ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো (২৯)

0
558

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(২৯)
পরিক্ষা হল থেকে বেরিয়ে লাবিবা আজ দুজন মানুষ কে একসাথে পেল।ইসমাইলের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তানভীর। লাবিবাকে ইসমাইলই নিয়ে আসে নিয়ে যায়। টানা চার ঘন্টা একটানা এখানেই অপেক্ষা করে। বাবারা কখনও বিরক্ত হয় না। তারা অপেক্ষা করতে জানে তাদের সন্তানের সর্বোচ্চ জন্য। অনেকের দৃষ্টি এদিকে। লাবিবা এগিয়ে যেতে যেতে খইরুল ইসলামও এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকের মুখটা থমথমে। কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে লাবিবা জানতে পারে না। লাবিবা যেতেই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। খইরুল ইসলাম হাসি মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আমার মামনির এক্সাম কেমন হলো?’

লাবিবা ঝটপট উত্তর দিতে পারল না। সময় নিয়ে শুকনো হাসল। ধীরে ধীরে আওডালো,” ভালোই ।”

অতি চঞ্চল লাবিবার ভালোই কথাটা খইরুল ইসলাম না বুঝলেও ইসমাইল এবং তানভীর ঠিকই বুঝে গেলো। পরিক্ষা ভালো হয়নি। ভালো হলে এতোক্ষনে হাসতে হাসতে কথা বলত। পারলে লাফাতোও। খইরুল ইসলাম বললেন, ”ফাস্ট ক্লাস পেতে হবে। ওকে? হা হা।”

লাবিবা মাথা ঝুমালো। উনি চলে যেতেই তানভীর গম্ভীর মুখে লাবিবার থেকে প্রশ্ন চাইলো। গাড়ির কাছে সরে দাঁড়াল। প্রশ্নের টিক মার্ক গুলো দেখল। হতাশ হল। তবুও জিজ্ঞেস করল,
” গ’ বিভাগের কয়টা দিয়েছ? একটাতে টিক দেওয়া কেন? আর কোনটা দিয়েছ দেখাও। ”

“দেয়নি তো।”

“লাবিবা এখানেই পঞ্চাশ নাম্বার। আর কোনটা দিয়েছ?”

” একটাই।”

” আচ্ছা খ বিভাগের কয়টা দিয়েছ? তিনটা টিক মার্ক আছে।”

” তিনটাই।”

” আমার সাথে মজা করো না প্লিজ। প্রত্যেকটা পরিক্ষা এরকমই দিয়েছ? তার পরেও বলো ভালোই! ”

” আরও ভালো চান? যথেষ্ট নয়? আমার তো সব ভেসে গেলো। পরিক্ষা ভালো হলেই কি না হলেই কি?”

” কি ভেসে গেলো? লেখাপড়ার প্রতি এতো উদাস কেন তুমি? তুমি তো এমন ছিলে না। লাবিবা কি হয়েছে তোমার ? পড়াশোনা করছো না কেন? প্লিজ আমাকে বলো আমি তোমাকে হেল্প করবো। ”

” আমি প্রেমে পড়েছি। মারাত্মক ভাবে প্রেমে পড়েছি। ব্যথাও পেয়েছি। ঘা হয়ে গেছে। ”

“বাজে বকা বন্ধ করো। প্লিজ সিরিয়াস হও। তোমার পড়াশোনার জন্য আমি ঠিক কতটা সেক্রিফাইস করেছি ইভেন করে যাচ্ছি তুমি কিছুটা হলেও জানো। আর একটা বছর আছে। প্লিজ এই এক কে দুই বানিয়ে দিও না। আমি এতো ভোগতে চাইনা। মুক্তি চাই। আর পাঁচ জনের মতো নরমাল একটা লাইফ চাই। ”

“চাকরী করে আমি কি আপানাকে মাসে মাসে টাকা দিবো? কে করতে বলেছে সেক্রিফাইস ? আমি বলেছিলাম? ডেকে এনেছিলাম আপনাকে যে আমাকে বিয়ে করুন। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন? নাকি আপনি আমাকে মেয়েই মনে করেন না? তৃতীয় শ্রেণীর কেউ মনে করেন যে আমি আপনাদের মতো স্বাভাবিক জীবন চাইলেও পাবোনা। ”

” কি চাও তুমি? ”

” চাইনা। লাব্বুর আর কিছুই লাগবেনা।”

জেদ দেখিয়ে বাবার হাত ধরে চলে যায় লাবিবা। তানভীর বুঝে পায়না কেন জেদ করছে এতোটা। কি হয়েছে ওর?

পরবর্তী পরিক্ষার একদিন আগে তানভীর এসে দাঁড়ায় আঙিনায়। সাবিনার মুখ থেকে হাসি সরছে না। তানভীর অভিযোগ দেয়, “আম্মু আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন। আপনার মেয়ে একটুও পড়াশোনা করছে না।”

“আমাকে তো দেখায় পড়াশোনা করছে। আদৌ করছে কিনা সেজন্যই তো তোমাকে বললাম। ”

” আমি দেখছি। ধন্যবাদ।”

কে কার কথা শুনবে? তানভীর থাকাকালীন লাবিবা ঘরেই গেলো না। তানভীর না পেরে নিজেই খুঁজে বের করল লাবিবাকে। বাড়ি থেকে গজ পঞ্চাশেক দূর পুকুর পাড়ে। কিন্তু লাবিবাকে দেখে বড্ড অসন্তুষ্ট হল। চোখের নিচে আজ অব্দি যার ডার্ক সার্কেল দেখা মেলেনি সেই মেয়েটার মুখে ব্রণের দাগ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। র ফেসে মাস দুয়েক থেকে দেখা হয়নি জন্য বুঝতেও পারেনি। প্রব্লেম টা ঠিক কোন জায়গায় তানভীর ঠাহর করতে পেরেও পারছে না। এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ায়।
” উঠে আসো।”

” আপনি?”

“হাত দাও। এতো এগিয়ে বসেছো পুকুরে পরে যাবে তো। ”

লাবিবা হাত না ধরেই উঠে আসে। তানভীর নিজে থেকেই হাত মুঠো ধরে। এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। বউ তার বিগড়ে যাচ্ছে। তার আগেই বউয়ের মস্তিষ্ক পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। বিছানার কোণায় লাবিবাকে বসিয়ে নিজে টুল টেনে বসে। গাল দুটো আলতো ভাবে দু হাতের আজলায় পুরে নেয়। লাবিবার শান্ত দৃষ্টিতে নিজের অশান্ত দৃষ্টি ফেলে। জিজ্ঞেস করে,
” আমার বউটার কি হয়েছে? ”

এতো আদুরে ডাক! লাবিবা চোখ দুটো বুঝে নেয়। কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে দু ফোটা জল। তানভীরের অশান্ত মনটা আরো অশান্ত হয়ে উঠে। লাবিবার কন্ঠে অপরাধ বোধ জেগে ওঠে।
” সরি স্যার। আপনার সাথে অনেক বেয়াদবি করেছি। আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি। আপনার প্লেসটা আমি প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। সব কিছুর জন্য সরি। ”

” কি হয়েছে বলো । ”

” তেমন কিছু না।”

” বলো। প্লিজ।”

” কি বলবো? বলার কিছু নেই।”

” রাতে ঘুমাওনা কেন?”

” আমি রাতে ঘুমাই। ”

” তাহলে আমার কথা ভেবে চোখের নিচে কালো দাগ কেন ফেলেছো?”

” ইয়্যু ডোন্ট লাভ মি স্যার। যে আমাকে লাভ করেনা আমি তাকে নিয়ে ভেবে আমার টাইম ওয়েস্ট করিনা।”

‘ তো এটাই কারণ? আমি তোমাকে কেন ভালোবাসি না? পাগল তুমি? এটার জন্য তুমি এরকম এবনর্মাল বিহেভ করছ? নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো। পড়াশোনা করছোনা।সেজন্য তুমি ফেল করার পণ নিয়ে বসেছো? আমার সম্মান ঢুবাতে যাচ্ছ। তোমার আব্বুর কাছে আমাকে অপরাধী করতে চাইছো? ”

“আব্বুর কাছে কেনো অপরাধী হবেন? ”

“তো হবোনা? তোমার রেজাল্ট খারাপ হলে তো উনি আমাকেই দায়ী করবেন। ভাববেন তার মেয়েকে আমি প্রেমের রাজ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াই পড়তেই দিই না। দায় তো সব আমার উপরেই পড়বে। আমি কি তোমাকে কখনও বলেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি না? তোমাকে নিয়ে আমি কি যে করি ওহ গড!”

” প্লিজ এখন আপনি আমাকে ভালোবাসেন এই মিথ্যাটা অন্তত বলবেন না। আমি কিন্তু শুনবো না। কান পচে যাক আমার তবুও শুনবো না।”

” লাবিবা ”

” না আমি এই বানোয়াট কথা শুনবো না। খান সাহেব আপনি স্বাধীন মানুষ। আপনাকে নিশ্চয় কেউ ধরে বেঁধে রাখার স্পর্ধা দেখাবেনা। পুরোপুরি আপনার উপর একমাত্র অধিকারী হয়েও আমি সে স্পর্ধা দেখাচ্ছি না। আপনি এই পর্যন্ত অনেক গুলো ভূল করে ফেলেছেন। আমাকে বিয়ে করেই ভূল করেছেন। আমি আপনার যোগ্য না। আমাদের মধ্যে অনেক তফাৎ যা আপনি দেখেও দেখছেন না। আপনি যে লোক দেখানো কাজ গুলো করেন তা প্লিজ আর করবেন না। আপনার টাকা পয়সা সত্যিই আমার চাইনা। আপনি যে নাম মাত্র দায়িত্ব পালন করেন তা কখনওই একজন হাজব্যান্ড এর দায়িত্ব না। আপনাকে তো সেদিও বললাম আমি চাকরী করে আপনাকে টাকা দিবো না। তাহলে আমার যা হোক তাতে আপনার কি? আপনার করা সব থেকে বড় ভুল কোনটা জানেন? প্রেমিকাকে ঠকিয়ে আমাকে বিয়ে করা।”

” লিমিট ক্রস করবেনা লাবিবা। কে আমার প্রেমিকা? বলতে বলতে বেশীই বলে ফেলছো তুমি। আমার কোন প্রমিকা নেই ছিলও না। ”

” ও সরি। ছিল আপনার ভাইয়ের বউ । কি যেনো বলে দেবর ভাবী উমমম”

কথাটা শেষ করতে দেয়না তানভীর। মুখ চেপে ধরে প্রাণপনে। রাগে মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দাঁতে দাত চেপে ধরে,
” আল্লাহর দোহাই লাগে বউ। এতো বড় কথা এই পবিত্র মুখে বলিস না। প্লিজ তুই অন্তত ঐ মহিলার মতো আমাকে বিনা দোষে কাঠগড়ায় তুলিস না। যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না। কে বলেছে তোকে এসব? বল কে কান ভাঙিয়েছে তোর?”

” কান ভাঙাতে হবে কেন? আমি কি কচি খুকি যে কেউ কান ভাঙাবে তা নিয়ে আমি নেচে বেড়াবো? আমি নিজে নিজেই বুঝে নিতে জানি। আমাকে বুঝিয়েছেন আপনি নিজে আর আমার প্রতি আপনার অবহেলা।”

দরজার বাইরে থেকে সাবিনা সবটাই শুনতে‌ পায়। শুনে হজমও করে নেয়। চুপচাপ সেখান থেকে সরেও যায় যখন বুঝতে পারে তানভীর চলে যাচ্ছে। জামাইয়ের জন্য রান্না করা খাবার গুলো টেবিলে সাজিয়ে লাঞ্চ করার জন্য ডাকতে এসেছিলেন সে। দরজার সামনে এসে দাড়াতেই সব কথা কানে আসে। মেয়ে আর জামাই সমন্ধে তার যা ধারণা ছিলো পুরোটাই উল্টে যায়। কোনো মা ই এমন খবর সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু সাবিনা। অতি শোকে পাথর হওয়া যাকে বলে। কিন্তু তার জন্য যে আরেকটা চমক অপেক্ষা করছিলো তা সে জানতো না। তানভীর যখন তার সামনেই ইসমাইলের কাছে আবদার করে বসে লাবিবার পরিক্ষা শেষ হতেই তাকে ঘরে তুলতে চায় তখন ইসমাইলের আগে সাবিনাই এর প্রতিবাদ করে।
“লাবি মা কি তাই চায়? ”

তানভীর উত্তর দিতে পারেনা। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য সে। বাবার সাথে তার ও সায় আছে। অভিজ্ঞতাপূর্ণ দূরদর্শীতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সে। বেশ বুঝতে পারছে জল ঘোলা হতে চলছে। তার সংসার জীবনের খুঁটি বেশ লড়বড়ে। বউ বেঁকে বসেছে। শ্বাশুড়ী বেঁকে বসেছে। শ্বশুরের ভাব ভঙি বোঝা দায়। সাবিনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে ইসমাইল তানভীরকেই প্রশ্ন করে,
” তুমি হটাৎ এতো জলদি এমন আবদার কেন করছো? তোমাদের মাঝে কোন সমস্যা?”

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। নড়েচড়ে বসে। কন্ঠে জোড় নিয়ে বলে, “না আব্বু। কোনো সমস্যা না।”

” আমার মেয়েটা সহজ সরল বুদ্ধি কম জেদ বেশী। আমার বিশ্বাস তোমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা হতে পারে না।হলেও তুমি ঠিক সামলে নিবে। অসময়ে এমন আবদার করোনা। বেয়াই এর সাথে আমার কথা বার্তা সেটেল। সময় মতো আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করবো। ”

এর উপর কোনো কথা থাকতে পারে না। তানভীর এবার নিজের উপর রিস্ক নিলো। বউকে হাত ছাড়া করলো না। নরম পুষ্পের ন্যায় বউ তার। ভীষণ নাজুক! দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আবেগপ্রবণ কোনো কিশোর বা যুবক নয় সে। প্রাপ্তবয়স্ক সুঠামদেহী তাগড়া পুরুষ। চোখের সামনে টসটসে যুবতী বউটা ঘুরঘুর করবে আর সে টেলিভিশন দেখার ন্যায় সোফায় গা এলিয়ে তাকিয়ে থাকবে দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক চলে গেলেও তা কার্যকর হবে না। সেজন্যই অবাধ্য মনটাকে বাধ্য করতে দূরে থাকা। তানভীরের কয়েকটা দিনের সঙ্গ যদি এতোটা ডেম্পারেট করে তুলে লাবিবাকে তাহলে নিজেকে সরিয়ে না নিলে কি হতো সেটাই ভেবে ভেবে তানভীর কূল কিনারা হারায়। নরম মনের আনটাচড বউ তার! জামাই পাগল হবে এটা অবাক হবার কিছু না। তাই বলে এতো অল্পতেই? এ্যাফেকশন টা আগে থেকেই ছিলো তানভীরের দৃষ্টির বাইরে সেটা না নাকি হাজব্যান্ড বলেই লাবিবার যত উম্মাদনা? কঠিন সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করেও তানভীর এবার পাড় পেলো না। নাকের ডগায় তার বউ যে পাকা লংকার তরকারি রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে ধারণাতেও ছিল না।

চলবে__

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here