#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(২৩)
দেওয়ান বাড়ির বুড়ো মুরুব্বি এসেছে। বয়স নব্বই পার করেছে সেই কবে!সবাই তাকে দাদীমা বলেই ডাকে। লাবিবাকে খুব আদর করে। ছেলে বউ আর নাতির হাত ধরে এই বাড়িতে পা রেখেছে। হাতে লাঠি ভর করেই হাঁটতে পারে। তবে একটু দূরে গেলেই কারো সাহায্য লাগে। সাবিনা তাঁদের দেখেই বসতে বলেছে। সকাল সকাল অতিথিদের দেখে খোশ আলাপে চায়ের কাপের সাথে মজেছে। উনারা তানভীর লাবিবার কথা জিজ্ঞেস করে। দাদীমা বলে,
” সকালে উঠোনে একটু দাঁড়িয়েছিলাম। দেখি তোমার জামাই তোমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরছে।এতো সকালে ভাগ্যিস গ্ৰামের চার পাঁচ জন আর দেখেনাই! তাহলে তো কথা উঠতো পুরো গ্ৰামে। তা জামাই মেয়ে ভালোই আছে তো?”
“হ্যা চাচী আম্মা। সবই আপনাদের দোয়ায়। মেয়ে ভালো আছে এর থেকে বড় পাওনা আর কি হতে পারে বলুন!”
“তা গেছিল কই এতো সকালে?”
” আপনার নাতি কেমন জেদি জানেনই তো। কাবিন করিয়ে রাখছি তুলে দেয় নাই। এর আগে কি শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যেতে পারি? কাল আমরা সবাই গিয়েছিলাম দাওয়াতে ওকে নিই নাই তাই রাগ করে রাতের বেলা বাইরে কোথায় যেনো বসে ছিলো। জামাই গেলো রাগ ভাঙাতে ফিরলো রাত কাবার করে।”
দাদীমা হাসে।
” ওরা নতুন বিয়ে করছে। এখন কত সময় বাইরে ঘরে থাকবো! ঐসব বাদ দাও। ডাকো। নাত জামাইরে ডাকো। দোয়া দিয়ে যাই। ”
“ঘুমিয়ে আছে চাচীমা।”
“জামাই ঘুমাক। লাবুরে ডাকো। দুই খান কথা কয়ে যাই।”
সাবিনা বাইরে থেকে লাবিবাকে ডাকে। লাবিবা ঘুমে কাতর। দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে চোখ মেলে। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। একটা চিৎকার দেবার আগে দরজা ধাক্কানো বন্ধ হবে না।
“আসছি। ”
“বাইরে আয়। তোর দাদীমা এসেছে। ডাকছে। ”
দাদীমার কথা শুনে লাবিবা আড়মোড়া ভাঙ্গে। পাশ ঘুরতেই কম্বলে মোডানো এতো বড় কোলবালিশ দেখে চমকে উঠে। কোল বালিশ নয়। এটা মানুষ। লাবিবার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। লাবিবা কম্বলটা অল্প একটু টেনে চোখ দুটো বের করে। ইসস! এই চোখেই তো লাবিবা দিনে হাজার বার মরে। গভীর ঘুম বুঝে পুরো মুখটা বের করে। এতো সুন্দর কেনো লাগে? ছোট্ট ছোট্ট দাঁড়িগুলো আরো বেশি সুন্দর লাগে। রাত টা কতো সুন্দর ছিলো তাদের! হিম ঠাণ্ডায় তানভীরের বুকে । এখান থেকে না উঠলে ইস ইস করতে করতে তার জান যাবে ।
লাবিবা ফ্রেস হয়ে আসে । জানালার পার্ট গুলো খুলে দিয়েই পর্দা মেলে দেয়। সে যা চেয়েছিলো তাই হলো। ভর দুপুর! অথচ তানভীর তার সাথে। এমনটা কখনো হয়েছিলো? রাত ফুরোতেই লোকটা দৌড়। কেন আসে রাতে? এমন তো নয় বউকে আদর করতে আসে।ভালোই তো বাসে না। আবার আদর! লাবিবা ধপ ধপ পা ফেলে তানভীরের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে ভেংচি কাটে।
” ইসস! আসছে আমার সাধু পুরুষ!”
মাথায় চিরুনি করতে করতে গুনগুনিয়ে গান করে,
“আম বাগানে ইটের ভাটা, হচ্ছে আমার মিছেই হাঁটা
আম বাগানে ইটের ভাটা, হচ্ছে আমার মিছেই হাঁটা
বন্ধু তুমি ঝড়ের দিনে আমের মতো না।
দমকা হাওয়া আসে বন্ধু তুমি আসোনা। ”
লাবিবার গান শুনে তানভীর নড়ে চড়ে আবার ঘুমায়। বাইরে ঠিকই তার কন্ঠ চলে গেছে। দাদীমা গান শুনে ডাকে, ” ওরে লাবু। এদিকে আয়।”
“আসছি দাদীমা।”
গলায় উড়না জড়িয়ে লাবিবা বেরিয়ে আসে। লাবিবাকে দেখে দাদীমা তার ফোকলা দাঁতে হাসি দেয়।
“কিরে? নাত জামাই ছাড়লো তোরে? ”
“উনি ঘুমায় দাদিমা। ”
“ত গান শুনাইলি কারে?”
“কারে আবার? তোমারে। তুমিই তো শুনলা।”
” রাইগা আছস নাকি? কি কয়ছে জামাই য়ে?শোন বোইন। রাগা রাগি ভালা না। জামাই একটা কথা কইলে চুপ করি শুনবি। রাগা রাগী করবিনা। পরে ভালোবাইসা বুঝায়া কবি এইটা তোমার ঠিক হয়নাই। পুরুষ মানুষের রাগ করে কিছু কইলে হিতে বিপরীত হয়। ‘
“কখন আসছো দাদীমা?”
” আসছি অনেকক্ষন । সকালে দেখলাম জামাইয়ের কোলে উইঠা সুখ খাইতে খাইতে বাড়ি ফিরলি। আল্লার রহমতে জামাই পাইছোস, মাশাআল্লাহ। ”
” সুন্দর না?”
” হ। মেলা সুন্দর।”
লাবিবা খুশি মনে দাদীমার গা ঘেঁষে বসে।
” এতো সুন্দর পুরুষটারে কেমনে ধরে রাখি বলতো দাদীমা? আমার কাছে থাকতেই চায় না । শুধু কাজ কাজ করে বেড়ায়। ”
” শ্বশুর বাড়ি তাই হয়তো আসতে লাজ পায়। একবার তুলে নিয়ে যাক দেখবি তোর ঘর ছাড়বোনা। ঘরে জামাই, এইগুলা তুই কি পরছোস?”
“গাউন। কি সমস্যা?”
” ঐ ছেমড়ি তোর বিয়া হয়ছে না? শাড়ি কাপড় পরবি। শাড়ি কাপড় পড়ে জামাইরে আঁচলে বাধবি। সেজেগুজে থাকবি সব সময়। দেখবি তোরে দেখার লাইগা হলেও লাজ শরম ফেলে দিয়ে শ্বশুড় বাড়ি পরে থাকব। জামাই কি কি পছন্দ করে রান্না-বারা করে খাওয়াবি। ঘুরতে যাবি। প্রেমের কথা কবি। জামাই এমনিতেই পিছু ছাড়ব না। ‘
” আমি শাড়ী সামলাতে পারিনা দাদী। ”
” পরতে পরতেই পারবি। কপালে টিপ দিবি। লিপিস্টিক দিবি। এরম বিধবার মতো হয়ে থাকস কে? সর। সর। তোর মত মেয়ে ছেলে কত পাং পুং করে আর তুই মরার মতো পরে থাকস।”
“শাড়ী পরিয়ে দিবা দাদী?”
“আন পরাইয়া দেই। ”
” আম্মুর রুমে চলো। আমার রুমে উনি ঘুমায়। ”
” দরদ তো দেখি মেলা!”
” হিংসা করো না বুড়ি। একমাত্র জামাই আমার। ভাগ হবেনা। ”
বুড়ো থরথর হাতে শাড়ি প্যাচ লাগায় দাদীমা। লাবিবা দেখে বিরক্ত হয়।
” ভালো করে পরাও। দেখো কেমন হয়ে আছে উচুম্ভা ভুচুম্ভা!”
” এমনেই পরে থাক। এলোমেলো শাড়ী পরে থাকলে জামাইগো চোখ লাগে। ঠোঁট ভর্তি লিপিস্টিক দে। জামাইয়ের কাছে গিয়ে ঘুম ভাঙা। আমি তোর মা চাচীর কাছে গিয়ে গপ্প করি।”
” আচ্ছা।”
সাজগোজের জিনিস সব নিজের রুমে। লাবিবা আয়নাতে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে গা ঢেকে নেয়। তারপর এ রুম থেকে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। দরজা পেরোতেই শাড়ির সাথে পা বেজে খায় উষ্টা। ফ্লোরে ধুপ শব্দ হতেই কিচেন থেকে সাবিনা ঢেকে উঠে, ” কি হলো? লাবি মা?”
” কিছুনা আম্মু। লাফ দিলাম এই যা!”
মিথ্যা কথা বলেই দাতে ঠোঁট কাটে। উঠে দাঁড়ায়। না।তেমন ব্যথা লাগেনি। তবে শাড়ির একপাশ খুলে গেছে। বুড়ি যে কি পরালো! ওমনেই ধরে কোমড়ে গুঁজে দেয়। টিপ টিপ পা ফেলে রুমে আসে। এভাবে শাড়ি পরে আর দৌড়ানো যাবে না।
তানভীর উল্টো হয়ে ঘুমুচ্ছে। লাবিবা কম্বল সরিয়ে দেয় গা থেকে। সাথে সাথে উদোম গা দেখে আবার ঢেকে দেয়। উদোম গায়ে কেনো ঘুমুবে এতো গুলো টি শার্ট রেখে? ইসমাইল জামাইয়ের জন্য শার্ট প্যান্ট টি শার্ট, সর্টস সব কিছুই কিনে এনেছে। যাতে জামাইয়ের কোন অসুবিধা না হয় কোনভাবে। লাবিবা তানভীর কে ডাকে।
” এই উঠুন না! উঠুন।”
তানভীর বালিশে নাক ঘসে গোঙায়। ” উমম!”
লাবিবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। ভীষণ লজ্জা পায়। লজ্জাকেই তো জয় করতে হবে। নাহলে পাবে কিভাবে এই সুন্দর পুরুষ টাকে? এক হাতে চোখ ঢেকে আরেক হাতে কোমর অব্দি কম্বল সরায়। দু আঙুল ফাঁক করে একবার তাকিয়ে আবার লজ্জা পায়। লজ্জাটা একটু সয়ে আসলে চট করে উঠে ড্রেসিং টেবিলে যায়। বেছে বেছে লাল টকটকে ম্যাট লিপস্টিক টা নিয়ে আসে। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলা করছে। ফোনের ক্যামেরায় গাঢ় করে লিপস্টিক লাগায়। এক মিনিটের ভেতরেই লিপিস্টিক টা শুকিয়ে যায়। তাই আর সময় নষ্ট করে না। পটাপট তানভীরের ঘাড়ে ছোট ছোঁয়ায়। গাঢ় লাল ট্যাটু এঁকে যেনো আরো খায়েশ বেড়ে যায়। একে একে পুরো পিঠ ছোট ছোঁয়ায়। তানভীর বার বার আক্রমনে নড়ে উঠে। দুবার মোচড় দিয়েই চিত হয়ে ঘুরে শোয়। আবার ঘুমিয়ে পড়ে।আগলা খোলা বুকে চোখ পড়তেই লাবিবা অজান্তেই কেঁপে উঠে। এক টাক পরিমাণ বুকটা এখন তার সামনে পুরোটাই খোলা। হাত বাড়িয়ে লোমশ বুকের উপর রাখে। লাবিবার কেমন যেনো পাগল পাগল লাগছে এই মুহূর্তে। মাথায় যেনো নেশা চেপে বসে। রাঙিয়ে দিতে থাকে তানভীর বুক পেট কোমল রাঙা ঠোঁটের ছোঁয়াতে। ঘুমটা বুঝি এবার হালকা হয়ে এলো। তানভীর হাত রাখে পেটের উপরে। তার আগেই লাবিবা সরে যায়। দৌড়ে যায় বাইরের দিকে। দরজা অব্দি গিয়েই আবার ফিরে আসে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে টিপের বক্স থেকে বড় লাল টিপ বের করে। কপালে লাগিয়ে নিয়ে নিজেকে আপাদমস্তক দেখে নিজেই কেঁপে উঠে। এ এক নতুন লাবিবা। সাংঘাতিক রুপ লাবণ্যে গড়া! লাবিবা ঘাড় ফিরিয়ে ঘুমন্ত মানুষটার দিকে তাকায়। চোখ বন্ধ করে বিরবির করে,
” খান সাহেব! আপনার প্রেমে আমি পাগল! আমি উম্মাদ! আপনি কবে আমার বাড়ির নিমন্ত্রন গ্ৰহন করবেন?”
আজকের ভোরের সূর্যোদয়টা ছিলো জীবনের শ্রেষ্ঠ তম সূর্যোদয়। সমুদ্রে সূর্যোদয় অনেক দেখেছে তানভীর। কিন্তু নদীর তীরে সূর্যোদয় কখনো দেখা হয়নি। চারপাশ টা যখন ডিমের কুসুমের মতো ছোবড়া ছোবড়া হয়ে উঠে পুরো আকাশে কী অভাবনীয় সৌন্দর্য! আর যদি বুকের সাথে মিশে যদি থাকে প্রিয় মানুষটা! লাবিবার জেদের জন্যই এতো সুন্দর একটা ভোর কাটলো। লাবিবা তো আসতেই চাইছিলো না। তানভীর জোর করে কোলে করে নিয়ে এসেছে। বাসায় এসে শোয়ার পর শুরু হয়েছে লাবিবার মাথা ব্যথা। তানভীর কপালে প্রেস করে দিয়েছে জন্যই লাবিবা ঘুমাতে পেরেছে। সেজন্যই তারভীরের ঘুম ভাঙতে দেড়ি হয়ে গেলো। উঠে লাবিবাকে পাশে পেলো না। ঘুমের মাঝে ঠিক ই টের পেয়েছে কেউ তার বুকের উপর হামাগুড়ি দিচ্ছে। এটা যে তার বউ নিশ্চিত বুঝে তানভীর হালকা হাসে। কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে মাথার চুল চুলকাতে চুলকাতে এসে বাথরুমে ঢুকে। আয়নাতে তাকাতেই তানভীরের চোখ উপরে! বুক পেট পুরোটাই লিপসের লাল ট্যাটু আঁকা। পেছনে ঘুরতে দেখে ঘাড়ে পিঠেও একি অবস্থা। তানভীর উঁচু গলায় হাকে,
” লাবিবা ,লাবিবা!”
লাবিবার কোনো সাড়া নেই। তানভীর বেরিয়ে এসে ওয়ার্ডোব থেকে একটা শার্ট বের করে বোতাম লাগাতে লাগাতেই বেরিয়ে আসে। পুরো বাড়িতে লাবিবাকে খুঁজে। লাবিবা নেই। রাস্তার পাশে দেখে শালা শালীরা বল খেলছে। তানভীর জিজ্ঞেস করে,
“এই রতন? তোমার আপু কোথায়?”
“আপু তো ছাদে। দোলনা খেলে।”
তানভীর তখনই ছুটে ছাদে। আজ বউয়ের একদিন কি তার যতদিন লাগে। খুব বার বেড়েছে। ইমম্যাচিউর বউ বিয়ে করার এই একটা জ্বালা। শুধু প্রেম প্রেম আর ভালোবাসা! প্রেম ভালোবাসা যে কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না সেটা তো আর বুঝবেনা। ঘুমের মাঝে পারবে হাজব্যান্ডের ইজ্জত লুটে নিতে। এতো কেন জ্বালাচ্ছে বউটা?
চলবে __