এক_ফালি_সুখ🌼 |১০| #তাসনিম_জাহান_মৌরিন

0
339

#এক_ফালি_সুখ🌼 |১০|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
_”ওয়ালাইকুম আসসালাম। আচ্ছা মৌরিন শুনো, একটা ঝামেলায় পরে গেছি বুঝলে। আসলে আমার অনেক ছোটবেলার একটা বন্ধুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সেটা আমি মাত্রই জানতে পারলাম। ওকে দেখতে যাওয়াটা ও ইম্পর্টেন্ট, কিন্তু সেখানে গেলে আমার পক্ষে আর রাতের আগে আসা সম্ভব হবেনা হয়তো।”

মৌরিন রাতুল এর চিন্তিত কণ্ঠের বিপরীতে বলে,
_”চিন্তা করবেন না ভাইয়া,উনি ঠিক হয়ে যাবেন দোয়া করি। আর আপনার যাওয়ার দরকার হলে নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।”

_”সে নাহয় গেলাম, কিন্তু সন্ধ্যার শুটং এর কি করি বলতো? শুটিং টা তো ক্যানসেল করা সম্ভব নয় এমন একটা সময়ে এসে। আচ্ছা তোমাকে তো আমি সব বুঝিয়েই দিয়েছি। আজকের একটার দিন একটু ম্যানেজ করে নিতে পারবে?”

_”আপনার কি মনে হয় ভাইয়া?”

_”আমার তো মনে হয় তুমি একটু ট্রাই করলেই পারবে। স্ক্রিপ্ট এ কিছু চেঞ্জ করার দরকার হলে সেটাও ভালোই করতে পারবে,এটা আমার বিশ্বাস।”

_”যদি বিশ্বাস করেন,তাহলে আমিও সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনার কাজটুকু সামলে নেওয়ার। আজকের শুটিং এর সবটাই তো জানা আছে, তেমন একটা সমস্যা হওয়ার ও কথা নয়। তবুও কিছু হলে, আমি চেষ্টা করবো দেখে নেওয়ার।”

_”বাঁচালে বোন। আচ্ছা আমি রুবেল ভাইকে জানিয়ে দিচ্ছি, এখনি বেরোতে হবে আমায় তাহলে।”

_”জি ভাইয়া,চিন্তা করবেন না।”

_”আর হ্যা, শোনো।”

_”বলুন ভাইয়া।”

_”তূর্যের কথায় কিছু মনে করোনা আবার। আসলে ও ছেলেটাই এমন, ভীষণ অ্যারোগেন্ট। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ টা একটু বেশিই করে, আর যাকে পছন্দ হয়না তার সঙ্গে আরো বেশি করে। তবে তোমাকে নিয়ে যে ওর কি প্রবলেম সেটাই বুঝিনা।”

মৌরিন মৃদু হেসে উত্তর দেয়,
_”মানুষ এর কথা আমি কোনো কালেই কানে নেইনি ভাইয়া। নিলে এই সমাজে বোধ হয় টিকে থাকতে পারতাম না। আল্লাহ মানুষ কে মুখ দিয়েছে বলার জন্য, কান দিয়েছে শোনার জন্য। শোনার মতো ভালো অনেক জিনিস আছে, সেখানে শুধুশুধু অন্যদের ফালতু কথা কানে নেওয়াটাই বেকার। আপনি ভাববেন না এসব নিয়ে, উনি কেমন মানুষ এটা আমি প্রথম দিনই বুঝে গেছি। তাই তার কথায় কিছু মনে করার প্রশ্নই আসেনা।”

_”ঠিক আছে মৌরি, তোমার উপর তাহলে ভরসা করলাম। বাকিরা কিছু জিজ্ঞেস করলে জানিয়ে দিও ইমার্জেন্সি ছিলো আমার,নাহলে যেতাম না।”

_”আচ্ছা ভাইয়া,সাবধানে যাবেন। আল্লাহ হাফেয..”

কলটা কেটে দিলো রাতুল। মৌরিন ফোনটা বিছানার উপর রেখে চুলে প্যাঁচানো টাওয়াল টা খুলে এনে চুলগুলো সুন্দর করে মুছে নেয়। এরপর আয়নার কোণায় লাগিয়ে রাখা ছোট কালো রঙের টিপটা নিয়ে কপালে পরে নেয়। এত কঠিনতার মাঝে এই একটা অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনা মৌরিন, চায়ও না। সাজগোজ এর শখ তো কোনো কালেই ছিলোনা। ছোটবেলায় নূপুর পরার শখ ছিলো,সেটাও কেটে গেছে। রয়ে গেছে কেবল এই টিপ পরার শখটা,এই একটা শখ নাহয় রয়ে যাক।

মৌরিন খেয়াল করলো বাসায় আসার পর থেকে মারুফা তার সঙ্গে কোনো কথা বলেনি,এই ঘরেও আসেনি। তখন থেকে সামনের ঘরেই বসে আছে। বিছানা থেকে ওড়নাটা গলায় ঝুলিয়ে নেয় মৌরিন, চুলগুলো না আছড়েই কাকড়া দিয়ে পিছনে হালকা করে আটকে রেগে চলে যায় সামনের ঘরে। মারুফা সেখানে চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে ছোট খাটে বসে আছেন। মৌরিন তার সামনে দাঁড়িয়ে এক কাধে হাত দিয়ে বলে,
_”কি হয়েছে মা? এত চিন্তা করছো,কথাও বলছো না আমার সঙ্গে।”
মৌরিন কিছুটা থেমে আবার বলে,
_”ওখান থেকে কি আবারো কল..”

_”না না, ও বাড়ি থেকে কল আসেনি।”
উঠে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেন মারুফা। তার কপালে ঈষৎ ভাজ,মুখে এখনো চিন্তার ছাপ বিদ্যমান। মৌরিন তা দেখে বলে,
_”তাহলে,হয়েছে টা কি?”

_”বাড়িওয়ালা এসে বলে গেছে আআগামী মাস থেকে ভাড়া একহাজার বাড়িয়ে দিতে। বিল্ডিং এর সকলেরটাই নাকি বাড়ানো হয়েছে।”

মৌরিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
_”তারা নাকি পাঁচবছর এর আগে বাসা ভাড়া বাড়ায় না?”

_”সেটা বলার পর উল্টো আমাকে ধমক দিয়ে চলে গেলো।”

_”ঠিক কে এসেছিলো বলো তো? বাড়িওয়ালা আঙ্কেল?”

_”নাহ,তার যে ছেলে আছেনা একটা? ও এসেই তো এমনটা বলে গেলো।”

_”বুঝেছি।”

_”কি বুঝলি?”

মৌরিন একবার মারুফার দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। বিছানার উপরে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে ফিরে এলো আবার। চুলগুলো অমন অবস্থায়ই রইলো,ওড়নাটা টেনে মাথায় তুলে মৌরিন মারুফার কাছে এসে বললো,
_”তুমি থাকো,আমি একটু আসছি।”

_”কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

_”বাড়িওয়ালার বাসায়।”

_”ভাড়া নিয়ে কথা বলতে?”

_”উম হু, তাদের গুণধর ছেলের কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে।”

_”মানে?”

অবাক হয়ে বললেন মারুফা। মৌরিন স্মিত হেসে বলে,
_”তার ছেলে আমার অনেক উপকার করতে চেয়েছিল মা, উপকার নেইনি তো। তাই রেগে গিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে দিলো। আমার হাসি পাচ্ছে ওর কথা ভেবে। উনি বোধ হয় ভেবেছে আমি কেবলই তাকে ভয় দেখিয়েছি,বাস্তবে আমি সেই কাজটা করতে পারবো না। তাই তাকে তো এখন দেখানো উচিৎ, মৌরিন যা বলে তা করেও দেখাতে পারে।”

কথাটা বলে দরজার কাছে গেলেই মারুফা আবারো পিছন থেকে বলে ওঠে,
_”বড়লোকের ছেলে ও, ওর সঙ্গে লাগতে যাসনা মৌ। যদি তোর কোনো..”

তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে মৌরিন। ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
_”আফসোস টা কি জানো মা? তুমি নিজেই এখনো তোমার মেয়েকে চিনতে পারলে না। বাকিদের থেকে তো কিছু আশা করাই ভুল। এটুকু বিশ্বাস তুমি আমার উপর রাখতেই পারো। নিজেকে নিরাপদ এ রাখার অ্যাবিলিটি আছে আমার।”

আর একটা কথাও বললো না মৌরিন,মারুফাও কিছু বলতে পারলেন না। মৌরিন জুতোটা পরে নিচে নেমে গেলো।

_____
আফজাল সাহেব আর আফসানা সোফায় বসেই কিছু কথা বলছিলেন। কলিং বেল এর আওয়াজ পেয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন তিনি। মৌরিনকে বেশ পছন্দ তার, কি সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটা!
আফসানা দরজা খুলতেই তাকে সালাম দেয় মৌরিন। তিনিও সালামের উত্তর দিয়ে ভিতরে আসতে বলে মৌরিনকে। আফজাল সাহেব এতে বিরক্ত হন। উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,
_”অ্যাডভান্স কিন্তু আমি বাদ দিতে পারবোনা বাবা। ঐ নিয়ে আর কথা বলতে এসোনা।”

মুচকি হাসে মৌরিন। আফজাল সাহেবের সামনে এসে বলে,
_”না আঙ্কেল, ভাড়া নিয়ে আজ আর কথা বলতে আসিনি।”

_”তুমি ওনার কথা ধরোনা তো, আগে বসো। তারপর বলো কি বলবে। বাসায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?” (আফসানা বলে)

_”তা আপনার ছেলে বাড়িতে নেই আন্টি?”

_”আরাফ এর কথা বলছো? ও তো বাড়িতে নেই এখন। কেন বলো তো?”

আফজাল আর আফসানা দুজনেই অবাক হয়। মৌরিন নিজের ফোন থেকে রেকর্ডিং টা বের করতে করতে বলে,
_”একটা জিনিস শোনাবো আপনাদের। মন দিয়ে শুনবেন হ্যা।”

আফজাল,আফসানা একে অপরের দিকে তাকালো। মৌরিন রেকর্ডিং টা বের করে সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো। প্রথমেই আরাফের কণ্ঠ শুনে চমকে যান দুজন। এরপর ধীরেধীরে বাকি কথাগুলো শুনতেই যেন মাথার উপর আকাশ ভেঙে পরে তাদের।
চার মিনিট এর ভয়েস রেকর্ডটা শেষ হতেই ফোনটা অফ করে দেয় মৌরিন। আফজাল আর আফসানাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে,
_”আমি প্রথমে এটা আপনাদের শোনাতে চাইনি, আপনাদের ছেলেকে ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম। কিন্তু সে তো আমার কথার গ্রাহ্যই করলো না, বরং বাসায় গিয়ে আমার মাকে বলে এলো বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে। তাই আর চুপ করে থাকতে পারলাম না আঙ্কেল। আমি যতটা জানি, বাড়িটা এখনো আপনার। তাই আপনি বললে আমরা বাড়ি ছেড়ে দিতেও বাধ্য, তবে আপনার ছেলেকে একটু বুঝিয়ে দেবেন মেয়েদের অসহায় না মনে করতে। নইলে আজ যে রেকর্ডিং টা আপনাদের শোনালাম,সেটা ইন ফিউচার পুলিশকেও শোনাতে পারি। ব্যাপারটা আপনার ছেলের জন্য খুব একটা ভালো হবেনা বোধ হয়।”

আফসানা ভয় পেয়ে আফজাল এর একহাত চেপে ধরলেন। আর আফজাল লজ্জায় কেবলই নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিজের ছেলের ব্যাপারে এমন কথা শুনে কোন বাবাই বা ঠিক থাকতে পারে?
ফোনটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে দুজনকে আবারও সালাম দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো মৌরিন। এখন বাসায় গিয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়েই নিহাকে পড়াতে যাবে। সন্ধ্যার পর যেহেতু বাসায় থাকবে না তাই আগেই পরিয়ে রাখবে ওকে।

______
শুটিং সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হলো। রাতুল আগে থেকেই সবগিছু সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তাও তেমন সমস্যাও হয়নি। আর বাকিটা মৌরিনই সামলে নিয়েছে। তূর্যর থেকে এখন আর কথা শুনতে হয়নি,শুনলেও অবশ্য তা গোনায় ধরতো না মৌরিন।

রাত ৯ টার মতো বাজে। এই অফিসে শুট আজকেই শেষ, তাই একেবারে সবকিছু গুছিয়েই বের হবে তারা। তন্নি আর তূর্যও পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে, আর তাদের সামনেই অন্য চেয়ারে বসে আসে রিরেক্টর রুবেল। তন্নি কোনো একটা বিষয়ে হাসতে হাসতে বলে,
_”তা রুবেল ভাই, আপনিও কি সন্যাস জীবন পার করার সিদ্ধান্ত নিলেন নাকি? বয়স তো পঁয়ত্রিশ হতে চললো,এবার অন্তত বিয়েটা করে ফেলুন।”

রুবেল গালে হাত দিয়ে বলে,
_”পছন্দসই মেয়ে পাচ্ছিনা রে।”

তূর্য ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
_”এই ব্যাপার! আগে বলবেন তো। আমার আম্মুর সাথে যোগাযোগ করেন ভাইয়া, সব ধরণের মেয়ের খবর আছে তার কাছে, মোটা-চিকন, খাটো-লম্বা, ওয়েস্টার্ন-ঘরোয়া সব মেয়ের লিস্ট আছে, জাস্ট সবাই ফর্সা। তবে প্রত্যেককেই আপনার পছন্দ হবে।”

_”হ্যা,এতো সুন্দর মেয়ে। তাও তোর পছন্দ হলো না!” (তন্নি বলে)

তূর্য চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,
_”আই ওয়ান্ট মোর বিউটিফুল দ্যান দোস গার্লস।”

তন্নি কপালে হাত দিয়ে বলে,
_”ফর্সা মেয়ে তোর কপালে জুটবো না রে।”

এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় মৌরিন। রুবেল এর কাছে বলে সে চলে যেতে চাইলেই তন্নি তাকে বাধা দিয়ে বলে,
_”এদিকের রাস্তাঘাট কিন্তু রাতের বেলায় খুব একটা সুবিধার থাকে না। তুমি একা যেতে পারবে তো মৌরি?”

#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here