#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-২০
রাতের নিস্তব্ধতা আজ প্রখরভাবে অনুভূত হচ্ছে। আকাশ আজ নিকষ, চাঁদ-তারার আনাগোনা অনুপস্থিত; তবে পুঞ্জীভূত মেঘের ছুটোছুটি দৃশ্যমান। ঝি ঝি পোকার ডাকের পাশাপাশি খড়কুটো পো*ড়ার শব্দ কানে বাজছে। এগুলো দিয়ে জ্বা*লা*নো আ*গু*নের আলোয় চারপাশ হলদেটে বর্ণধারণ করেছে। চারপাশের মতো দারোয়ান আজাদের অবয়বটাও হলদেটে লাগছে। মাটিতে পড়ে থাকা আজাদের সেই মৃ*ত দে*হ*টার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্য। শুধু কানে বাজছে মৃত্যুর আগ-মুহুর্তে আজাদের কা*ত*রা*নো কন্ঠে বলা শেষ কথাটা,
-“এই চাবিটা আমার সিন্দুকের। ওখানে তোমার অজানা সবকিছু জানতে পারবে। আর আমাকে… আমাকে ক্ষমা করে দিও!”
চাবিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে আজাদ শে*ষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। সৌহার্দ্য চাবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। সে ভাবতেও পারেনি, তাদের আজাদের কাছে আসার কারণে আজাদের প্রাণটা-ই যাবে। আজাদের জানা সত্যিটা কাউকে জানতে দিতে না পারার জন্যই তাকে মে*রে ফেলা হলো।
পনের মিনিটের মাথায় প্রহর জঙ্গলের বাহিরে এসে সৌহার্দ্যের কাছাকাছি এলো ছুটন্ত পায়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “পারিনি ধরতে। গু*লি করেই ছুটে পালিয়েছে। দূর থেকে ছুটে যেতে দেখেছি। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে দেখি, গায়েব হয়ে গেছে। তবে যে গু*লি*টা করেছে, সে একটা মেয়ে। ”
সৌহার্দ্য অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, “মেয়ে? আর ইউ শিয়র? তুই কিভাবে বুঝলি?”
প্রহর সৌহার্দ্যের চোখের সামনে একটা ব্রেসলেট ঝুলিয়ে দেখালো। হলুদ আলোয় চিকচিক করছে সেটা। প্রহর বললো, “এটা দেখেছিস? মেয়েদের ব্রেসলেট! এটা ঐ খু*নি*র হাত থেকে পড়েছে। অন্ধকারেও চকচক করছিল এটা।”
সৌহার্দ্য ব্রেসলেটটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলো। মনে মনে বললো, ” এটা… এটা তো তরীর হাতের ব্রেসলেট! এটা কীভাবে এখানে? তারমানে তরী-ই এখানে এসেছিল! তরী আজাদকে খু*ন করলো? কিন্তু তরী এমনটা কেন করলো? আমরা তো এখানে আজাদের কাছ থেকে জানতে এসেছিলাম, কে তরীকে পুঁ*তে দিয়েছিল! তাহলে কি তরী চায় না যে, আমরা সত্যিটা জানতে পারি? তারমানে তরী নিজেও সবটা জানে!”
সৌহার্দ্যের ভাবনা ভাঙলো প্রহরের কথা শুনে, “দূর শা*লার! চা খেয়ে এই নির্জনে এসে বসাটা-ই ভুল হয়েছে। সবটা জানতে গিয়ে অজানা রয়ে গেল আর মাঝ থেকে একজন মানুষের প্রাণ গেল!”
সৌহার্দ্য সবটা প্রহরের কাছ থেকে চেপে গেল। আজাদের দেওয়া চাবিটাও দেখালো না আর ব্রেসলেটটা যে তরীর, সেটাও বললো না! প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুলিশ ফোর্স ডাকলো।
সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরলো মাঝরাতে। ফিরে দেখলো তরী জেগেই আছে। সৌহার্দ্য বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তরীকে পরখ করলো। আর প্রচন্ড অবাক হলো তখন, যখন দেখলো তরীর হাতে ব্রেসলেট-টা ঠিকমতই আছে। সৌহার্দ্য নিজের পকেটে হাত দিয়ে একবার দেখলো। না, তার পকেটে তো ব্রেসলেট-টা আছেই! তাহলে তরীর হাতে সেটা আবার গেল কীভাবে? তাহলে কি এটা অন্য কারো? নাকি তরীর-ই দুটো ব্রেসলেট ছিল, যার একটা হারিয়ে যাওয়ায় আরেকটা সে পরেছে যেন সৌহার্দ্য তাকে সন্দেহ করতে না পারে? অদ্ভুত গোলকধাঁধায় ফেঁ*সে গেছে সৌহার্দ্য। এটা থেকে হওয়া অসাধ্য না হলেও দুঃসাধ্য ব্যাপার বটেই!
৩২.
তরী আজ অনেকটা খুশী মনেই পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে এলো। জাহাঙ্গীরনগরে এই নিয়ে দুটো ইউনিটে পরীক্ষা দিলো সে। এই দুটো ইউনিটের জন্যই সে ফর্ম তুলেছিল। কালকের পরীক্ষাটা তেমন ভালো না হলেও আজকেরটা কালকের তুলনায় ভালোই হয়েছে।
তরীকে হাসিমুখে বের হতে দেখে সৌহার্দ্য ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। তরীর মাথায় হাত রেখে বললো, “পরীক্ষা ভালো হয়েছে?”
তরী মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, “হ্যাঁ, ভালো হয়েছে।”
তরী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই অদূরে মধুকে দেখতে পেল। মধু এখানে কেন এসেছে? তারমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মধু পরীক্ষা দিয়েছে। তরী ভীষণ খুশি হলো ভেবে।
সৌহার্দ্য তরীর দিকে তেমন খেয়াল না করে প্রহরকে ফোন দেওয়ার জন্য গাড়ির পেছনের দিকটায় এগুতেই দেখলো, অর্ণব গাড়ি থেকে নামছে। এই ছেলে নিশ্চয়ই তরীর সাথে দেখা করার জন্যই এখানে এসেছে। ভেবেই সৌহার্দ্যের প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো। তরী মধুর দিকে পা বাড়াবে এমন সময় হুট করে সৌহার্দ্য এসে ওকে ঠেলে গাড়িতে ঢুকিয়ে দিলো। নিজে গাড়িতে উঠে বললো,
-“খাবার কিনে রেখেছি আমি তোমার জন্য। এখন এখানে অহেতুক সময় নষ্ট না করে চলো তোমায় বাসায় পৌঁছে দেই। আমার হসপিটালে এমারজেন্সি আছে।”
সৌহার্দ্যের তাড়া আছে দেখে তরী আর কিছু বললো না। মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো শুধু।
সৌহার্দ্য তরীকে বাসার সামনে নামিয়ে আবার গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। সেই ডুপ্লেক্স বাড়িটায় আজ সে একাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে আজাদ দারোয়ান হিসেবে কাজ করতো। সিন্দুকের চাবিটা নিয়ে এতোদিন ঘুরলেও অবশেষে এই রহস্য উদঘাটনের জন্য সবটা জানা ছাড়া আর কোনো পথ পেল না সে।
গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। সৌহার্দ্য বাড়িটার গেইটের কাছাকাছি যেতেই নতুন দারোয়ানকে দেখতে পেল। সৌহার্দ্য বললো, “আচ্ছা, এই বাড়ির মালিকের সাথে আমি একটু দেখা করতে চাই।”
“আপনি কে?”
“এই বাড়ির পুরনো দারোয়ান যিনি কয়েকদিন আগে মারা গেছে, তার আত্নীয় আমি।”
“আচ্ছা, আসুন। ভেতরে আসুন!”
সৌহার্দ্য লোকটার সাথে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। বাগান পেরিয়ে যেতে যেতে নতুন দারোয়ান সৌহার্দ্যকে বললো, “বাড়ির মেইন ডোরের ভেতরে তো প্রবেশ করা যাবে না! আমি বরং আপনাকে পুরনো দারোয়ানের বউয়ের সাথে দেখা করিয়ে দেই। উনি এখন এখানেই আছেন।”
সৌহার্দ্য হাঁটা থামিয়ে দিলো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “কেন? এই বাড়ির মালিক কোথায়? তার সাথে দেখা করা যাবে না?”
“ম্যাডাম তো এখন বাসায় নাই! আজকে না-ও আসতে পারে!”
“ম্যাডাম? মানে এই বাড়িতে একটা মেয়ে থাকে! আর কেউ থাকে না?”
“না! এ বাড়িতে কেউ-ই থাকে না। ম্যাডাম মাঝে মাঝে আসেন। তাও খুব কম!”
সৌহার্দ্যের মনে সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হলো। কিন্তু এখন যেই কাজে এসেছে, সেই কাজটাই সেরে ফেলা উচিত আগে। তারপর এই বাড়ির মালিককে নিয়ে ভাবা যাবে।
আজাদের স্ত্রী সৌহার্দ্যকে দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও পরিচয় দেওয়ার পর ভীষণ খুশি হলো। সৌহার্দ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর বললো, “কত বছর কেটে গেল! তোদের দেখি না আমি। আজ এতো বড় হয়ে গেছিস!”
“চাচার সাথে এতো বছর পর দেখা হলো। আবার হারিয়ে ফেললাম ওনাকে। আচ্ছা, আমি মূলত এই চাবিটার জন্য এসেছি। মৃত্যুর আগে চাচা এটা আমাকে দিয়েছিল৷ এটা নাকি কোন সিন্দুকের চাবি? তুমি কি কিছু জানো?”
আজাদের স্ত্রী চাবিটা দেখে বললো, “হ্যাঁ, এটা তো ঐ সিন্দুকের চাবি! এই সিন্দুকে তোর চাচা কিছু কাগজপত্র রেখেছিল। এর বেশি কিছু তো জানি না।”
সৌহার্দ্য সিন্দুকটার দিকে তাকালো। এগিয়ে গিয়ে চাবি দিয়ে সেটা খুলতেই ভেতরে শুধু কিছু কাগজ ও খাতাপত্র পেল। সৌহার্দ্য ওগুলো ঘেঁটে না দেখে পুরো সিন্দুকে যা যা পেল, সব কাগজ নিয়ে নিল একটা ব্যাগে। বললো, “আজ আমি আসি, চাচী। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এমনি অনেক দূরের পথ।”
সৌহার্দ্যকে খেয়ে যাওয়ার জন্য জোর করলেও সৌহার্দ্য শুনলো না। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো। অন্ধকার নেমে এসেছে। ফাঁকা রাস্তা পেরিয়ে শহরের কাছাকাছি চলে এসেছে সৌহার্দ্য। তার পাশ কে*টে কয়েকটা গাড়ি মাঝে মাঝে যাওয়া আসা করছে। সৌহার্দ্যের ফোন বেজে উঠতেই সে গাড়ির ব্রেক ক*ষে গাড়িটা থামাতে চাইলো। কিন্তু গাড়ির ব্রেক কাজ করছে না সেই মুহুর্তেই সে বুঝতে পারলো, তার গাড়ি ব্রেক ফেইল করেছে। সৌহার্দ্য অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি থামাতে পারছে না। উপায় না পেয়ে সে চলন্ত গাড়িটা বামি ঘুরিয়ে একটা গাছের সাথে আঘাত করালো। সৌহার্দ্যের মাথাটা স্টিয়ারিং-এ লেগে কপাল ও কান বেয়ে গ*ল*গ*ল করে র*ক্ত*স্রোত বইতে লাগলো।
তরী ফোনে মধুর সাথে অনেকক্ষণ চ্যাটিং করলো। হঠাৎ অর্ণবের টেক্সট এলো, “কী রে? আজকে আমি তোর সাথে দেখা করতে গেলাম হলে! তোকে তো পেলাম না!”
তরী লিখলো, “ডক্টর সৌহার্দ্যের কাজ ছিল। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছি।”
“ডক্টর সৌহার্দ্য? ওয়াও! এতো আদুরে ভঙ্গিতে ডাকিস?”
“মানে? এখানে আদুরের কী দেখলে?”
“নাহ্! কিছু না। ওনাকে অনেক ভালোবাসিস তুই, তাই না?”
তরী বিব্রত হলো। কী বলবে ভেবে না পেয়ে বললো, “তোমাকে আমি পরে নক করছি। এখন একটু ব্যস্ত আছি।”
অর্ণব নিজের রকিং চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে মলিন হাসলো। আনমনে বললো, “তোকে আমি আজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম, তরী! আজীবনের জন্য!”
তরীকে ফোনে মগ্ন থাকতে দেখে দাদী বললেন, “তোরে না বলসি? আমার নাতি আসার আগে আগে ওর যত্নআত্তির সব ব্যবস্থা করে রাখবি? তোরে কি এখন আমি ঘাড় ধইরা শিখাইয়া দিবো কেমনে তুই আমার নাতির মনে জায়গা কইরা নিবি?”
তরী হকচকিয়ে গেল। দ্রুত হাত থেকে ফোন রেখে উঠে দাঁড়াতেই ওর ফোন বাজতে শুরু করলো। তরীকে কেউ কখনো কল করে না তেমন! তাই এমন সময়ে কল পেয়ে তরী কিছুটা অবাক হলো। দাদীও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তরী ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে প্রহরের গলার আওয়াজ ভেসে এলো,
“জানি কথা বলবেন না। কিন্তু আজ আপনার অভিনয়ে ইতি ঘটাবো আমি!”
তরী প্রচন্ড বিরক্ত হলো। এই ছেলেটা ওর পেছনে এমনভাবে পড়েছে যে, শেষ দেখা না পর্যন্ত ওকে ছাড়বেই না। তরী ফোন রাখতে যাবে, এমনসময় প্রহর বললো,
“ওয়েট! ফোন রাখার এতো তাড়া কিসের? সৌহার্দ্যের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। ও আপাতত ওর হসপিটালেই ভর্তি। এসে দেখা করে যান, মিসেস অরিত্রী সেহরীশ!”
-চলবে….
(আগামী পর্বে একটু চমক আসবে ইনশাআল্লাহ!)