#এক_ফালি_সুখ🌼 |৮|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
একটা রেস্টুরেন্ট এ সামনাসামনি বসে আছে নির্ঝর এবং জ্যোতি। বেশি রাত হওয়ায় খুব একটা মানুষ ও নেই। দু টেবিল পড়ে একটা ছেলে আর মেয়ে বসে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক।
রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে আর আধাঘণ্টার মধ্যেই। নির্ঝর আর জ্যোতি এসেছে আরো ত্রিশ মিনিট আগে। অর্ডার করার মধ্যে কেবল দুটো ক্যাপাচিনো অর্ডার করেছে তারা। যা আরো পনেরো মিনিট আগেও চলে এসেছে। দুজনের টাই শেষ হওয়ার পথে। তবে আশ্চর্যজনক বিষয়, দুজনের মধ্যে কারোর মুখে কোনো কথা নাই। দুজনেই নিজেদের ফোনের মধ্যে ডুবে আছে। জ্যোতি মাঝেমধ্যে দু একটা ছবি তুলছে, আর নির্ঝর পুরোপুরি স্ক্রোলিং এ ব্যস্ত।
জ্যোতি নির্ঝর এর চেয়ে তিন বছর এর ছোট। তবে সেটা তাদের আচার আচরণ এ প্রকাশ পায়নি কখনো। ছোটবেলা থেকে একসাথেই বড় হয়েছে তারা। চা বাগানের শহর সিলেটে প্রতিবেশি হিসেবেই তাদের সম্পর্ক এগিয়ে যায়, যা ধীরে ধীরে বেস্ট ফ্রেন্ড এর নাম নিয়েছে। নির্ঝর ইউনিভার্সিটি তে উঠে ঢাকায় চলে আসে আর জ্যোতি স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়েই পাড়ি দেয় রাজধানীতে।
হঠাৎ কিছু একটা হতেই ফোন থেকে চোখ সরিয়ে নির্ঝর এর দিকে তাকালো জ্যোতি। চোখে একটা চিকন ফ্রেমের চশমা, সঙ্গে ঠোঁটের কোণে তার মুচকি হাসি বিদ্যমান। এভাবে হেসেহেসে কার সঙ্গে কথা বলছে ঠিক বুঝতে পারলো না জ্যোতি। কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে খপ করে ফোনটা কেড়ে নিলো নির্ঝর এর থেকে। এমন আকস্মিক ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলোনা নির্ঝর। তবে জ্যোতি তার ফোনটা একটুও চেক করলোনা, বরং নিজের এবং নির্ঝর এর দুজনের ফোনটাই একসাথে পাশে সরিয়ে রাখলো।
নির্ঝর বুকে হাত গুঁজে বলে,
_”এটা কি হলো?”
_”যা হলো সেটাই। এই তুমি কি এখানে ফোন ঘাটতে এসেছো নাকি?”
নির্ঝর টেবিলের উপর এক হাতের কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বলে,
_”আচ্ছা, তুই নিজে কি করছিলি?”
জ্যোতি আমতা আমতা করে বলে,
_”এটাও তোমার দোষ, তোমার বাতাস লাগছে বোধ হয় আমার।”
_”হাহ,ফাজলামো করিস না। ফোনটা দে।”
রেগে যায় জ্যোতি। নির্ঝর এর ফোনটা তার দিকে ছুড়ে মেরে পাশে থাকা ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। নিজের ফোনটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে টেবিলের উপর জোরে আঘাত করে বলে,
_”থাকো তুমি, এই ফোন নিয়েই থাকো। কবরেও না এই ফোন সঙ্গে নিয়ে যেও।”
হনহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো জ্যোতি। নির্ঝর হা করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে, হঠাৎ এমন রেগে যাওয়ার কারণ টা বুঝতে পারলো না সে। তবে পুনরায় ফোনটা সামনে এনে দিয়াকে মেসেজ করলো সে। মেয়েটা সদ্য এত বড় ছ্যাকা খেলো, তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার দায়িত্বটা যেন নির্ঝর নিজের কাঁধেই নিয়ে রেখেছে।
_____
রাতের খাবার খেতে বসে মারুফা অনেকক্ষণ ধরে প্লেট এর খাবার নাড়াচাড়া করছে, খাচ্ছে কম। বিষয়টা লক্ষ্য করলো মৌরিন, শুরুতে কিছু না বললে মারুফাকে বারবার নজর লুকোতে দেখে আর চুপ করে থাকতে পারলোনা মৌরিন। খাওয়া বন্ধ করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
_”কিছু বলবে মা?”
মারুফা কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মৌরিন আবারো বলে,
_”ঠিক করে খাচ্ছো না। এমন চোরের মতো করছো কেন? কি বলবে স্পষ্টভাবে বলো তো।”
মারুফা সামান্য হাসার চেষ্টা করে বললো,
_”তুই রেগে যাসনা মা।”
_”এমন কি বলবে যাতে আমি রেগে যাবো? আর হেঁয়ালি করোনা মা, বলো কি বলবে। আচ্ছা আমি রাগ করবোনা, এবার বলো।”
মারুফা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে কিছুটা পানি খেয়ে নিলেন। এরপর মৌরিন এর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন,
_”ও বাড়ি থেকে কল করেছিল সন্ধ্যাবেলা, তুই যখন নিহাকে পড়াতে গিয়েছিলি।”
_”ও বাড়ি মা..”
থেমে যায় মৌরিন। কুঁচকানো কপালের ভাজ সরে যায় মুহূর্তের মাঝেই,সঙ্গে চোখেমুখে ফুটে ওঠে রাগের আভা। মারুফা বাম হাতের দ্বারা মৌরিন এর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
_”তুই বলেছিলি রেগে যাবিনা, এইজন্যই তো আমি তোকে বলতে..”
হাতে থাকা খাবারটুকো প্লেট এর উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো মৌরিন। বেসিন এ হাত ধুয়ে সেকেন্ডের মধ্যে চলে গেলো অন্য ঘরে। মারুফা ডাকলেও তার কথার কোনো উত্তর দিলোনা মৌরিন।
অন্য ঘর থেকে মারুফার ফোনটা নিয়ে সামনে এলো মৌরিন। একহাত কোমড়ে রেখে অন্যহাতে কললিস্ট এ ঢুকলো সে। প্রথম নম্বরটা সামনে এনে ফোনটা মারুফার দিকে ঘুরিয়ে বললো,
_”নম্বর এটা?”
_”মৌ আমার কথাটা..”
অপেক্ষা করলো না মৌরিন। নম্বরটা ব্লকলিস্ট এ ফেলেই লম্বা নিঃশ্বাস নিলো সে। এরপর ফোনটা মারুফার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার পাশে বসে পরলো মৌরিন। মারুফা তাকে কিছু বলার আগেই মৌরিন তার দিকে ঘুরে বলতে লাগলো,
_”তুমি এই নম্বরগুলো এখনো ব্লক করোনি কেন? আমি তোমায় আরো আগে বলেছিলাম, তারপরও!”
কিছু না বলে চুপ করে রইলেন মারুফা, মৌরিন খুব একটা রেগে যায়নি। তবে এবার গাম্ভীর্যতা কাটিয়ে শান্ত কন্ঠেই বললো,
_”আননোন নম্বর থেকে কল এলে রিসিভ করবেনা মা। আর ঐ বাড়িতে থেকে এলে তো একদমই না। আশা করি আমার এই কথাটা রাখবে তুমি।”
_”আমি ইচ্ছে করে ফোনটা ধরিনি মৌ, দু তিনবার কল করেছিল তাই..”
_”হাজার বার কল করলেও ধরবেনা, বুঝতে পেরেছো?”
মাথা নাড়ালেন মারুফা। মৌরিন উঠে চলে যেতে নিলেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
_”খাবারটাতো শেষ করে যা।”
_”খেতে ইচ্ছে করছেনা মা,জোর করো না প্লিজ।”
নিজের উপর রাগ হলো মারুফার। কেন যে কথাটা বলতে গেলো মৌরিন কে!
_____
শুটিং এর তৃতীয় দিন আজ,তবে শুট করা হচ্ছে প্রথম দিনের অর্থাৎ নাটকের একদম শুরুর দৃশ্য যেখানে তূর্যের লুকটা থাকবে অন্যরকম। একটু বোকাবোকা টাইপ। যার কারণে তার গেটআপ চেঞ্জ করতে হবে। ক্লিন শেভ করতে হবে যা তার একদমই অপছন্দের, তবুও করতে হবে। অভিনয়ের এই এক ঝামেলা, একেক সময় একেক লুক এ চলে আসতে হয় সেটা পছন্দ হোক বা না হোক।
তূর্যের ও আজ হয়েছে তেমন ই এক অবস্থা। এই বোকাবোকা লুক এ সবার সামনে শুটিং করাতেও অস্বস্তি হতে পারে তবে খুব একটা নয়। কারণ এরকম অভিজ্ঞতা তার আগেও আছে। এই শুটিং এর জন্য তাকে হেয়ার স্টাইল ও চেঞ্জ করতে হয়েছে। অনেকটাই ছোট করে ফেলতে হয়েছে চুলগুলো। ছোট বাচ্চাদের ‘বাটিকাট’ নামে একটা হেয়ারস্টাইল থাকে। বর্তমানে তূর্যের চুলের অবস্থাও অনেকটা সেরকম। পরিচিত যে কেউ ওকে এই রুপে দেখে হাসতে বাধ্য।
আজকের শুটিংটা একটা অফিসের ভেতরে,তন্নির আজকে শুট নেই। রাতুল,মৌরিন,মেকআপ আর্টিস্ট, ক্যামেরাম্যান সহ সকলেই একজায়গায় রয়েছে। আরো দু তিনজন মেয়েও রয়েছে এটা ওটা এগিয়ে দেওয়ার জন্য।
তূর্য পাশের একটা কেবিন থেকে রেডি হয়ে চলে আসে সেই কেবিনে। শরীরে লাল রঙের টি শার্ট, অ্যাশ কালার প্যান্ট। আর মাথায় একটা কালো রঙের ক্যাপ পরা। এটা মূলত নিজের হেয়ারস্টাইল লুকোনোর জন্যই পরেছে। নইলে তাকে জোকারের থেকে কোনো অংশে কম লাগছেনা। তবে ক্যাপটা বেশিক্ষণ মাথায় রাখতে পারলোনা।
শুটিং শুরু হবে এখন, ক্যাপটা সরাতেই হবে। ডিরেক্টর তূর্যকে পুরোপুরি প্রস্তুত হতে বলে। এবার বাধ্য ক্যাপটা মাথা থেকে সরায় তূর্য। সেখানে উপস্থিত সবার তার দিকে দু সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হো হো করে হাসতে শুরু করে। মৌরিনও হাসলো, তবে বাকিদের মতো নয়। নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে সামান্য হাসলো সে, তবে সেই হাসি তূর্যের নজর এড়ালো না। বাকিদের হাসিতে তার বিন্দুমাত্র রাগ হয়নি, তবে মৌরিন এর এই মুচকি হাসিই যেন সহ্য হলোনা তার। রেগে গিয়ে বাকিদের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো,
_”সার্কাস হচ্ছে এখানে?”
থেমে যায় সবাই। রাতুল তূর্যের পাশে এসে হাসি থামিয়ে বলে,
_”আরে ভাই রেগে যাচ্ছো কেন? এই লুক দেখে সবার ই হাসি পাবে বুঝলে। চাপ নিও না, শুট শেষে চেঞ্জ করে নিও হেয়ারস্টাইল।”
কিছুই বললোনা তূর্য,কেবল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মৌরিন এর দিকে, মৌরিন এর সেদিকে তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ ও নেই। রাতুল ডিরেক্টর রুবেলের কাছে গিয়ে কিছু কথা বলতে লাগলো। তূর্য তখন ই পা বারিয়ে এগিয়ে এলো মৌরিন এর দিকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
_”মজা নেওয়ার জন্য এসেছো এখানে? হাসছিলে কেন?”
তূর্য ভেবেছিলো মৌরিন হয়তো তার এমন কথায় অবাক হবে, তবে তেমনটা হলো না। মৌরিন শান্ত দৃষ্টিতেই তার দিকে তাকিয়ে বললো,
_”মানুষ তো আমি, তাই হাসি পেতেই পারে। আর এখানে বাকিদের হাসির সামনে আমার হাসিটা গোনায় ধরার মতো বলে তো মনে হয়না।”
মৌরিন এর দিকে আরও এক কদম এগিয়ে যায় তূর্য। বুকে হাত গুঁজে বলে,
_”ইউনিক হতে চাইছো?”
নিচের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে মৌরিন। এরপর তূর্যের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বলে,
_”মানুষ জন্মগত ভাবেই ইউনিক। কেউ কারোর মতো হতে পারে না, অনুকরণ করা যায় তবে পুরপুরি অন্য ব্যক্তির মতো কখনই হওয়া যায়না। আপনি কখনো আমার মতো হতে পারবেন না, আর না আমি আপনার মতো হতে পারবো। তাই নতুন করে চাওয়ার কিছু নেই। চেয়ে হোক বা না চেয়ে, আমি এমনিতেই ইউনিক। অ্যান্ড, ইউ শুড আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট..”
#চলবে?
[অলস হয়ে যাচ্ছেন নাকি? ১২০০+ শব্দের গল্প দিলাম, গঠনমূলক কমেন্ট করতে হবে কিন্তু।
হ্যাপি রিডিং।]
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/