ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো (২৪)

0
614

#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো

(২৪)
ছাদে উঠে লাবিবার দিকে চোখ পড়তেই তানভীরের রাগান্বিত চোখ শীতল হয়ে এলো। কিন্তু বুকের বা পাশে হৃদয় নামক যে যন্ত্রটা আছে তুলনামূলক যেনো একটু বেশিই বিট করতে লাগলো। এলোমেলো ভাবে পড়া লাল শাড়ি, খোলা চুল, লাল টিপ, লাল ঠোঁট! একি তানভীরের মরণ সাজ! এই টুকটুকে বউটা একটু আগে বুকের উপর লুটোপুটি খাচ্ছিল দেখতে পেলে তানভীরের যত্নে গড়া এতো বছরের ধৈর্য্য তখনি ধ্বংস রুপ নিতো। তানভীর বরাবরই ধৈর্য্যশীল বোঝদার শক্তপোক্ত মানুষ। তার ভেতরের নরম যে মনটা আছে তার খোঁজ আজ পর্যন্ত কেউ পায়নি। এক দুই করে জীবনে কম নারী সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা করে নি। খোলসে আবৃত মনটাকে হাজার চেষ্টা করেও ছুয়ে দিতে পারেনি। নিজেকে নিয়ে খুবই গর্ব! সেই গর্ব এবার যেনো সত্যি কেউ চূর্ণ করলো। তানভীর এক নারীতে আসক্ত একজন পুরুষ। তার টার্গেট ছিলো সেই নারীকে হারানো।নিজে থেকেই এসে শক্ত খোলস উম্মোচন করে প্রেয়সীর কাছে আত্মসমর্পন করবে ভেবেছিলো। তার আগেই যে প্রেয়সী তাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিবে সেটা কি কখনো ধারণা করেছিলো? তানভীর বড় শ্বাস ফেললো। নিজেকে শান্ত করতে চাইলো। তাকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে। আরো ধৈর্য্যশীল। সিদ্ধান্ত নিলো নিচে‌ চলে যাবে। ছাদে আর এক মুহূর্ত নয় । কিন্তু তার আর নেমে আসা হলো না। তার মরণ সাজে বউয়ের মিষ্টি কন্ঠ কানে এলো। চোখ তুলে সাথে সাথে তাকালো। দোলনায় দোল খেতে খেতে লাবিবা গেয়ে উঠা গান তার সিদ্ধান্তটা পাল্টে দিলো।

লাবিবা বুঝতেও পারেনি ছাদে তার পেছনে তানভীর এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। লাবিবার ভাবনার আকাশ জুড়ে এখন শুধুই তানভীর। যখন নিজেকে দেখবে কি রিয়েকশন টাই না হবে! ভেবেই খিল খিল করে হেসে উঠে চিকন গলায় সুর টানে,

” ভাবনার আদরে তোকে খুঁজে ফিরে
বড্ড ভীষণ করে আমার এ মন!
আকাশের নীলিমায় অনুভবে খুঁজে যাই
যখন খুঁজে না হারিয়ে
বৃষ্টি শেষে রোদ এলো, আমি আজও এলোমেলো
বৃষ্টি শেষে রোদ এলো, আমি আজও এলোমেলো ”

” লাবিবা।”

গানের মাঝেই তানভীরের গম্ভীর ডাকে বাঁধা পড়ে লাবিবা। পেছন ফিরতেই চোখাচোখি হয়। তানভীরের দৃষ্টি নেমে যায়। পতিত হয় ঐ লাল ঠোঁট জোড়ায়। তানভীর এগিয়ে যেতে যেতে বলে ,
“এদিকে তোমার হাজব্যান্ডের সর্বনাশ হয়ে গেল আর তুমি ছাদে বসে আকাশ বাতাস কে গান শোনাচ্ছো ?”

তানভীরের কথায় লাবিবা ভীষণ চিন্তিত হয়ে উঠলো। দোলনা ছেড়ে শাড়ি উঁচিয়ে ধরে দৌড়ে তানভীরের সামনে এলো। সন্ধানু চোখে প্রশ্ন করলো,
“হায় আল্লাহ! কে কি করেছে আপনার?”

“ইজ্জতে হাত দিয়েছে। ”

তানভীরের কথায় লাবিবা চোখ বড় বড় করে তাকালো। হাত এগিয়ে নিয়ে দাড়ী ছুলো। থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো,
” খুলে বলুন। আমার বাড়িতে এতো সাহস কার এতো বড় একটা কাজ করার!”

তানভীর চটপট শার্টের দুটো বোতাম খুলে ফেললো। বুকের পাশে টেনে ধরে আঙুল তাক করে দেখালো।
“এই যে! এই কাজটা নিশ্চয় লাবিবার।”

লাবিবা ঝটপট মাথা নড়ালো।
” না। আমি কিছু করিনি। আমি ভালো মানুষ। ”

” লিপস্টিক লাগাবে তুমি ছাড়া এ বাড়িতে কে? এই তোমার ভালো মানুষীর নমুনা?”

” না। আমি কিছু করিনি বললাম না?”

” কে কতটুকু করেছে দেখাচ্ছি। দাঁড়াও। ”

” এই না! না। একদম না। এগুবেন না। একদম এগুবে না।”

” দাঁড়াতে বলেছি। দাঁড়াও ঐখানে। ”

” আম্মু বাঁচাও! ”

” লাবিবা পরে যাবে। দৌড়াবেনা। দাঁড়াও বলছি। ”

” না না। আম্মু! ধরে ফেললো। আহ!”

ছাদের দরজায় মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছিল। ফ্লোরে দু হাত ঠেকিয়ে রক্ষা। লাবিবাকে পড়তে দেখে তানভীর তুলতে আসে কিন্তু লাবিবাকে ছুঁতে অব্দি পারে না। ব্যথা পেয়েও পেছনে তাকিয়ে তানভীরকে ধেয়ে আসতে দেখে উঠেই দৌড়। তানভীর ও পিছু ছুটে। লাবিবার শাড়ির আঁচল সিঁড়িতে ছড়িয়ে গেছে। মুঠো করে ধরেই প্রাণপণে ছুটলো। শেষ রক্ষা আর হলোনা। রুমে ঢুকে দরজা লাগানোর আগেই তানভীর আটকে দিলো। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো দেয়ালের দিকে। লাবিবার পিঠ ঠেকলো দেয়ালে। তানভীরের দিকে তাকিয়ে ই জোরে জোরে হাঁপাতে লাগলো। তানভীর এগিয়ে আসতেই লাবিবা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মনে মনে পালানোর পথ খুঁজতে লাগলো।
” শাড়ি পরেছো কেন?”

গম্ভীর গলায় অদ্ভুদ লাগলো প্রশ্নটা। লাবিবা চট করে তানভীরের দিকে তাকালো। মুখ খুলতে গিয়েও ঠোঁট চেপে গেলো। তানভীরের আবার প্রশ্ন।
” লাল শাড়ি কেন পরেছো?”

লাবিবার ইচ্ছে করলো এই মুহূর্তে মরে যেতে। লাল শাড়ী কেন পরেছে সে জানেনা? কেন জানবেনা? বিয়ে করেনি লাবিবাকে? বউ কি লাল শাড়ি পরবে না? এখন কি সাদা শাড়ি পরে থাকবে? লাবিবাকে অবাক করে দিয়ে তানভীর শাড়ির আঁচল চেপে ধরলো।
” তুমি আমার সামনে শাড়ি পরবে না বুঝছো? প্রথম দিনই না করে দেওয়া উচিত ছিল। সরি। প্লিজ! আমার মাথা ঠিক থাকে না। ”

” স্যার! ছাড়ুন। ”

” শোনো। আমার একটা সম্মান আছে। আমি মোটেই শ্বশুড়বাড়িতে পার্মানেন্ট হতে চাই না। খুলো। আমার সামনে শাড়ি পরবে না। আচ্ছা আমিই খুলে দিচ্ছি।তোমাকে হাত লাগাতে হবে না। ”

সত্যি সত্যি শাড়িটা খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলে। লাবিবা ভয় সংকোচে চিৎকার করে উঠে। লজ্জা ঢাকতে তানভীরের বুকে মুখ গুঁজে। তানভীর সাথে সাথেই লাবিবাকে ধাক্কা দেয়। লাবিবা হাত দুটো বুকের উপর ক্রস করে চেপে ধরে। তানভীরকে তার মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। এতোটা রেগে যাবে বুঝতে পারলে লাবিবা মোটেও এমন ধরনের কাজ করতো না। কই কত ভাবেই তো জ্বালিয়েছে কোনদিন তো রেগে যায়নি। আজ কেনো রেগে গেল? গা ছুঁয়েছে জন্যই কি? লাবিবার কি হলো সে জানে না। বিরবির করলো,
” আর কোনদিন বিনা অনুমতিতে আপনার কাছে ঘেঁসবো না।”

তানভীর কপালের টিপ টা খুলে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” এইখানে সৃষ্টিকর্তার নাম লেখা থাকে। খবরদার তিলক লাগাবে না। ”

কপালে ঠোঁট লাগিয়ে শব্দ করে চুমু দিলো। শুষ্ক ঠোঁটের ছোঁয়ায় লাবিবা কেঁপে উঠলো। তানভীর সরে গেলো না। মুখ নামিয়ে গালে নাক চেপে ধরলো। রক্তিম ঠোঁট জোড়ার উপর দৃষ্টি রেখে জবাব চাইলো,
” লিপস্টিক দিয়েছো কেন? লিপস্টিক ”

তানভীরের গলা ভেঙে এলো। একটু সময় নিল । তানভীরের এসব অচেনা কর্মকান্ডে লাবিবার শরীরের সব শক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। তানভীর এবার জোর গলায় বললো,
” আমার সামনে লিপিস্টিক লাগাবেনা। কারো সামনেই লাগাবেনা। মুছে ফেলো। এক্ষুনি মুছে ফেলো। আচ্ছা যাও শুধু শুধু টিস্যু নষ্ট করতে হবে না। আমিই মুছে দিচ্ছি। ”

বলতে বলতেই লাবিবার ঠোঁট জোড়া ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে নিলো। লাবিবা এই হটাৎ আক্রমণ এ মূর্ছা গেলো। শরীর ছেড়ে দিল। তানভীর বুঝতে পেরেই লাবিবাকে দু হাতে আগলে নিলো। মিনিট কয়েক পরে ঠোঁট ছেড়ে দিলো। লিপস্টিক একটু মুছেনি দেখে বিভ্রান্ত হলো। তবে কি সে লিপস্টিক মুছতে অক্ষম? বিষটা মাথায় কেস করতেই আবারো ঠোঁটে ঠোঁট নিয়ে নিলো। লাবিবা শ্বাস নেবার সময়টাও পেলো না। এবার যেনো দম বন্ধ হয়ে এলো। বুকের উপর থেকে হাত নেমে গেলো। কোমড় খামচে ধরলো তানভীরের কাঁধ। ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। বিশ্রি একটা গালি দিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো,
” দুই হাজার টাকার ম্যাট লিপস্টিক আমার সারাদিন চেষ্টা করলেও তুলতে পারবিনা। ব্যাটা এখন বউ আছে না? কসমেটিকস এর উপর পিএইচডি নিতে পারিস না?”

ততোক্ষণে অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। তানভীর পুরোপুরি একটা ঘোরের মাঝে ঢুবে গেছে।‌ হাতের বাঁধন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। ফ্লোর থেকে তুলে নিয়েছে লাবিবাকে পায়ের পাতার উপরে।

ভালো সময় কাটতে বেশীক্ষন লাগে না। তানভীর লাবিবার এই মধুক্ষনে বাগড়া দিতে হাজির হয়ে যায় সব থেকে ক্ষুদে আড়াই বছরের ভাইটা। হাউমাউ করে কেঁদে ঢুকে লাবিবার ঘরে। লাবিবা ভাইয়ের কান্না শব্দ পেয়ে তানভীরকে ধাক্কাতে থাকে। তানভীরের ছাড়ার নাম নেই। বাচ্চার কান্নার শব্দে হুস ফিরে। চটপট ঠোঁট ছেড়ে থুতনিতে শক্ত পোক্ত একটা কামড় বসিয়েই ছেড়ে দেয়। লাবিবা ধপ করে নিচে বসে পড়ে। মুখ গুঁজে দেয় হাঁটুর ভাঁজে। তার ভাই কাঁদতে থাকে, ” মাম মাম মারচে আফুই মাম মাম মারচে ” বলে। তানভীর গিয়ে বাবুকে কোলে তুলে নেয়। ঝাঁকিয়ে শান্ত করে,
” কি হয়েছে? অন্তু সাহেবের কি হয়েছে?”

” মাম মাম মারচে।”

” মাম মাম কে বকে দিবো হে? চকলেট নিবা চকলেট?”

” চককেট?”

অন্তু কান্না থামিয়ে দেয়। তানভীর হাতের উল্টো পাশ দিয়ে গালের জল মুছে দেয়।
” হুম । চকলেট। তোমার আপুর কাছছ অনেক মজার চকলেট আছে। আমি খাচ্ছিলাম। তুমি খাবে?”

অন্তু মাথা নাড়ায়। সে খাবে।
” না শালা সাহেব। আমারটা আমিই খাবো। তুমি বরং অন্য কোন চকলেট খাও।”

” হে।”

তানভীর আড়চোখে লাবিবার দিকে তাকায়। সে লজ্জায় আরো গুটিসুটি হয়ে যাচ্ছে। তানভীর বাঁকা হাসে। বিছানা থেকে শাড়িটা নিয়ে মেলে ধরে লাবিবার উপর ছুঁড়ে দেয়। লাবিবা আগা গোড়া শাড়িতে আবৃত হয়ে যায়। তানভীর অন্তুকে নিয়ে আলমারির কাছে যায়। সেখানে অনেক গুলো ইন্ডিয়ান চকলেট লুকানো আছে। তানভীর সকালে প্যান্ট চেঞ্জ করতে গিয়ে দেখে ফেলেছে। সেখান থেকেই একটা অন্তুর হাতে ধরিয়ে দেয়। অন্তুকে নামিয়ে দিয়ে ফোন আর ওয়ালেট টা নিয়ে পকেটে ঢুকায়। লাবিবাকে শুনিয়ে বলে,
” অন্তু সাহেব । এলাম তবে। তোমার বোনকে একটু পাহারায় রেখো। তোমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। তুমি আমার চকলেট পাহারা দিবে আর আমি তোমাকে আলমারি থেকে চকলেট বকশিশ দিবো। ”

অন্তু হাসে। মাথা দুলিয়ে বলে,
” হে। ”

তানভীর লাবিবার কোন হেলদোল পেলো না। চলে যাবার সময় আবার বললো,
” আমি এলাম তবে। ”

লাবিবার কোনো সাড়া নেই। লজ্জায় একেবারে সিটিয়ে গেছে। তানভীর নিঃশব্দে হেসে আরেকটু লজ্জা দিতে বলে, ” জ্যেকেট, ফর্মাল ড্রেস রেখে গেলাম। আবার তো আসতেই হবে।”

এবার লাবিবার গলা পাওয়া গেলো। মিন মিন করা কন্ঠ।
” হট সাওয়ার নিয়ে যান। প্লিজ ও বাড়িতে গিয়ে আমাকে লজ্জায় ফেলবেন না। ”

তানভীর মৃদু স্বরে বলল,
“‘ আছে। থাকুক না!”

তানভীর বেরিয়ে গেলো। লাবিবার শাড়ি সরিয়ে শেষ বার তানভীরকে দেখার ক্ষমতাটুকু হলোনা। লজ্জায় সেখানেই পড়ে রইলো। আজ আর এখান থেকে উঠতে পারবে মনে হয়না। চোখ নামাতেই দেখে নিচ থেকে কেউ শাড়ি গুটিয়ে তুলছে। মি. অন্তু সাহেব। মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওর হাতে চকলেট। মুখের কোনাতেও লেগে আছে। লাবিবাকে পেয়েই ফোকলা হাসে। চিকন স্বরে ডাকে,
” বউ! আফু বউ! ”

লাবিবার হাঁটুর মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়। চকলেট মাখা হাত লাবিবার মুখে বুলায়।
” চুন্দল বউ! আমায় চুন্দর আফু বউ! ”

লাবিবা লজ্জানত হাসে। অন্তুকে ধরে বলে,
“বল। খান সাহেবের বউ। ”

“কান সাবেবের বউ।”

লাবিবা খিল খিল করে হেসে উঠে। লাবিবার হাসি দেখে অন্তুও খ্যা খ্যা করে মুখে ফ্যানা তুলে কাঁধ মুখ এক করে হাসে।

চলবে __

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here