#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(২৮)
থার্ড ইয়ার বোর্ড পরিক্ষা। তানভীর একের পর এক খবর নিয়েই চলছে। লাবিবা কখন পড়তে বসে? কতটুকু পড়ে সবটাই তার জানা চাই। সাবিন মোটেও বিরক্ত হচ্ছে না। বরং তার ভালো লাগছে ছেলেটা এতো খোঁজ খবর রাখে মেয়েটার। মন থেকে তাদের আগামী জীবনের জন্য দোয়া করে। সন্তান সুখে আছে স্বামীর সাথে এর থেকে বড় একটা মায়ের কাছে কিছু হতে পারে না। মেয়েকে নিয়ে প্রত্যেকটা মায়ের একটা সপ্ন থাকে। সাবিনার ও আছে। রাজপুত্র এসেছে তার মেয়ের জন্যে। মেয়েকে নিয়ে এতো ভাবে। আদব জানা ভদ্র তার মেয়ে জামাই। আম্মু আম্মু বলে যখন ডাকে তার না হওয়া ছেলের জন্য আফসোস টুকু সেখানেই সমাপ্তি হয়। যেন সে সন্তান পেয়েছে আরেকজন। ছেলে মেয়ের ভাব দেখেও তার বুক শান্তিতে ভরে যায়। কিন্তু ইদানিং লাবিবাটা বেশ রাফ আচরণ করে সময় সময়। তোতাপাখির মত মেয়েটা কথা কম বলে। যার জন্য কেঁদে কেটে একসার হতো সেই জামাইবাবার ফোনটাও রিসিভ করেনা। কথা বললে সময় নষ্ট হয়। পরিক্ষার জন্য সব বাদ দিয়ে বই হাতে নিয়ে বসে থাকে। চোখে মুখে খেলা করে দুশ্চিন্তা। পরিক্ষা তো আজ নতুন নয়। আরো পরিক্ষা দিয়েছে জীবনে। কিন্তু এতোটা দুশ্চিতা আর একগুয়ে হতে কখনোই দেখেনি সাবিনা। কি চলে লাবিবার মনে? বিষয়টা নিয়ে ইসমাইল এর সাথেও আলোচনা করেছে। ইসমাইল পাত্তা দেয়নি।সব দিক ভেবে সাবিনা নিজে নিজেই একটা উত্তর বের করেছে। উত্তরটা অনেকটা গ্ৰহণীয় ও মনে হয়েছে তার কাছে। লাবিবার এমন আচরণের কারণ তানভীরের এবাড়িতে না আসা। সেটা নিয়েই অভিমান। তানভীর মাস কয়েক হলো এ বাড়িতে মাঝে মাঝে এলেও থাকছে না। গত মাস থেকে তো তার দেখাই পাওয়া যায় না। বিয়ের পর কোন মেয়েটা থাকবে এতো দিন স্বামী ছাড়া? শখ আহ্লাদ চাহিদা সবারই আছে। তানভীর কি পারেনা আগের মতো এসে মেয়েটাকে সময় দিতে? শ্বশুর বাড়িতে আসতে নাকি লজ্জা পায়। পাছে লোকের কথা ধরলে চলবে? তার মেয়ে যে অভিমানে তিক্ততা অনুভব করছে সেটা কিছুনা? বড় একটা বোন থাকলে নয় এসব খেয়াল রাখতো। নেই তো। মা হয়েছে বলে কি আর খেয়াল রাখতে হবে না? তানভীর ফোন করলে কথাটা পেতে ই বসে সাবিনা।
” লাবি মার পরিক্ষা চলছে দূর থেকে খোঁজ না নিয়ে তুমি কি একটু এসে দেখিয়ে দিতে পারো না? তোমার মা না হয় একদিন নাইবা বাড়িতে পেলো তোমায়, আমি কি মা না? দাবী তো আমারও আছে মেয়ে জামাইকে আদর যত্ন করার। তোমার মায়ের বেশী বৈ কম পড়বে না।”
তানভীর হালকা হাসে। মাথা নাড়ায়।
” না না। কি বলেন আম্মু? আসলে কাজের চাপ তো অনেক। তাই যেতে পারি না।”
” আমাকে বোকা পেও না। এখানে থেকে কি কলেজে যাতায়াত করা যায় না? ”
” তা তো যায়। কিন্তু আম্মু এতো আদর পেলে আমি তো আর সেখান থেকে আর ফিরতে চাইবো না। ছি ছি! লোকে কি বলবে? ছেচড়া জামাই শ্বশুরবাড়ি ছাড়তেই চায়না।”
তানভীরের রসিকতায় সাবিনার মন গললো না। উপর দিয়ে বললো,
” লোকের কথায় কি আসে যায়? তুমি আর অন্য জামাইরা কি এক হল? এই বাড়ি তো তোমারই। তুমি কেন আসবেনা? তুমি আসো বাবা। তুমি এলে আমার মেয়েটা প্রফুল্ল থাকে। ওর পরিক্ষাটাও ভালো হবে।”
ড্রয়িংরুমে আসতে গিয়ে দরজার বাইরে থেকে লাবিবা তার মায়ের কথপোকথন শুনতে পায়। ফোন নামিয়ে নিলে দরজার বাইরে থেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে।
” কাকে আসতে বলছো আম্মু?”
” কাকে আবার জামাইকে। ”
” কেন?”
” দিনে কয়েকবার ফোন করে তোর কথা জানতে চায়। তাই বললাম নিজে আসুক। তোকে গাইড করুক। ”
‘ আমাকে গাইড করার জন্য আমার টিচার আছে আম্মু। মাস গেলে হাজার দশেক করে টাকা দেওয়া হয়। তার উপর কোন টিচারের প্রয়োজন নেই। ‘
” এভাবে কথা বলছিস কেন? ”
” শোন টাকা দিতে না করবে। আর যেন না খরচ করে আমার জন্য। টাকা দিয়েই যদি সব দায়িত্ব পালন হয়ে যায় মনে করে তাহলে তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার আব্বুর যথেষ্ট আছে। আমি অনেক আগে থেকেই পড়ে আসছি। ”
” মাথা গরম করে না মা। তোর কথা ভেবেই আমি বলেছি জামাইকে আসতে। সেও তো বিজি। তোকে বুঝতে হবে। ”
” হ্যা। তাইতো। বিজি। অন্য মেয়েকে নিয়ে। ”
লাস্টের কথাটা আস্তেই বলে লাবিবা। তার চোখ থেকে দু ফোটা অনায়াসেই পড়ে। এতেই সাবিনার মনে অস্থিরতা বেড়েই যায়। জানতে চায়,
” কি বললে লাবি মা? ”
লাবিবা চোখ মুছে। উত্তর দেয়না। বিছানায় পরে থাকা ফোনটা নিয়ে বেড়িয়ে যায়। তানভীরের কাছে জানতে চায়,
” আপনি কেন আমার পড়াশোনার এতো খোঁজ খবর রাখছেন? আপনি যে শীট গুলো পাঠিয়েছেন বিশ্বাস করুন আমি ছুঁয়েও দেখিনি। দেখবোও না।”
” কি প্রব্লেম তোমার? ”
” আমার কোনো প্রব্লেম নেই। আপনি কেন আমার প্রতি এতো জোড় দিচ্ছেন? ”
“তোমাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে লাবিবা। তোমার রেজাল্ট আরও ভালো করতে হবে নয়তো আমার মান সম্মান কিছু থাকবেনা। তোমার আব্বুকেই বা কি জবাব দিবো? যদি উনি বলেন আমি তোমার পড়াশোনার দিকে দৃষ্টি রাখিনি? মুখ থাকবে আমার? ”
“ওহ। সেজন্যই? ”
“আমি সর্বদা তোমার ভালো চাই লাবিবা। তোমার সপ্নগুলো পূরণ হোক। ”
“ধন্যবাদ। ”
” আসছি।”
” আমার একটা রিকুয়েস্ট রাখবেন? যেহেতু আপনি আমার সর্বদা ভালো চান। ”
” কি রিকুয়েস্ট? ”
” আপনি দয়া করে আমার বাড়িতে আসবেন না। আপনি না এলে আমি কমফোর্ট ফিল করি। ”
” কেন? ফর গড সেক এটা বলোনা আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করি। অর তোমার দিকে তাকালে তোমার অস্বস্তি হয়। এরকম কেন করছো লাবিবা? আমি মোটেই তোমার উপর কোনো অধিকার খাটাতে যাই না।”
“ধন্যবাদ। ”
” হুয়াটস রং উইথ ইয়্যু?”
” ইয়্যু ডোন্ট লাভ মি। ”
ফোন রেখে লাবিবা গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে। তানভীর খান ওকে লাভ করেনা। ফ্লোরাকে লাভ করে। সেদিন উত্তেজনা বশত দ্বিতীয় বার দেখাতেই লাবিবা ফ্লোরার দিকে কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। যা হজম করা ফ্লোরার জন্য মোটেই অস্বাভাবিক নয়। একটু হয়তো চমকে গেছে। তবে স্মার্টলি তার এনস্যার দিয়েছে।
” আপনাদের মধ্যে খুব ভালো একটা রিলেশন ছিল। আমি যতটুকু শুনেছি সেজন্যই আপনার ডিভোর্স হয়েছে। কথাটা কি সত্যি?”
ফ্লোরা স্বাচ্ছন্দে জবাব দিয়েছে, ‘”সত্যি।”
” আপনি স্যার কে ভালোবাসেন?”
” উমম। হ্যা। ভালোবাসি।”
” উনিও কি আপনাকে ভালোবাসে?”
” আমার তো তাই মনে হয়। হি স্টিল লাভ মি। আমাকে আগের মতোই ইমপর্টেন্স দেয়। এড়িয়ে যেতে চেয়েও পারেনা। কেন তোমার মনে হয় না? ”
” আপনি কি জানেন না আমি স্যারের ওয়াইফ? আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আপনি কেন আমাদের মাঝে আসতে চাইছেন? ‘”
” আমি আসতে চাইছি নাকি তুমি এসেছো? আমরা তো ভালোই ছিলাম লাবিবা। তুমি কেন এলে আমাদের মাঝে? প্লিজ এটা বলো না যে তানভীর তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। সামনাসামনি একটা মেয়ে ঘুরঘুর করলে হাজার চরিত্রবান ছেলে হলেও চোখ পড়বে। তোমার উপরে ও চোখ পড়তে পারে। কিন্তু আমার তো তা মনেই হয়না। তোমাকে দেখেই আমি হলফ করে বলতে পারি তুমি এখনও আনটাচড। বিবাহিত মেয়ের কোনো চিহ্ন ই তোমার মাঝে নেই। তোমাদের দেখলেও বোঝা যায়না তোমরা একটা রিলেশনে স্টে করছো। নামে মাত্র বিবাহিত তোমরা । তোমাদের মধ্যে কোনো কানেকশনই নেই।”
” হতে কতক্ষন? আপনি আমাদের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়ান। তানভীর খান শুধু আমার। ”
” হী ডোন্ট লাভ ইয়্যু লাবিবা। ”
” বাট আই লাভ হিম। হী ইজ মাই হার্ট মাই এভরিথিং। ”
” আফসোস হচ্ছে তোমার জন্য। তানভীর তোমাকে নিয়ে ভাবেই না। টাকা উড়ানোর জায়গা নেই তাই উড়ায়। তোমার বাবা মাকে তো কিছু একটা বোঝাতে হবে। বোকার রাজ্যে বাস করো না। তার থেকে একটা বুদ্ধি দিই। যে ছেলেটা তোমার জন্য পাগলামী করে কি যেনো নাম! তার সাথে তোমার আলাপও ছিলো। তার সাথে জীবন শুরু কর। তানভীরকে ছেড়ে দাও।”
একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে আসে লাবিবা। তানভীরের অগ্ৰাহ্য তাকে পয়েন্টে পয়েন্টে ধরিয়ে দেয় ভবিষ্যত তাকে তানভীর ছাড়া কাটাতে হবে। তানভীর শুধু মাত্র একটা সাপোর্ট। নেহাত ভালো মানুষ বলেই তার এতো বন্ধুসুলভ আচরণ। তানভীরের চোখে লাবিবা সেই দৃষ্টি কখনোই পায়নি যা একজন স্ত্রী তার স্বামীর চোখে দেখে। কখনোই এতোটা আকুলতা পায়নি যতটা একজন স্ত্রী তার স্বামী থেকে পায়। দু একবার যা ঘটেছে তা এক্সিডেন্ট বলেই বিবেচনা করে লাবিবা। কাছাকাছি থাকলে এরকম হতেই পারে। তবুও পরম ধৈর্য্য শীল পুরুষের পরিচয় দিয়েছে তানভীর। একবারো আসেনি লাবিবার বুকে। ভালোবেসে নেয়নি বুকে টেনে। দূরে দূরে থেকেছে। বার বার বুঝিয়েছে তাকে স্নেহ করে। তার জন্য ভালোবাসা নেই। শুধু কাছে আসা কখনোই ভালোবাসা হতে পারে না। হাতে হাত রেখে পাশে থাকাই সত্যিকারের ভালোবাসা। কই তানভীর তো তার পাশে থাকে না। কলেজে পা না রাখলে তো তার মুখ ও দর্শন করা হতো না। ফোন করে দেখায় সে দায়িত্ব বান। লোক দেখানো দায়িত্ব পালন করে। লাগবেনা তার এসব শো অফ করা। চলে যাক তার জীবন থেকে। যে তাকে ভালোবাসে না তাকে জীবনে আর লাগবেনা।
চলবে___
আরও লিখতে গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাই ছোট করেই দিলাম।