রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭৮| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
217

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭৮|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে অর্পণ। ইরার নাম্বার ডায়াল করছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না৷ বারবার ব্যস্ত দেখাচ্ছে৷ হয়তো তার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলছে৷ শাহাদাৎ মোড়ল‚ নাজমা আর আরশ দুপুরের দিকে গ্রামে ফিরে গিয়েছে৷ বিয়েরও তো একটা জোগাড় রয়েছে। তবে ইরার বিয়েটা গ্রামে হচ্ছে না। ঢাকাতেই একটা কমিউনিটি সেন্টার বুকড করা হয়েছে৷ প্রলয়ই বুকড করেছে সেটা। আর ইরার পরিবার আত্মীয় স্বজনরা এসে থাকবেন হোটেলে। চারদিনের জন্য। কমিউনিটি সেন্টার থেকে হোটেল প্রায় সামনেই। কাল থেকে বিয়ের কেনাকাটা শুদ্রু করে দেওয়া হবে৷ ইরাকে কলে না পেয়ে বিরক্ত হলো অর্পণ। এই নিয়ে সাতবার কল করেছে৷ প্রতিদিন তো এই সময়টাতেই দুজনের প্রেমালাপ হয়৷ তবে আজ কেন এত ব্যস্ততা দেখাচ্ছে ইরা? অর্পণ ফোন ঘেটে মৃত্তিকার জন্য দুটো লেহেঙ্গা অর্ডার করল। এটাই তার বোনকে দেওয়া প্রথম উপহার তার পক্ষ থেকে। বিয়ে আর রিসেপশনের জন্য দুটো লেহেঙ্গা সে মৃত্তিকাকে উপহার দিতে চায় সে৷ ইরাকে তো সে নিজে পছন্দ করে শপিং মল থেকে কিনে দেবে৷ মৃত্তিকাকে তো এখনই কারো সামনে আনা যাবে না। আসল ধামাকা তো শুরু হবে মেহেন্দির অনুষ্ঠান থেকে৷ মিনিট পাঁচেক সময় পর ইরা নিজে থেকে কল করল৷ সঙ্গে সঙ্গেই অর্পণ কল রিসিভ করল। তার বিরক্তি নিমিষেই উবে গেছে। সে তো এই অপেক্ষাতেই ছিল। ফোন কানে নিয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“কী করছিলে বউ?”

“আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি মশাই। আর আমি বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম।”

“হতে কতক্ষণ? আর মাত্র এক সপ্তাহ। তারপর থেকে তুমিই আমার একমাত্র বউ।”

“তো এই এক সপ্তাহ অপেক্ষা কর। তারপর থেকে বউ বলে ডাকবে।”

“আমার তো আর তড় সইছে না।”

অর্পণের কথার প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ হেসে ইরা বলল‚ “লুচু বদ লোক।”

“ওটা তো শুধু তোমার জন্য।”

সলজ্জে হাসল ইরা। অর্পণ আবারও বলল‚ “আচ্ছা ইরাবতী! বিয়েতে শাড়ি পড়বে নাকি লেহেঙ্গা?”

“শাড়ি আমি সামলাতে পারি না।”

“তাহলে মেহেন্দি‚ হলুদ‚ বিয়ে আর রিসেপশনে লেহেঙ্গা?”

“পাগল নাকি? প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে কেউ লেহেঙ্গা পড়ে?”

সঙ্গে সঙ্গে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “তাহলে?”

“শাড়ি লেহেঙ্গা মিলিয়েই পড়ব।”

“এই না বললে তুমি সামলাতে পারো না।”

“তাতে কী? বিয়ে কী আমরা বারবার করব নাকি? প্রত্যেকটা রিচ্যুয়ালসে আমার আলাদা আলাদা লুক থাকবে।”

“তুমি কমফোর্ট ফিল করবে তো?”

“হ্যাঁ করব। তোমাকেও পাঞ্জাবি‚ শেরওয়ানি পড়তে হবে৷”

“অবশ্যই। আমি খুব এক্সাইটেড— প্রথম বিয়ে কি-না!”

“আমি মোটেও এক্সাইটেড নই।”

অবাক হয়ে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “কেন?”

“কারণ এটা আমার পাঁচ নাম্বার বিয়ে।”

শেষোক্তটি রাগান্বিত স্বরেই বলল ইরা। অর্পণ এবার শব্দ করে হেসে উঠল। ইরাকে বলল‚ “এ বাবা! আমার ইরাবতী কী রাগ করেছে?”

“তো সে কী নাচবে?”

“অবশ্যই। বিয়ের প্রত্যেকটা রিচ্যুয়ালস এ আমরা কাপল ডান্স করব।”

“আমার লজ্জা লাগবে।”

“ভাইয়ের বিয়েতে নেচেছিলে কীভাবে?”

ইরা ভেবেছিল অর্পণ হয়তো সে কথা ভুলে গিয়েছে৷ তবে তার ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল তা অর্পণ নিমিষেই প্রমাণ করে দিল! ইরা বলল‚ “তখন তো পিচ্চি ছিলাম!”

ইরাকে আরেকটু রাগানোর জন্য অর্পণ বলল‚ “এক বছরে তুমি বুড়ি হয়ে গেলে?”

“তুমি কী এই রাতের বেলায় আমার ভুল ধরবে?”

বোকা স্বরে প্রশ্ন করল‚ “ভুল কোথায় ধরলাম?”

“জানি না। ঘুম পাচ্ছে আমার। অনেক কথা হয়েছে।”

“আমার ইরাবতী কী আবার রাগ করেছে?”

হাই তুলে ইরা বলল‚ “একদমই না৷ ভীষণ ঘুম পাচ্ছে৷”

“আচ্ছা তাহলে তুমি ঘুমোও। আমি রাখছি তাহলে।”

“হুম! তুমি এখন ফোন রেখে সোজা ঘুমবে। বিয়েতে যদি দেখেছি চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল তাহলে তোমার খবর আছে।”

“যথা আজ্ঞা বিবি সাহেবা।”

কল কেটে দিয়ে মৃত্তিকার নাম্বারে কল লাগাল অর্পণ। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ না হলেও মৃত্তিকা পরবর্তীতে কল ব্যাক করল৷ তনুজাকে ঔষধ খাইয়ে সবেই ঘুম পাড়িয়েছে সে৷ সুদর্শিনী তার স্বামী অর্ণবের সঙ্গে ফোনালাপে ব্যস্ত। কাল তার স্বামী ঢাকা ফিরছে৷ আবারও সংসারে ফিরে যেতে হবে সুদর্শিনীকে৷ এ কদিন খুব ভালো সময় কাটিয়েছে সে৷ মৃত্তিকা তার ফোন নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে এসেছে৷ ফোন কানে নিতেই অর্পণ সোজাসুজি বলে ফেলল‚

“বোন তোকে একটা কথা বলার আছে।”

“কী কথা ভাইয়া?”

“ইরার আর আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

ওদের বিয়ের কথা শুনে খুবই খুশি হলো মৃত্তিকা৷ ওরা একে অপরকে ভালোবাসা এটা তো সেই প্রথম থেকেই জানা৷ অতি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মৃত্তিকা বলল‚ “ওয়াও! কংগ্রাচুলেশনস ভাইয়া।”

“থ্যাংক ইউ বোন। কিন্তু তোকে আমাকে একটা প্রমিজ করতে হবে। এতদিন যাবৎ তোর সকল প্রমিজ আমি চুপচাপ মেনে এসেছি। এবার তোকেও আমার একটা কথা শুনতে হবে।”

“কোন প্রমিজের কথা বলছ ভাইয়া?”

“আগে বল— আমি যা বলব সেটা তুই শুনবি?”

“আগে তো শুনি।”

“না আগে প্রমিজ কর— আমি যা বলব সেটা তুই শুনবি এবং অক্ষরে অক্ষরে পালনও করবি।”

না পারতেই মৃত্তিকা রাজি হয়ে গেল। মুখে বলল‚ “আচ্ছা প্রমিজ।”

যেমনটা প্ল্যান করেছিল ঠিক তেমনটাই হচ্ছে৷ এই ভেবেই ভীষণ খুশি অর্পণ। সে ঝটপট বলে ফেলল‚ “আমার বিয়ের প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে তুই থাকবি। সবকিছুতে অংশগ্রহণও করবি৷ তুই হবি কনে পক্ষ৷ ইরাকে সব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“তার মানে ইরা সব জেনে গিয়েছে? তোমাকে তো আমি কাউকে বলতে বারণ করেছিলাম! আরেকটা কথা— এ হয় না ভাইয়া। ও বাড়িতে আমি আর যাব না৷ ”

“তুই আমাকে প্রমিজ করেছিস৷ যেভাবে আমি তোর প্রমিজ রক্ষা করে যাচ্ছি ঠিক সেভাবে তোকেও আমার সব কথা শুনতে হবে। আর ইরা জেনেছে তো কী হয়েছে? ইরাকে তো তুই আমার আগে থেকে চিনিস। আমি যেমন তোর ভালো চাই‚ ঠিক তেমনই ইরাও তোর ভালো চায়।”

আরেক মুসিবতে পড়ে গেল মৃত্তিকা৷ অর্পণ তাকে আচ্ছা ফাঁসান ফাঁসিয়েছে৷ না-ও করতে পারবে না সে৷ অগত্যা যাওয়ার জন্য রাজি হতেই হলো৷ খুশি হলো অর্পণ। সে জানত মৃত্তিকা তার এ কথা ফেলতেই পারবে না— প্রমিজ যে করেছে৷ মৃত্তিকা কল কে’টে দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো৷ পুনর্বার তাকে দেখে ও বাড়ির মানুষগুলো কেমন রিয়েক্ট করবে সেটার দেখার পালা! বিশেষ করে মাধুরী! তিনি তো তাকে মোটেও পছন্দ করতেন না৷ মৃত্তিকা ভেবে নিল ও বাড়িতে থেকেই মেহরাব শিকদারকে চোখে চোখে রাখবে। আর তো মাত্র কিছুদিন। একবার নাজিম চৌধুরী ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরুক তারপর তো বাকি খেলা হবে৷ ফোন হাতে নিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল মৃত্তিকা৷ তাকে দেখে সুদর্শিনী জিজ্ঞেস করল‚

“কে কল করেছিল?”

“ভাইয়া।”

“ডক্টর তাসরিফ ইফরাদ অর্পণ?”

ফোনটা চার্জে বসিয়ে মৃত্তিকা সায় জানাল‚ “হ্যাঁ!”

সুদর্শিনী সোজা হয়ে বসে বলল‚ আমি এটা ভেবে অবাক হই যে‚ মেহরাব শিকদারের মতো একজন পশুর ছেলে কী করে এতটা ভালো হতে পারে!”

“তুমি তো মামনিকে দেখনি। উনিও খুব ভালো। ভাইয়া একদম মামনির মতো হয়েছে।”

“উনার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে আমার।”

“ইনশাআল্লাহ একদিন দেখা করাব তোমাদের সঙ্গে।”

“হুম! অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুমতে আয়৷”

“তুমি আমাকে বিষাদে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলেছ ভূমি কন্যা। তোমাকে ভুল বোঝার মতো ভুলটা আমার পুরো জীবনটাকে একাকীত্বে মুড়িয়ে রেখেছে। বড্ড এলোমেলো হয়ে গিয়েছি আমি। সেদিন তো তুমি অভিমান করে আমার অপূর্ণ কথাগুলো না শুনেই চলে গেলে। একটিবার কী আমার জীবনে থেকে যাওয়া যেত না? আমার ভুলটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া উচিত ছিল না? সেদিন তুমি চলে যাওয়ার পরপরই আমি বুঝতে পেরেছিলাম‚ ঘোরের মাঝে কী জঘন্য ভুলটাই না আমি করেছি! সারাটা রাত তোমাকে প্রত্যেকটা জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজে বেরিয়েছি। সেদিন হয়তো ভাগ্য আমার সহায় ছিল না। যার জন্য উপর ওয়ালা আমাকে বিষাদের একটা বছর উপহার দিয়েছিলেন৷ আচ্ছা ভূমি কন্যা আমার শাস্তির পরিমান কী এখনো শেষ হয়নি? আমারও যে ইচ্ছে করে নিজের সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে! জানো ভূমি কন্যা— সেদিন চাচ্চু আমাকে মিথ্যে বলেছিল! ব্যস্ততার কারণে তোমাকে আমার সময় দেওয়াই হচ্ছিল না। কাজের অনেক প্রেসার ছিল আমার উপর। তারপর চাচ্চুর কল পেয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। চাচ্চু জানাল আমার ভূমি কন্যা দুই সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট। মায়ের হাহুতাশ বিলাপে মাথা ধরে আসছিল। একপ্রকার ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছিলাম। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে তোমাকে অবিশ্বাস করে বসেছিলাম। আমার উচিত ছিল শান্ত হয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলার। বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম‚ চাঁদের গায়ে দাগ থাকতে পারে তবে আমার ভূমি কন্যার চরিত্রে কোনো দাগ নয়। সে যে তার মায়ের পদ্মিনী আর স্বামীর নির্মলা ভূমি কন্যা। জানো ভূমি কন্যা— আমার বুকে বাঁ পাশটায় না তীব্র যন্ত্রণা হয়! কাউকে বোঝানো যায় না। সবাই শুধু আমার ভুলটা আর আমার রাগটাই দেখল কিন্তু আমার ভেতরের যন্ত্রণাটা কেউই দেখল না। আর না উপলব্ধি করতে পারল। প্রথম দেখায় তোমার প্রতি এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছিল৷ সেটা কখনোই মোহ ছিল না ভূমি কন্যা। মায়ের পর তুমিই আমার জীবনের প্রথম নারী। যাকে আমি আমার সবটা উজার করে ভালোবেসেছিলাম। যখন থেকে তোমাকে জানতে শুরু করলাম তখন ভেবে নিলাম— তোমাকে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন উপহার দেব। তোমাকে সকল দুঃখ কষ্ট থেকে আগলে রাখব কিন্তু আফসোস তোমার জীবনের সব থেকে বড়ো দুঃখের কারণ এই আমিই। একটু একটু করে তুমি আমার হৃদয়ের সাথে মিশে গিয়েছ। তোমাকে ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে কল্পনা করাও পাপ৷ তুমি আমার অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছ ভূমি কন্যা। এই একটা বছর ঠিক কী করে কেটে সেটা শুধু আমিই উপলব্ধি করেছি! দ্বিতীয়বার তোমাকে ফিরে পেয়ে আমি সত্যিই মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। অতি শীগ্রই আমি তোমার মান ভাঙাব৷ তোমাকে আর আমাদের সন্তানকে আবার আমি আমার জীবনে ফিরিয়ে আনব। তার জন্য যদি আমাকে আর দশ বছর তপস্যা করতে হয় তাহলে তাই হবে৷ তোমার সকল দুঃখ কষ্টকে দ্বিতীয়বার নিংড়ে নেওয়ার সুযোগটুকু দিয়ো ভূমি কন্যা!”

নিদহীন তমসাচ্ছন্ন রজনি৷ প্রলয় দাঁড়িয়ে রয়েছে বারান্দায়। ঘুম আসছে না তার৷ তিনটে ঘুমের ঔষধ খাওয়ার পরও ঘুম আসছে না। তাই সে ভেবে নিল সারারাত জেগেই কাভার করে দেবে। আজ ভূমিকে তার একটু বেশিই মনে পড়ছে। রাতের আঁধারে এই একাকীত্বে ভূমির স্মৃতি গুলো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ এই মুহূর্তে ভূমির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে তার। একটু জড়িয়ে ধরে নিজের ভেতরে দাবিয়ে রাখা সমস্ত ব্যথা উগলে দিতে ইচ্ছে করছে। এ দূরত্ব যে আর সইছে না। প্রলয় তার হাতে থাকা সিগারেটটা আবার ধরাল। ইতিমধ্যেই দুটো শেষ। ভূমি কাছে থাকলে হয়তো এই সিগারেটকে সে ছুঁয়েও দেখত না। শরীর কেমন নিঃসাড় হয়ে আসছে! হয়তো এবার ঘুমের ঔষধ নিজের প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করে দিয়েছে৷ পা দুটো টলছে ক্রমাগত৷ রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঝিমচ্ছে প্রলয়৷

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here