সুখের_ঠিকানা #শারমিন_হোসেন #পর্ব১৪

0
124

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১৪

“শুধুমাত্র বিয়ের দোহাই দিয়ে আর যাইহোক কখনো সংসার হয়না।আবার হয়তো বা হয়। কিন্তু সেটা কখনো সুখের হয়না জাস্ট লোক দেখানো,মেনে নেওয়া এই আরকি।আমার কথাটা তোমাদের সবার কাছে খা’রাপ লাগতে পারে।বাট আমার কিছু করার নেই। সারাজীবন একটা দূর্ঘটনাকে বয়ে বেড়ানো আমার পক্ষে পসিবেল নয়।”

একনাগাড়ে নির্ভীক চিত্তে কথাগুলো বলে থামে লিয়া।জারিফ মাথাটা তুলে লিয়ার দিকে তাকায়।জারিফের কথাগুলোই যেনো দ্বিগুণ তাচ্ছিল্য ভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছে লিয়া।যা জারিফের ইগোতে লাগে। রাজিয়া সুলতানা লিয়ার সামনা-সামনি দাঁড়ালেন।চোখ মুখ শক্ত করে ধমকের সুরে বলে উঠলেন,,”লিয়া তুমি কিন্তু তোমার সীমা অতিক্রম করছো। এখানে বড়রা কথা বলছে তার মধ্যে তোমার এসব ডেস্পারেট কথাবার্তা মানা যাচ্ছে না।এখানে ডিসিশন নেওয়ার জন্য তোমার আব্বু তোমার বড় আব্বু ওনারা আছেন।ওনারা নিশ্চয় তোমার খা’রাপ চাইবে না।আর তুমি এখনো ছোটো তাই ভালো মন্দ বোঝার মতো জ্ঞান তোমার খুব কমই হয়েছে।”

লিয়া মুখায়বে অসহায়ত্বের ছাপ নিয়ে ফের কিছুটা করুণ স্বরে বলে উঠলো,,”আম্মু লাইফটা আমার।সেখানে ডিসিশন নেওয়ার রাইট আমারও আছে।”

উপস্থিত সবাই লিয়ার কথায় স্তব্ধ হয়ে যায়। লিয়ার কথা শুনে জাহানারা বেগমের মেজাজটা খা’রাপ হয়ে যায়।লিয়ার একরোখা কথা শুনে ওনার লিয়াকে ডেস্পারেট মনে হচ্ছে। উনি মনেমনে আওড়ায়,যেখানে বাবা চাচারা কথা বলছে সেখানে এতটুকু মেয়ের এভাবে বিরোধিতা করা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।মেয়েটার মধ্যে আদব কায়দা মনে হয় কমই আছে।তাইতো মুখে মুখে কথা বলছে।যেখানে আমার ছেলে এখনো চুপ করে আছে।আর মেয়েটার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না।আমার ছেলেকে কিনা সরাসরি মুখের উপর রিজেক্ট করছে।এসব কথা মনেমনে ভাবলেও মুখে কিছুই বললেন না।তবে স্পষ্ট বিরক্তবোধটা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

লিয়ার বাবা এনামুল খান লিয়াকে ধমক দিয়ে বললেন,,”লিয়া অনেক কথা বলে ফেলেছো।তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।তুমি এতোটা বড়ও হওনি যে সব বিষয়ে নিজের ডিসিশন নিজে নিবে।এই মুহূর্তে আর নতুন করে কোনো সিনক্রিয়েট করো না।এমনিতেই তোমার জন্য যথেষ্ট মান সম্মান ক্ষুন্ন হয়েছে।”

আনোয়ার রহমান কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ভাবলেন। অতঃপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এনামুল খাঁনকে উদ্দেশ্য করে বেশ স্বাভাবিক গলায় বললেন,,”ভাইজান মাথা ঠান্ডা রাখুন।আর আমার মনেহয় ছেলে মেয়েকে চাপ দেওয়া ঠিক হবে না।জোর করে কোনো কিছু করলে তার ফলাফল ভালো হয়না।তাই বলছি ওদেরকে সময় দেওয়া যাক।ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবে।লিয়া আম্মুকে ভাববার জন্য সময় দেওয়া হোক।লিয়া বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুক।তারপর লিয়া যা জানায়। আপনারা আমাদেরকে ফোনে জানিয়ে দিয়েন।তাহলে আমরা সে ভাবেই আগাবো।আর একটা রিকোয়েস্ট থাকবে বাচ্চা মেয়েটাকে জোর করবেন না।”

অবশেষে আনোয়ার রহমানের কথাই রইলো। নীল জারার চুলে থাকা একটা হলুদ গাঁদা ফুল হাতে নেয়।অন্য হাত দিয়ে পাপড়ি গুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে মৃদু আওয়াজে বলে,,”লে হালুয়া।কি থেকে কি হয়ে গেলো রে জারা।এ যাবত কাল ধরে তোর ভাইয়ের পছন্দের জিনিস আমি নিয়ে আসলেও।এবার তো দেখছি তোর ভাই একদম ছক্কা মে’রে দিলো।আমার মনেমনে পছন্দ করা মেয়েকে একদম বউ বানিয়ে ফেললো।”

জারা সরু চোখে চাইলো।কপাল কুঁচকে দাঁত কটমট করে বললো,,”হোয়াট?কি বলতে চাইছিস?তোর পছন্দ করা মানে?”

নীল কথা এড়িয়ে যেতে বলে,,”কানে সমস্যা হয়েছে তোর।কি বললাম আর কি শুনলি।যাইহোক অতি দ্রুত একজন নাক কান গলা স্পেশালিস্টের কাছে তোকে নিয়ে যেতে হবে।না হলে এরকম বয়রাকে কেউ বিয়ে করতে আসবে না।না জেনে বিয়ে যদিও বা করে।বিয়ে করে এক গাড়িতে করে নিয়ে যাবে। ঘন্টা খানেক পরে অন্য গাড়িতে পাঠিয়ে দিবে।”

জারা নাক মুখ কুঁচকে বললো,,”নীলের বাচ্চা।”

নীল জারার চুল ধরে টান দিয়ে বলল,,”আমি তোর থেকে গুণে গুণে আট বছরের বড়।তাই সম্মান দিয়ে কথা বলবি।”

জারা মুখ ভেংচি কে’টে চলে যায়। নাতাশা জারার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো। নাতাশা ঘাড় তুলে জারার দিকে তাকায়। কপাল কুঁচকে বলে,,”খালামনি।আ্যই খালামনি।মামার বিয়ে খাবো কখন?”

জারা নাতাশার দিকে তাকালো।মজার ছলে বলল,,”বিয়ে আবার খায় কিভাবে?নাতাশা বেবি।”

নাতাশা দুইহাত কোমড়ে রাখল। ছোট ছোট চোখ করে চাইল। ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,,”খায় তো।এইতো কিছুদিন আগেই তো আমি নানুভাই আর নানুমনির সাথে বিয়ে খেয়ে আসলাম।তুমি ভুলে গিয়েছো?”

জারা মৃদু হাসলো।কিছুটা দূরে লিয়াকে গাড়ির সামনে দেখতে পেলো মূহূর্তেই হাসিটা মিইয়ে গেলো।নাতাশার দিকে ঝুঁকে ম্লান মুখে ক্ষীন আওয়াজে বলতে থাকে,,”তোমার মামার বিয়ে তো অলরেডি হয়ে গিয়েছে।”

জারার কথার মাঝেই নাতাশা একগাল হেসে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললো,,”তাই!ওয়াও!তাহলে তো মামী এখন আমাদের সাথে থাকবে।নানুমনি তো বলেছিলো মামার বিয়ের পর থেকে মামী আমাদের সাথেই থাকবে।কি মজা!এখন থেকে ভালো আন্টি আমাদের সাথে থাকবে।!”

জারা ভারী গলায় বলে,,”ওহ্ সোনা!ভালো আন্টি নয়।মিষ্টি হলো তোমার মামার বউ।”

“ওহ্!”

ঠোঁট উল্টিয়ে একশব্দে কথাটা বলে । অতঃপর নাতাশা জোরে ডেকে বলে উঠলো,,”আ্যই মিষ্টি আন্টি।”

লিয়া গাড়িতে উঠবে বলে পা দিবে সেই মুহূর্তে নাতাশার ডাক শুনে থেমে যায়।নাতাশা দৌড়ে যায়।দুইহাতে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে।।লিয়া তাল সামলাতে না পেরে খানিকটা পিছিয়ে যায়।নাতাশা লিয়ার দিকে তাকিয়ে চমৎকার হাসে। মিষ্টি করে আদূরে গলায় বলে,,”খালামনি বলছিলো তুমি আমার মামার বউ।তাহলে তুমিই আমার মামী।”

লিয়ার মনের ভেতরে অনুভূতির ঝড় বইতে থাকে। তবুও লিয়া বাইরে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে রাখে।বাহিরে বেশ কাঠিন্যতার ছাপ ফুটিয়ে রেখে।লিয়া নির্বিকার থাকে।জারিফ পার্কিং লনে আসে। ওদের গাড়ির কাছে যাবে।সেইসময় লিয়া আর নাতাশাকে দেখতে পায়।লিয়া জারিফকে দেখতে পাওয়ার সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। নাতাশা আবেদনময়ী কন্ঠে ফের বলতে থাকে,,”মামী তুমি আমাদের সাথে যাবে না?ঐতো মামার গাড়ি। চলো।আমি তোমার কাছে বসবো,হ্যা।আর মামী আমাকে কিন্তু এত্ত এত্ত আদর করতে হবে।যেমন আমার মামা আদর করে। অনেননননক।”

শেষের কথাটা দুইহাত মেলে ধরে দেখিয়ে টেনে বলে।লিয়া নাতাশার কথা এড়িয়ে যায়। আলতোকরে নাতাশার দুইগালে হাত রাখে। খানিকটা ঝুকে নাতাশার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।তারপর মৃদুস্বরে ঠোঁট আওড়ালো,,”ভালো থেকো কিউটিপাই। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সবসময় সুস্থ রাখুক।ভালো রাখুক।তোমার জন্য এত্ত এত্ত দোয়া রইলো।”

কথাগুলো বলে লিয়া নিজেকে নাতাশার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। অতঃপর দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে।সবাই গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করে।লিয়ার বাবার পাজেরো গাড়িটা শাশা শব্দে শহরের পিচঢালা পথ দিয়ে যেতে থাকে। উল্টো পথে জারিফের টয়োটা গাড়িটা গন্তব্যের দিকে ছুটছে।
.
বিয়ে বাড়িতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।সবারই চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।রাজিয়া সুলতানা মেয়ের পাশে বসে এটা সেটা বুঝিয়ে যাচ্ছেন আসার পর থেকে। স্বামীর কড়া নির্দেশ লিয়াকে রাজি করানো।লিয়া মূর্তির মত বিছানার হেডের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।কোনো কথায়ই সাড়াশব্দ নেই।আসার পর থেকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েও যখন মেয়ের মুখ থেকে পজেটিভ উত্তর মিললো না।সেই সময় বি’র’ক্ত হয়ে রাজিয়া সুলতানা রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত্রি নয়টা বাজতে চললো।এইতো কিছুক্ষণ আগে এনামুল খাঁন এসে শাসিয়ে গেলেন।আর ঘন্টা খানেক দেখবেন। অতঃপর জারিফের বাবার কাছে ফোন দিয়ে পজেটিভ মতামত দিবেন।লিয়া যেনো কোনো বাড়াবাড়ি না করে।ধমকিয়ে বেশ শাসিয়েই গেলেন।লিয়া বিছানা থেকে নেমে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নিচে গেলো।নিচে দক্ষিণে দাদিমনির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,,

“দাদিমনি আসবো?”

জান্নাত বেগম কিছুক্ষণ আগেই এশার নামাজ শেষ করে একটা চেয়ারে বসে আঙ্গুলের সাহায্যে তাসবিহ গুনছিলেন। বয়সের ভারে অতটা পথ জার্নি করে শহরের কমিউনিটি সেন্টারের হলুদ প্রোগ্রামে জাননি।তবে সবটাই শুনেছেন।ছেলে আর ছেলের বউদের মুখ থেকে।সবকিছু শুনে নির্বাক আছেন।মাথাটা তুলে দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়ানো অষ্টাদশী লিয়াকে দেখে কন্ঠে একরাশ স্নেহ জড়িয়ে বললেন,,”আসো।ভেতরে আসো ছোটো আপা।”

লিয়া ভেতরে যায়। ফ্লোরে বসে পড়ে। দাদিমনির কোলের উপর মাথাটা রাখে। জান্নাত বেগম একহাত লিয়ার মাথায় রাখেন। স্নেহের হাত বুলিয়ে আদরমাখা গলায় বললেন,,”এই লিয়া কিছু বলবি?আমার ছোটো আপার নিশ্চয় কোনো বড়সড় আবদার আছে।”

লিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। ঠোঁট প্রসারিত করে বলে উঠলো,,”দাদিমনি আমি এই সম্পর্কটা আগাতে চাইনা। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কিছু কখনোই কাংখিত কোনো ফল বয়ে আনে না।আর এই বিয়েটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।আমি চাই তুমি আব্বুকে বুঝিয়ে বলো।তুমি বললে আব্বু তোমার কথা ফেলতে পারবে না। কালকের বিয়ের প্রোগ্রাম এসব বাদ দিতে বলো।আর এও বলো দ্রুত সমঝোতা করতে।এই জোর করে হওয়া তথাকথিত বিয়েটার সমাধান করতে।নামে মাত্র বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে।”

জান্নাত বেগম লিয়ার চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,,”বিয়ে শাদি কি এতটাই খেলনা ছোটো আপা?মন চাইলো না আর ভেঙ্গে দিলাম। একটা সম্পর্ক ভাঙ্গা সহজ তবে গড়াটা খুবই কঠিন।”

লিয়া দাদিমনির দিকে মুখ তুলে তাকায়। তড়িৎ বলল,,”সম্পর্ক যেখানে তৈরিই হয়নি সেখানে ভাঙ্গার প্রশ্নই আসে না দাদিমনি।জোর করে কখনো সম্পর্ক হয়না।আর দূর্ঘটনা সব সময় দূর্ঘটনাই সেটাকে মন থেকে মেনে নেওয়া যায়না।চাপে পরে পরিস্থিতির কাছে হার মেনে হয়তো মানিয়ে চলতে হয়। সেটা শুধু লোক দেখানো। সেখানে ভালোবাসা থাকে না।সেখানে থাকে শুধু দয়া দক্ষিণা।”

লিয়া একটু থামে। খানিকটা সময় নিয়ে ধরে আসা গলায় ফের বলে,,”দাদিমনি তুমি নিশ্চয় চাইবে না। তোমার নাতনি সারাজীবন অন্যর দয়ায় থাকুক।কেউ তাকে দয়া করে বউ হিসেবে মেনে নিয়েছে।দয়া করে সারাজীবন বোঝা হিসেবে বয়ে বেড়াবে।কখনো ভালোবেসে নয়।”

জান্নাত বেগম মৃদু হাসলেন।যা লিয়ার দৃষ্টিগোচর হলোনা। শান্ত গলায় ফের বললেন,,”আজ ভালোবাসা নেই।তবে ভালোবাসা তৈরি হতে কতক্ষন ছোটো আপা।আর বিয়ে হলো এমন একটা পবিত্র বন্ধন।যেখানে আপনা আপনি মহব্বত ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।যে বন্ধনে ভালোবাসা দিনদিন ফিকে হয়না বরং গাঢ় হয়। সন্তান সন্ততির মাধ্যমে বন্ধন আরো মজবুত হয়।তাই বলছি ছোটো আপা আরেকটু ভেবে দেখলে হয়না?”

লিয়া চোখ বন্ধ করলো। দুইচোখের কার্নিশ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।ভেজা গলায় ঠোঁট আওড়ালো,,”দাদিমনি এসবের জন্য উনি আমাকেই দোষারোপ করেন।ওনার মতে সেদিন যদি আমি ওনার সাথে না থাকতাম তাহলে এই দূর্ঘটনা ঘটতো না।”

লিয়া নাক টেনে নিয়ে ফের ক্ষীন আওয়াজে বলতে থাকে,,”অবশ্য ওনার কথাটাও ফেলনা নয়।ঠিকই তো বলেছেন আমিই দায়ী।আর আমিই যেহেতু দায়ী।তাই এই ভুলটা শুধরে নেওয়ার দায়িত্বটাও আমারই। প্লিজ দাদিমনি আব্বুকে বোঝাও।”

জান্নাত বেগম অনেকটা সময় নিয়ে ভাবলেন।কিছুক্ষণ নিরব থাকলেন। অতঃপর কাজের মেয়েটাকে ডেকে ছেলে আর ছেলের বউদের এখানে উপস্থিত হতে বললেন।একএক করে সবাই উপস্থিত হলো।সবাই উৎসুকভাবে আছে।কি বলবেন তা জানার জন্য। অবশেষে জান্নাত বেগম গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন,,”মেজো খোকা আমি চাইবো লিয়াকে জোর না করতে।”

এনামুল খাঁন অবাক হয়ে তড়িৎ বললেন,,”কি বলছো মা?তারমানে লিয়ার কথামতো এখন বিয়েটা ভাঙ্গতে হবে।”

জান্নাত বেগম গম্ভীর গলায় ফের বললেন,,”আহ্! আমার কথা শেষ করতে দাও।হুট করেই কখনো কোনো চরম পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয়না।এখন লিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।আবার লিয়ার কথামতো এখনই একটা চরম সিদ্ধান্তেও উপনীত হওয়া যাবে না।রয়েসয়ে, ভেবেচিন্তে যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।তাই আমি বলছি,কালকের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দাও।আর লিয়াকে আরো সময় দেওয়া হোক।লিয়ার পরিক্ষা অব্দি এভাবেই থাক।তিনমাস সময় পাবে লিয়া ভাববার জন্য।তিনমাস পরেও যদিও লিয়া আজকের অনুরূপ কথা বলে।তবে তাই হবে।”

কিয়ৎক্ষন থেমে ফের স্পষ্ট করে বললেন,,”সবার কথাশুনে যা মনেহলো,ছেলেটারও তো মতামত ছিলো না।আর না থাকারই কথা। সেখানে বিয়ের দোহাই দিয়ে আমাদের মেয়েকে চাপিয়ে দিতে পারিনা।লিয়া জারিফ এই তিনমাস ভেবে দেখবে। অতঃপর যদি ওরা বিয়েটা মেনে নিতে নাই পারে।তবে আমি নিজে দাঁড়িয়ে সমঝোতা করে দেবো।আমি যেটা বললাম।সেই কথাটা ফোন করে ওবাড়িতে জানিয়ে দাও।আমি আশাকরবো এর বাইরে তোমরা কেউ কিছু বলবে না।আর নাতো লিয়াকে কোনো চাপ দিবে।”

অবশেষে লিয়া কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে জান্নাত বেগমের দিকে তাকায়।লিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস তিনমাস কেনো? তিন বছর পরেও জারিফ এই সম্পর্কটা মেনে নিবে না।তাই এখন থেকেই মনটাকে সেই ভাবেই কঠোর করে গড়ে তুলতে হবে। অবশেষে জান্নাত বেগমের কথাগুলো ওবাড়িতে জানিয়ে দেওয়া হয়। ফোনকলের মাধ্যমে।
.
ডায়নিং এ বসে আছে সবাই। আনোয়ার রহমান,নীল,জারা।সাথে জারিফের একমাত্র ফুপু কল্পনা বেগম।বিয়ে উপলক্ষে আজকেই আসছে।
জারিফ এসে চেয়ার টেনে বসতেই আনোয়ার রহমান সবটা বললেন। ওবাড়ি থেকে একটু আগে ফোনে যা যা বলেছে সেইসব।তবে সেসবে জারিফের কোনো ভাবান্তর নেই। জারিফ ভাবলেশহীন আছে। নিরুপমা বেগমকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। দাঁড়িয়ে জগ থেকে পানি ঢালছেন আর মনেমনে ভাবছেন,ইশ!কি থেকে কি হয়ে গেলো।কোথায় ভেবেছিলাম জারিফের বিয়েটা হবে।এদিকে নীলের পড়াশোনা শেষ হয়ে কোনো চাকরি বাকরিতে ঢুকলেই।জারিফকে দিয়েই লিয়ার সাথে নীলের বিয়ের প্রস্তাব দিবো।বাড়ির বড় জামাই প্রস্তাব দিলে ওনারা নিশ্চয় ফেলতে পারতেন না। উফ্!এদিকে তো সব এলোমেলো হয়ে গেলো।ভারী মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে আমার নিজের বউমা করতে খুব ইচ্ছে হয়ছিলো।ধ্যাত কি থেকে কি হয়ে গেলো।নিরুপমা বেগমের ভাবনার ছেদ ঘটে জাহানারা বেগমের ডাকে,,

“এই ছোটো।কি এতো ভাবছিস বলতো। গ্লাস ভরে পানি উপচেপড়ে টেবিল ভেসে যাচ্ছে।আর তুই কিসের ধ্যানে আছিস বলতো?”

নিরুপমা বেগম নিজেকে তটস্থ করে হাত থেকে কাঁচের জগটা নামিয়ে রাখে। অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠে,,”এইরে খেয়াল করিনি।আসলে লিয়ার কথা ভাবছিলাম।”

লিয়ার নাম শুনতেই জাহানারা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন,,”বাদ দে ঐ মেয়ের কথা।ঐ মেয়ের জিদ দেখলি।পরিবারের সবাই বলল।অথচ তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়লো না।তিনমাস পরেও যে একই সিদ্ধান্তে থাকবে সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। তাই ঐ মেয়েকে নিয়ে আমি আর কিছুই ভাবতে পারবো না।”

কল্পনা বেগম ফোড়ন কে’টে বলে উঠলেন,,”বাদ দাও তো ভাবী।ভাত ছিটালে যেমন কাকের অভাব হয়না।ঠিক তেমনি মেয়ের অভাব হবে না।আমাদের হিরের টুকরো ছেলে জারিফ।তারজন্য কখনো উচ্চ শিক্ষিত, সুন্দরী মেয়ের অভাব হবে নাকি?আর মেয়েটাও তো বেশি শিক্ষিত না। ইন্টার পাশ করেনি।এসব বাদ দাও।বড় মেয়েটা তাও জারিফের জন্য উপযুক্ত ছিলো। ডক্টর ছিলো।তাই বলছি আমাদের এই মেয়েকে নিয়ে আর না ভাবাই উত্তম। তারচেয়ে বরং যতদ্রুত ঝামেলা গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।আমার জারিফ বাবার জন্য যোগ্য মেয়ে আমি নিজে খুঁজে দিবো,হু।”

নীল বিড়বিড় করে বললো,এইরে ফুপ্পি তো আগুনের মধ্যে কেরোসিন তেল ঢালার উস্তাদ।একদম বড়মাকে উস্কে দিচ্ছে।নীল গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো,,
“তা ফুপ্পি কিযেনো বলছিলে। ওহ্!মনে পড়েছে।লিয়া বেশি শিক্ষিত না। ইন্টার পাশ করেনি।তা বলি ফুপ্পি লিয়ার বয়স কত জানো তুমি?লিয়া সবে আঠারোতে পা দিয়েছে।আর সামনে ও এইচএসসি দিবে।বয়স অনুযায়ী পড়াশোনা সব ঠিক আছে।আর পড়াশোনায়ও ভালো।আঠারো বছর বয়সে কি ও এমবিএ কমপ্লিট করবে নাকি?আজব!তোমার ভাতিজার তো ছাব্বিশ বছর চলছে। মাস্টার্স এখনো শেষ হয়নি।”

নীলের কথাটা কল্পনা বেগমের গায়ে লাগে।মুখটা চুপসে যায়।মুখ কাচুমাচু করে ফেলেন। জারা মিটমিট করে হাসছে।জাহানারা বেগম নীলকে বললেন,,”আহ্!নীল হচ্ছে টাকি। চুপচাপ খাবার খাতো।”

কল্পনা বেগম ফের ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠলেন,,”যতই বলো ভাইজান।ঐ মেয়ে বড়দের সামনে যেভাবে কথা বললো। সেটা আমি মেনে নিতে পারছিনা।আর আমাদের বাড়ির ছেলেকে কিনা মুখের উপর প্রত্যাখ্যান করলো। নাহ্!এটা কিচ্ছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।তুমিই বলো মানা যায়?”

উফ্!আবার শুরু করলো।এই ফুপ্পি তো দেখছি দমবার পাত্রী নয়। নিজের মেয়ের সাথে ব্রো এর বিয়ে দিতে চেয়েছিলো।সেটা তো আর হয়নি।তাই এখন কিভাবে উস্কে দেওয়া যায় তাই করছে। উফ্!এসব কথা মনেমনেই আওড়ায় নীল। আনোয়ার রহমান কল্পনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে শান্ত গলায় বললেন,,”আসলে মেয়েটা ছোটো।কতই বা বয়স।ওর কথা ধরলে চলে।আর সবার মনের অবস্থা তো জানা যায়না।মেয়েটার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো না কোনো কারন থাকতেই পারে।কারো আচরণের জন্যও হয়তো বা এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে পারে।”

শেষের কথাটা জারিফের দিকে তাকিয়ে বলেন।কথাটা কিছুটা হলেও জারিফের গায়ে লাগলো।এরমধ্যে কল্পনা বেগম ফোড়ন কাটল ঠোঁট আওড়িয়ে ফের বলল,,”আরে ভাইজান কোনো কারন যে আছে তা আমি শতভাগ নিশ্চিত।এখনকার মেয়েছেলে।কোনো যায়গায় লাইন টাইন আছে হয়তো।অন্যকারো সাথে সম্পর্ক আছে। সেইজন্যই হয়তো এই বিয়ে মানতে চাইছে না।”

কথাটা জারিফের কাছে মোটেই ভালো লাগলো না। ফুপ্পিকে সম্মান করে তাই সহজেই কিছু বলতে পারলো না।আবার কেনো যেনো একদম চুপ করেও থাকতে পারলো না। মুখশ্রীতে বিরক্তবোধটা নিয়ে বলে উঠল,,”স্টপ ফুপ্পি। প্লিজ স্টপ দিস।তখন থেকে একই কথা ভালো লাগছে না।”

এতটুকু বলে খাবার রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় জারিফ।হাত ধুয়ে গটগট করে রুমে চলে যায়।

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here