রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭৭| #ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

0
547

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭৭|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

সকাল থেকেই রান্নাঘরে কাজের তোড়জোড় চলছে৷ আজ ইরার বাবা মা আর আরশ আসবে৷ বিয়ের কথা এ বাড়িতেই হবে৷ উনারাই অনিন্দ্যনগর থেকে ঢাকা আসবেন। ভোরের ট্রেনে রওনা দিয়েছিলেন উনারা৷ এখানে পৌঁছাতে হয়তো আরও ঘণ্টা দেঁড়েক সময় লাগবে৷ সেই ফাঁকে বাড়ির মহিলাগন সকলেই কাজে একে অপরকে সাহায্য করছেন। তৃপ্তিও রান্নাঘরে রয়েছে৷ ফিরোজার কাছ থেকে রান্না শিখছিল৷ উনার হাতের একটা রেসিপি তার বেশ ভালো লেগেছে৷ ভাগ্য ভালো বলে সেই খাবারটা আজ রান্না করা হচ্ছে৷ সেই খাবারটা ফিরোজা খুব ভালো রান্না করেন৷ এই সুযোগে সেও রান্না শিখবে। আজ সকাল থেকে মাধুরীকে বেশ অন্যরকম লাগছে৷ বেশ হাসিখুশি। উনাকে খুব একটা হাসিখুশি দেখা যায় না৷ বেশির ভাগ সময়ই কেমন গম্ভীর হয়ে থাকেন। প্রলয়ও হয়েছে ঠিক তার মায়ের মতো। দুজনের স্বভাব একদম এক৷ আজ অর্পণ বা মেহরাব শিকদার কেউই হসপিটালে যাবেন না৷ আর না প্রলয় আর তার বাবা কোথাও যাবেন! আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷ বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করা হবে আজ৷ অর্পণ চাইছে বিয়েটা এই মাসের মধ্যেই হোক৷ আর এই মাসের আর মাত্র আটদিন সময় রয়েছে৷ বিয়ের কেনাকাটা‚ ডেকোরেশনেরও তো ব্যাপার রয়েছে। সময় তো প্রয়োজন। অর্পণের এই তাড়াহুড়োর ব্যাপারটা কেউই হজম করতে পারছে না৷ বিপরীতে হাসছেও বটে৷ তবে তা কিছুতেই পাত্তা দিচ্ছে না অর্পণ। সে তার মতো চলাফেরা করছে৷ রান্নাবান্নার কাজও প্রায় শেষের দিকে। এদিকে বাসন ধুয়ে রাখছে সাবিনা। পূর্ণতা পুষ্পিতা আজ কলেজ যাবে না৷ এতে করে প্রলয় একবার চোখ রাঙিয়েছিল। পড়াশোনা নিয়ে গাফেলতি মোটেও পছন্দ নয় তার৷ কিন্তু ছোটো বোনদের আবদারও ফেলতে লারল না সে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতার পড়াশোনা বিষয়ক সিদ্ধান্ত গুলো প্রলয়ই নেয়৷ আর এই ব্যাপারে প্রলয় ছাড়া আর কেউ হস্তক্ষেপ করতে আসে না৷ মোর্শেদ শিকদারও নিশ্চিন্ত।

এরই মাঝে কলিং বেল বেজে উঠল। মাধুরী কাজের ফাঁকে তৃপ্তিকে বললেন সদর দরজা খুলে দেওয়ার জন্য৷ উনারা দুজন রান্নাঘরের কাজই করছেন। আসলে তাড়াহুড়োর কাজ সবসময় এলোমেলোই হয়৷ যতই এগোনো যায়‚ মনে হয় যেন কোনোটাই সঠিক ভাবে হয়নি বা এগোচ্ছে না। এদিকে মাধুরীর কথানুযায়ী তৃপ্তি গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল। দরজার সামনে তিনজন দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মধ্যবয়সী পুরুষ এবং মহিলা আর একজন ছেলে। তৃপ্তি দরজা আগলে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“কাকে চাই?”

শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমা কিছুটা ক্লান্ত৷ রাতে ঘুম হয়নি। ভোরের ট্রেনে করে এসেছেন উনার৷ দেখে মনে হচ্ছে ঝিমচ্ছেন। আরশ একবার তার সামনে থাকা মেয়েটার দিকে তাকাল। গায়ের রং তার উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের৷ চুলে দুটো বিনুনি গেঁথে রেখেছে৷ প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো কিছুটা ব্যাপার আছে। মেয়েটা তার কোমড়ে ওড়না সুন্দর করে পেঁচিয়ে রেখেছে৷ মেয়েরা কাজ করতে গেলে যেমন করে কোমরে পেঁচিয়ে রাখে ঠিক তেমনই। আরশ তার মাকে আর ইরাকে এভাবে কাজের সময় ওড়না পেঁচিয়ে রাখতে দেখেছে৷ হাতে থাকা ব্যাগটাকে নিচে রেখে এবার সে বলল‚

“আপনি কে?”

“আপনি বুঝি প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করেন?”

উনাদের যে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে বলবে এই কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছে তৃপ্তি৷ আরশ যারপরনাই বিরক্ত হলো৷ কিছুক্ষণ আগে তো এই মেয়ের প্রেমেই পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মেয়েটা শুধু বড়োই হয়ে কিন্তু মাথায় বোধবুদ্ধি নেই বললেই চলে। আরশ বলল‚

“অপ্স স্যরি৷ আমি ফারহান এনায়েত আরশ। এবার কী আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?”

“তৃপ্তি জুনাইরাহ।”

এরই মাঝে মাধুরী এসে জিজ্ঞেস করলেন‚ “কে এসেছে তৃপ্তি?”

তৃপ্তিকে কিছুই বলতে হলো না৷ আরশকে দেখে খুশি হলেন মাধুরী। গদগদ হয়ে বললেন‚ “বাহিরে কেন দাঁড়িয়ে আছ বাবা— ভেতরে এসো! তৃপ্তি তুমি এতক্ষণ ধরে উনাদের বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ?”

শেষোক্তটি কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললেন মাধুরী। তৃপ্তি বুঝল এরা হয়তো এ বাড়ির চেনা কেউ হবে৷ সে সদর দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। আরশ সহ তার বাবা মা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই সদর দরজা আটকে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল তৃপ্তি। আরশ তার বাবা মাকে অতিথি শালায় রেখে এসেছে৷ উনাদের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আর সে ছুটে চলে গেল অর্পণের ঘরে দিকে৷ এখন সময় সাড়ে নয়টায় গড়িয়েছে৷ এতক্ষণ সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। এখনো পর্যন্ত কেউ নাস্তা করেননি— একসঙ্গে খাবেন বলে। অর্পণের ঘরের দরজা খোলাই ছিল৷ আরশ অনুমতি ব্যাতীত অর্পণের ঘরে ঢুকল। এমনটা সে হরহামেশাই করে এসেছে৷ বন্ধুর ঘরে আসাতে আবার অনুমতি কীসের? তবে বিয়ের পর সেটা অন্য কথা৷

এদিকে…

হাতের সমস্ত কাজ শেষ। সাবিনা সুযোগ বুঝে সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কর‍তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রান্না করা খাবার গুলো ডাইনিং টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে৷ শাহাদাৎ মোড়ল আর নাজমা হাতমুখ ধুয়ে এলেই সবাইকে নাস্তা দেওয়া হবে৷ তৃপ্তি ডাইনিং টেবিলের ধারে দাঁড়িয়ে ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করল‚ “আন্টি উনারা কে?”

“ইরার কথা তো শুনেছই! ওরা ইরার পরিবার। বাবা‚ মা আর ভাই।”

“আর আমি কি-না উনাদের বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখলাম।”

“ধ্যাৎ তুমি কী আর ইচ্ছে করে করেছ নাকি? এটা নিতান্তই একটা ছোট্টো ভুল। এই নিয়ে মন খারাপ করার কিছু হয়নি।”

“আন্টি একদমই অন্যরকম।”

প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ হাসলেন ফিরোজা৷ উনি বরাবরই এমন৷ ছোটো থেকে উনি খুব শান্ত স্বভাবের৷ স্কুল আর কলেজ জীবনে উনার খুব একটা বন্ধু ছিল না৷ কেউ উনার সঙ্গে বন্ধুত্বই করতে চাইত না। বন্ধু মহল থেকে শুনতে হত ‘তুই খুব বোরিং! তোর বরও ঠিক এমনই হবে৷ এত চুপচাপ থাকিস কী করে? কথা পেটে আটকে যায় না? অস্বস্তি হয় না? দম বন্ধ হয়ে আসে না?’ এরকম আর অনেক কথা শুনতে হয়েছে ফিরোজাকে। তবে তিনি আগে যেমনটা ছিলেন আজও ঠিক তেমনটাই আছেন।

সকাল সাড়ে দশটা…

সকালের নাস্তা সবাই একসঙ্গে করেছেন। সবার আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েছে অর্পণ আর আরশের৷ উনারা যে ঢাকা পৌঁছে গিয়েছেন এই কথাটা ইরাকে এখনো জানানো হয়নি৷ বিকেলে একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করে রেখেছে অর্পণ এবং ইরার পরিবার৷ আরশ আর অর্পণ বৈঠকখানার সোফায় বসে রয়েছে৷ সর্বপ্রথমে টিপ্পনী কে’টে অর্পণ বলল‚

“কী রে শালা ডাক্তারি করে করে তুই তো নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিস! তোকে তো কল করলেও পাওয়া যায় না। নাকি লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম টেম করছিস?”

“তেমন কিছুই না। ব্যস্ততায় দিন পার হচ্ছে এই আরকি।”

“তা কোনো মেয়েকে পটাতে পেরেছিস? মনে ধরেছে কাউকে?”

“প্রথম দেখায় একজনকে মনে ধরেছে৷ ভাবছি পটাব। যদি রাজি হয়ে যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা।”

“আমাকেও বল— সেই পোড়া কপালি কে?”

“তুই কী আমাকে অপমান করছিস?”

“অপমান কোথায় করলাম?”

“ওই যে পোড়া কপালি বললি? সে তো হবে অনিন্দ্যনগরের বিখ্যাত ডাক্তার ফারহান এনায়েত আরশের একমাত্র বউ হবে।”

“জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়ে কাজে লেগে পড়। পাগলের বিলাপ পরেও করতে পারবি।”

সোফার উপর থাকা কুশন অর্পণের দিকে ছুড়ে মারল আরশ৷ এরপর দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠল। ইতিমধ্যেই অনেকের খাওয়া হয়ে গিয়েছে৷ এঁটো বাসনগুলোকে রান্নাঘর রেখে এসে ফিরোজা বললেন‚

“তোদের দুটোতে আবার কী হলো? এভাবে হাসছিস কেন?”

অর্পণ ঝটপট বলল‚ “আর বোলো না মা— আমাদের আরশের একজনকে মনে ধরেছে।”

ফিরোজা জিজ্ঞেস করলেন‚ “মেয়েটার নাম কী? কোথায় থাকে? পরিবারে কে কে আছে?”

“আন্টি তোমার এক ছেলের বিয়েটা আগে দাও তারপর আমার জনকে খুঁজে দিয়ো৷”

অর্পণ বলে উঠল‚ “তার আগেই যদি তোর জনকে অন্য কেউ চুরি করে নিয়ে চলে যায়?”

“সেটা হতে দিচ্ছি না। একদম চোখে চোখে রাখব।”

বড়োদের এই সমস্ত কথাবার্তায় প্রলয় থাকতে চায় না। তাই সে নিজের ঘরে চলে এসেছে৷ মাধুরী অনেকবার বলেছিলেন। যেহেতু সে এ বাড়ির বড়ো ছেলে তার মতামতেরও সমান মূল্যায়ন করা হবে৷ কিন্তু কে শোনের কার কথা! এদিকে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে তাই লজ্জায় আর বৈঠকখানায় পা মাড়ায়নি অর্পণ৷ তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। লাইক সিরিয়াসলি? যে কি-না নিজের বিয়ের কথা নিজেই ঢোল পিটিয়ে পরিবারকে জানাল‚ সেই কি-না লজ্জা লাচ্ছে! ঘরে বসে একা একা লজ্জা পেতেও বোর হচ্ছিল না অর্পণ। তাই সে সোজা প্রলয়ের ঘরে চলে এলো৷ এ ঘরে এসে দেখল তার ভাই গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে৷ কী যে ভেবে যাচ্ছে প্রলয় হয়তো নিজেও জানে না৷ সে গিয়ে বিছানার তার ভাইয়ের পাশে বসে বাহুতে একটা খোঁচা মে‘রে দিল৷ এবার যেন ভাবনার ঘোর কাটল প্রলয়ের৷ অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚

“কী এত ভাবছ ভাই?”

“ভাবছি‚ একজনের হিসাব আমি কড়ায়গণ্ডায় নেব।”

“কার?”

“সেটা পরেই জানতে পারবি।”

জানার আগ্রহ বাড়তে শুরু করল। অতিরিক্ত কৌতূহল দাবিয়ে রাখতে না পেরে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “ভাই তুমি কী মনে মনে বড়োসড়ো কিছু ভাবছ?”

“সবসময় যেভাবে আঠার মতো লেগে লেগে থাকিস৷ খুব শীগ্রই সেটাও বুঝে যাবি।”

প্রলয়ের কথাগুলো তালগোল পাকিয়ে গেল৷ একদিনের মধ্যেই প্রলয়কে আবারও আগের মতো চনমনে লাগছে। সবকিছুতেই অতি উচ্ছ্বাস। মনে থেকে যেন বিষাদ নীল রঙ ঝরে গিয়ে রঙিন শত ডানার প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে তার মনাকাশে৷ অর্পণ আবারও বলল‚

“ভাই কাল থেকে তোমাকে অন্যরকম লাগছে।”

“লক্ষ্য করেছিস না?”

অর্পণ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল‚ “হ্যাঁ!”

“আমিও লক্ষ্য করেছি।”

বোকা বনে গেল অর্পণ। প্রলয় কখনোই তার কোনো প্রশ্নের জবাব সোজাসুজি দিতেই পারে না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এমন কিছু বলবে যাতে করে তাকে বিড়ম্বনায় পড়তেই হয়। কিছুটা বিরক্ত হয়ে অর্পণ বলল‚

“তোমার সঙ্গে কথা বলাই বৃথা।”

এবার খানিকটা হাসল প্রলয়৷ অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “হুট করে বিয়ের তাড়া কেন?”

থতমত খেয়ে গেল অর্পণ। আমতা আমতা করে বলল‚ “আমার সমবয়সী সবগুলো বিয়ে করে ফেলেছে৷ ভাবলাম আমি কেন পিছিয়ে থাকব! তাই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

চশমা ঠিক করে ছোটো ছোটো চোখে তাকাল অর্পণের দিকে৷ এই ছেলেটার কথা বিশ্বাস হলো না৷ অর্পণের সব বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেই তার পরিচিতি রয়েছে৷ প্রলয় বলল‚

“তাই নাকি?”

প্রলয়কে সুবিধের ঠেকছে না। অর্পণ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল‚ “হ্যাঁ!”

“তাহলে আরশ কেন বিয়ে করল না? তোর আরও দুজন বন্ধু এখনো সিঙ্গেল।”

“উফ ভাই! তোমার এমপি না হয়ে গোয়েন্দা হওয়ার প্রয়োজন ছিল।”

“গোয়েন্দার কাজ শুরু করে দিই— কী বলিস?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্পণ। প্রলয়ের সঙ্গে সে কখনোই কথায় পারবে না৷ যুক্তির উপর যুক্তি দাঁড় করাবে। তার থেকে বরং চুপ করে যাওয়াই শ্রেয়৷ এরপর মুখ দিয়ে কী না কী বেরিয়ে যায়৷ যদি ভুল করে ভূমির সত্যিটা বেরিয়ে আসে! তাহলে তো আরেক কাণ্ড।

চলবে?…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here