রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭৯| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
617

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭৯|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

কেটে গেছে আরও তিনটে দিন। অর্পণ ইরার বিয়ে দিন একেবারেই এগিয়ে এসেছে৷ কাল মেহেন্দি। ডেকোরেশনের সকল কাজ পুরোপুরি হয়ে এসেছে৷ মালঞ্চ নীড় আজ রঙ বেরঙে সেজে উঠেছে৷ রঙিন মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো বাড়িটা। বাগানে ফুল গাছগুলোর উপর মরিচ বাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ বাড়ির সৌন্দর্য যেন আরও অধিক বেড়েছে৷ শিকদার বংশের ছোটো ছেলের বিয়ে বলে কথা৷ চারদিন আগে থেকে সবকিছু মেতে উঠেছে। বিয়ের সকল কেনাকাটাও হয়ে গিয়েছে। ইরার জন্য প্রত্যেকটা রিচ্যুয়ালসের আলাদা আলাদা শাড়ি‚ লেহেঙ্গা অনেক ধরনের অর্নামেন্টস নেওয়া হয়েছে৷ সেই সঙ্গে ম্যাচিং করে অর্পণের জন্য পাঞ্জাবি‚ শেরওয়ানি নেওয়া হয়েছে৷ বাকি সদস্যরাও প্রচুর শপিং করেছে। অর্পণের খালামণির পরিবার আর মামার পরিবার কালই চলে এসেছেন। আজ মাধুরীর মা আর ভাই পরিবার সমেত এসেছে। গুলবাহার অনেকদিন পর মেয়ের বাড়িতে এসেছেন। আত্মীয়স্বজন আর শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও নিমন্ত্রণ করা হয়েছে৷ আজ হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়েছে অর্পণ। পুরো এক সপ্তাহের ছুটি চেয়েছিল এবার। এমনিতে খুব একটা ছুটির প্রয়োজন হয় না তার৷ ছুটির আবেদন এপ্রুভ হয়েছে আজ সকালেই। এরই মাঝে অর্পণের ফোনে মৃত্তিকার কল এলো। সে এতক্ষণ ইরার কলের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাত হয়েছে৷ কিছুক্ষণ আগেই খাবার খেয়ে নিজের ঘরে শুতে এসেছে অর্পণ। এই মুহূর্তে কোনো কাজের ব্যস্ততা না থাকায় অর্পণ সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ করল। সে কিছু বলবে তার আগেই অপরপ্রান্ত হতে মৃত্তিকার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো৷ মৃত্তিকা বলছে‚

“কাজটা কী তুমি ঠিক করেছ ভাইয়া?”

প্রথমত না বুঝেই অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “আমি কী করেছি বোন?”

“আমার জন্য শুধু শুধু টাকা নষ্ট করেছ তুমি। এগুলো কেনার কোনো প্রয়োজন ছিল না।”

“বিয়ে আর রিসেপশনের দিন ওগুলো তোকে পড়তেই হবে। আমি কোনো বারণ শুনব না। তুই আমাকে প্রমিজ করেছিস— আমি যা বলব সব শুনবি।”

মৃত্তিকা বুঝল তার ভাই কেন এমনটা করছে৷ কিন্তু সে যে অতীত পানে ফিরে চাইবে না। না প্রলয়কে ক্ষমা করবে। অর্পণ এহেন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা কিছুতেই যে সফল হবে না। মৃত্তিকা এবার অর্পণকে বলল‚ “এ কোথায় ফাঁসিয়ে দিলে ভাইয়া?”

কথাটা শেষ হতেই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেল মৃত্তিকা৷ সে বুঝল তার এমন অবস্থার জন্য মজা লুটছে তার ভাই। হাসি থামিয়ে অর্পণ বলল‚

“ম্যাজেন্টা রঙা লেহেঙ্গাটা বিয়ের দিন পড়বি আর হালকা গোলাপিটা রিসেপশনের দিন পড়বি— কেমন?”

“কাজটা তুমি মোটেও ঠিক করলে না৷”

“চুপ থাক! আমি তোর বড়ো নাকি তুই আমার বড়ো? আমি যেটা ভালো মনে করব সেটাই আমার বোনের জন্য করব। এটা নিয়ে নো মোর ওয়ার্ডস।”

এই নিয়ে আর কথা বাড়াল না মৃত্তিকা৷ অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “কাল আসছিস তো?”

“না এসে উপায় আছে?”

“আচ্ছা শোন আন্টিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসিস। আর হ্যাঁ— শাড়ি দুটো কী আন্টির পছন্দ হয়েছে?”

“মামনি বলছেন অহেতুক কেন এত খরচা করতে গেলে!”

“কেন আমি কী উনাকে কিছু দিতে পারি না? জানিস বোন— উনাদের কাছে আমি খুব ঋণি। কারণ উনাদের জন্যই তোকে দ্বিতীয়বার পেয়েছি৷ উনার সঙ্গে আমার কথা বলিয়ে দিস৷”

“আচ্ছা।”

“কাল সময়ের আগেই চলে আসবি৷ আমার বিয়ের প্রত্যেকটা রিচ্যুয়ালসে তুমি প্রাণ ভরে নাচবি৷ আমি ভাইয়ের থেকে শুনেছি‚ তুই নাকি আগের থেকেও ভালো নাচিস! আমি চাই আমার বিয়েতে সবাই খুব বেশি আনন্দ করুক৷”

“আচ্ছা! তুমি যা যা ভেবেছ সব হবে৷ আমি সকলের আগেই চলে আসব৷ আমি তো কনে পক্ষ। ইরার বান্ধবী।”

মৃত্তিকার শেষের কথাটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল অর্পণের। সে বলল‚ “কী ভাগ্য আমার!”

অর্পণের কথার মর্মার্থ বুঝতে পারল না মৃত্তিকা। তাই সে জিজ্ঞেস করল‚ “তোমার আবার কী হলো ভাইয়া?”

“আমার বোনটাকে মিথ্যে পরিচয়ে আমার বিয়েতে অ্যাটেন্ড করতে হচ্ছে। অথচ তারই অধিকার ছিল সবথেকে বেশি আনন্দ করার।”

“ওসব কথা মনে করে মন খারাপ করার কোনো মানেই হয় না। আমি কাল সঠিক সময়ে চলে আসব ভাইয়া।”

“আমার আরেকটা কথা রাখবি বোন?”

“আবার কী কথা”

“তুই আবার আমাদের বাড়িতে ফিরে আয় না। অন্ততপক্ষে বিয়ের এই কটা দিন?”

“এই নিয়ে তুমি আমাকে জোর কোরো না ভাইয়া৷ আমি সত্যিই ক্লান্ত! তবে তুমি চিন্তা কোরো না৷ আমি মালঞ্চ নীড় ফিরব তবে থাকার জন্য নয়৷ শুধুমাত্র তোমার বিয়ে অ্যাটেন্ড করার জন্য।”

“তোর যেভাবে ভালো লাগবে তুই সেটাই কর৷ আমি তোকে আর কোনো কিছুতে জোর করব না।”

এরই মাঝে মৃত্তিকার ফোনে তার কাজের জায়গা থেকে ক্রমাগত কল আসছে৷ তাই সে কিছুটা তাড়া দিয়ে অর্পণকে বলল‚

“আমার কলিগের নাম্বার থেকে কল আসছে৷ তুমি ওখান থেকে কল কেটে দাও ভাইয়া৷ আমাদের পরে কথা হবে ইনশাআল্লাহ।”

অর্পণ ‘টাটা’ বলে নিজে থেকেই কল কেটে দিল। কাজের জায়গা থেকে আসা কল রিসিভ করল মৃত্তিকা। অর্পণের বিয়ে উপলক্ষে সে-ও চারদিনের ছুটি চেয়েছে৷ সে ছুটি চেয়েছিল সকালে আর এই লোক তাকে রাত দেড়টার কাছাকাছি সময় এসে কল করছে। এমনিতে সে এখানে জয়েন করেছে খুব বেশিদিন হয়নি। এখনই ছুটি চাওয়াতে হয়তো তারা খুবই বিরক্ত তার উপর৷ কিন্তু সে যে তার ভাইকে প্রমিজ করেছে— বিয়ের প্রত্যেকটা রিচ্যুয়ালসে সে থাকবে৷ ফোনের অপরপ্রান্তে হতে লোকটা বলছে‚

“ঠিক কী কারণে আপনার এখন ছুটির প্রয়োজন হলো? আপনি এখানে সবে সপ্তাহ খানেক সময় হলো জয়েন করেছেন‚ পরপরই আবার ছুটি। একদিন হলেও মানা যায়! আর আপনি তো পুরো চারদিনের ছুটি চেয়ে বসে রয়েছেন।”

“একচুয়্যালি স্যার আমার খুবই কাছের একজনের বিয়ে৷”

“বিষয়টাকে আপনাকে এক্সপ্লেইন করতে হবে৷”

লোকটার প্রতি বেজায় বিরক্ত হলো মৃত্তিকা। এই লোককে নাকি আবার সবকিছু এক্সপ্লেইন করতে হবে! মৃত্তিকা বলল‚

“একচুয়্যালি স্যার— এমপি সেহরিশ আরশান প্রলয়ের চাচাতো ভাইয়ের বিয়েতে আমাকে অ্যাটেন্ড করতেই হবে৷”

মৃত্তিক্র মুখে প্রলয়ের কথা শুনে কিছুটা যেন নরম হলেন লোকটা৷ মুখে বললেন‚ “উনারা কী আপনার রিলেটিভস হয়?”

“না স্যার! উনার ভাইয়ের হবু স্ত্রী আমার বান্ধবী হয়।”

“ওহ তাহলে এই কথা! তুমি এক সপ্তাহের মতো ছুটি নিতে পারো।”

এরই মাঝে লোকটার ভোলই যেন পাল্টে গেল। কিছুটা হলেও ভূমির সঙ্গে তো ভালো ব্যবহার করলেন। মৃত্তিকা এবার বলল‚

“আমার শুধুমাত্র চারদিনের ছুটির প্রয়োজন। বেশি দিনের ছুটি আমার কোনো কাজে আসবে না।”

“তাহলে তোমার যেভাবে ভালো মনে হয়।”

এই বলে লোকটা কল কেটে দিলেন৷ তার মানে মৃত্তিকা ছুটি পেয়ে গিয়েছে৷ এখন অন্তত সে কিছুটা নিশ্চিন্ত। আরামসে ভাইয়ের বিয়ে খেতে পারবে। যেহেতু সে অর্পণের বিয়েতে অ্যাটেন্ড করছে। তার মানে প্রলয় এবং তার পরিবারের সঙ্গেও দেখা হতে যাবে৷ এ কথা ভাবতেই মাথায় যেন সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে৷ ওই মানুষগুলোর সামনে তো সে আর কোনো দিনও যেতে চায়নি। সমস্ত চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে মৃত্তিকা বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে চলে এলো। অর্পণের দেওয়া উপহার গুলো ঘরের সিঙ্গেল সোফার উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ পার্সেলগুলো বিকেলে এসেছে। সে ব্যস্ত থাকায় কল করে জানানো হয়নি। তার আর তনুজার জন্য গিফট পাঠিয়েছিল অর্পণ। মৃত্তিকা সেগুলোকে গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখল। তার ভাই ভালোবেসে তার জন্য এই প্রথম কিছু কিনে দিয়েছে৷ প্রথমে মনটা খুঁতখুঁত করলেও এখন সে প্রচণ্ড খুশি। মৃত্তিকা গিয়ে বিছানার কোণে বসল। খাবার আর ঔষধ খেয়ে তনুজা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। মৃত্তিকা গিয়ে শুয়ে পরল তনুজার পাশে৷ তার অবশ্য এখন ঘুম আসছে না। তবে রাত তো বাড়ছে৷ ঘুমতে তো হবেই। মৃত্তিকা চোখ বন্ধ করে ঘুমনোর চেষ্টা করল৷ এভাবেই অতিবাহিত হল মিনিট দশেক। না! মৃত্তিকার চোখে এখনো নিদ এসে হানা দেয়নি। এরই মাঝে বেহায়া ফোনটা বেজে উঠল। দৈবাৎ চোখ মেলে তাকাল মৃত্তিকা৷ এই রাতের বেলায় কে তাকে স্মরণ করল সেটাই দেখার জন্য ফোনটা হাতে নিল! সময় রাত দেড়টা। এত রাতে এক অচেনা নাম্বার থেকে কল আসছে। প্রথম কল রিসিভ করল না সে। পরপরই দুই তিনবার এভাবে কল বেজে কেটে গেল৷ এবার না পারতেই মৃত্তিকা কল রিসিভ করল। কিছু ওপাশ থেকে কারো কণ্ঠস্বর তো দূর আওয়াজ এলো না৷ মৃত্তিকা পরপর কয়েক বার জিজ্ঞেস করল‚

“হ্যালো কে বলছেন?”

তারপরও ওপাশ থেকে কোনো কথারই উত্তর এলো না। মৃত্তিকা অপেক্ষা করল। কিন্তু কোনো স্বরই এলো না অপর প্রান্ত থেকে। সে বিরক্ত হয়ে অত্যন্ত তেজি স্বরে আবারও বলল‚ “অসভ্যের মতো রাতবিরেতে মেয়েদের বিরক্ত করতে লজ্জা করে না? দ্বিতীয়বার কল করলে‚ আপনাকে দেখে নেব।”

এই বলে কল কেটে দিল মৃত্তিকা। মিনিট পাঁচেক সময় পর একই নাম্বার থেকে আবারও কল এলো। রাগ তখন তুঙ্গে চড়ল। কল রিসিভ করেই আরও চারটে কড়া কথা শুনিয়ে দেবার জন্য উদ্যত হলো মৃত্তিকা৷ তবে অপর প্রান্ত থেকে এক শান্ত‚ ভারী কণ্ঠস্বরে থমকাল সে। এ কণ্ঠস্বর যে‚ তার বহু চেনা। চুপটি করে শুনতে লাগল‚

“ভূমি কন্যা… ভূমি কন্যা… ভূমি কন্যা… ভূমি কন্যা…!”

ঘুমের ঘোরে প্রলয়ের পাগলের বিলাপ। মৃত্তিকা শুনল। কথা বাড়াল না। সে শুনতে চায়। কিন্তু আর কোনো কথা কানে এলো না। ফোনটাকে আবারও চোখে সামনে রাখল। না! প্রলয় এখন কল কেটে দেয়নি। ভারি নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ আচ্ছা লোকটা কী ঘুমের ঘোরে তাকে কল করেছে? লোকটা তার নাম্বার পেল কোথায়? তার নাম্বার তো অর্পণ ছাড়া আর কারো কাছে নেই৷ তাহলে কী অর্পণের থেকে নাম্বার জোগাড় করেছে? মৃত্তিকা তাড়াহুড়ো করে কল কেটে দিল৷ দ্বিতীয়বার মনে প্রলয়ের প্রতি সফট কর্ণার তৈরি হতে দেবে না সে৷ এবার সে মালঞ্চ নীড় যাবে শুধুমাত্র মহুয়া আর তার অনাগত মৃ’ত সন্তানের মৃ’ত্যুর প্রতিশোধ নিতে। তার আর কোনো পিছুটান নেই। সমস্ত পিছুটান এক বছর আগেই চুকিয়েছে সে।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here