সুখের_ঠিকানা #শারমিন_হোসেন #পর্ব১৩

0
115

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১৩

জারিফ স্তব্ধ হয়ে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে।কিকরে এখন সবাইকে সেদিনের বিষয়টা বলবে ভেবে পাচ্ছে না।অথচ এখন না বলেও উপায় নেই।এতবড় একটা বিষয় গোপন রেখে কোনো মেয়ের সাথে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা একজন বিবেকবান ,জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের কাজ নয়।সেদিনও জারিফের বিবেকবোধ বিষয়টা সবাইকে জানাতে মরিয়া ছিলো।বাট লিয়া বারংবার বাঁধা দিয়েছিলো।হাত জোড়করে রিকোয়েস্ট করেছিলো বিষয়টা আড়ালে রাখতে।আজ এই পর্যন্ত আসলেও জারিফের সততা,ন্যায়বোধ জারিফকে আরো প্রকট করে তুলেছে।সত্যিটা না বলা পর্যন্ত এতটুকু স্বস্তি মিলছে না জারিফের।তাই জারিফ মনেমনে ডিসিশন নিয়ে নেয়।লিয়া বাঁধা দিলেও সে সবাইকে সত্যিটা বলবে।জারিফকে নির্বিকার দেখে জাহানারা বেগম ভরাট কন্ঠে ফের শুধালেন,,

“কি ব্যাপার জারিফ।এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় ন’ষ্ট করবি।ওদিকে সবাই অপেক্ষা করছে তো।”

জারিফ মাথাটা নুইয়ে নিল।চোখ বন্ধ করে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। কন্ঠে অপরাধ বোধ নিয়ে বলল,,”মা আমার কিছু কথা আছে।যা এখন বলাটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট।আর এসব হলুদ প্রোগ্রাম সব ক্যান্সেল করো।”

জারিফের এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে জাহানারা বেগম তড়িৎ বেগে বিস্ফোরিত নয়নে ছেলের মুখপানে চাইলেন।ছেলে যে তার মজার ছলে এমন কথা বলছে না তা ওনার ভালোভাবেই জানা।বিয়ে নিয়ে এমন সিরিয়াস বিষয়ে নিশ্চয় জারিফ মজা করবে না।এমন হেঁয়ালি কথার পিছনে কোনো না কোনো কারন তো বটেই আছে। জাহানারা বেগম খেয়ালি নজরে ছেলেকে পরখ করলেন। অবাক গলায় ফের শুধালেন,”মানে?কি বলতে চাইছিস? পরিষ্কার করে বল।”

নীল জারিফের কথা শুনে চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে নির্বাক হয়ে যায়।এমন মূহূর্তে এসে এই ধরণের কথায় যে কেউ অবাক হবে অস্বাভাবিক কিছু নয়। লিয়া ঘামতে শুরু করে।টেনশনে লিয়ার গলা শুকিয়ে আসছে।বিষয়টা সবাই জানার পর পরিবারের মান সম্মান কোথায় যাবে?এটা ভাবতেই লিয়ার হৃদস্পন্দন যেনো বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো।সব কিছুর জন্য লিয়ার নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে।

জারিফ দৃঢ় কন্ঠে বলল,,”আমি সবার সামনেই বলতে চাই।সবার থেকে আগে তাসনিমের আর ওর পরিবারের জানা জরুরী।”

.
কমিউনিটি সেন্টারের একটা রুমে দুই পরিবারের সবাই উৎসুক ভাবে দাড়িয়ে আছে।সবারই চোখে মুখে কৌতুহল।কি এমন কথা যা বলার জন্য হলুদের অনুষ্ঠান বাদ রেখে জারিফ দুই পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে এক জায়গায় দাড় করিয়েছে।লিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সবটা জানার পর কি হবে তাই ভেবে। দূর্ঘটনার কথা জানার পর যদি তাসনিমের বিয়েটা ভেঙ্গে যায়।তবে লিয়া নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।লিয়া সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে মনেমনে বারবার প্রে করছে।সবাই যেনো দূর্ঘটনাটাকে দূর্ঘটনা হিসেবেই নেয়।আর বিয়েটা যাতে না ভাঙ্গে।জারিফ লিয়ার দিকে এক নজর তাকালো।যা লিয়ার নজরে পড়লো না।কারন লিয়া মাথা নুইয়ে চোখ বন্ধ করে দুইহাতে লেহেঙ্গার এক অংশ মুঠো করে আছে।জারিফ মাথা নুইয়ে তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে ক্ষীন আওয়াজে আওড়ালো,,

“সরি তাসনিম।আ’ম রিয়েলি সরি।আমার আরো আগে বলা উচিত ছিলো।লেইট করে আমি বড্ড বো’কা’মি করে ফেলেছি।জানিনা সত্যিটা জানার পর তোমার সহ সবার রিয়াকশন কেমন হবে।তবুও আমাকে সবটা বলতেই হবে।”

একটু থামে জারিফ। তাসনিম বিস্ময়কর চাহনিতে জারিফের মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে।আর বোঝার চেষ্টা করছে জারিফ একচুয়েলি কি বলতে চাইছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কন্ঠে একরাশ অপরাধ বোধ নিয়ে ঠোঁট আওড়ায়,,” আমার জীবনে একটা দূর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।যা আপনাদের সবার জানা জরুরী।পরিস্থিতির কাছে হার মেনে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে।যদিও এই বিয়ের কোনই ভ্যালু নেই আমার কাছে।একদম ভ্যালুলেস।যেটা হয়েছে এক্সিডেন্টলি। পরিস্থিতির শিকার হয়ে সে রাতে বাধ্য হয়ে তথাকথিত বিয়ে হয়েছে।”

সবাই অবাকের উপর অবাক হচ্ছে।লিয়ার আত্মা শুকিয়ে আসছে।বাবা মা পরিবার জানলে লিয়াকেই দোষারোপ করবে নিশ্চয়।কেনো জানায়নি?এতবড় একটা ঘটনা আড়ালে রেখেছে কেনো? জাহানারা বেগম যেনো ঘটনার আকস্মিকতায় মূর্ছা যাওয়ার ন্যায় হলেন।ছেলে এসব কি বলছে তা ওনার বোধগম্য হলো না।কয়েক কদম এগিয়ে আসলেন।জারিফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে উঠলেন ,,”জারিফ বাবা কি যাতা বলছিস।বিয়ে হয়েছে মানেটা কি?তুই এসব মজা করে বলছিস তাইনা?কালকে তোর বিয়ে সেখানে এরকম মজা কেউ করে বাবা।বাইরে কত অতিথিরা আছে।সবাই এরকম কথা শুনলে কি বলবে ভাবতো।তুই না আমার বুঝদার ছেলে।”

জারিফের বাবা আনোয়ার রহমান সুক্ষ নজরে ছেলেকে পরখ করলেন।ওনার তীক্ষ্ণ নার্ভ জানান দিচ্ছে ছেলে এমনি এমনি এসব বলছে না।মজা করার মতো ছেলে জারিফ না।আর বিয়ের মতো বিষয় নিয়ে কখনোই মজা করবে না। এতটুকু দৃঢ় বিশ্বাস ছেলের উপর আছে।তাইতো স্ত্রীকে থামিয়ে দিতে বললেন,,”আহ্ জারিফের মা তুমি থামবে।জারিফকে বলতে দাও।জারিফ কোনো প্রকারের হেঁয়ালি ছাড়াই স্পষ্ট করে বলো।এখানে এতো গুলো মানুষ এইমূহুর্তে কেউ তোমার তামাশা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে নেই।তাই বলছি অনেস্টলি সব ক্লিয়ার করে বলো।”

জারিফ মৃদুস্বরে স্পষ্টভাবে বলল,,”বাবা সেদিন যখন বিয়ের শপিং করে তাসনিমদেরকে ওদের বাসায় রেখে ফিরছিলাম।আমার সাথে লিয়া ছিলো।”

এরমধ্যে তাসনিম কপাল কুঁচকে বলে উঠলো,,”হ্যা জানি তো।”

মনের ভেতর ভালোলাগার অনুভূতিকে দমিয়ে রেখে ফ্লোরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো জারিফ।তাসনিমের চোখে চোখ রাখতে পারলো না। তাই মাথাটা হেট করে সাহস সঞ্চয় করে নির্ভীক দৃঢ় কন্ঠে বলল,,”তুমি সবটাই জানো না।আমাকে বলতে দাও।”

তাসনিম ঠোঁট মেলে বললো,,”ওকে ফিনিশ করো।”

জারিফ বলতে থাকে,,
সেদিন রাতে লিয়াকে সাথে করে আসার সময় মাঝপথে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়।দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টিপাতও হয়। সময়ের সাথে কালবৈশাখী ঝড় থেমে যায়।তবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি রয়ে যায়।জারিফ স্বাভাবিকভাবেই ড্রাইভ করে আসছিলো। এরমধ্যে হঠাৎ করেই জারিফ গাড়ির ব্রেক কষে। জারিফের এভাবে ব্রেক করায় লিয়া পাশে বসা জারিফের দিকে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকায়।জারিফ দৃষ্টি সামনে রেখে একহাতে স্টিয়ারিংয়ে হালকা পাঞ্চ করে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে উঠলো,”ওহ্ শিট।”

লিয়া সামনে তাকিয়ে এতক্ষণে খেয়াল করলো বিষয়টা। রাস্তা জুড়ে বড়সড় একটা গাছ উপড়ে পড়ে আছে।ঝড়ের কারনে এমন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।জারিফ গাড়ির দরজা খুলে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়ে।সামনে এগিয়ে গিয়ে বিষয়টা ভালো করে দেখে। কিন্তু না যাওয়ার মতো কোনো অবস্থায়ই নেই।জারিফ মুখায়বে স্পষ্ট বিরক্তবোধ নিয়ে গাড়িতে এসে বসলো। বৃষ্টির পানিতে জারিফের চুলগুলো কিছুটা ভিজে যায়।জারিফ একহাতে চুলগুলো ঝাড়তে থাকে।ঘাড় ঘুরিয়ে লিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,

“শহরে যাওয়ার এই একটাই কি রাস্তা।না মানে এদিকে কোনোদিন আসা হয়নি।আজ দিয়ে দুইবার হবে।আর সেদিনও এদিকটা দিয়েই গিয়েছিলাম। তোমাদের বাড়ি যাওয়ার পথঘাট ।তোমার তো কিছু জানার কথা।”

লিয়ার চোখে মুখে কয়েক ফোঁটা পানি ছিটে আসে।লিয়া একহাতে মুখে ছিটে আসা পানিটুকু মুছে নেয়।একটু সময় নিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”ইয়ে মানে আমার জানা নেই।আসলে আমরা গ্রামে খুব কমই আসি।বিশেষ করে কোনো অকেশন ছাড়া তেমন আসা হয়না।এই ঈদ কিংবা কোনো অনুষ্ঠান এই যা আসা।আর আমি যতবার এসেছি ড্রাইভার আঙ্কেলকে তো এইদিকটা দিয়েই আসতে দেখেছি।”

জারিফ পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললো,,”ওকে।দেখছি এখন কি করা যায়।”

লিয়া ফোন বের করতে করতে বলল,,”আচ্ছা আমি আম্মুর কাছে ফোন দিয়ে জেনে নেই।”

“ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। ইমার্জেন্সি উঠে আছে।”

জারিফের কথা শোনার সাথে লিয়া নিজেও নিজের ফোনে দেখতে পায় নেটওয়ার্ক নেই। বৃষ্টি যেনো তার বেগ আরো চারগুণ বাড়িয়ে দিলো।আকাশ ভেঙ্গে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হতে থাকলো।জারিফ হতাশ গলায় বললো,,”উফ্!ঝড় বৃষ্টির কারনে হয়তো ইলেকট্রিসিটিও নেই আর সেইজন্য নেটওয়ার্কেও সমস্যা দেখা দিয়েছে।”

লিয়া ক্ষীন আওয়াজে বলল,,”এমনিতেই বৃষ্টির সময় গ্রামে নেট প্রবলেম দেখা দেয়।তার উপরে ঝড় হয়েছে।”

জারিফ ভেজা চুলের মধ্যে আঙুল চালনা করতে করতেই বলল,,”আচ্ছা কিছুক্ষণ ওয়েট করা যাক। বৃষ্টি একটু কমলে তখন আশে পাশে কারো দেখা হলে জেনে নেবো অন্যকোনো রাস্তা আছে কিনা।”

জারিফ সিটের উপর কাধটা দিয়ে নিশ্চুপ রয়।লিয়া উসখুস করতে থাকে।লিয়াকে উসখুস করতে দেখে জারিফ কিঞ্চিত কপাল কুঁচকে বাম ভ্রুটা নাচিয়ে ইশারায় বোঝায়,,”কি হয়েছে?”

লিয়া জবাবে বলল,,”কই কিছু না।”

জারিফ একটু নড়েচড়ে বসে।দুইহাত স্টেয়ারিংয়ের উপর রাখলো ফের শান্ত কন্ঠে শুধালো,,”কোনো হেজিটেশন ছাড়া বলতে পারো।”

লিয়া জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আওড়ায়,,”পানি পিপাসা পেয়েছে। প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে।”

জারিফ গাড়িতে থাকা ওয়াটার বোটলটা খোঁজে।না অনেক খুঁজেও বোটলটা পাওয়া গেলো না।জারিফ ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,,”সরি।পানি নেই তো দেখছি।বোটলটাই তো দেখছি নেই।”

“ইটস্ ওকে।”

জারিফের ফের জবাব আসলো,,”আচ্ছা। একটু ওয়েট করো বৃষ্টিটা একটু কমলে।দেখি আশেপাশের কোনো বাড়ি থেকে তোমাকে পানি খাওয়াবো।আর শোনাও যাবে অন্যকোনো রাস্তা আছে কিনা।তারপর সেই রাস্তা দিয়ে বাসায় ফেরা যাবে।তোমার বাসার সবাই নিশ্চয় এতক্ষণে খুব টেনশন করছে।ফোন করে বলে দেওয়াও যাচ্ছে না।কি একটা যন্ত্রনা!উফফ!”

লিয়ার নিজেরও ভীষণ টেনশন হচ্ছে।বাসার সবাই খুব টেনশন করবে।যে করেই হোক দ্রুত ফিরতে হবে।এমন সময় একটু দূরে একটা বাড়িতে মৃদু আলো জ্বলছে দেখে লিয়ার চোখ চিকচিক করে উঠল।লিয়া এক আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে উঠলো,,”ঐ যে পাশেই তো একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে।আলো জ্বলছে দেখুন। তারমানে লোকজন আছে।তাহলে গিয়ে শুনুন না।শহরে যাওয়ার বিকল্প কোনো রাস্তা আছে কিনা।আর নয়তো হেল্প চাইবেন গাছের গুঁড়িটা যাতে সরিয়ে দেয়।আর আমরা যেতে পারি।”

জারিফ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,”এখনকার মানুষকে এতো ভালো মনেহয় তোমার।এই বৃষ্টির মধ্যে তোমার আর আমার জন্য রাস্তা ক্লিয়ার করে দিবে।আর এইসময় বৃষ্টির মধ্যে এই পথে তো অন্যকোনো যানবাহনের চিহ্ণও দেখা যাচ্ছে না।”

একটু থেমে কিছু মনে হতেই জারিফ বলে উঠল,,”আচ্ছা একটা জিনিস তো করাই যায়।এখন বৃষ্টিটাও একটু কমেছে।ঐ বাড়ি থেকে গিয়ে লোকজনের থেকে শুনে নেই বিকল্প রাস্তার কথা।”

জারিফ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।লিয়াকে বলে,,”তুমি গাড়িতেই থাকো আমি ফাস্ট শুনে আসছি।”

লিয়া শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে জড়তা নিয়ে বলে,,”এই অন্ধকার রাতে একা একা আমি থাকবো।যদি গোস্ট টোস্ট আসে তখন।”

এমন একটা ঝামেলাময় সময়েও লিয়ার কথাশুনে জারিফের হাসি পায়।তবে গম্ভীর মুখাবয়বের পেছনে হাসিটা আড়ালে রাখে। গম্ভীর কন্ঠেই বুলি আওড়ালো,,”ওকে চলো।আর তোমার তো পানি পিপাসা পেয়েছে বললে।চলো দেখি পানি খেয়েও আসবে।”

গুটিগুটি পায়ে লিয়া জারিফের পিছুপিছু যায়।হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।টিনের বাড়ি।বেশ কয়েকটা রুম বোধহয়।সামনে বড় বারান্দা। বারান্দায় হারিকেনটা মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। বারান্দার সামনে শান বাঁধা দুইটা সিঁড়ি। সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে জারিফ হালকা কাশে।কেউ আছেন কিনা বলে।এমন সময় এক মাঝবয়সী মহিলা বের হয়।কানে কয়েকজোড়া স্বর্ণের দুল,নাকে বড় নাকফুল,হালকা আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দাঁত দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে আরো কয়েক কদম সামনে এগিয়ে আসলেন।জারিফ সালাম দিয়ে ভদ্র নম্র স্বরে বলল,,

“এখান দিয়ে শহরে যাওয়ার অন্য কোনো রাস্তা আছে কি?আর আন্টি এক গ্লাস পানি হবে।”

মহিলাটি বারান্দা থেকে উঠানে পানের পিক ফেললেন।মৃদু হাসলেন। ঠোঁট আওড়ালেন,,”নিশ্চয় হবে। শুধু পানি কেনো সবই হবে।ভেতরে আসো।”

মহিলার কথাটা জারিফের সুবিধার লাগলো না।জারিফ বলে উঠলো,,”নো থ্যাংকস।এখানেই ঠিক আছি।আপনি এক গ্লাস পানি দিন তাতেই হবে।”

লিয়া চুপটি করে জারিফের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।মহিলাটি ব্যাকা হেসে ফের বললো,,”ভেতরে যাও।পানি বিছানা সবই আছে।কোনো কিছুর কমতি নেই। শুধু রেটটা একটু বেশি।”

মহিলার এহেন কথা জারিফের বোধগম্য হলো না।কথাটা ভালোও লাগলো না।পানি চাইলো তার সাথে বিছানা,রেট এসব বলার মানে কি?জারিফ ভাবতে থাকে।মহিলাটি আবার দাঁত দিয়ে পান পিষতে পিষতে বলল,,”নতুন আইছো।তাই বুঝবার পারতোছো না।তোমার মতো কত শহরের পোলাপাইন আসে।সাথে তো একদম কচি মাইয়া লইয়া আইছো দেখছি।এখন দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সময় নষ্ট করবা নাকি?”

মহিলার বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শ্রবণ হতেই জারিফের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ভ’য়ে লিয়া আরেকটু জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়। জারিফ রাগান্বিত হয়ে কিছু বলবে।সেই মুহূর্তে টর্চ লাইটের আলো এসে পড়লো।সাথে কয়েকজোড়া ধপধপ পায়ের শব্দ ধ্বনিত হলো।জোড়েসড়ে একজন বলে উঠল,,

“এইযে মাতব্বর সাব দেখছেন।নিজ চোখে দেখছেন।রোজিনা খালা যে এরহম খা’রাপ কারবার করে।এবার হাতে নাতে পাইলেন তো।”

এমন কথায় জারিফ লিয়া দুজনে হকচকিয়ে উঠলো। কয়েকজন লোক।এদিকেই তেড়ে আসলো।ফের তাদের মধ্যে থেকে বলে উঠলো,,”এই দেহেন।এইযে শহরের এক পোলা সাথে মাইয়া লইয়া আছে।আমি আপনারে আগেও কইছি।রোজিনা খালা ঘর ভাড়া দেয়।আবার মাইয়া জোগাড়ও করে দেয়।এখন বিশ্বাস হইলো তো।”

জারিফ অবাক হয়ে বললো,,”হোয়াট এসব কি বলছেন।”

জারিফের কথা থোড়াই কেয়ার না করে একটা মাঝ বয়সী ছেলে ঘরের দিকে গেলো।কয়েকটা কক্ষের দরজায় নক করতেই জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়ে বের হয়ে আসলো।টুপি মাথায় দেওয়া একটা মাঝ বয়সী লোক বলে উঠলো,,” নাউজুবিললাহ।মাতব্বর সাহেব হামাগো গ্রামে এমন কাজ চলছে।এটা ঘোর পা’প এখন এর বিচার আপনি করেন।”

মাতব্বর দাড়িতে একহাত বুলিয়ে নিলেন গম্ভীরভাবে বললেন,,”রোজিনার শাস্তি ওকে পুলিশে দেবো।আর এই পোলা মাইয়ারে বিয়া দিতে হইবে।”

জারিফ সবটা বললো।এখানে আসার কারনটা কি।জারিফের কথাকে কেউ বিশ্বাস করলো না। একজন তো বাজেভাবে বলে উঠলো,,”এইডারে বেশি ভদ্র দেখাচ্ছে।আর এই শা”লায় তো দেখছি বেশি**।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই জারিফ লোকটার কলার চেপে ধরে বললো,,”একদম মুখ সামলে কথা বল।বারবার বলছি এখানে বাকিরা যে উদ্দেশ্যে এসেছে।আমরা সেই উদ্দেশ্যে নই।বিপদে পড়ে হেল্প চাইতে আসছিলাম।বাট জানতাম না।এটা একটা বাজে জায়গা।”

লিয়ার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। কিকরবে ভেবে পাচ্ছে না।এতজনের সাথে জারিফ একা পেড়ে উঠবে না।লিয়া জারিফের হাত ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,,”ছাড়ুন ওনাকে। প্লিজ ছাড়ুন। রা’গটা কন্ট্রোল করে ঠান্ডা মাথায় ভাবুন কি করা যায়।”

লিয়ার কথা শুনে জারিফ লোকটাকে ছেড়ে একহাতে কপালের ঘামটা মুছে নেয়।পকেট থেকে ফোন বের করে।সেখানে নেটওয়ার্ক নেই। উফ্!বিপদ বোধহয় একসাথে সব দিক দিয়েই আসে। মাতব্বর সাহেব বলে উঠলেন,,”এই ছেলে তোমার সাহস তো কম না।আমার সামনে দাঁড়াইয়া আমার লোকের গায়েই হাত তোলো।আর রাত বিরাতে মাইয়া নিয়া ঘুরতাছো।নিজেরে ভালো কইয়া জাহির করছো,হ্যা।”

আরেকজন বলল,,”মাতব্বর সাব।এইডারে আগে বিয়া দেন।পরে বাকি কয়টারে।”

“হোয়াট?কি সমস্যা আপনাদের হ্যা।বিয়ে একটা ছেলেখেলা নাকি?বললেই হলো।এভাবে জোড় করে কখনো বিয়ে হয়।বিষয়টা হাস্যকর। প্লিজ স্টপ দিস।”

মাতব্বর কন্ঠে কঠোরতা নিয়ে ফের বলল,,”এই ছেলে এই।মাইয়া নিয়া অশ্লীল কাজ করে বেড়াবে আর বিয়া করবে না।এই রফিক ফটো তোল মোবাইলে।সব কয়টার ফটো তোল।আর কাইলকে শহরে যাইয়া পত্রিকায় ছাপাবি। অশ্লীল কাজ করতে গিয়ে এই পোলা মাইয়া হাতে নাতে ধরা পড়ছে।”

জারিফ লিয়া দুজনের মাথায় যেনো বাজ পড়ে।একজন মোবাইল বের করে ফটফট ছবি তুলে নেয়। মাতব্বর ফের শাসিয়ে বললেন,,”এইবার ভাইবা দেখো।বিয়া করবা নাকি এইসব কাজ কর্মের কথা পত্রিকায় ছাপাবো।আর রফিক এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। ফেসবুক না কি কয়।ঐখানেও ছাড়বি।”

লিয়ার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।জারিফ নিজেও ভেবে পাচ্ছে না কিকরবে। মানুষ তো আর ওদের মুখের কথা বিশ্বাস করবে না।কারন যেহেতু এখানে আসলেই এরকম ঘটনা ঘটেছে।ওরা দুজনে এসবে জড়িত না থাকলেও এই মুহূর্তে এইখানে থাকার জন্য কেউ বিশ্বাস করবে না ।আর এই খবর সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোর গতিতে ভাইরাল হয়।এটা ভাইরাল হলে সমাজে পরিবারের নিজের সম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?তা ভাবতেই জারিফের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।লিয়া বাকশুন্য হয়ে পড়ে। অবশেষে পরিস্থিতির কাছে হার মেনে জারিফ লিয়াকে বিয়ে করতে হয়। মাতব্বর সেই সময় একজন কাজী ডেকে বিয়ে দেন।সেদিন সেই মুহূর্তে কয়েক জোড়া বিয়ে হয়।সাথে লিয়া জারিফেরও।
.
সবাই সবটা শোনার পর বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। পিনপতন নীরবতা বইছে।সবার মুখেই কোনো কথা নেই। এরমধ্যে লিয়ার ছোট চাচিমা শিরিন সুলতানা তহমিনা বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,,”কি সাংঘাতিক ব্যাপার।আমাদের বাড়ির এক মেয়ের সাথে অলরেডি বিয়ে হয়ে গিয়েছে।আর আজ অন্য মেয়ের সাথে হলুদ অনুষ্ঠানে এসে এসব বলছে।”

কথাটা আস্তে বললেও সবারই কর্ণপাত হয়। জাহানারা বেগম সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে নেন।শিরিন সুলতানার কথাটা ঠিক হজম করতে পারছেন না। আবার প্রতিবাদ করে কিছু বলতেও পারছেন না।জারিফের বাবা আনোয়ার রহমান কঠোরভাবে বললেন,,”মানছি দূর্ঘটনা ঘটেছে।এতে তোমার বা লিয়ার কোনো হাত ছিলোনা।তবে তোমরা গোপন রেখেছো কেনো?জারিফ তুমিতো ছোটো নও।তুমি কিকরে পারলে এতবড় বিষয়টা গোপন রাখতে।তোমার থেকে এটা আমি আশা করিনি। আরো আগে বলা উচিত ছিলো।”

বাবার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে জারিফ মাথা হেট করে নিশ্চুপ রয়।এটা দেখে লিয়া অবাক হয়।জারিফকে চুপ করে থাকতে দেখে লিয়া মনেমনে আওড়ায়,উনি সত্যিটা বলছে না কেনো।আমিই তো বলেছিলাম।আমিই তো বাঁধা দিয়েছিলাম সত্যিটা সবাইকে বলতে।উনি তো সেদিনই সবাইকে বলতে চেয়েছিলেন।আমি বারবার ওনাকে বাঁধা দিয়ে বলেছি,বিষয়টা গোপন রাখতে। আর আপুকে বিয়েটা করতে।যা কিছু ঘটেছে দু’জনের মধ্যেই গোপন থাক।আর ভালো উকিল দেখে গোপনেই সমস্যা টা সলভ করতে।উনি প্রথমে মানতে চাননি। আগে সবাইকে বলবে তারপর সমাধান করবে।আপুর বিয়ে ভেঙ্গে গেলে বড়মা,বড় আব্বু কষ্ট পাবে ফ্যামেলির সম্মান হানি হবে।এটাসেটা বুঝিয়ে আমি ওনাকে বাঁধা দিয়েছিলাম।উনি তো চাইলেই আমার কথা বলতে পারে।এখন সবাই দোষটা উনাকে দিচ্ছে।উনি চুপচাপ মেনে নিচ্ছে।সবাই উনাকে ভুল বুঝছে।

ইমতিয়াজ খাঁন এনামুল খান দুজনেই নির্বাক।কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এরমধ্যে তাসনিম স্বাভাবিক গলায় বলল,,”মানছি যা হয়েছে এক্সিডেন্টলি।তারপরেও জারিফ আমি তোমাকে বলবো সবটা মেনে নিতে।”

“এটা নিতান্তই একটা দূর্ঘটনা।যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।আর দূর্ঘটনাটার প্রতিকার করতে চাই আমি।”

জারিফের কথাশুনে তাসনিম ছোট করে শ্বাস টেনে নিয়ে ফের ঠোঁট আওড়ালো,,”বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়েছে। যেখানে আমার ছোটো বোনের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে।সেখানে আর কোনোভাবেই আগানোর কথা আমি ভাবতে পারবো না।সেটা শুধু এখন কেনো কখনোই নয়।তুমি যদি ভাবো লিয়াকে ডিভোর্স দিয়ে পরে নতুন করে আমার সাথে শুরু করবে।তাহলে আমি বলবো এটা কখনোই সম্ভব হবে না।আমি সাফ আমার কথা বলে রাখলাম।আর বাকিটা তোমার ইচ্ছা। তুমি কিকরবে সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার।”

আনোয়ার রহমান ইমতিয়াজ খাঁনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,”ভাই আমি দুঃখিত।আমার ছেলের হয়ে আমি নিজে ক্ষমাপ্রার্থী।বিষয়টা দুইদিন আগেই বললে আজ লোকজনের সামনে অনন্ত মাথা হেট হতো না ।বুঝে শুনে বিষয়টা হ্যান্ডেল করা যেতো।তবে ভাইজান আমি বলবো যেটুকু সম্মান খুইয়েছে সেটুকুই থাক।আপনারা যদি রাজি থাকেন তাহলে কালকে বিয়ে হবে।কালকের বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে না।”

আনোয়ার রহমানের কথায় সবাই বড়বড় চোখ করে চাইলেন।বিয়ে হবে মানে কি?সবারই এক প্রশ্ন।আনোয়ার রহমান কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ফের শান্ত গলায় বললেন,,”আমি আপনাদের কাছে রিকোয়েস্ট করছি। কালকে আপনাদের ছোটো মেয়ে লিয়ার সাথেই জারিফের বিয়ে হবে।যদি আপনারা রাজি থাকেন তবেই।”

জারিফ বাবার দিকে মাথাটা তুলে তাকালো।যেখানে হাজারো দ্বিধা আছে।তারপরেও বাবার মুখের উপর কিছুই বলার সাহস হলো না।লিয়ার বাবা এনামুল খান নির্বাক কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ইমতিয়াজ খাঁন কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বললেন,,”ঠিক আছে তাইই হবে। যেহেতু বিয়ে হয়ে গিয়েছে।যেভাবেই হোক না কেনো।আর সবাইকে ইনভাইটও করা হয়েছে।বিয়ে বিষয়টা তো আর ছেলেখেলা নয়।তাই আমিও আপনার সাথে সহমত পোষণ করছি।”

তাসনিমের নিজেকে কেনো জানি অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে।জারিফ চুপচাপ ঠাঁয় বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে।লিয়ার কোনো কিছুই ভালো লাগছিলো না।নিজেকে খুব খাঁটো মনে হচ্ছিলো।লিয়া বুঝতে পারে জারিফ নিশ্চয় বাবার কথার বিরুদ্ধে কিছু বলবে না। সেইজন্য চুপচাপ আছে।লিয়া সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,,”বড় আব্বু আমার কিছু বলার আছে।”

সবার দৃষ্টি তখন লিয়ার দিকে। তাসনিম লিয়ার কাছে এগিয়ে গেলো।লিয়া হাত মুঠো করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় অতঃপর চোখ বন্ধ করে দৃঢ়তার সাথে বলে উঠলো,,

“আমার পক্ষে সম্ভব নয়।আমি এই দূর্ঘটনাকে দূর্ঘটনা হিসেবেই নিতে চাই।এটাকে আঁকড়ে ধরে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই না।আমি চাইবো তোমরা জোর করবে না আমাকে ‌। বরং আমি সমঝোতা চাই।আমার পক্ষে কালকে আবার নতুন করে বিয়ের আসরে বসা সম্ভব নয়।সেদিনের দূর্ঘটনাকে আমি দূর্ঘটনা হিসেবেই মনে রাখতে চাই।সেটাকে বিস্তৃত করে ফের কোনো বাঁধনে বাঁধা পড়তে চাইনা। প্লিজ,আমার কথাটা তোমরা রাখবে।।সামনে আমার এক্সাম।আর এখন আমার একমাত্র ডেসটিনেশন পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করে নামকরা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া।বিয়ে শাদি ঘর সংসার এসব নিয়ে আমি এক্ষুনি কিছু ভাবতে পারবো না। প্লিজ প্রাডোন মি।পারলে তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও।তবুও আমি এই দূর্ঘটনাকে বয়ে বেড়াতে চাইনা। যতদ্রুত সম্ভব সমঝোতা চাই।”

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here