষন পরেই কন্ঠে শীতলতা নিয়ে ফের আওড়ালো,,”আজ থেকে যেকোনো প্রয়োজনে কোনো হেল্প লাগলে ফ্রেন্ড হিসেবে বলতে পারো।আশাকরি ফ্রেন্ড হিসেবে আমি মানুষটা মন্দ হবো না।”
এদিকে সবার ভিড়ে জারিফের দুচোখ লিয়াকে খুঁজছিলো।সেইসময় জারিফ দেখতে পায় নীল আর লিয়াকে পাশাপাশি কথা বলতে। এরমধ্যে লিয়া সামনে তাকাতেই খানিকটা দূরে জারিফকে দেখতে পায়।বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়।মোচড় দিয়ে উঠলো বুকের ভেতরটা। চোখদুটো ছলছল করে উঠলো।লিয়ার চোখ মুখের দিকে চেয়ে নীল কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে বাম ভ্রুটা নাচিয়ে ইশারায় বোঝায় “কি হয়েছে? ”
লিয়া হালকা হাসার চেষ্টা করে নাক টেনে নিয়ে বলে,,”তেমন কিছু নয়।চোখে বোধহয় কিছু একটা পড়েছে।”
এই বলে লিয়া নীলকে এড়িয়ে চলে যায়। সবার ভিড় এড়িয়ে একপাশে ফাঁকা স্পেসে গিয়ে দাঁড়ায়।এতক্ষণের দলা পাকিয়ে রাখা কান্না গুলো উপচে পড়তে থাকে।চোখ বন্ধ করতেই গাল বেয়ে পড়তে থাকে ভারী বর্ষণ।ওদিকে জারিফ লিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সেদিকে যাবে মনস্থির করে।এমন সময় হলুদের ডালা হাতে জারা জারিফকে পিছু ডাকে।জারার সাথে নাতাশাও ছিলো।জারা গলা ছেড়ে ডাকে,,”এই ভাইয়া ওদিকে কোথায় যাস? স্টেজে সবাই অপেক্ষা করছে।এখন হলুদ পর্ব শুরু হবে।”
জারিফ জারার দিকে এগিয়ে আসে। গম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকে,,”আমার একটু কাজ আছে।ওয়েট আমি আসছি।”
এরমধ্যে জারার পাশ থেকে নাতাশা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে উঠলো,,”মামা সবার আগে আমি তোমাকে হলুদ দিবো।”
জারিফ নিশ্চুপ রয়।জারা মিষ্টি হেসে বললো,,”ঠিক আছে।তুমিই দিবে।”
নাতাশা হলুদের বাটির দিকে ইশারা করে ফের আবদার জুড়ে বসলো,,”আমি এক্ষুনি দিবো।যদি আবার কেউ আগেভাগে মামাকে হলুদ ছুঁইয়ে দেয়।তখন।”
এই বলে নাতাশা গাল ফুলিয়ে রাখে। মনমস্তিষ্ক যখন চিন্তাগ্রস্থ তখন অন্য কোনো কিছু সহজেই নিউরনে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। জারিফকে নির্বিকার দেখে জারা ঠোঁট মেলে বললো,,”এই ভাইয়া নাতাশা যখন এতো করে বলছে।তখন বেচারিকে দে না একটু হলুদ ছোঁয়াতে।”
জারার কথা কর্ণপাত হতেই জারিফ খানিকটা ইতস্তত বোধ করে।নিজেকে যেখানে এলোমেলো লাগছে।সেখানে এসব কিছু বিরক্ত লাগছে জারিফের কাছে। অবশেষে নাতাশার আবদার রাখতে জারিফ নাতাশার সামনে কিছুটা ঝুঁকে। নাতাশা জারার কাছ থেকে হলুদের বাটি থেকে একহাতে অনেকখানি হলুদ তুলে নেয়। উৎফুল্ল হেসে ঝকঝকে দাঁত বের করে জারিফের দুইগালেই লাগিয়ে দেয়।জারা নাতাশার কাজ দেখে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আওড়ালো,,”মামাকে এতো হলুদ মেখে দিয়েছো।তুমি একাই তো পাঁচজনের তা লাগিয়ে দিয়েছো। আচ্ছা যাইহোক এবার হ্যাপি তো?”
নাতাশা ঘাড় নাড়িয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,,”হুম।”
লিয়া হাতের উল্টো পাশ দিয়ে গাল বেয়ে পড়া পানিটুকু মুছে নেয়।এমন সময় হঠাৎ করেই লিয়ার হাতে টান পড়ে।জারিফ লিয়ার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।আচমকা টানে লিয়া হকচকিয়ে যায়।লিয়া টাল সামলাতে না পেড়ে পড়ে যেতে নেয়। তৎক্ষণাৎ লিয়া নিজেকে সামলাতে আচমকা জারিফের পাঞ্জাবি খামচে ধরে খিচে চোখ বন্ধ করে নেয়।লিয়ার এভাবে পাঞ্জাবি খামচে ধরাতে জারিফ লিয়ার দিকে খানিকটা ঝুঁকে যায়।সেইসময় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জারিফের গাল লিয়ার গালের সাথে লাগে।জারিফ মূহূর্তেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়।লিয়া চোখ মেলে তাকায়।জারিফের পাঞ্জাবি ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।লিয়া গালে ভেজা ভেজা অনুভব করায় এক আঙ্গুল গালে স্পর্শ করায়। অতঃপর আঙ্গুলটা চোখের সামনে ধরতেই দেখতে পায় হলুদ।সাথে সাথেই লিয়ার দৃষ্টি যায় জারিফের মুখে। যেখানে স্পষ্ট হলুদ লেগে আছে।লিয়ার টানাটানা নজরজোড়া টলমল করতে শুরু করে।জারিফ চোখমুখ শক্ত করে কন্ঠে কঠোরতা নিয়ে বলে উঠলো,,
“আমার লাইফটাকে হেল করে দিয়ে তুমি তো বেশ আছো।বেশ তো সবার সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছো।আর এদিকে আমার জন্য নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা নিঃশ্বাস আমাকে বলছে আমি তাসনিমকে ঠকাতে যাচ্ছি।আমি ওর সরলতার সুযোগ নিচ্ছি।”
জারিফের এহেন কথা লিয়ার বোধগম্য হয়না।এসে তো কারো সাথেই তেমন কথা হয়নি।যেটুকু হয়েছে নীলের সাথে।তবে কি সেইটাকেই তাচ্ছিল্য করে আড্ডা বলছে।জারিফ একটু সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্ষীন আওয়াজে স্পষ্ট গলায় আওড়ালো,,”আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব নয়।”
তড়িৎ বেগে লিয়া মাথাটা তুলে জারিফের দিকে তাকায়।ঘন পল্লব কয়েকবার ঝাপটায়।লিয়ার সর্বাঙ্গে শিরশির করে শীতলতা বয়ে গেলো।বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ খেলে গেলো।লিয়া যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।লিয়া নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।লিয়া শীতল চাহনিতে জারিফের চোখে চোখ রাখে।এরপর জারিফ যা বললো লিয়া তা শোনার জন্য এই মুহূর্তে মোটেই প্রস্তুত ছিলো না।যা শুনে লিয়ার আকাশে বাজ পড়লো।লহমায় মনটা আবার বিষাদে ছেয়ে ধরলো।জারিফ চোখ বন্ধ করে নেয়। লম্বা শ্বাস টেনে কঠোরভাবে বলতে থাকে,,
“তোমার কথামতো সত্যিটা আড়ালে রেখে তাসনিমকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।বিয়ে যদি তাসনিমকে করিই তাহলে তিনমাস পরেই হবে। এবং যদি তাসনিম রাজি থাকে তবেই।এছাড়া নয়।কাউকে ঠকিয়ে বিয়ে করবে আয়মান জারিফ নেভার।আয়মান জারিফ কোনোদিন কাউকে ঠকায়নি।কোনো মিথ্যের আশ্রয় নেয়নি। সেখানে কিনা তাসনিমের মতো একটা সহজ সরল ভালো মনের মেয়েকে চিট করে বিয়ে করবে। অসম্ভব।”
লিয়ার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিলো। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকে রাখে। হরিণী চোখদুটো জলে টইটম্বুর করতে থাকে।লিয়ার ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে বলতে,আপনি তাসনিমের দিক দেখলেন।আর আমার।আমার কথা একটাবারও ভাবলেন না। তাসনিম ভালো মেয়ে। আর আমি? আপনার কথা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?তারমানে আমি ভালো নই।তাইতো আমাকে ঠকানো কোনো ব্যাপার নয়। তাসনিমকে বিয়ে করলে আমার সাথে অন্যায় করা হবে না?আফসোস!আমার চোখের ভাষা আপনি কোনোদিনই বুঝলেন না।
এসব কথা মনেমনেই আওড়ায় লিয়া। মুখে কিছুই বলে না।লিয়াকে নিশ্চুপ দেখে জারিফ ফের রাগান্বিত স্বরে বললো,,”কি হলো চুপ করে আছো কেনো?এই মুহূর্তে তুমি সবার সামনে গিয়ে সত্যিটা বলবে।সে রাতের এক্সিডেন্টের জন্য সম্পূর্ণ তুমি দায়ী ছিলে।তাই সেটা বলার দায়িত্বও তোমার।”
লিয়া নাক টেনে ভেজা গলায় বলে,,”আপনার কি মনেহয়?সবটা জানার পর আমার পরিবার আপনার সাথে আমার আপুর বিয়ে দেবে।এটা ভেবে থাকলে ভুল।সব জানলে আমার ফ্যামেলি কখনোই আপনার সাথে আপুর বিয়ে দিবে না।আমি শিওর।কারন আমার দাদিমনি বিয়ে শাদির ব্যাপারে খুব সিরিয়াস।আর আমার দাদিমনির কথার বিরুদ্ধে গিয়ে আমার বড় আব্বু আম্মু রাজি হবেন না।তাই বলছি গোপন বিষয়টা গোপনই থাক।আমাদের দুজনের মধ্যেই থাক।আর আপনার যদি নিজের কাছে অপরাধী লাগে।তবে সেখান থেকেও তিনমাস পর মুক্তি পাবেন। এরপরেও বাকিটা আপনার ইচ্ছা।”
জারিফ লিয়ার দুইবাহু চেপে ধরে চোখমুখ লাল করে ধমক দিয়ে বলে,,”জাস্ট শাট আপ।ইটস্ ইম্পসিবল টু মি ফর হিডেন এ্যনি থিং। ক্লিয়ার?”
লিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,,
“হুয়াই ডু ইউ আঙরি ইউথ মি? প্লিজ লিসেন টু মি। ট্রায় টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”
জারিফ লিয়ার দুইবাহু ছেড়ে একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। রা’গ টাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,”তোমার কোনো কথা শোনার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।আর আমি যা বলছি তাই করো।সত্যিটা সবাই জানার পর।যা হবার হবে।সেটাই মাথা পেতে নেবো।মেনে নেবো।”
লিয়া করুণ চোখে চেয়ে ক্ষীণ আওয়াজে গোলাপি পাতলা ওষ্ঠ নাড়িয়ে আবেদনময়ী কন্ঠে বলতে থাকে,,”তাহলে মেনে নিন না আমাকে।”
নিজের কথায় লিয়া নিজেই থতমত খায়। দ্রুত কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,,”যদি সবাই বলে এক্সিডেন্টটাকে মেনে নিতে।পারবেন মেনে নিতে?”
জারিফের তাচ্ছিল্য জবাব,,”এক্সিডেন্টকে মেনে নেওয়া যায়। নাকি কেউ কখনো কোনোকালে যেকোনো এক্সিডেন্টটাকে মেনে নিয়েছে?তুমিই বলো।”
জারিফের তাচ্ছিল্য জবাব লিয়ার বুকে ধারালো ছু’ড়ির মতো বিঁধে। বুকটা যেনো দুঃখে কষ্টে র’ক্তা’ক্ত হয়ে গিয়েছে। লিয়ার এমন ফিল হচ্ছে।লিয়া অসহায় চাহনিতে ফের জারিফের রক্তিম চোখে চোখ রাখে।মনেমনে আওড়ায়,আমি কি এতটাই খা’রাপ?আমাকে মেনে নেওয়া কি যায়না?আমার আমিতে আপনি ছাড়া কেউ নেই।আমার সেই চোখের ভাষা আপনার নজরে কোনোদিন পড়লো না।সেদিন এক মূহুর্তের জন্য হলেও ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় আমার হয়ে গেলেন।আমার ভাগ্যে হয়তো আপনি ছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্ক বলে উঠলো,না যা হলো মোটেই ঠিক হলো না।তিনটা জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হলো।সাথে দুই পরিবারের মানসম্মান সব জলাঞ্জলিত হবে।এতো কিছুর পরেও আমার মনের কোথাও একটা ফিলিংস থেকেই যাচ্ছে। আপনি মানুন আর না মানুন আমি আপনার
“তোমার বউকে তুমি ঘরে তুলনা!এমন মিষ্টি বউ আর খুঁজে পাবে না!!
লিয়ার ভাবনার ছেদ ভাঙ্গে কারো গলার আওয়াজে।সুর করে গান গাইতে গাইতে নীল এদিকে আসছিলো।নীলের এমন গান শুনে জারিফ লিয়া দুজনেই ভড়কে যায়। প্রথমে চরম আশ্চর্যান্বিত হলেও পড়ে বুঝতে পারে নীল গান গাইছে।নীলকে দেখে জারিফ লিয়া দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।নীলও অবাক চোখে চেয়ে থাকে।নীল আরো কয়েক কদম এগিয়ে এসে লিয়া আর জারিফের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে উঠলো,,
“কি ব্যাপার ব্রো। তুই আর লিয়া এখানে।আর ওদিকে হলুদের জন্য সবাই তোর খুজাখুঁজি করছে।ওদিকে হবু ভাবীর গাল শুকনো। হলুদ লাগেনি এখনো।আর এদিকে তোদের দুজনের গালে হলুদ।তোরা দুজনে হলুদ ছুয়াছুয়ি খেলছিস নাকি?”
এরমধ্যে হঠাৎই জারিফ লিয়া আরো চমকে উঠে জাহানারা বেগমের গলা পেয়ে। জাহানারা বেগম জারিফকে এখানে দেখে খানিকটা অবাক হন।নীলকে উনিই জারিফকে খুঁজতে পাঠিয়েছিলেন। লিয়া জারিফের দুজনের গালে হলুদ লেগে আছে এটা দেখে আরো বিস্মিত হন।বিষয়টা ওনার কাছে সুবিধার ঠেকলো না।লিয়ার দিকে ব্যাকা চোখে তাকান। জারিফকে উদ্দেশ্য করে কন্ঠে গম্ভীরতার ছাপ নিয়ে শুধালেন,,”জারিফ তুই এখানে।ওদিকে সবাই তোকে খুঁজছে। অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে তো।”
[চলবে..ইন শা আল্লাহ]
(গল্প দিতে আলসেমি করেনি 😐আজকে তাড়াতাড়িই গল্প দিয়েছি। তাই আপনারাও রেসপন্স করতে আলসেমি করবেন না 😒সবাই ভালো মন্দ মন্তব্য করবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং। আসসালামুয়ালাইকুম।)